মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডের হসপিটালিটি বক্সে বসে অ্যাশেজ টেস্টের রূপ-রস উপভোগ করছেন। আপনি ছাড়াও জনা পাঁচেক দর্শক আছে, সেটাও একেবারে পিছনের দিকে। অল্প আলোতে কেমন যেন ভৌতিক পরিবেশ দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে পঞ্চম দিনের শেষ বিকেলে মাঝ মাঠে টানটান উত্তেজনায় লড়ছে স্টিভেন স্মিথ বনাম অ্যালিস্টার কুকের দল। এমন সময় চোখের কোণ দিয়ে দেখলেন, আপনার ৮-৯ আসন বাদেই আবছা অন্ধকারে কেউ একজন বসে আছে। একটু খেয়াল করতেই মনে হলো, চেহারাটা স্যার ডোনাল্ড ব্র্যাডম্যানের মতো! অস্ট্রেলিয়ান কিংবদন্তীর ভূত ভেবে চমকে উঠবেন? ঠিক সেই সময়েই যদি আস্তে করে ঘাড় ঘুরিয়ে আপনার দিকে একবার তাকিয়ে পিলে চমকানো হাসি দেন ব্র্যাডম্যান, কেমন লাগবে?
ব্যাপারটি আজগুবি মনে করে ভুলে যাওয়া যেতে পারে। কিন্তু আল্লাহর দুনিয়ায় কতকিছুই না রহস্য রয়ে যায়। সেই রহস্য ছাড়েনি খেলার স্টেডিয়ামকেও। সারা দুনিয়া জুড়ে এমন সব স্টেডিয়ামের কমতি নেই যেখানে কোনো না কোনো ‘ভূতুড়ে’ অভিজ্ঞতা আছে। ফুটবলেই যেন এমনটা বেশি হয়। বিশ্বের এমন কিছু স্টেডিয়ামের ছোট কিন্তু আলোচিত ঘটনা নিয়েই এই আয়োজন।
স্টেডিয়াম অব লাইট (সান্ডারল্যান্ড, ইংল্যান্ড)
ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের সময় চলছে। স্কাই স্পোর্টস চ্যানেলে পরদিন সন্ধ্যার ম্যাচের প্রিভিউ বয়ান করছেন বিশ্লেষকরা। সান্ডারল্যান্ডের ম্যাচ। পিছনের জায়ান্ট স্ক্রিনে সান্ডারল্যান্ডের দর্শকশূন্য গ্যালারি আর মাঠের একটি কোণা দেখা যাচ্ছে। মাঠকর্মীরা সেখানে কাজ করছে। হুট করে টেলিভিশন ক্যামেরায় ধরা পড়ল একজন মাঠকর্মী কাজ করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছে, এর মধ্যে হুট করে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল! জলজ্যান্ত মানুষ এভাবে মিলিয়ে যাওয়া নিয়ে তুমুল আলোচনা হয়েছিল ২০১৬ সালের ওই ঘটনায়। এরপরও একাধিকবার একইভাবে মাঠকর্মীর হাওয়ায় মিলিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু সত্যি সত্যি নিখোঁজ হয়েছে বলে এমন কোনো খবর তদন্ত করে পাওয়া যায়নি।
তারও আগে ২০০৫ সালের ঘটনা। দুজন কর্মচারী হঠাৎ ক্লাব কতৃপক্ষকে অভিযোগ জানাল, করিডোরে তারা ভূত দেখেছে। শুরুতে তো হেসেই উড়িয়ে দিল সবাই। ক্লাব তাদের কর্মীদের বোঝাল, আরেকপাশ থেকে কেউ একজন হেঁটে যাচ্ছিল, সেটার ছায়া পড়েছে এ পাশে। ঐ দুজন নাকি সেই ছায়া দেখেই ভয় পেয়েছে।
কিন্তু তারা যে ভুল ছিল না তা প্রমাণ করলেন আইরিশ স্ট্রাইকার স্টিফেন এলিয়ট। তিনি অভিযোগ আনেন, তিনিও ভূত দেখেছেন করিডরে। এরপর থেকে পুরো স্টেডিয়াম ভূতুড়ে বলে পরিচিত হয়ে যায়। অনেকে বিশ্বাস করেন, যাকে ভূত বলে দাবি করা হচ্ছে সে আসলে ১৮ শতকের এক অভিশপ্ত আত্মা। যে কিনা ধ্বংসপ্রাপ্ত জাহাজ লুট করে বেড়াত। সে-ই স্টেডিয়ামে এভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
কিন্তু জাহাজের ভূত কিভাবে ফুটবলপ্রেমী হয়ে সান্ডারল্যান্ড স্টেডিয়ামে ভর করল সে ব্যাখ্যা এখনও কেউ দিতে পারেনি।
গাজী স্টেডিয়াম (কাবুল, আফগানিস্তান)
মধ্যযুগে খোলা মাঠে অপরাধীদের শাস্তি দেওয়া হত। কাউকে ফাঁসিতে ঝোলানো, শিরচ্ছেদ, এমনকি কেটে টুকরো টুকরো করা; লোমহর্ষক সব শাস্তিই আয়োজন করে, মাঠ ভর্তি দর্শকের সামনে দিত শাসক গোষ্ঠীরা। সেটা শত শত বছর আগে। পরবর্তীতে সেই সব জায়গাগুলোয় অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটেছে, এমন প্রমাণ ইতিহাসের পাতায় লেখা আছে। কিন্তু আধুনিক যুগেও এমন জায়গা খুঁজে পাওয়া যায়, সেটাই যেন মনে করিয়ে দেয় যুদ্ধবিদ্ধস্ত আফগানিস্তানের গাজী স্টেডিয়াম। রাজধানী কাবুলের এই ফুটবল স্টেডিয়ামটির আশেপাশে এখনও সন্ধ্যার পর কেউ যেতে চায় না।
কারণ, তালিবানরা এই স্টেডিয়ামকে বানিয়েছিল একরকম ফাঁসি কিংবা শিরচ্ছেদের মঞ্চ। তালিবানদের জন্য প্রাণ বাঁচানোয় দায় ছিল সাধারণ আফগান নাগরিকদের। সেখানে ফুটবল খেলা তো স্বপেরও বাইরে। কিন্তু স্টেডিয়ামে আসতেই হত বাধ্য হয়ে। তালিবান জঙ্গী গোষ্ঠী ‘অপরাধী’ ধরে এনে এখানে শাস্তি দিত, সেটা দেখার জন্য হাজির হতে হত স্থানীয়দের। সবাই যেন ভয় পায় সে কারণেই জোর করে মাঠে উপস্থিত হতে বলত তালিবান সদস্যরা।
একবার এক আফগান সাংবাদিক ওই সময়ের অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছিলেন,
‘এক চোর নিজের গ্রাম থেকে কিছু চুরি করেছিল। তাকে এই মাঠে এনে সবার সামনে ডান হাত কেটে দেওয়া হল। আরেকবার এক নারী ও পুরুষ অবৈধ সম্পর্কের কারণে দোষী সাব্যস্ত হয়। তাদেরকে ১০০ বার দোররা মারা হয় এবং একে অপরকে বিয়ে করতে বাধ্য করা হয়। এই মাঠে অনেক মানুষের শিরচ্ছেদ করা, গুলি করার প্রত্যক্ষদর্শী আমি। আফগান জাতি কখনই এই দুঃসহ স্মৃতি ভুলবে না।’
আরেক স্থানীয় জানান, গাজী স্টেডিয়ামে তিনি অনেক কথিত অপরাধীকে গুলি করে হত্যা হতে দেখেছেন। ওই মুহূর্তগুলো খুবই আতংকের হত। অনেকে এসব স্বপ্নেও দেখত। অনেকে এসবের কারণে মানসিকভাবে বিকারগ্রস্থ হয়ে গিয়েছে বলেও কথিত আছে।এসব কারণে একা স্টেডিয়ামে ঢোকারই সাহস পায় না কেউ। মেয়েরা তো আশেপাশেও ভিড়তে চায় না।
দ্য ঘোস্ট অব দ্য দ্রাগাও (পর্তুগাল)
চ্যাম্পিয়নস লিগের ২০১২ আসরের এক ম্যাচে প্যারিস সেইন্ট জার্মেইকে (পিএসজি) ১-০ গোলে হারিয়ে দিল পোর্তো ফুটবল ক্লাব। সেবার জেমস রদ্রিগেজের ওই একমাত্র গোল যেন উল্লাসের বন্যা বইয়ে দিয়েছিল এস্তাদিও দো দ্রাগাওয়ের গ্যালারিতে। কিন্তু তার মধ্যে যে একজন ‘ভূত’ সমর্থক ছিল সেটা তখনও টের পায়নি কেউ। যার কারণে পরবর্তীতে পুরো স্টেডিয়ামকেই ‘হন্টেড’ তকমা সেঁটে দেওয়া হল।
ঘটনাটি ছিল এমন, রদ্রিগেজ যখন গোল করার পর উদযাপন করছিলেন তখন টিভি ক্যামেরায় দেখা যায় সবার সঙ্গে গ্যালারিতে বসে অদ্ভুত চেহারা ও বেশভূষার একজন উচ্ছ্বাস করছেন। পর্তুগীজ গণমাধ্যম সেই মানুষটিকে ভূত বলেই দাবি করে। তাকে উল্লেখ করে ‘দ্য ঘোস্ট অব দ্য দ্রাগাও’। কিম্ভূতাকার লোকটির মুখের দিকে তাকালে দীর্ঘদিন আগে মৃত্যুবরণ করা মানুষের মনে হবে। পরনে ১৯০০ সালের সময়কার পোশাক। ওই ঘটনার পর থেকেই গুজব রটে যায়, স্টেডিয়ামে ভূত আছে। পরবর্তীতে ব্যাপারটিকে ধামাচাপা দেওয়ার কম চেষ্টা করেনি ক্লাবটি। এমনকি যে আলোকচিত্রী ছবিটি তুলেছিলেন, তিনিই প্রমাণ করার চেষ্টা করেন লোকটি ভূত নয়, বরং একজন বৃদ্ধ মানুষ। কিন্তু তাতে সমর্থকদের ভূতের ভয় কাটেনি!
লুমি ক্যাসলের ভূতের খপ্পরে (ডারহাম, ইংল্যান্ড)
স্টেডিয়াম থেকে বের হয়ে খেলোয়াড়রা কোথায় যায়? টিম হোটেলে। এবারের গল্পটা সেই হোটেলকে ঘিরেই। ফুটবল নয়, ক্রিকেটাররা কীভাবে আক্রান্ত হয়েছিল সেই গল্পটাই শোনা যাক।
অ্যাশেজ খেলতে ২০০৫ সালে ইংল্যান্ডে সফর করল অস্ট্রেলিয়া। মাঠের পারফরম্যান্সে তো পারদের উত্তজনা ছড়িয়ে পড়ছিল সবার মধ্যে। প্রতিপক্ষকে কতভাবে বল-ব্যাটের কেরামতিতে ঘায়েল করা যায় তা নিয়ে দুই দলের সমর্থকরা সেবারও দু’ভাগ হয়েছিল। কিন্তু স্টেডিয়াম থেকে হোটেলে ফিরে বিপত্তিটা বাঁধালেন স্বাগতিক দলের অলরাউন্ডার শেন ওয়াটসন। তিনি নাকি হোটেলে ভূত দেখেছেন! এমনকি তার সঙ্গে যোগ দিলেন অজি ক্রিকেট দলের মিডিয়া ম্যানেজার! তিনি শপথ করে বললেন, ‘আমি ভূত দেখেছি। বিশ্বাস করুন, আমি সত্যি বলছি।’
ওই সময়ে এই ঘটনা খুব আলোড়িত করেছিল সমর্থকদের। শেন ওয়াটসন ভয়ে নিজের ঘর বদলে ঘুমিয়েছিলেন ফাস্ট বোলার ব্রেট লির ঘরে। শুধু তা-ই নয়, দুই দলের ক্রিকেটারদের সঙ্গে থাকা তাদের স্ত্রী-বান্ধবীরাও নাকি নিজেদের ঘর বদলাতে চেয়েছিল। ভূতুড়ে কাণ্ডের বর্ণনা দিতে গিয়ে এক অজি ক্রিকেটার বলেছিল, ‘কথা নেই, বার্তা নেই একা একাই গভীর রাতে বাথরুমের ট্যাপ ছেড়ে দিত কেউ।’ কড়িডোরেও নাকি ছায়া দেখা যেত!
শুধু অস্ট্রেলিয়া কিংবা ইংল্যান্ডের ক্রিকেটারই নয়, আরও পাঁচ বছর আগে ২০০০ সালে ইংল্যান্ডে সফর করতে এই হোটেলেই উঠেছিল উইন্ডিজ জাতীয় ক্রিকেট দল। তারাও লুমি ক্যাসলেই উঠেছিল, কিন্তু টিকতে পারেনি। অনেকেই রহস্যজনক অস্বাভাবিক অনেক কিছু টের পেত। অধিনায়ক জিমি অ্যাডাম সহ কয়েকজন খুব ভয় পেয়েছিলেন। ফলাফল, একদিন বাদেই হোটেল বদলায় ক্যারিবিয়ানরা।
কিন্তু কাহিনীটা কি? আসলেই কি ভূত ছিল অনেক পুরাতন হোটেলটিতে! স্থানীয়দের মতে, ১৪ শতকে এক ধনী ব্যক্তিকে খুন করেছিল এক ক্যাথোলিক পুরোহিত। শুধু তা-ই নয়, যে লুমির নামে এই হোটেল, সেটি একসময় শুধুই দুর্গ ছিল। লুমির পুরো নাম ছিল লিলি লুমি। তাকেও কয়েকজন ক্যাথোলিক পুরোহিত মিলে খুন করে। তার অপরাধ, ক্যাথলিক চার্চে না যাওয়া এবং তাদেরকে অনুসরণ না করা।
ফিচার ইমেজ: The Offside Rule