মহেন্দ্র সিং ধোনি অধিনায়কত্ব ছাড়লেও এখনও ভারতের হয়ে সীমিত ওভারের ক্রিকেট খেলছেন। তিনি কাগজে-কলমে অধিনায়ক না হলেও ম্যাচের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে বিরাট কোহলি, রোহিত শর্মাদের পরামর্শ দিয়ে থাকেন। ‘ক্যাপ্টেন কুল’ উপাধি পাওয়া ধোনির ক্রিকেটীয় জ্ঞান সমসাময়িক অন্যান্য ক্রিকেটারের চেয়ে অনেক বেশি।
তিনি একজন ক্রিকেটার হিসেবে যেমন সফল, অধিনায়ক হিসেবেও তেমনই অতুলনীয়। তার নেতৃত্বে ভারত বিশ্বসেরা টেস্ট দল হয়েছিলো। একমাত্র অধিনায়ক হিসেবে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ, ওয়ানডে বিশ্বকাপ এবং চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জিতেছিলেন। আইপিএলেও তার বিচক্ষণতার কারণে অনেক কঠিন ম্যাচে শেষ হাসি হেসেছিলো তার দল, সেখানেও তিনি সফল। তিনবার আইপিএলের শিরোপা জেতানোর পাশাপাশি দুবার চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জিতিয়েছেন তিনি। ধোনির ‘আউট অফ দ্য বক্স মুভ’গুলো বেশিরভাগ সময় সফলতার মুখ দেখেছে। তাই তিনি অধিনায়ক হিসাবে অনেকের কাছে রোল মডেল হয়ে থাকবেন।
ভারতের হয়ে সর্বজয়ী অধিনায়ক ধোনি তার ক্রিকেট ক্যারিয়ারে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন, যেগুলো অন্য কেউ গ্রহণ করার আগে দ্বিতীয়বার চিন্তা করবে। অধিনায়কত্বের শুরুতেই তিনি সীমিত ওভারের ম্যাচে তরুণ ক্রিকেটারদের দলে নেওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন। দুর্দান্ত ফিল্ডিং করা রোহিত-জাদেজা-রায়নারা তাই তার সুনজরে ছিলো। এতে করে অনেক অভিজ্ঞ ক্রিকেটারকে নিজের দলে চাননি, যার দীর্ঘমেয়াদী ফলাফল এখন ভারত ভোগ করছে।
২০১১ সালের বিশ্বকাপের ফাইনালেও ফর্মে থাকা যুবরাজকে বসিয়ে নিজে ব্যাট করতে নেমে ভারতকে শিরোপা জিতিয়ে তবেই সাজঘরে পা রেখেছিলেন। ঐদিন বাঁহাতি যুবরাজকে মুত্তিয়া মুরালিধরনের সামনে না পাঠানোর জন্যই এই বিস্ময়কর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন পুরো বিশ্বকাপে নিজের ছায়া হয়ে থাকা ধোনি। এরকম আরও অনেক ম্যাচে তার বুদ্ধিদীপ্ত সিদ্ধান্তের কারণে শেষ হাসি হেসেছিলো তার দল। উইকেটের পেছনে থেকে ব্যাটসম্যানদের গতিবিধি বুঝে সেই অনুযায়ী ফিল্ডিং সেটআপ এবং বোলিং পরিবর্তন করার ক্ষেত্রে তিনি অতুলনীয়।
তার এমন আউট অফ দ্য বক্স মুভে অনেক ক্রিকেটারের ক্যারিয়ার বদলে গিয়েছে। বর্তমানে সীমিত ওভারের ক্রিকেটে অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান রোহিত শর্মার সফলতার পেছনেও ধোনির বড় অবদান রয়েছে। রোহিতের প্রতিভার কমতি ছিলো না, কিন্তু ক্যারিয়ারের প্রথমদিকে নিজের প্রতিভার সদ্ব্যবহার করতে পারছিলেন না তিনি। ২০০৭ সালে ওয়ানডে ক্রিকেটে অভিষেক ঘটার পর প্রায় ছয় বছর মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান হিসেবে খেলেছেন তিনি। এরপর ২০১৩ সালে মোহালিতে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ইনিংস উদ্বোধন করার জন্য রোহিতকে পাঠান ধোনি। ঘরোয়া ক্রিকেটেও তিনি ওপেনার হিসেবে খেলতেন না।
ধোনির সিদ্ধান্তকে যথাযথ প্রমাণ করে মোহালিতে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৮৩ রানের ইনিংস খেলেছিলেন রোহিত। ঐ ম্যাচের আগে মিডল অর্ডারে ব্যাট করতে নেমে শেষ ছয় ইনিংসে ৪, ৪, ৪, ০, ০ এবং ৫ রান করে সাজঘরে ফিরেছিলেন তিনি। এখন তো ওপেনার রোহিতের কীর্তি সবার জানা। এখন পর্যন্ত ১০৩ ম্যাচে ৫৬.১১ ব্যাটিং গড়ে ৫,০৫০ রান করেছেন। তার এমন সাফল্য পাওয়ার পেছনে ধোনির অবদানও কম নয়।
মহেন্দ্র সিং ধোনির পরামর্শে লোকেশ রাহুল টেস্ট ক্রিকেটে এবং জাসপ্রিত বুমরাহ বড় পরিসরে নিজেদের সামর্থ্যের জানান দিতে পেরেছেন। লোকেশ রাহুল সীমিত ওভারের ক্রিকেটে নিজেকে প্রমাণ করে টেস্ট দলেও জায়গা করে নিয়েছিলেন। ২০১৪ সালে ধোনি যখন টেস্ট ক্রিকেটকে বিদায় জানান, তখন রাহুলের অভিষেক ঘটে। অভিষেক ম্যাচে মিডল অর্ডারে ব্যাট করতে নেমে দুই ইনিংসে সংগ্রহ করেছিলেন মাত্র ১ রান। সিডনিতে পরের ম্যাচে ধোনি না খেললেও তার পরামর্শে রাহুল ওপেনিংয়ে খেলেছিলেন। এবং ওপেনিংয়ে নেমে প্রথম ইনিংসেই ১১০ রানের অনবদ্য ইনিংস খেলেছিলেন তিনি। ২০১৬ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টিতে টপ অর্ডারে পজিশন খালি না থাকার কারণে ধোনি তাকে চারে খেলানোর সিদ্ধান্ত নেন এবং রাহুল মাত্র ৫১ বলে ১১০* রান করে তার আস্থার প্রতিদান দেন।
জাসপ্রিত বুমরাহ আইপিএলে দুর্দান্ত বোলিং করে ভারতের টি-টোয়েন্টি দলে জায়গা করে নিয়েছিলেন। ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজ খেলতে অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমিয়েছিলেন তিনি। তখনও তাকে ওয়ানডে দলে নেওয়ার কোনো পরিকল্পনা ছিলো না। কিন্তু ধোনি অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে শেষ ওয়ানডের জন্য বুমরাহকে একাদশে রাখেন। এর আগের চারটি ওয়ানডেতে ভারতীয় বোলাররা দুবার তিন শতাধিক এবং ২৯৫ রান ডিফেন্ড করতে ব্যর্থ হয়েছিলো। বুমরাহ হঠাৎ করে সুযোগ পেয়ে দুই হাতে সুযোগ কাজে লাগিয়েছেন। নিজের অভিষেক ম্যাচে মাত্র ৪০ রান খরচায় দুই উইকেট শিকার করেছিলেন। এরপরের ঘটনা তো সবারই জানা। মাত্র ৩৯ ওয়ানডে খেলে ৬৯ উইকেট শিকার করেছেন এই পেসার।
কেদার যাদবের ক্যারিয়ার বদলে দেওয়া পদক্ষেপ
মহেন্দ্র সিং ধোনির অনেকগুলো আউট অফ দ্য বক্স মুভের মধ্যে অন্যতম কেদার যাদবের হাতে বল তুলে দেওয়া। ২০১৬ সালের অক্টোবরে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজ শুরু হওয়ার আগে নেটে অনিয়মিত উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান কেদার যাদবের হাতে বল তুলে দিয়েছিলেন ধোনি। সেখানে তার বোলিং অ্যাকশন এবং নিয়ন্ত্রণ দেখে তিনি তাকে মূল ম্যাচেও পার্টনারশিপ ব্রেকার হিসেবে ব্যবহার করেন।
কেদার যাদব বল হাতে সুযোগ পেয়ে ধোনির আস্থার প্রতিদান দিয়ে ৩ ওভার বল করে মাত্র ৬ রান দিয়ে ২ উইকেট শিকার করেন। এই ম্যাচের আগে ঘরোয়া ক্রিকেটেও তাকে খুব বেশি বল করতে দেখা যেতো না। তবে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ঐ সিরিজে তাকে যে কারণে বোলিং আক্রমণে আনা হয়েছিলো সেটা সঠিকভাবে পালন করতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। এরপর থেকে বদলে যায় কেদার যাদবের ক্যারিয়ার। ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি লো-আর্ম অ্যাকশনে বল করে অলরাউন্ডার হিসেবে ভারতের হয়ে ওয়ানডে ক্রিকেট খেলছেন তিনি এবং এই ভূমিকা ভালোভাবেই উপভোগ করছেন তিনি।
এশিয়া কাপের গ্রুপ পর্বের ম্যাচে পাকিস্তানের বিপক্ষে বোলিং করার সময় ইনজুরিতে পড়েন হার্দিক পান্ডিয়া। তাই তার বাকি ওভারগুলো শেষ করার জন্য কেদার যাদবের শরণাপন্ন হন অধিনায়ক। বল করতে এসে স্ট্যাম্প টু স্ট্যাম্প বল করে পাকিস্তানি ব্যাটসম্যানদের চাপে রাখেন তিনি। তার আরেকটি গুণ হলো তিনি তার ওভারগুলো দ্রুত শেষ করেন, ব্যাটসম্যানদের বাড়তি কোনো সময়ই দেন না। পাকিস্তানের বিপক্ষে শুধুমাত্র পান্ডিয়ার বাকি ওভারগুলোই শেষ করলেন না, করলেন ম্যাচজয়ী স্পেল। ম্যাচে ৯ ওভার বল করে ২৩ রানের বিনিময়ে তিনি ৩ উইকেট শিকার করেছিলেন, যা তার ছোট বোলিং ক্যারিয়ারের সেরা বোলিং ফিগার।
কেদার যাদব এখন পর্যন্ত ২৪ ইনিংসে বল করে ৩০.৬৮ বোলিং গড়ে ১৯ উইকেট শিকার করেছেন। তার ইকোনমি রেটও দুর্দান্ত। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের যুগে ওভারপ্রতি মাত্র ৪.৯৪ রান খরচ করেছেন। আসন্ন বিশ্বকাপের জন্য ভারত ছয় নাম্বারে একজন ব্যাটিং অলরাউন্ডারের সন্ধানে ছিলো। কেদার যাদবের বোলিং প্রতিভা উন্মোচিত হওয়ার পর খুব সম্ভবত তিনিই এই ভূমিকা পালন করবেন।
নিজের বদলে যাওয়া ক্যারিয়ার সম্পর্কে কেদার যাদব বলেন, “নিউজিল্যান্ড সিরিজে ধোনি যখন আমাকে বল করতে বললেন, এরপর থেকে আমার জীবন পুরোপুরিভাবে পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে এবং আমি এখন বোলিংয়ের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী।” তিনি আরও বলেন, “আমার বোলিংয়ের সম্পূর্ণটাই হলো ব্যাটসম্যানদেরকে বোঝা। আর আমার পরিকল্পনা হলো স্ট্যাম্প-টু-স্ট্যাম্প বল করা। তুমি যদি রান করো তাহলে ঠিক আছে, আর যদি মিস করো তাহলে আমার জন্য উইকেট অপেক্ষা করছে।“
পার্টনারশিপ ব্রেকার হিসেবে বোলিং করলেও দলে যে তিনি ব্যাটসম্যান হিসেবে খেলছেন সেটা ভুলে যাননি। এই সম্পর্কে তিনি বলেন, “সত্যি বলতে আমি ম্যাচের আগে ট্রেনিং সেশনে কয়েক ওভার বল করি। নেটেও আমি খুব বেশি বল করি না। আমি অনুভব করি, আমি যদি বোলার হওয়ার চেষ্টা করি তাহলে আমার এখন যেটা আছে সেটা হারিয়ে ফেলবো। তাই আমি সীমার মধ্যে থাকছি। শুরুতে যখন আপনার পেসাররা ভালো বল করবে তখন প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানরা স্পিনারদেরকে আক্রমণ করার চেষ্টা করবে। এতে আমাদের উইকেট নেওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। এবং এটা কাজে দেয়।“
কেদার যাদবের সবচেয়ে বড় লড়াই হলো তার নিজের সাথে। গত ছয় মাসে তিনি তিনবার হ্যামস্ট্রিং ইনজুরিতে পড়েছেন। ইনজুরির কারণে সর্বশেষ আইপিএল আসরের প্রথম ম্যাচের পর আর মাঠে নামতে পারেননি। বর্তমানে তিনি তার ফিটনেস নিয়ে বেশ সচেতন। প্রতিদিনই নিজের ফিটনেস নিয়ে কাজ করছেন।
বোলিংয়ের পাশাপাশি ব্যাট হাতেও ফিনিশারের ভূমিকা পালন করছেন কেদার যাদব। শক্তিশালী টপ অর্ডারের কারণে ব্যাট হাতে খুব বেশি সুযোগ পান না তিনি। এখন পর্যন্ত ৪৪ ম্যাচের মধ্যে ২৮ ইনিংসে ব্যাট করে ৪১.৩০ ব্যাটিং গড়ে এবং ১০৮.৮২ স্ট্রাইক রেটে ৮২৬ রান করেছেন।
ব্যাট হাতে যখনই সুযোগ পেয়েছেন, তখনই কাজে লাগিয়েছেন। ব্যাটসম্যান হিসেবে তার স্মরণীয় মুহূর্তের মধ্যে একটি হলো ২০১৭ ইংল্যান্ডের বিপক্ষে পুনেতে। ঐ ম্যাচে ইংল্যান্ডের দেওয়া ৩৫১ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে মাত্র ৬৩ রানে ৪ উইকেট হারায় ভারত। এরপর বিরাট কোহলির সাথে পঞ্চম উইকেট জুটিতে ২০০ রান যোগ করে ভারতকে নাটকীয় জয় পেতে সাহায্য করেন। তিনি মাত্র ৭৬ বলে ১২টি চার এবং চারটি ছয়ের মারে ১২০ রানের অনবদ্য ইনিংস খেলেছিলেন। কলকাতাতে একই সিরিজের তৃতীয় ম্যাচে হ্যামস্ট্রিং ইনজুরি নিয়েও ৭৫ বলে ১২টি চার এবং একটি ছয়ের মারে ৯০ রানের ইনিংস খেলেন।
যাদব জানেন, বিশ্বকাপের টিকিট পেতে হলে তাকে ব্যাটিংয়ের উপর-ই বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।
ফিচার ইমেজ: BCCI