‘প্রফেসর, আপনার সমস্যা কোথায়, আপনি কি জানেন? আপনার কাছে পুরো ২৪ ঘন্টা মানেই হলো ফুটবল। কিন্তু আমাদের এর বাইরেও আলাদা জীবন আছে।’
অনেকটা অসহায় হয়ে নিউ ওয়েলস ডিফেন্ডার ফার্নান্দো গ্যাম্বোয়া কথা গুলো বলেছিলেন ‘এল লোকো’-কে। এল লোকো মানে কী, জানেন তো? বদ্ধ উন্মাদ। তার ফুটবল নিয়ে ধ্যানজ্ঞান এতটাই ছিল যে, ছুটির দিনগুলোতেও ১৪ ঘন্টা করে সময় ব্যয় করতেন ফুটবলের নতুন নতুন চিন্তাভাবনা নিয়ে। সেই দিনগুলোয় খেলা দেখতে দেখতে নোট টুকে রাখার জন্য কাজে লাগাতেন স্বয়ং নিজের শ্বশুরকেই।
ফুটবল নিয়ে যতটা ভালবাসা, বাস্তব জীবনে ঠিক ততটাই খামখেয়ালি তিনি। লিডসের সাধারণ এক অ্যাপার্টমেন্ট থেকে পায়ে হেঁটে ট্রেনিং গ্রাউন্ডে পৌঁছানো আর সাধারণ এক ট্র্যাকস্যুটই বলে দেয়, ফুটবলকে তিনি রাখেন সবার উপরে। এমনকি ফিফার গালা অনুষ্ঠানেও তিনি হাজির হন ট্র্যাকস্যুট পরিধান করেই। লিডস আর ট্র্যাকস্যুট এর কথা পড়ে হয়তো পাঠক বুঝে ফেলেছেন, কার কথা বলে হচ্ছে। হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন, তিনি ফুটবলের ‘ম্যাড ম্যান’-খ্যাত মার্সেলো বিয়েলসা।
বেড়ে ওঠা
রোজারিও সম্ভবত ‘ম্যাড জিনিয়াস’দের জায়গা। বিপ্লবী চে গেভারার কথা তোলা থাক আজকের জন্য। লিওনেল মেসি কিংবা ডি মারিয়া – রোজারিওতে জন্ম নেওয়া ফুটবল প্রতিভাও নেহায়েত কম নয়। তবে সবাই এক ব্যাপারে একমত হবেন যে, ফুটবলীয় জ্ঞানে সবাইকে টেক্কা দেওয়ার ক্ষমতা আছে শুধু একমাত্র মার্সেলো বিয়েলসারই।
১৯৫৫ সালের জুলাই মাসে যার জন্ম এই রোজারিওতেই। ফুটবল নিয়ে আগ্রহ সেই ছোটবেলা থেকেই। ২১ বছর বয়সে রোজারিওর ক্লাব নিউ ওয়েলসে খেলা শুরু করলেও বিয়েলসা বুঝতে পারেন, তার ফুটবলীয় টানটা পায়ে নয়, বরং মগজে। খেলা ছেড়ে দেন সেই সময়টাতেই। জ্ঞানই শক্তি – দাদা থেকে পাওয়া এই মূলমন্ত্রকে পুঁজি করে বিয়েলসা পাগলের মতো আহরণ করেছেন ফুটবলীয় জ্ঞান। ফুটবল সম্পর্কিত তিন সহস্রাধিক বই না হয় বাদই দিন আপনি, এই বয়সে এসেও বিয়েলসা সাবস্ক্রাইব করে রেখেছেন দেশ-বিদেশের ৪০টিরও বেশি ফুটবল ম্যাগাজিন!
বিয়েলসার ভাষ্যমতে, নিজের প্রথম ১৬ বছর তিনি কাটিয়েছেন নিজের আদর্শ মানা দুই কোচকে দেখে। প্রথম আট বছর ছিলেন মেনোত্তিতে আবিষ্ট, পরের আট বছর নিরীক্ষা করেছেন কার্লোস বিলার্দোকে। আর্জেন্টিনার এই দুই বিশ্বকাপজয়ী কোচই বিয়েলসার ডাগআউটে আসার অনুপ্রেরণা।
শুরুর কথা
মার্সেলো বিয়েলসার ডাগআউটের যাত্রা একেবারে যৌবনের শুরু থেকেই। বুয়েন্স আয়ার্সের বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক দল বাছাইয়ে সর্বপ্রথম সবাইকে চমকে দেন তিনি। মাত্র ২০ জনের দল গঠনের জন্য তিনি ৩০০০-এর বেশি খেলোয়াড় চেখে দেখেন। শুধু দল গঠনেই ক্ষান্ত থাকেননি, সবাই মুগ্ধ হয়ে দেখেছে বিয়েলসার ট্রেনিং সেশনের আপোষহীনতা।
আর্জেন্টাইন মিডিয়া ফলাও করে প্রচার করে বিয়েলসার কথা। তাই প্রফেশনাল কোচ হিসেবে প্রথম ডাকের জন্য বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি তাকে। খেলোয়াড়ি জীবনে যে ক্লাবকে বিদায় জানিয়েছিলেন কোচ হওয়ার তাগিদে, সেই নিউ ওয়েলস ওল্ড বয়েজের যুব একাডেমির ডাগআউটেই আগমন ‘এল লোকো’র।
কোচ হিসেবে যাত্রা
‘যখন প্রথম পৌঁছালাম, তখন বেশ মোটাসোটা ছিলাম আমি। আলফাহোরেস খেতে খুব পছন্দ করতাম। বিয়েলসা কী করলেন, প্রথমেই সেটার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে দিলেন। শিখালেন, বৃষ্টির মধ্যে ট্রেনিং করতে হবে। সে কারণে আমি তাকে দেখতেই পারতাম না!’
কথাগুলো শুনে ভাববেন না, ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন কেউ। এই কথাগুলো বলেই যেন বিয়েলসাকে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করলেন আর্জেন্টাইন কিংবদন্তি গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতা। নিউ ওয়েলস এর যুব প্রকল্পের দায়িত্ব নেওয়ার পর বিয়েলসা লক্ষ্য করলেন, তৃণমূল থেকে খেলোয়াড় একদমই উঠে আসছে না। উপায় বের করতে আর্জেন্টিনার ম্যাপ নিয়ে বসলেন। পুরো আর্জেন্টিনাকে ভাগ করলেন ৭০ ভাগে। নিজের পুরনো ফিয়াট-১৪৭ চালিয়ে প্রতিটি ভাগে গিয়ে গিয়ে ট্রায়াল শুরু করে খেলোয়াড় তুলে আনতে লাগলেন। যেই পরিশ্রমের ফসলেই বিশ্ব পেয়েছিল বাতিস্তুতা-আয়ালা-পচেত্তিনো-ওয়াল্টার স্যামুয়েল-জানেত্তি-সিমিওনেদের।
ফিরে আসা যাক বাতিস্তুতার কথাতে। আগেই জেনেছেন, বাতিস্তুতাকে যখন আবিষ্কার করলেন তিনি, তখন বাতিস্তুতার ভালবাসা ছিল আলফোহোরেস, এক ধরনের চকলেট বিস্কুট। বিয়েলসার কড়া ট্রেনিং সেশন সেই বাতিস্তুতাকে আদতেই ‘জিরো ফিগার’-এ রূপান্তর করে। নিউ ওয়েলসের মাঠে সেইসব অমানুষিক সেশনগুলোতে ঘাম ঝরানো বাতিস্তুতার তাই বিয়েলসাকে ঘৃণা করারই কথা বৈকি। কিন্তু বাতিগোল এটাও জানেন যে, বিয়েলসা ছাড়া ফুটবল জগতে কোনো ‘বাতিগোল’-এর আগমন হতো না।
বিয়েলসা নিজের কাজের প্রতি এতটাই ‘অবসেসড’ ছিলেন যে, একবার রাত দুইটায় নিজ বাসা থেকে ৭০ মাইল দূরের বাসায় গিয়ে দরজায় টোকা মেরে বসেন। কারণ? সেই বাসা থেকে আসা এক ছেলের পা দেখবেন বলে। ট্রায়ালে বিয়েলসার পা দেখে মনে হয়েছিল, এই ছেলে ভালো ফুটবল খেলতে পারবে। ছেলেটি কে ছিল জানেন? মরিসিও পচেত্তিনো। যার ভাষ্যমতে, সেদিন বিয়েলসা ঘরের দরজায় টোকা না দিলে তার জীবন হতো অন্যরকম। যুব একাডেমিতে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়ে খুব দ্রুতই মূল দলের ডাগআউটে আসেন বিয়েলসা। ১৯৯০-৯১ মৌসুমে নিউ ওয়েলস ‘এল লোকো’কে নতুন কোচ হিসেবে ঘোষণা করে।
এই ‘এল লোকো’ উপাধির পিছনেও রয়েছে আরেক গল্প। দায়িত্ব নেওয়ার প্রথম মৌসুমেই বিয়েলসার নিউ ওয়েলস ‘লাতিন আমেরিকার চ্যাম্পিয়নস লিগ’-খ্যাত কোপা লিবার্তাদোরেসের এক ম্যাচে সান লরেঞ্জোর বিপক্ষে ৬-০ গোলে হেরে বসে। ক্ষুব্ধ বিয়েলসা নাকি সেই সময়ে আত্মহত্যার চিন্তাও করে ফেলেছিলেন! এদিকে এত বড় হারের পর কিছু আল্ট্রাস সমর্থকেরা বিয়েলসার বাড়ি ঘেরাও করে। ম্যাচ হারের বেদনায় তখন ঘরে বসে কাঁদছিলেন বিয়েলসা। আর উপরি পাওনা হিসেবে সমর্থকদের জ্বালাতনও যোগ হয়েছে। অতিষ্ঠ বিয়েলসা গ্রেনেড হাতে বাসা থেকে বের হয়ে লোকবলের সামনে চলে আসেন। হুশিয়ারি দেন, মুহূর্তের মধ্যেই সবাই এই জায়গা ত্যাগ না করলে তিনি গ্রেনেডের সেফটি পিনটি খুলে ফেলবেন। সেই থেকে ভক্তরা তার নাম দেয় ‘এল লোকো’ বা উন্মাদ।
যে লিবার্তাদোরেস নিয়ে এত কাহিনী, পরের মৌসুমে সেই নিউ ওয়েলসকেই বিয়েলসা নিয়ে যান এই প্রতিযোগিতার ফাইনালে। যদিও সাও পাওলোর সাথে পেনাল্টিতে হেরে যায় তার দল। এই হারের পর স্বেচ্ছায় নিউ ওয়েলস ত্যাগ করেন তিনি। অথচ দুই বছরের মধ্যে দুইবারই দলকে লিগ জিতিয়েছিলেন তিনি। আর্জেন্টিনা ছেড়ে এবার চলে আসেন মেক্সিকোতে। অ্যাটলাস ক্লাবের দায়িত্ব নিয়ে সেখানেও খোলনলচে পাল্টে দেন ক্লাবের দর্শন। বুরগেত্তি-মার্কেজ-পাবলো পারদো-অসভালদো সানচেজসহ অসংখ্য প্রতিভা উঠে আসে বিয়েলসার হাত ধরে, যার ফল ভোগ করে মেক্সিকান জাতীয় দল।
২০০৬ বিশ্বকাপের দ্বিতীয় রাউন্ডে আর্জেন্টিনাকে প্রায় হারিয়ে দেওয়া মেক্সিকো দলের ৯ জন খেলোয়াড়ই ছিল বিয়েলসার অধীনে বেড়ে ওঠা। সেই বিশ্বকাপে মেক্সিকোর দুর্দান্ত ফুটবলও বাহবা কুড়িয়েছিল বেশ। বিয়েলসার প্লেয়ার তৈরি করার খ্যাতি এতই যে, পরবর্তীতে পেপ গার্দিওলা-আর্সেন ওয়েঙ্গারের মতো কোচরাও বিয়েলসার প্রশিক্ষিত খেলোয়াড়দের উপর ভরসা করেছেন বেশি। লাপোর্ত, মেন্ডি, সানচেজ, নিকোলাস পেপে প্রমুখ তাদের মধ্যে অন্যতম।
তবে সহজেই থিতু হওয়ার ধাতুতে গড়া ছিলেন না বিয়েলসা। মেক্সিকোতে যাওয়ার বছরকয়েক না ঘুরতেই আবার স্বদেশে প্রত্যাবর্তন। এইবার তার দলের নাম ভেলেজ সার্সফিল্ড। নিজের প্রথম সংবাদ সম্মেলনেই বুঝিয়ে দেন, তাকে কেন ‘এল লোকো’ নামে ডাকা হয়। আগের মৌসুমের প্রতিপক্ষের ৫১টি এনালাইসিস টেপ নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে তাক লাগিয়ে দেন।
তাছাড়া সেই ১৯৯৭ সালে ক্লাবের কাছে একজন কম্পিউটার অ্যানালিস্ট আবদার করেও বিস্মিত করেছিলেন সবাইকে। তখনকার সময়ে প্রতিপক্ষকে ভিডিও দিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণের চিন্তা প্রথম বিয়েলসার মাথাতেই এসেছিল। স্বভাবতই বিয়েলসা ম্যাজিকে লিগ শিরোপা ঘরে তোলে ভেলেজ সার্সফিল্ড। তার মানে দাঁড়ায়, তিন বছর আর্জেন্টাইন ক্লাবকে কোচিং করিয়ে তিনবারই লিগ শিরোপা ঘরে তুলতে সক্ষম হন তিনি।
আন্তর্জাতিক ফুটবলে বিয়েলসা
১৯৯৮ সালে স্প্যানিশ ক্লাব এস্পানিওলের ডাকে সাড়া দিলেও বেশিদিন থাকতে পারেননি তিনি। নয় ম্যাচে ডাগআউটে দাঁড়ানোর পর ডাক আসে ‘আলবিসেলেস্তে’দের কোচ হওয়ার। ‘৯৮ বিশ্বকাপ শেষে ড্যানিয়েল প্যাসারেলার ফেলে আসা ডাগআউটে দাঁড়ান বিয়েলসা।
বিয়েলসার আট বছরের কোচিং ক্যারিয়ারে ততদিনে আর্জেন্টিনাই সবচেয়ে বড় দল। সেই আর্জেন্টিনার একটি জেনারেশনের ভিত কীভাবে গড়ে দিয়েছিলেন, সেটা জানার আগে আমরা দেখবো বিয়েলসার খেলার দর্শন ও ধরন।
বিয়েলসার ট্রেনিং নিয়ে কিছুটা ধারণা আগেই দেওয়া হয়েছিল। তা থেকেই পাঠক নিশ্চয়ই আঁচ করতে পেরেছেন, হাইপ্রেসিংই বিয়েলসার অন্যতম হাতিয়ার। তিনি চান যে, ৯০ মিনিট তার খেলোয়াড়েরা দৌঁড়াবে। কিন্তু দেখা যায়, প্রায়ই খেলোয়াড়ের অভাবে সেটি হয়ে উঠে না। নাহলে হয়তো বিয়েলসাকে আক্ষেপ করে বলতে হতো না,
‘If my players aren’t human, I would never lose.’
‘বিয়েলসিস্তা’ হিসেবে খ্যাত এই মাস্টারমাইন্ডের সিগনেচার ফর্মেশন ছিল ৩-৩-১-৩। ফুটবল বিশ্বে এই অদ্ভুত ফর্মেশনের আবিষ্কারকও তিনি। তিনজন ডিফেন্ডারের সামনের তিনজনের মধ্যে মূলত দুইজন থাকত উইংব্যাক হিসেবে, আক্রমণের পাশাপাশি রক্ষণেও যারা সমান পটু। মাঝে থাকতো একজন রেজিস্তা। তার ঠিক সামনে একজন ক্ল্যাসিক্যাল নাম্বার টেন খেলিয়ে দুই পাশে দুই উইং ও সামনে টার্গেটম্যান মিলিয়েই বিয়েলসার এই ফর্মেশনের উদ্ভাবন। বিয়েলসার যেহেতু মূলমন্ত্র ছিল হাইপ্রেসিং, সেজন্য তিন ডিফেন্ডারের পাশাপাশি মাঝমাঠে এমন একজনকে তিনি প্রাধান্য দিতেন, যার কাজ থাকত হাইপ্রেসিংয়ের মধ্যেও বল মাঝমাঠের ফাঁকা জায়গায় পৌছে দেওয়া। আপনি লক্ষ্য করলে দেখবেন যে, আর্জেন্টিনায় এই জায়গায় তিনি খেলিয়েছিলেন সিমিওনেকে, আর গড়ে তুলেছিলেন ক্যাম্বিয়াসো-মাশচেরানোকে। মাশচেরানোকে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বিয়েলসা যে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন, সেটা জানতে হলে আপনাদের জানাতে হবে ছোট্ট একটি গল্প।
২০০৩ সালে রিভারপ্লেটে সদ্যই নাম লিখিয়েছেন হাভিয়ের মাশচেরানো। তখনও রিভারপ্লেটের হয়ে মাঠে নামাই হয়নি এই আর্জেন্টাইনের। কিন্তু অনুসন্ধানী বিয়েলসা ততদিনে মাশচেরানো সম্পর্কে রিভারপ্লেট কর্তৃপক্ষ থেকেও ঢের বেশি জানেন। তাকে বাজিয়ে দেখার জন্যই রিভারপ্লেট কোচকে ফোন বিয়েলসার। তার পরিকল্পনা শুনে রিভারপ্লেট কোচ হতভম্ব হয়ে বললেন, ‘বস, সে তো এখনো ক্লাব ক্যারিয়ারই শুরু করেনি!’ বিয়েলসার থোড়াই কেয়ার জবাব, ‘সে আমি দেখবো।’
বিয়েলসার হস্তক্ষেপে সেই বছরেই ক্লাব অভিষেকের আগেই উরুগুয়ের বিপক্ষে আন্তর্জাতিক অভিষেক হয়ে যায় মাশচেরানোর।
ফিরে আসা যাক খেলার ধরনে। বিয়েলসার ফর্মেশনে আরেকটি গুরুত্বপূর্ন বিষয় ছিলো হোল্ডিং মিডফিল্ডার। যেহেতু দুই উইঙ্গারের সাথে বিয়েলসা দুই উইংব্যাকও খেলাতেন। সেক্ষেত্রে ওয়াইডলি বল ডিস্ট্রিবিউশনে হোল্ডিং মিডফিল্ডারের কাঁধে থাকতো গুরুভার, যেটিকে স্প্যানিশ ভাষায় ‘রেজিস্তা’ও বলা হয়ে থাকে। মূলত আক্রমণের লাগামটা টান মারতো এই হোল্ডিং মিডফিল্ডাররাই। বর্তমানে আপনি বুস্কেটস কিংবা রদ্রির দিকে তাকালে এই ব্যাপার সম্পর্কে কিছুটা আঁচ করতে পারবেন।
বিয়েলসার খেলার মূল দর্শনে রয়েছে গতিময়তা ও রোটেশন। কথিত আছে, বিয়েলসার খেলোয়াড়েরা কখনো দাঁড়িয়ে থেকে পাস রিসিভ করেন না। আর টোটাল ফুটবলের অনুরাগী এই কোচ খেলোয়াড় রোটেশনের ব্যাপারে বেশ সচেতন। বল পায়ে রেখে দ্রুত আক্রমণ আর রক্ষনভাগে হাইপ্রেসিং – এই দুইয়ে মিলেই বিয়েলসার ফুটবল দর্শন।
৩-৩-১-৩ এ খেললেও বিয়েলসার ফর্মেশন প্রতিপক্ষ বুঝে মাঝে মাঝে এদিক-সেদিক হতো, সেটা বলাই বাহুল্য। কদাচিৎ ৪-২-১-৩ ফর্মেশনে খেললেও আপনি একটা জিনিস খেয়াল করে দেখবেন যে, বিয়েলসার ফর্মেশনে অ্যাটাকিং থার্ডের পিছনে খেলা একজন এর জায়গা সবসময় বরাদ্দ ছিলো। যেটির ফুটবলীয় আরেক নাম এনগাঞ্চে। যার বাংলা অর্থ দাঁড়ায় আংটা। পুরো দলের মাঝমাঠ আর আক্রমনভাগকে এক সুতোয় গাঁথা ছিলো যাদের প্রধান কাজ। এরা অনেকটা স্বাধীনতা নিয়েই মাঠ বিচরণ করতেন। আলবিসেলেস্তে দলে তখন এই রোলের জন্য ছিলেন ওর্তেগা। পাশপাশি বিয়েলসা গড়ে তুলেছিলেন আইমার, রিকেলমেদের। যার ফল হিসেবে আর্জেন্টিনা ২০০৬ সালে পেয়েছিল একটি পরিপূর্ণ স্কোয়াড। যে দলের ২৩ জনের মধ্যে রিকেলমে থেকে শুরু করে ক্রেসপো, আইমার, তেভেজ, মাশচেরানো, সোরিন, আয়ালাসহ ১৯ জনই বেড়ে উঠেছিলেন বিয়েলসার সান্নিধ্যে।
আর্জেন্টিনায় নিজের প্রথম ট্রেনিং সেশন এসেই বিয়েলসা সবাইকে বলেছিলেন নিজের পছন্দের ফর্মেশন লিখে দেখানোর জন্য। লেখা শেষে বিয়েলসা খেয়াল করলেন, সবার ফর্মেশনের শুরুটা একইভাবে, চারজন ডিফেন্ডার।
‘আমি দেখতে পাচ্ছি যে, তোমরা সবাই চারজন রক্ষণভাগ নিয়ে খেলতেই বেশি আগ্রহী। কিন্তু আমরা খেলবো তিনজন নিয়ে। কালকে আবার দেখা হবে। আজকের জন্য ট্রেনিং শেষ।’
এভাবেই নিজের ধরন, পরিকল্পনা ও আপোষহীনতা শুরুতেই সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন বিয়েলসা।
দুর্দান্ত টেকনিকের সাথে আর্জেন্টিনায় বিয়েলসা পেয়েছিলেন প্রতিভাবান খেলোয়াড়দেরও। কিন্তু মেজর কোনো শিরোপা না পাওয়ার পিছনে ভাগ্যকে দায়ী করতেই পারেন এল লোকো। ২০০২ বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে আর্জেন্টিনা ছিল ধরাছোঁয়ার বাইরে। মাত্র ১ ম্যাচ হেরে পয়েন্ট তুলে নিয়েছিল সর্বোচ্চ ৪৩। সর্বোচ্চ ৪২ গোলও করেছিল বাতিস্তুতা-বাহিনীরা। যে দুই রেকর্ড গত বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে তিতের ব্রাজিলও ভাঙতে পারেনি।
কিন্তু হট ফেভারিট হয়েও সেই বিশ্বকাপে মাত্র ২ গোল করে গ্রুপপর্বে বাদ পড়ার কারণ এখনো খুঁজে বের করতে পারেননি ফুটবলবোদ্ধারা। ২০০৪ কোপা আমেরিকাতেও একই পরিণতি। নির্ধারিত সময়ের খেলা শেষ হওয়ার ২০ সেকেন্ড আগে আদ্রিয়ানোর গোলে ২-২ সমতায় ফেরা ব্রাজিল পরবর্তীতে আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে ফাইনাল জিতে নেয় টাইব্রেকারে।
তবে অলিম্পিকে আর পা হড়কাননি বিয়েলসা। ১৯২৮ সালে উরুগুয়ের পর প্রথম লাতিন আমেরিকা দল হিসেবে ফুটবলে গোল্ড মেডেল গলায় ওঠে আর্জেন্টিনার। এমনকি ৬২ বছর পর যেটি কি না আর্জেন্টিনার প্রথম স্বর্ণপদক। সেই মেডেলই বিয়েলসার জেতা সর্বশেষ কোনো পদক। অলিম্পিক শেষেই বিয়েলসার জায়গায় স্থলাভিষিক্ত হন পেকারম্যান।
তবে আন্তর্জাতিক ফুটবলে বিয়েলসার প্রভাব থাকে আরো চার বছর ধরে। চার বছর বললে আদতে ভুল বলা হবে। গুগল দেখাবে চিলির কোচ হিসেবে বিয়েলসা দায়িত্ব পালন করেছিলেন ২০০৭-১১ সাল পর্যন্ত। কিন্তু তার ব্যাপ্তির পরিসর ছিল আরো অনেক বড়। বলিভিয়া আর চিলি ব্যতীত যে কোপা আমেরিকা সবার ভাগ্যে জুটেছিল, সে শিরোপার দেখা চিলি পেয়েছিল ৯৯ বছর পর। ইতিহাসে লেখা থাকবে, সে কোপাজয়ী কোচ ছিলেন আরেক আর্জেন্টাইন হোর্হে সাম্পাওলি। কিন্তু চিলিবাসী জানে, চিলির ফুটবল পুরো খোলনলচে বদলে দেওয়ার পিছনে বিয়েলসার অবদান কতটুকু। তার হাত ধরেই উঠে এসেছিল চিলির গোল্ডেন জেনারেশন। ভিদাল-সানচেজ-ব্রাভো বিয়েলসারই তুলে আনা সব প্রতিভা, যার অধীনে ১৯৯৮ সালের পর প্রথম বিশ্বকাপ বাছাই উতরে আসে চিলি।
২০১১ কোপা আমেরিকার পর চিলি ফুটবল ফেডারেশনের সাথে বনিবনা না হওয়ায় দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছিলেন আপোষহীন বিয়েলসা। যাওয়ার আগে অবশ্য চিলির ইতিহাসে সবচেয়ে সফল কোচ হিসেবে নাম লিখিয়ে যান। ৬৬ ম্যাচে ৩৪ জয় নিয়ে বিয়েলসার সময়ে চিলির শতকরা জয় ছিল ৫১.৫%!
স্পেনের ডায়েরি
ভিয়ারিয়ালের সাথে ২-২ ড্র শেষে সংবাদ সম্মেলনে আসলেন বিলবাও কোচ বিয়েলসা। এক সাংবাদিক থেকে ছুটে এলো অদ্ভুত এক প্রশ্ন,
‘বিলবাওয়ের আক্রমণের সময় আপনি ১৩ কদম ডানে আর ১৩ কদম বামে হাঁটেন। এর সাথে আক্রমণের কোনো যোগসূত্র আছে?’
বিয়েলসা জবাব দিলেন,
‘আপনার প্রশ্নের চেয়েও আমাকে বেশি অবাক করেছে যে, আপনি এত সুন্দর একটি খেলা বাদ দিয়ে আমার কদম গুনছিলেন!’
মিথ্যা বলেননি বিয়েলসা। দুই বছরের দায়িত্বে বিলবাওকে নিয়ে বিয়েলসা উপহার দিয়েছিলেন অনন্য সুন্দর এক দলগত ফুটবল। দায়িত্ব নেওয়ার আগে ৫৫টি ভিডিও আর একটি খাতা নিয়ে হাজির হয়েছিলেন সংবাদ সম্মেলনে। যার মধ্যে ৪২টি ভিডিও তিনি দেখেছেন দুইবার করে। কীসের ভিডিও ছিল সেগুলো? বিগত মৌসুমে অ্যাথলেটিক বিলবাওয়ের খেলা সবগুলো ম্যাচের।
বিয়েলসা বিশ্লেষণ করে বের করেছিলেন, একজন খেলোয়াড় আরেকজন খেলোয়াড়কে পায়ের ৮টি অংশ দিয়ে মোট ৩৬ ভাবে পাস দিতে পারে। পাঠক হয়তো ভাবছেন, সেটি তিনি বোর্ডে এঁকে খেলোয়াড়দের বুঝিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু ‘ম্যাড ম্যান’ বিয়েলসা নিজের জুতার উপর একেই সেটি ধরিয়ে দিয়েছিলেন বিলবাও খেলোয়াড়দের। সেই জুতা পায়ে ডাগ আউটেও ছিলেন বেশ ক’দিন। বিয়েলসার ফুটবল নিয়ে পাগলামীতে সাংবাদিকরা একবার বিলবাও খেলোয়াড় ইকার মুনিয়ানকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘বিয়েলসা কি সবসময় এমন পাগল?’ মুনিয়ান হেসে জবাব দিয়েছিলেন, ‘তিনি এর চেয়েও বেশি পাগল।’
সেই অ্যাথলেটিক বিলবাওতে মুনিয়ান ছাড়াও বিয়েলসা গড়ে তুলেছিলেন আন্দ্রে হেরেরা, ইতুরাস্পে, জাভি মার্টিনেজ, লরেন্তে, সুসায়েতা প্রমুখদের। হেরেরা ছিলেন বিয়েলসার মাঝমাঠের প্রাণ, যেখানে ‘রেজিস্তা’র ভূমিকায় ছিলেন জাভি মার্টিনেজ। ফরোয়ার্ডে গোলমুখে দুর্দান্ত করে তুলেছিলেন আদুরিজকে। তবে লিগের চেয়ে ইউরোপা লিগে বিলবাও ছিল দুর্দান্ত। সেকেন্ড রাউন্ডে ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে গিয়ে ফার্গির ম্যানইউকে ৩-২ গোলে হারিয়ে আসে বিয়েলসার শিষ্যরা। কিন্তু দুর্ভাগ্য বিয়েলসাকে পিছু ছাড়েনি। সেবার লিগ টেবিলে ১০ নাম্বারের চেয়ে কষ্টদায়ক ছিল কোপা দেল রে ও ইউরোপা লিগ দুই ফাইনালেই পরাজয় বরণ।
দ্য কিং ইন দ্য নর্থ
স্পেনে সুন্দর ফুটবল খেলেও কিছু না জেতার অভিমানে বিয়েলসা চলে আসেন মার্শেইতে। সেখানেও ছিলেন মোটে ১২ মাস। কায়েনের সাথে এক ম্যাচে ১-০ হারের পর হুট করেই নিজের উপর আক্ষেপ করে দায়িত্ব ছেড়ে দেন। অথচ মার্শেইকে টালমাটাল অবস্থা থেকে লিগে চতুর্থ বানিয়েছিলেন তিনি। তবে যাওয়ার আগে ফ্লোরিয়ান থাউভিন, লুকাস ওকাম্পস, দিমিত্রি পায়েতের মতো তারকাদের গড়ে দিয়ে এসেছিলেন। বিয়েলসা চলে যাওয়ার পর মার্শেই প্রেসিডেন্ট আক্ষেপ নিয়ে বলেছিলেন,
‘আমার কাছে মনে হয়েছিলো আমরা ১২ মাসের জন্য লিওনেল মেসিকে সাইন করিয়েছিলাম।’
তারপর? তারপর বিয়েলসা লাৎসিওর হয়ে ৩ দিন আর লিলের হয়ে ডাগআউটে সময় কাটিয়েছিলেন মাত্র ১১ দিন! কারণ? ফুটবলের ব্যাপারে আপোষহীনতা ও উন্মাদ ভালবাসা। লাৎসিও ছাড়ার সময় বিয়েলসা বলেছিলেন,
‘আমি যাদের ক্লাবে চাই, স্পষ্টতই ক্লাব তাদের চাচ্ছে না। এক্ষেত্রে এই ক্লাবকে আমার দেওয়ার কিছুই নেই।’
লাজিও অবশ্য সরে দাঁড়ানোর জন্য বিয়েলসার নামে ৫০ মিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরন মামলাও করেছিলো। ধোপে টেকেনি সেটি।
পাঠক নিশ্চয়ই এতক্ষণে বুঝে গিয়েছেন, ট্রেনিং সেশন কিংবা ম্যানেজারিয়াল পদক্ষেপ – সবকিছুতেই বিয়েলসা চান পূর্ণ স্বাধীনতা। এমনকি ম্যাচের আগে গভীর রাত অবধি ট্রেইনিং করানোর নজিরও আছে তার। বিয়েলসার ট্রেনিংকে অনেকে তুলনা দিয়েছিলেন ‘কমান্ডো ট্রেনিং’-এর সাথে। আর এসব ক্ষেত্রে বোর্ডে বা খেলোয়াড়দের হস্তক্ষেপই হতো বিয়েলসার ফুটবল দর্শনের সাথে সাংঘর্ষিক। তাই কোথাও বেশিদিন থিতু হতে পারেননি। পারেননি বড় কোনো ক্লাবের কোচ হতেও, যেখানে অনেক বড় মাপের খেলোয়াড়রা নিজেদের পছন্দমতো ট্রেনিং করতে ভালবাসে।
কিন্তু ফুটবলের প্রতি ভালবাসা মার্সেলো বিয়েলসাকে বেশিদিন দূরে রাখতে পারেনি। বিয়েলসার আগমনের আগে ১৪ বছর ধরে প্রিমিয়ার লিগ খেলতা না পারা লিডস ইউনাইটেডের ডাগআউটে ফিরলেন তিনি, যারা কি না বিগত ১৪ বছরে কোচ পরিবর্তন করেছে ১১ বার। তবে বিয়েলসাতেই ভরসা রাখেন লিডস ইউনাইটেড। তার হাতে তুলে দেন পূর্ণ স্বাধীনতা। প্রথম বছরেই পেয়ে যেতে পারতেন আরাধ্য প্রিমিয়ার লিগ খেলার টিকেট। কিন্তু শেষ দিকে পা হড়কানোয় তৃতীয় হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয় তাকে। তবে ২০১৯-২০ মৌসুমে আটকানো যায়নি বিয়েলসার লিডসকে। চ্যাম্পিয়ন হয়েই প্রিমিয়ার লিগের ডাগআউটে ফিরছেন বিয়েলসা, যেখানে রয়েছে তারই মন্ত্রমুগ্ধ ছাত্র গার্দিওলা-ক্লপরা।
যে লিডস দ্বিতীয় বিভাগে বিগত এক যুগ ধরে প্রথম দশেই ঢুকতে হিমশিম খেতো সেই লিডসকে দুই বছরের মাথায় চ্যাম্পিয়ন করে প্রিমিয়ার লিগে ফেরানো চাট্টিখানি কথা না। যে সাফল্যের মূলে রয়েছে বিয়েলসার মাথা ও পাগলামি। লিডসে এসেও বিয়েলসার পাগলামি কমেনি। ডার্বির বিপক্ষে এক ম্যাচে প্রতিপক্ষের ট্রেইনিং গ্রাউন্ডে গুপ্তচর পাঠিয়ে পত্রিকার শিরোনাম হয়েছিলেন মাঝে। অকপটে স্বীকার করেছেন, এ স্বভাব তার বহু পুরনো। অবশ্য ক্লাবকে করা ২,০০,০০০ ইউরো জরিমানার পুরোটাই দিয়েছিলেন নিজের পকেট থেকে। বিয়েলসা লিডসকে নিজের ট্রেডমার্ক ফর্মেশন থেকে বেড়িয়ে এসে খেলিয়েছেন ৪-১-৪-১ ফর্মেশনে। মাঝে মাঝে অবশ্য ৩-৪-৩ এবং ৩-৩-১-৩ ফর্মেশনেও দেখা যেত তার দলকে। কিন্তু খেলোয়াড়ের অভাবে মূলত ৪-১-৪-১ কেই প্রাধান্য দিয়েছিলেন বেশি।
লিডসে গতিময়তার সাথে পাসিং ও বল ধরে রেখে খেলার মন্ত্রনা দিয়েছেন বিয়েলসা, যার জন্য পজেশন (৬০%) ও পাসিং দুই দিক থেকেই এক নাম্বারে ছিল বিয়েলসার শিষ্যরা। আক্রমণের ক্ষেত্রে বিয়েলসা ব্যবহার করেছেন তার পছন্দের ওয়াইড এরিয়া। দুই ফুলব্যাককে কাজে লাগিয়ে সবচেয়ে বেশি কাউন্টার অ্যাটাক গোলও (৬) আদায় করেছেন তিনি। পাশাপাশি প্রতি ম্যাচে সবচেয়ে বেশি ক্রসেও (২৬) প্রথম স্থান লিডসের দখলে। যারই ফলশ্রুতিতে প্রিমিয়ার লিগে বিয়েলসা বাহিনী। ইংল্যান্ডের নর্থে অবস্থিত লিডসের ফ্যানরা ‘জেইমি ল্যানিস্টার’খ্যাত লিডস ফ্যান নিকোলাই কোস্টার ওয়ালডোর সাথে গলা মিলিয়ে তাই বলতেই পারে, ‘He is the new king in the north.’
ব্যক্তিজীবনে বিয়েলসা
ব্যক্তিজীবনে নিতান্তই সাদামাটা বিয়েলসা। তবে প্রখর ব্যক্তিত্বের অধিকারী হিসেব তাঁর বেশ শুনাম রয়েছে। ট্রেইনিং গ্রাউন্ডে যতই কড়া হন না কেন, ‘মানুষ বিয়েলসা’কে ভালবাসে নিজের খেলোয়াড়, প্রতিপক্ষসহ ভক্তরাও। একবার এক বিলবাওয়ের ছোট্ট ভক্ত এসে অটোগ্রাফ চেয়েছিলেন এল লোকো’র কাছে। তিনি সেই খুদে ভক্তকে অপেক্ষমান রেখে পুরো দলের সই নিয়ে এসে চমকে দিয়েছিলেন তাকে।
ফুটবল নিয়ে উন্মাদনা যতই থাক না কেন, আদর্শ ও নীতির বেলায় বিন্দুমাত্র ছাড় দিতে নারাজ তিনি। প্রথম মৌসুমেই লিডসকে প্রিমিয়ার লিগে জায়গা পাইয়েই দিয়েছিলেন প্রায়। শেষ দিকে এসে অ্যাস্টন ভিলার সাথে এক গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে জয় নিয়ে মাঠ ছাড়তে পারলেই কেল্লাফতে। কিন্তু বাদ সাধলো অসামান্য এক মানবীয়তা।
লিডসের প্রথম গোলটির সময় অ্যাস্টন ভিলার এক খেলোয়াড় ব্যাথায় মাঠে কাতরাচ্ছিলেন। রেফারির চোখ সেটি এড়িয়ে গেলেও বিয়েলসার চোখ এড়ায়নি। তার কাছে মনে হয়েছিল, গোলটি ফুটবলীয় আইনে সঠিক হলেও ছিল নীতিবিরুদ্ধ। তাই নিজ আদর্শে অটল বিয়েলসা নিজের শিষ্যদের নির্দেশ দিয়েছিলেন তারা যাতে অ্যাস্টন ভিলাকে একটি গোল স্বেচ্ছায় করতে দেয়। শেষ পর্যন্ত ম্যাচটি ১-১ ড্র হওয়ায় প্লে-অফ খেলতে হয় বিয়েলসার দলকে। সেখানে হেরে তাই লিডসের প্রিমিয়ার লিগে আসা হয়ে উঠেনি সেবার। তবে বিয়েলসার কাজে যারপরনাই বিস্মিত হয়েছিল ফুটবল বিশ্ব। ফিফাও বিয়েলসা ও তার দলের এই কাজের স্বীকৃতি জানায় ফিফা ফেয়ার-প্লে অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত করে।
দিনশেষে বিয়েলসার স্থান কোথায়?
সাফল্যের বিচারে হয়তো ঢের পিছিয়ে থাকবেন, কিন্তু ফুটবলে প্রভাবের বিচারে তিনি শীর্ষস্থানীয় একজন। সাংবাদিক জোনাথন উইলসন বলেছেন, ষাটের দশকে ব্রাজিলের ‘ব্যাক ফোর’ প্রথা চালুর পর আধুনিক ফুটবলে বিয়েলসার মতো প্রভাব রাখতে পারেননি আর কোনো লাতিন আমেরিকান। তাই তো বিয়েলসাকে ‘পিতৃতুল্য’ মানেন সিমিওনে-পচেত্তিনোরা। বার্সেলোনার দায়িত্ব পেয়ে ১১ ঘন্টার ফ্লাইটে বিয়েলসার সাথে আলোচনা করতে আর্জেন্টিনায় ছুটে যান গার্দিওলা। যে আলোচনা শেষে গার্দিওলা বলেছিলেন, বিয়েলসা বার্সেলোনা নিয়ে যা জানেন, আমি কোচ হয়েও তা জানি না। রিয়াল মাদ্রিদের দায়িত্ব পেয়ে জিদান মার্শেইতে গিয়ে তার সান্নিধ্যে সময় কাটান তিন ঘন্টা। নিউ ওয়েলস ওল্ড বয়েজ নিজেদের স্টেডিয়ামের নামকরণ করে তার নামে। এমনকি বাদ যায় না লিডস শহরের রাস্তাও।
সাংবাদিক সিড লো’র মতে বিয়েলসা হচ্ছেন ফুটবলের ‘বোটানিস্ট’। কিংবদন্তি গায়ক জন লেনন একটি কথা বলেছিলেন, ‘বিটলস মানেই রক এন্ড রোল যেমনটা মাইকেল জ্যাকসন মানেই পপ।’ জন লেননের সুরে যদি আমি আপনি বা যে কেউ বলি ‘বিয়েলসা মানেই ফুটবল’, তাতে বোধ করি আপত্তি জানানোর লোক খুব একটা পাওয়া যাবে না।