১.
দলের সেরা দুই ব্যাটসম্যান ডেভিড ওয়ার্নার এবং স্টিভেন স্মিথ নিষিদ্ধ। দলের সেরা দুই বোলার মিচেল স্টার্ক এবং জস হ্যাজলউডও বেশ কয়েকদিন সীমিত ওভারের ক্রিকেট থেকে দূরে ছিলেন। ইনজুরি এবং টেস্ট সিরিজ খেলার পর বিশ্রাম দুইয়ে মিলে তাদের ওয়ানডে খেলা হচ্ছিল না। এদিকে বিশ্বকাপের স্কোয়াড ঘোষণা করার সময় খুব বেশি হাতে নেই। শেষ পর্যন্ত সব জল্পনাকল্পনার অবসান ঘটিয়ে স্টিভ স্মিথ, ডেভিড ওয়ার্নার এবং মিচেল স্টার্ককে স্কোয়াডে রাখা হয়। স্কোয়াড ঘোষণার সময় সম্পূর্ণ ফিট না হওয়ার কারণে অ্যাশেজের কথা মাথায় রেখে জস হ্যাজলউডকে স্কোয়াডে রাখেনি ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া।
চ্যাম্পিয়নস ট্রফির পর থেকে বিশ্বকাপের আগ পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়া মোট ৩১টি ওয়ানডে ম্যাচ খেলেছিল, যার মধ্যে মাত্র সাতটি ম্যাচ খেলেছিলেন মিচেল স্টার্ক। বিশ্বকাপে আসার আগে নিজের শেষ ওয়ানডে ম্যাচ খেলেছিলেন গত বছরের নভেম্বরে। দীর্ঘদিন ওয়ানডে দলের বাইরে থাকার পরও তার উপর আস্থা রেখেছিল ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া। অবশ্য তিনি তো আস্থা রাখার মতোই বোলার। গত বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি এবং ম্যান অব দ্য টুর্নামেন্ট জেতা এই ক্রিকেটার এইবারও দুর্দান্ত ছন্দে আছেন। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে এইবারও তিনি আসরের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারিদের তালিকায় শীর্ষে থেকেই হয়তো টুর্নামেন্ট শেষ করবেন।
২.
বিশ্বকাপে এখন পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়া দলের ব্যাটিং লাইনআপ সামাল দিচ্ছেন দুই ওপেনার অ্যারন ফিঞ্চ এবং ডেভিড ওয়ার্নার। তাদের দুর্দান্ত ব্যাটিংয়ে মিডল-অর্ডারের ব্যাটসম্যানদের ব্যর্থতা ফলাফলে খুব একটা প্রভাব ফেলছে না। অস্ট্রেলিয়ার বোলিং ডিপার্টমেন্টেও দুর্বলতা রয়েছে। সেই দুর্বলতা থাকা সত্ত্বেও ম্যাচের ফলাফল নিজেদের অনুকূলে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করছেন মিচেল স্টার্ক।
টুর্নামেন্টের শুরু থেকেই মিচেল স্টার্ক এবং প্যাট কামিন্সই ছিল অস্ট্রেলিয়া মূল ভরসা। তৃতীয় বোলার হিসাবে নাথান কোল্টার-নাইল, কেন রিচার্ডসন এবং জেসন বেহরেনডর্ফ পালাবদল করে খেলেছেন। জেসন বেহরেনডর্ফ গত কয়েক ম্যাচে সফলতা পেয়েছেন, তবে কোল্টার-নাইল এবং কেন রিচার্ডসন খুব একটা খারাপ না করলেও দলের চাহিদা পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। এছাড়া প্রধান স্পিনার হিসাবে খেলা অ্যাডাম জাম্পাও উইকেটশূন্য থাকার পাশাপাশি রান আটকাতেও ব্যর্থ হয়েছিলেন। পঞ্চম বোলারের অভাব তো এখনও বোধ করছে অস্ট্রেলিয়া। মার্কাস স্টোইনিস, গ্লেন ম্যাক্সওয়েলের পাশাপাশি অ্যারন ফিঞ্চ, স্টিভেন স্মিথকেও হাত ঘোরাতে দেখা গিয়েছে।
দলের অন্যান্য বোলাররা প্রতিপক্ষের উপর চাপ প্রয়োগ করতে ব্যর্থ হলেও প্রতি ম্যাচেই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে উইকেট তুলে নিয়ে প্রতিপক্ষকে কোণঠাসা করে দেওয়ার দায়িত্ব একাই সামলাচ্ছেন মিচেল স্টার্ক। শুরুতে, মিডল ওভারে কিংবা ডেথে – যখনই উইকেটের প্রয়োজন পড়ে, অধিনায়ক স্টার্কের শরণাপন্ন হন। স্টার্ক এখন পর্যন্ত অধিনায়ককে হতাশ করেননি।
৩.
বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার প্রথম ম্যাচ ছিল আফগানিস্তানের সাথে। বিশ্বকাপের কয়েক মাস আগে অস্ট্রেলিয়ার দুর্গতি এবং আফগানিস্তানের বিশ্বমানের তিন স্পিনার থাকার দরুন অনেকেই ভেবেছিল, হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে এই ম্যাচে। কিন্তু পাঁচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নরা ম্যাচের প্রথম ওভার থেকেই জানান দিয়েছিল, বিশ্বকাপ তাদের ঐতিহ্যের সাথে মিশে আছে, বিশ্বকাপে তারা সবসময়ই সেরা। ম্যাচের প্রথম ওভারের তৃতীয় বলে আফগান ওপেনার শেহজাদের স্ট্যাম্প উপড়ে ফেলে অস্ট্রেলিয়াকে শুভ সূচনা এনে দিয়েছিলেন স্টার্ক। এরপর ধারাবাহিকভাবে উইকেট তুলে নিয়ে এবং ওয়ার্নারের দায়িত্বশীল ব্যাটিংয়ে সহজ জয় পায় অস্ট্রেলিয়া।
বিশ্বকাপে নিজেদের দ্বিতীয় ম্যাচেই মুদ্রার ওপিঠ দেখে ফেলে অস্ট্রেলিয়া। টসে হেরে ব্যাট করতে নেমে ৩৮ রানে চার উইকেট এবং ৭৯ রানে পাঁচ উইকেট হারিয়ে বসে তারা। সেখান থেকে অবশ্য স্টিভ স্মিথ এবং কোল্টার-নাইলের দুর্দান্ত অর্ধশতকের উপর ভর করে ২৮৮ রানের লড়াকু সংগ্রহ জমা করতে সক্ষম হয়েছিল তারা। এই রানের মধ্যে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে আটকে রাখতে হলে জ্বলে উঠতে হতো স্টার্ককে। তিনি হতাশ করেননি। ক্রিস গেইল, আন্দ্রে রাসেল, কার্লোস ব্রাথওয়েট এবং জেসন হোল্ডারদের মতো আক্রমণাত্মক ব্যাটসম্যানের উইকেটসহ মোট পাঁচ উইকেট শিকার করে অস্ট্রেলিয়াকে ১৫ রানের জয় পাইয়ে দিয়েছিলেন। শেষদিকে যখন ব্র্যাথওয়েট এবং হোল্ডারের জুটি থিতু হয়ে গিয়েছিল, তখন তিনি এক ওভারে দুইজনকে ফিরিয়ে অজিদের জয়টা সময়ের ব্যাপারে পরিণত করেছিলেন।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে মিচেল স্টার্ক ৪৬ রানের বিনিময়ে পাঁচ উইকেট শিকার করেছিলেন। পাঁচ উইকেট নেওয়ার পথে তিনি ওয়ানডে ক্রিকেটে ১৫০ উইকেটের মাইলফলক অতিক্রম করেন। ওয়ানডেতে ১৫০ উইকেট শিকার করতে তিনি ম্যাচ খেলেছিলেন ৭৭টি। এর আগে সাকলাইন মুশতাক ৭৮ ম্যাচে ১৫০ উইকেট শিকার করে ওয়ানডেতে সবচেয়ে দ্রুত ১৫০ উইকেট শিকারের রেকর্ডধারী ছিলেন।
৪.
ভারতের বিপক্ষে মিচেল স্টার্ক খুব একটা সুবিধা করতে পারেননি। দশ ওভারে ৭৪ রান খরচায় শুধুমাত্র শিখর ধাওয়ানের উইকেট শিকার করেছিলেন তিনি। স্বাভাবিকভাবে অস্ট্রেলিয়াও এই ম্যাচে পরাজিত দল হিসাবে মাঠ ছাড়ে। ভারতের বিপক্ষে না পারলেও পাকিস্তানের বিপক্ষে অস্ট্রেলিয়ার জয়ে বড় ভূমিকা রেখেছিলেন স্টার্ক। অস্ট্রেলিয়ার দেওয়া ৩০৮ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে ২০০ রানে সাত উইকেট হারানোর পরও ওয়াহাব রিয়াজের দুর্দান্ত ব্যাটিংয়ে অঘটন ঘটানোর সম্ভাবনা তৈরি করেছিল পাকিস্তান। অধিনায়ক সরফরাজ আহমেদের সাথে বেশ সাবলীলভাবে ব্যাট করছিলেন তিনি। যখন পাকিস্তানের জয়ের সম্ভাবনা উঁকি দিয়েছিল, তখন আক্রমণে এসে ৪৫ রান করা ওয়াহাব রিয়াজ এবং মোহাম্মদ আমিরের উইকেট একই ওভারে তুলে নিয়ে অস্ট্রেলিয়াকে ৪১ রানের জয় এনে দিয়েছিলেন স্টার্ক।
যখনই প্রতিপক্ষের কোনো জুটি উইকেটে থিতু হয়ে যায়, তখনই স্টার্ক এসে দলকে ব্রেক-থ্রু এনে দেন। বাংলাদেশের বিপক্ষে এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। দশ ওভারে ৫৫ রান দিয়ে দুই উইকেট নেওয়া স্টার্ক এদিন ফিরিয়েছিলেন আশার আলো দেখানো তামিম ইকবালকে।
শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে অস্ট্রেলিয়া ৮৭ রানের জয় পেয়েছিল। জয়ের ব্যবধান দেখে মনে হতে পারে, শ্রীলঙ্কা দাঁড়াতেই পারেনি। জয়ের ব্যবধান দেখে সহজ জয় মনে হলেও জয়টা খুব একটা সহজ ছিল না। শুরুতে বেশ ভালোভাবেই লড়াই করেছিল শ্রীলঙ্কা। অস্ট্রেলিয়ার দেওয়া ৩৩৫ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে ১৫.৩ ওভারে উদ্বোধনী উইকেট জুটিতে কুশল পেরেরা এবং দিমুথ করুণারত্নে ১১৫ রান যোগ করেছিলেন। অবস্থা বেগতিক দেখে ফিঞ্চ তার মূল অস্ত্র স্টার্ককে পুনরায় বোলিং আক্রমণে আনেন, এবং স্টার্ক সেটাই করলেন যা তিনি করে আসছিলেন। মিডল স্ট্যাম্প বরাবর ফুল লেন্থের এক ডেলিভারিতে ৩৬ বলে ৫২ রান করা কুশাল পেরেরা উইকেট তুলে নিয়ে অস্ট্রেলিয়াকে ম্যাচে ফেরান তিনি। পেরেরার বিদায়ের পর আর কোন শ্রীলঙ্কান ব্যাটসম্যান তেমন আগ্রাসী ব্যাটিং করতে পারেননি, যার ফলে ৮৭ রানের জয় পায় অস্ট্রেলিয়া। ম্যাচে ৫৫ রানের বিনিময়ে চার উইকেট শিকার করেছিলেন স্টার্ক।
অস্ট্রেলিয়ার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী এবং এইবারের আসরের হট ফেভারিট ইংল্যান্ডের বিপক্ষেও জয়ের নায়ক ছিলেন স্টার্ক। অস্ট্রেলিয়াকে ২৮৫ রানে আটকে রেখে ব্যাট করতে স্টার্কের তোপের মুখে পড়েছিল ইংল্যান্ড। তিনি প্রথমে ইংল্যান্ডের সেরা দুই ব্যাটসম্যান রুট এবং মরগানের উইকেট তুলে নিয়েছিলেন। এরপর ফিরতি স্পেলে এসে ৮৯ রান করা স্টোকসকে ফেরান দুর্দান্ত এক ইয়র্কারে। ম্যাচে ৪১ রানের বিনিময়ে চার উইকেট শিকার করে অস্ট্রেলিয়ার ৬৪ রানের জয়ে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি।
প্রতিবেশী নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষেও দুর্দান্ত বোলিং করেছিলেন স্টার্ক। প্রথমে ব্যাট করে অস্ট্রেলিয়া ৯২ রানে পাঁচ উইকেট হারানোর পরেও উসমান খাজা এবং অ্যালেক্স ক্যারির অর্ধশতকের উপর ভর করে ২৪৩ রান সংগ্রহ করেছিল। জবাবে অস্ট্রেলিয়ার বোলাররা নিউ জিল্যান্ডের জন্য ২৪৩ রান পাহাড়সম রানে পরিণত করে। এদিন দলের সব বোলারই ছন্দে ছিলেন। যার ফলে নিউ জিল্যান্ড মাত্র ১৫৭ রানে গুটিয়ে গিয়ে ৮৬ রানে পরাজিত হয়। নিউ জিল্যান্ডকে ১৫৭ রানে বেধে রাখতে বরাবরের মতো সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছিলেন স্টার্ক। তিনি মাত্র ২৬ রান খরচায় পাঁচ উইকেট শিকার করেছিলেন।
৫.
মিচেল স্টার্ক এখন পর্যন্ত ওয়ানডেতে ৮৩ ম্যাচে ২০.৬০ বোলিং গড়ে এবং ২৪.৮ স্ট্রাইকরেটে ১৬৯ উইকেট শিকার করেছেন। ইনিংসে চার উইকেট শিকার করেছেন ১১ বার এবং পাঁচ উইকেট শিকার করেছেন সাতবার। বাঁহাতি পেসারদের মধ্যে ওয়ানডেতে তার চেয়ে বেশিবার পাঁচ উইকেট শিকার করতে পারেননি আর কোনো বোলার। সব মিলিয়ে ওয়ানডেতে সর্বাধিক পাঁচ উইকেট শিকারির তালিকায় তার উপরে আছেন ওয়াকার ইউনিস (১৩), মুত্তিয়া মুরালিধরন (১০), ব্রেট লি (৯), শহীদ আফ্রিদি (৯) এবং লাসিথ মালিঙ্গা (৮)।
বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি পাঁচ উইকেট শিকারের তালিকায় মিচেল স্টার্ক আছেন সবার উপরে। ২০১৫ সালের বিশ্বকাপে একবার এবং চলতি বিশ্বকাপে এখন পর্যন্ত দুইবার ইনিংসে পাঁচ উইকেট শিকার করেছেন তিনি। বল হাতে বিশ্বকাপে প্রতিনিয়ত সবাইকে ছাড়িয়ে যাচ্ছেন তিনি। নিজের দ্বিতীয় বিশ্বকাপ খেলা মিচেল স্টার্ক এখন পর্যন্ত ১৬ ম্যাচ খেলে মাত্র ১২.৯৭ বোলিং গড়ে এবং ১৮.০ স্ট্রাইকরেটে ৪৬ উইকেট শিকার করেছেন। বোলিং গড়, স্ট্রাইকরেট সবদিকেই তিনি নতুন মাইলফলক সেট করছেন।
মিচেল স্টার্ক বিশ্বকাপের এক আসরে সবচেয়ে বেশি উইকেট নেওয়ার নতুন কীর্তি গড়ার দ্বারপ্রান্তে রয়েছেন। তিনি চলতি বিশ্বকাপে মাত্র আট ম্যাচে ১৫.৫৪ বোলিং গড়ে এবং ১৮.৫ স্ট্রাইকরেটে ২৪ উইকেট শিকার করেছেন। তার স্বদেশী গ্লেন ম্যাকগ্রা ২০০৭ সালের বিশ্বকাপে ১১ ম্যাচে ২৬ উইকেট শিকার করে এক আসরে সবচেয়ে বেশি শিকারের রেকর্ড নিজের দখলে রেখেছেন। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে স্টার্ক কমপক্ষে আরও দু’টি ম্যাচ খেলার সুযোগ পাবেন।
তার প্রিয় সতীর্থ নাথান লায়ন টেস্ট ক্রিকেটে অফ স্পিনারদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি উইকেট তুলে নেওয়ার মধ্য দিয়ে ‘গ্রেটেস্ট অফ অল টাইম’ তথা ‘GOAT’ উপাধি পান। বড় টুর্নামেন্টে দুর্দান্ত খেলে আসা মিচেল স্টার্ককে অস্ট্রেলিয়া মিডিয়া উপাধি দিলো ‘FLOAT’ (ফাস্টেট লেফট-আর্মার অফ অল টাইম)। মিচেল স্টার্কের কাছে এখনও রেকর্ডগুলো মূল্যহীন, তার চাই উইনিং মেডেল।