আমরা পরে ব্যাটিং করব, কারণ আমার ঘুণাক্ষরেও ধারণা নেই সামনে কী হতে যাচ্ছে।
লন্ডনের এক গুমোট সন্ধ্যায় দ্য ওভালে মিডলসেক্সের বিপক্ষে টসে জিতে ফিল্ডিং করার সিদ্ধান্ত নেবার পর ঠিক এই কথাগুলোই বলেন সারের অধিনায়ক অ্যাডাম হোলিওক। নতুন ব্যাটসম্যান গার্ড নিতে নব্বই সেকেন্ডের বেশি বিলম্ব করতে পারবে না, ৭৫ মিনিটের মধ্যে এক ইনিংস শেষ করতে হবে, না করতে পারলে প্রতি ওভারের জন্য ছয় রানের শাস্তি দেয়া হবে- এমন খেলা কেউ যে দেখেনি আগে।
একপ্রকার অনিশ্চয়তার মাঝেই আজ থেকে ১৭ বছর আগে ইংল্যান্ডে জন্ম হয়েছিল টোয়েন্টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের। এরপর ইংল্যান্ডকে অনুসরণ করে ক্রিকেটখেলুড়ে প্রায় সব দেশই নিজেদের উদ্যোগে নিয়মিত আয়োজন করে আসছে ফ্র্যাঞ্চাইজিভিত্তিক কুড়ি ওভারের ক্রিকেটের প্রতিযোগিতা। কালের পরিক্রমায় আগমন ঘটেছে কুড়ি ওভারের চেয়েও সংক্ষিপ্ততর ক্রিকেটের।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের মৌসুমে কয়েকটা ঘরোয়া দল নিয়ে আয়োজিত প্রতিযোগিতা কতখানি ধোপে টিকবে, তা নিয়ে শুরুতে যথেষ্ট সন্দেহ ছিল। তবে একেবারে শুরু থেকেই ফ্র্যাঞ্চাইজিভিত্তিক আসরগুলোতে দর্শকদের হুমড়ি খেয়ে পড়া, সর্বোপরি দুর্দান্ত ক্রিকেটীয় প্রদর্শনী এই প্রতিযোগিতাগুলোর গ্রহণযোগ্যতা অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। টেস্ট বা একদিবসীয় ক্রিকেটের মতো দীর্ঘসময় ধরে অনুষ্ঠিত হয়না বলেই হয়তো দর্শকমহলে দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে কুড়ি ওভারের ক্রিকেট।
ইংল্যান্ডে ২০০৩ সালে টি২০ সুপার কাপ (এখন টি২০ ব্লাস্ট) শুরু হওয়ার দু’বছর বাদে নিউজিল্যান্ডে শুরু হয় সুপার স্ম্যাশ। বিতর্কিত ইন্ডিয়ান ক্রিকেট লিগ (আইসিএল) রহিত করে ২০০৮ সালে শুরু হয় টি২০ ক্রিকেটের সবচেয়ে জমকালো ঘরোয়া আসর ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (আইপিএল)। এরপর একে একে অস্ট্রেলিয়ায় বিগ ব্যাশ লিগ (বিবিএল), বাংলাদেশে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ (বিপিএল), ওয়েস্ট ইন্ডিজে ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (সিপিএল), পাকিস্তানে পাকিস্তান সুপার লীগ (পিএসএল) অভূতপূর্ব দর্শকপ্রিয়তা অর্জন করে। শ্রীলঙ্কা, দক্ষিণ আফ্রিকা ও আফগানিস্তানেও আয়োজিত হচ্ছে তাদের নিজস্ব ঘরোয়া টি২০ প্রতিযোগিতা।
টাকার ঝনঝনানি কিংবা ক্রিকেটের মান অথবা দর্শকপ্রিয়তা- সবদিক থেকেই প্রশ্নাতীতভাবে সেরা টি২০ আসর আইপিএল। বাংলাদেশের নিজস্ব ঘরোয়া টি২০ আসর বিপিএলও খেলা হয়ে গেছে সাত মৌসুম। পরিসংখ্যানের আলোকে চলুন দেখে আসা যাক আইপিএলসহ অন্যান্য টি২০ লিগগুলোর তুলনায় বিপিএলের অবস্থান ঠিক কোথায়।
দেশীয় ক্রিকেটারের সংখ্যা, বিদেশি ক্রিকেটারের সংখ্যা, একাদশে বিদেশির সংখ্যা, আসরে অংশগ্রহণকারী দলের সংখ্যা- সব ক্ষেত্রেই বিপিএলের সঙ্গে আইপিএল একই সরলরেখায় অবস্থান করছে। তবে বহুল জনসংখ্যার দেশ ভারত, যেখানে পেশাদার ক্রিকেট খেলে প্রায় হাজারের উপর ক্রিকেটার- সেখানে মানসম্পন্ন দেশীয় ক্রিকেটার পাওয়া খুব একটা কঠিন কাজ নয় ভারতের জন্যে। আইপিএলকে অন্যান্য ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ থেকে এগিয়ে রাখার এটাও একটা বড় কারণ।
ক্রিকভিজ ও ইএসপিএনক্রিকইনফো থেকে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তের সাহায্যে আইপিএল ও অন্যান্য টি২০ লিগের সাপেক্ষে বিপিএলের অবস্থান ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা হলো। এখানে সদ্যসমাপ্ত সিপিএল এবং চলতি আইপিএল ও টি২০ ব্লাস্ট মৌসুমকে এই আলোচনার বাইরে রাখা হয়েছে।
কুড়ি ওভারের ক্রিকেট রানের খেলা, চার ছক্কার খেলা। তাই ওভারপ্রতি রানসংখ্যা এই সংস্করণের ক্রিকেটের জন্য একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পরিসংখ্যান। ক্রিকভিজের উপাত্ত অনুযায়ী, ২০১৩ সাল থেকে ফ্র্যাঞ্চাইজি আসরগুলোর মধ্যে ওভারপ্রতি সবচেয়ে বেশি রান হয়েছে ইংল্যান্ডের টি২০ ব্লাস্টে। ওভারপ্রতি ৮.৩৭ রান নিয়ে ইংল্যান্ডের ঘরোয়া টি২০ লিগটি অবস্থান করছে তালিকার শীর্ষে। ওভারপ্রতি ৮.২৬ রান নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে আইপিএল। বিশ্বের ছয়টি শীর্ষস্থানীয় টি২০ আসরগুলোর মধ্যে এই তালিকায় বিপিএলের অবস্থান সবার নিচে। বাংলাদেশের ফ্র্যাঞ্চাইজিভিত্তিক এই আসরে এ পর্যন্ত রান এসেছে ওভারপ্রতি ৭.৭১ করে।
টি২০ ক্রিকেটের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলোর একটি হলো, বলকে সীমানাছাড়া করা, দ্রুত রান তোলার জন্যে যা খুবই জরুরি। ২০১৩ সাল থেকে হিসাব করলে, বলপ্রতি ছয়ের তালিকায় সবার আগে অনুমিতভাবেই আসে ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার লিগ অর্থাৎ সিপিএলের নাম। দুর্ধর্ষ শারীরিক শক্তির অধিকারী ক্যারিবীয় ক্রিকেটাররা অবলীলায় বল সীমানার উপর দিয়ে পাঠাবে সেটাই স্বাভাবিক। সিপিএলে প্রতি ১৭ বলে ব্যাটসম্যানেরা একবার ছয় হাঁকিয়ে থাকে। ছয়প্রতি ২০ বল নিয়ে তালিকার দ্বিতীয় স্থানে যৌথভাবে আছে আইপিএল ও পিএসএল। তালিকায় পরের নামটিই বিপিএলের। প্রতি ২১ বলে একবার এই আসরে সীমানার উপর দিয়ে উড়ে গিয়েছে বল। এই তালিকায় পিঠাপিঠি অবস্থানে থাকলেও এখানে একটা ফাঁক রয়েছে। চলুন সেটা বোঝার চেষ্টা করি।
বিপিএলে শতাধিক ছয় মেরেছেন কেবলমাত্র ক্যারিবীয় দানব ক্রিস্টোফার হেনরি গেইল। মাত্র ৪২ ইনিংসেই হাঁকিয়েছেন ১৩২টি ছক্কা। তালিকার পরবর্তী নাম ইমরুল কায়েস, যার সংগ্রহ ৭৩টি ছয়। বিপিএলে পঞ্চাশের বেশি ছক্কা হাঁকিয়েছেন ১১ জন ব্যাটসম্যান, যার চারজনই বিদেশি। বাকি সাতজন বাংলাদেশির মধ্যে ইনিংস সংখ্যার চেয়ে ছক্কার সংখ্যা বেশি শুধুমাত্র তামিম ইকবালের। বাঁহাতি এই ব্যাটসম্যান হাঁকিয়েছেন ৬৯ ইনিংসে ৭১টি ছয়। পঞ্চাশটির বেশি ছয় হাঁকানো আর সব বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানের ইনিংসপ্রতি ছয় সংখ্যা ১-এর নিচে।
অপরদিকে, তালিকায় থাকা বিদেশিদের মধ্যে এভিন লুইসের ইনিংসপ্রতি ছয় সংখ্যা ১.৯৭। বাকি তিন বিদেশির মধ্যে ম্যাচপ্রতি ছয়ের হিসেবে সবার নিচে রাইলি রুশো, যিনি ইনিংসপ্রতি মেরেছেন ১.৫২টি ছয়। আন্দ্রে রাসেল মেরেছেন ১.৫৫টি আর ক্রিস গেইল মেরেছেন ইনিংসপ্রতি ৩.১৪টি ছয়। অর্থাৎ, তালিকায় থাকা বিদেশিদের সকলে প্রতি ইনিংসে মেরেছেন গড়ে ১.৫টির বেশি ছয় আর বাংলাদেশিদের মধ্যে একজন বাদে আর কেউ ইনিংসপ্রতি গড়ে ১টির বেশি ছয় হাঁকাতে সক্ষম হননি।
আইপিএলেও সবচেয়ে বেশি ছক্কা হাঁকানো ব্যাটসম্যানের তালিকায় অবধারিতভাবেই ক্রিস গেইলের নাম। আসরে তিন শতাধিক ছক্কা হাঁকানো একমাত্র ব্যাটসম্যানও তিনি।
বিপিএলের সাত মৌসুমের বিপরীতে আইপিএলের চলতি মৌসুম ছাড়া আসরটি বসেছে এর আগে ১৩ বার। তাই তুলনামূলক আলোচনার সময় বিবেচনা করা হচ্ছে শতাধিক ছক্কা মারা ব্যাটসম্যানদেরকে।
ক্রিস গেইল ব্যতীত আইপিএলে শতাধিক ছয় হাঁকিয়েছেন ১৭ জন ব্যাটসম্যান, যার ১০ জন ভারতীয়। এই ১০ জনের মধ্যে ৭ জনেরই ইনিংসপ্রতি গড় ছক্কার সংখ্যা ১-এর বেশি।
তবে ছক্কা হাঁকানোর চেয়ে কুড়ি ওভারের ক্রিকেটে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ভালো স্ট্রাইকরেট ধরে রাখা। বিপিএলে এখানেও ভয়াবহ রকম পিছিয়ে দেশীয় ব্যাটসম্যানেরা। ন্যূনতম ১২৫ বল খেলা ব্যাটসম্যানদের মধ্যে বিপিএলে সর্বোচ্চ স্ট্রাইকরেটধারী ব্যাটসম্যানদের তালিকায় সেরা পঞ্চাশে আছেন মাত্র চারজন বাংলাদেশি। বাংলাদেশিদের মাঝে সর্বোচ্চ ১৩৩.৯ স্ট্রাইক রেট নিয়ে মুশফিকুর রহিম আছেন তালিকায় ৩১ নম্বরে। যেখানে আইপিএলের সর্বোচ্চ স্ট্রাইকরেটধারী ব্যাটসম্যানের ৫০ জনের তালিকায় ১৪ জন ভারতীয়, সেরা দশেই আছেন তিনজন। অর্থাৎ, আইপিএলের সমান সংখ্যক দেশি-বিদেশি ক্রিকেটার একাদশে থাকা সত্ত্বেও বিপিএলে সব রেকর্ডই গড়াগড়ি খাচ্ছে বিদেশিদের পায়ে।
বিপিএলে সেঞ্চুরির তালিকায়ও বিদেশিদের জয়জয়কার। আইপিএলে যেখানে ৫৮ শতকের ২৩টি এসেছে ভারতীয়দের ব্যাট থেকে, সেখানে বিপিএলের ২১ শতকের শুধুমাত্র ৫টি এসেছে দেশীয় ব্যাটসম্যানদের ব্যাট থেকে।
ক্রিকভিজের তৈরি করা মডেল থেকে ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগগুলোর ক্রিকেটের মানের একটা তুলনামূলক ধারণাও পাওয়া যায়। মডেল অনুযায়ী, একজন সাধারণ ক্রিকেটার আন্তর্জাতিক টি২০ ক্রিকেটে যে মানের ক্রিকেট খেলেন, সেই মানের ক্রিকেট খেলে তিনি আইপিএলে ০.০৪ রান কম করেন বা ০.০৪ রান বেশি খরচ করেন। নিচের ছবিতে ডানদিকে যে কলামগুলো দেখা যাচ্ছে, সেই লিগগুলোর খেলার মান তুলনামূলকভাবে বেশি। বামদিকে অবস্থিত কলামগুলোতে যে লীগগুলোকে দেখানো হয়েছে, তাদের খেলার মান আশানুরূপ নয়। ক্রিকভিজের এই মডেল অনুযায়ী নিউজিল্যান্ডের সুপার স্ম্যাশের পরেই সবচেয়ে কম মানসম্পন্ন লীগ বিপিএল। তবে সুপার স্ম্যাশে প্রতি একাদশে দুজনের বেশি বিদেশি খেলতে দেয়া হয় না, যেখানে বিপিএলে খেলেন চারজন।
বিপিএলের আরও একটা বড় সমস্যা হচ্ছে মাঠ সংকট। একই মাঠে তথা একই উইকেটে টানা ম্যাচ খেলার কারণে পিচের মান অনেক সময়ই কমে যায়। পিচের মান নিয়ে আগের আসরগুলোতে প্রশ্নও তুলতে দেখা গেছে ক্রিকেটারদের। দীর্ঘসময় একই পিচে খেলার দরুন পিচগুলো হয়ে ওঠে স্পিন সহায়ক, যার প্রমাণ ২০১৩-পরবর্তী সময়ে টি২০ লিগগুলোতে স্পিন বোলারদের করা ওভারের শতকরা পরিমাণের তালিকা।
তালিকায় অনুমিতভাবেই শীর্ষে বিপিএল, যেখানে ৪২% ওভারই করানো হয়েছে স্পিনারদের দিয়ে। ছয় মৌসুম বেশি খেলা হওয়া আইপিএলে স্পিনাররা করেছেন ওভারগুলোর ৩৬%। ক্লান্ত, স্পিন-সহায়ক পিচে তাই ইনিংসের শুরু-শেষেও বিপিএলে অধিনায়কেরা আস্থা রাখেন স্পিনারদের ওপরেই।
মাঠ সংকট বিপিএলের প্রথম কয়েক আসরে ওভারপ্রতি গড় রানেও ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। আগের মৌসুম তিন ভেন্যুতে আয়োজিত হলেও ২০১৫ মৌসুমে ম্যাচগুলো আয়োজিত হয়েছিল শুধুমাত্র ঢাকা ও চট্টগ্রামে। ফলাফল- ওভারপ্রতি রান মাত্র ৬.৯। ২০১৬ থেকে ভেন্যু হিসেবে ঢাকা ও চট্টগ্রামের সঙ্গে যুক্ত হয় সিলেট। পাশাপাশি সিলেটে ম্যাচসংখ্যা বাড়ানোর পাশাপাশি বিরতির সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়। যার প্রভাব দেখা যায় পরবর্তী আসরগুলোতে। সবশেষ মৌসুমে বিপিএলে ওভারপ্রতি রান এসেছিল ৮.২৪ করে, যা আইপিএলের ওভারপ্রতি রানের (৮.২৬) প্রায় সমান।
ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগসমূহ, বিশেষ করে আইপিএলের সঙ্গে বিপিএলের পরিষ্কার পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় দেশীয় ক্রিকেটারদের নৈপুণ্যে। বিপিএলে দলগুলোর প্রবণতা থাকে প্রথম ছয়জনের ব্যাটসম্যানের অধিকাংশ জায়গাই বিদেশীদের দিয়ে পূর্ণ করার। সেজন্য বিপিএলের প্রথম আসরের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকদের তালিকায় প্রথম পাঁচে ছিলেন না কোনো বাংলাদেশি। পরবর্তী আসরগুলোতে এর ব্যত্যয় ঘটলেও এই তালিকায় ঘুরে-ফিরে এসেছে তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহিম, মাহমুদুল্লাহদের নামই। তরুণ উদীয়মান ক্রিকেটারদের চাপের মুহূর্তে সুযোগ না দিয়ে বিদেশিনির্ভর দল গঠন করার প্রবণতা তাই বিপিএল থেকে নতুন ক্রিকেটার উঠে না আসার মূল কারণ।