“যেতে নাহি দেব হায়, তবু যেতে দিতে হয়, তবু চলে যায়।”
গত মে মাসের ১৯ তারিখের কথা। আইপিএল এর প্লে অফ নিশ্চিত করতে বাঁচা মরার লড়াইয়ে রাজস্থান রয়্যালসের বিপক্ষে ১৬৫ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করছিল রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোর। প্লে অফ খেলার স্বপ্ন দেখাচ্ছিলেন ভক্তদের। কিন্তু সেই স্বপ্ন আর বেশি দূর এগোয়নি। লড়াই করতে পারলেন না শেষ পর্যন্ত। আউট হওয়ার পূর্বে খেললেন ৩৫ বলে ৫৩ রানের এক ঝলমলে ইনিংস, যা দলের পক্ষে সর্বোচ্চ। বলছি ক্রিকেটের সুপারম্যান মিস্টার ৩৬০ ডিগ্রী খ্যাত এবি ডি ভিলিয়ার্সের কথা।
৩০ রানে হেরে আইপিএল এর প্লে অফ থেকে ছিটকে গেল তার দল। পরদিন স্ত্রী-সন্তান নিয়ে নিজের দেশ দক্ষিণ আফ্রিকায় উড়াল দেন। মাঝের ২ দিনে ক্লান্তি শেষে তার একটু বিশ্রাম নেওয়ার কথা। ২৩ মে নিজের টুইটার অ্যাকাউন্ট ও ভেরিফাইড ফেসবুক পেজের এক ভিডিও বার্তায় জানান, তিনি ক্লান্ত, বিশ্রাম চান ক্রিকেটের আন্তর্জাতিক আঙ্গিনা থেকে, সুযোগ দিতে চান অন্যদের। পূর্বঘোষণা দিয়ে যদি ছাড়তেন, তাহলে শেষবারের মতো আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ২২ গজে দেখা যেতো তাকে। কিন্তু তার এই হঠাৎ নেওয়া সিদ্ধান্তটা ভক্তদের কাছে ছিল বিনা মেঘে ব্জ্রপাতের মতো।
দক্ষিণ আফ্রিকার জার্সিতে এই মানুষটাকে দেখা যাবে না আর। চেহারায় রাগ বা বিরক্তির ছাপ আর দেখা যাবে না প্রতিপক্ষের বোলারদের। গত ৩০ মার্চ অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে খেলা টেস্ট ম্যাচটি ছিল তার সতীর্থ মরনে মর্কেলের শেষ টেস্ট। কেউ জানত না, ডি ভিলিয়ার্স হয়ত নিজেও ভাবেননি সেই ম্যাচটি হবে তারও শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচ। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দেখা যাবে না আর তার ব্যাটিং তাণ্ডব। ভক্তরা শুধু স্মৃতি রোমন্থন করে যাবেন তার রেখে যাওয়া সেরা ইনিংসগুলোর প্রতি। একনজরে তাই দেখে নেয়া যাক আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ডি ভিলিয়ার্সের সেরা ১০ ইনিংস।
১) ১৪৯, প্রতিপক্ষ ওয়েস্ট ইন্ডিজ (জোহানেসবার্গ)
২০১৫ সালের ১৮ জানুয়ারি। জোহানেসবার্গের দ্য ওয়ান্ডারার্স স্টেডিয়ামে খেলা হচ্ছে। মাঠ ও টেলিভিশন সেটের সামনে বসে থাকা লক্ষ কোটি ক্রিকেট ভক্ত দেখেছিল একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের দ্রুততম সেঞ্চুরি। দক্ষিণ আফ্রিকার ইনিংসের ৩৯তম ওভারে তার আগমন। বাকি সময়টুকু যেন ব্যাটিং রূপকথা। ১৬ বলে করলেন দ্রুততম অর্ধশতক, বাকি ৫০ রান করতে খেললেন মাত্র ১৫ বল।
১৯৯৬ সালে আফ্রিদির করা ৩৭ বলের সেঞ্চুরির রেকর্ডটি অক্ষত ছিল প্রায় ১৮ বছর। ২০১৪ সালের ১ জানুয়ারি ৩৬ বলে সেঞ্চুরি করে সেই রেকর্ডটি ভেঙ্গেছিলেন নিউজিল্যান্ডের কোরি অ্যান্ডারসন। এর মাত্র ১ বছরের ব্যবধানেই মাত্র ৩১ বলে একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের দ্রুততম সেঞ্চুরির রেকর্ডটি নিজের করে নেন এবি ডি ভিলিয়ার্স। ভিলিয়ার্স ঝড় স্থায়ী ছিল ৫৯ মিনিট। আউট হওয়ার পূর্বে ৪৪ বলে ১৬টি ছক্কা আর ৯টি চারে খেললেন ১৪৯ রানের ইনিংস।
২) অপরাজিত ১৬২, প্রতিপক্ষ ওয়েস্ট ইন্ডিজ (সিডনি)
২০১৫ বিশ্বকাপের সময়ের কথা। সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডে ওয়েস্ট ইন্ডিজের মুখোমুখি দক্ষিণ আফ্রিকা। যে দলটির সাথে কিছুদিন আগেই করলেন একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের দ্রুততম হাফ সেঞ্চুরি ও সেঞ্চুরি। এবার তবে কী হবে? দলের স্কোর তখন ৩ উইকেটে ১৪৬ । ব্যাটিংয়ে নামলেন তিনি। বাকি সময়টুকু জোহানেসবার্গের পুনরাবৃত্তি ঘটলো সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডে। করলেন সেঞ্চুরি, ১৫০ করতে খেললেন মাত্র ৬৪ বল। পরের ২ বলে পর পর ছক্কা হাঁকিয়ে করলেন ৬৬ বলে অপরাজিত ১৬২ রান। দলের সংগ্রহ বেড়ে দাঁড়ায় ৫ উইকেটে ৪০৮, যা বিশ্বকাপের ২য় সর্বোচ্চ।
৩. অপরাজিত ১০৬, প্রতিপক্ষ অস্ট্রেলিয়া (পার্থ)
২০০৮ সালে পার্থ টেস্টে সফররত দক্ষিণ আফ্রিকাকে ৪১৪ রানের বিশাল লক্ষ্য দেয় স্বাগতিক অস্ট্রলিয়া। নিজেদের ২য় ইনিংসে গ্রায়েম স্মিথের সেঞ্চুরিতে জয়ের আশা দেখছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। অর্ধশতক করেছিলেন হাশিম আমলাও। তবে মাত্র ৭ রানের ব্যবধানে ২ জন সেট ব্যাটসম্যান আউট হওয়ার কারণে ম্যাচ থেকে কিছুটা ছিটকে যাচ্ছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। পরের উইকেট জুটিতে ক্যালিস পূর্ণ করেন অর্ধশতক, ৫ম উইকেট জুটিতে জেপি ডুমিনিকে সাথে নিয়ে দলকে নিয়ে যান জয়ের বন্দরে। ২৭৬ বলে খেলেন অপরাজিত ১০৬ রানের ইনিংস, যেটি ছিল ডিভিলিয়ার্সের টেস্ট ক্যারিয়ার এর অন্যতম সেরা একটি ইনিংস। ডি ভিলিয়ার্সের ব্যাটিং দৃঢ়তায় পার্থ টেস্ট দক্ষিণ আফ্রিকা জিতে নেয় ৬ উইকেটে।
৪. অপরাজিত ২৭৮, প্রতিপক্ষ পাকিস্তান (আবু ধাবী)
২০১০ সালে আবুধাবির শেখ জায়েদ স্টেডিয়ামে ডি ভিলিয়ার্স খেলেছিলেন ক্যারিয়ারের সর্বোচ্চ ২৭৮ রানের ইনিংস। পাকিস্তানের বিপক্ষে ১ম ইনিংসে ব্যাট করতে নেমে শুরুতেই ধাক্কা খায় দক্ষিণ আফ্রিকা। মাত্র ৩৩ রানেই টপঅর্ডারের ৩ ব্যাটসম্যান ফেরেন সাজঘরে। ক্যালিসকে সাথে নিয়ে এগিয়ে নিয়ে যান দলের ইনিংস। ৩৩/৩ থেকে দলের সংগ্রহ দাঁড়ায় ৭ উইকেটে ৫৮৪, যেখানে ডি ভিলিয়ার্স এর অবদান ২৭৮।
৫. ৩৩, প্রতিপক্ষ অস্ট্রেলিয়া (অ্যাডিলেড)
অবাক হলেন? ভাবছেন, ৩৩ রান কিভাবে তার সেরা ইনিংসের একটি হয়? নিজের সামান্য কিছু অবদান দিয়ে যদি নিশ্চিত হারের মুখ থেকে দলকে ফেরানো যায় তবে সেটিও হতে পারে কোনো খেলোয়াড়ের কাছে তার সেরা ইনিংস। ২০১২ সালের অ্যাডিলেড টেস্টে ৪র্থ ইনিংসে দক্ষিণ আফ্রিকার জয়ের জন্যে প্রয়োজন হয় ৪৩০ রানের। ৪ উইকেটে ৭৭ রান নিয়ে ৪র্থ দিনের খেলা শেষ করে দক্ষিণ আফ্রিকা।
৫ম দিনে জয়ের জন্যে অস্ট্রেলিয়ার প্রয়োজন ছিল ৬ উইকেট। অন্যদিকে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রয়োজন ৩৬৩ রান, যা মোটামুটি অসম্ভব। এমতাবস্থায় ম্যাচ ড্র করাটাই ছিল দক্ষিণ আফ্রিকার মূল উদ্দেশ্য। ৪ ঘন্টারও বেশি সময় ধরে ক্রিজে টিকে ছিলেন ডি ভিলিয়ার্স। দলের প্রয়োজনে খেললেন ২২০ বলে ৩৩ রানের এক মন্থর ইনিংস। ৮ উইকেটে ২৪৮ রান নিয়ে ৫ম দিন শেষ করে দক্ষিণ আফ্রিকা। ড্র হয় অ্যাডিলেড টেস্ট।
৬. অপরাজিত ২১৭, প্রতিপক্ষ ভারত (আহমেদাবাদ)
২০০৮ সালের আহমেদাবাদ টেস্ট, সরদার পাটেল স্টেডিয়ামে প্রথম ইনিংসে ব্যাট করতে নেমে ডেল স্টেইনের বোলিং তোপে মাত্র ৭৬ রানে অল আউট হয় ভারত। জবাবে ব্যাট করতে নেমে ৪ উইকেট ২২৩ রান করে ১ম দিন শেষ করে দক্ষিণ আফ্রিকা। ৫৯ রানে অপরাজিত থাকেন ডি ভিলিয়ার্স। ক্যালিসকে সাথে নিয়ে শুরু করেন ২য় দিনের খেলা। শ্রীশান্তের বলে আউট হওয়ার আগে ক্যালিস সেঞ্চুরি করেন। তবে টিকে থাকেন ডি ভিলিয়ার্স। ৩ উইকেট হাতে রেখে ৭ উইকেটে ৪৯৪ রানে ইনিংস ঘোষণা করে দক্ষিণ আফ্রিকা, ২১৭ রানে অপরাজিত থাকেন ডি ভিলিয়ার্স। ২য় ইনিংসে ভারত ৩২৮ রানে অল আউট হলে ইনিংস ও ৯০ রানের ব্যবধানে জয় পায় দক্ষিণ আফ্রিকা। ম্যাচসেরার পুরস্কার ওঠে ডি ভিলিয়ার্স এর হাতে।
৭. ১১৬, প্রতিপক্ষ অস্ট্রেলিয়া (পোর্ট এলিজাবেথ)
সফররত অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ২০১৪ সালের পোর্ট এলিজাবেথ টেস্টে টসে জিতে ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নেন অধিনায়ক গ্রায়েম স্মিথ। মাত্র ৯ রানে অাউট হন স্মিথ। ০ রানে সাজ ঘরে ফেরেন হাশিম আমলা। পরের উইকেট জুটিতে এলগার এবং ডু প্লেসিস যোগ করেন ১০০ রান। পরে ডি ভিলিয়ার্সের ১১৬ রানের সুবাদে বড় সংগ্রহের পথে যায় দক্ষিণ আফ্রিকা। সেঞ্চুরি করেন আরেক ব্যাটসম্যান ডুমিনিও। সবগুলো উইকেট হারিয়ে ১ম ইনিংসে ৪২৩ রান করে দক্ষিণ আফ্রিকা।
৮. ১১২, প্রতিপক্ষ ভারত (চেন্নাই)
৫ ম্যাচ সিরিজের ৪র্থ একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে স্বাগতিক ভারতের মুখোমুখি হয় সফররত দক্ষিণ আফ্রিকা। বিরাটের সেঞ্চুরিতে নির্ধারিত ৫০ ওভার শেষে ভারতের সংগ্রহ দাঁড়ায় ২৯৯ রান। ৩০০ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে শুরুতেই আমলা এবং ডু প্লেসিসের উইকেট হারিয়ে কিছুটা তোপের মুখে পড়ে দক্ষিণ আফ্রিকা। ডি ভিলিয়ার্স এবং কুইন্টন ডি কক রানের চাকা কিছুটা সচল করেন। ৪৩ রানে ডি কক আউট হলে দলের আর কোনো ব্যাটসম্যানের সাথে বড় কোনো জুটি তৈরি করতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত ১১২ রানে আউট হন ডি ভিলিয়ার্স। ২৬৪ রানে থামে দক্ষিণ আফ্রিকার ইনিংস। ভারত জয় পায় ৩৫ রানের। বৃথা যায় ডি ভিলিয়ার্সের সেঞ্চুরি।
৯. অপরাজিত ১৩৬, প্রতিপক্ষ অস্টেলিয়া (হারারে)
২০১৪ সালে জিম্বাবুয়েতে অনুষ্ঠিত ত্রিদেশীয় সিরিজের ২য় ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকাকে ৩২৮ রানের টার্গেট দেয় অস্ট্রেলিয়া। জবাবে ডু প্লেসিস এবং ডি ভিলিয়ার্সের জোড়া সেঞ্চুরিতে মাত্র ৩ উইকেটে ৩২৮ রান সংগ্রহ করে তারা। ডি ভিলিয়ার্স খেলেন ১০৬ বলে ১৩৬ রানের হার না মানা ইনিংস।
১০. অপরাজিত ৬৯ প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ড (চট্টগ্রাম)
২০১৪ সালে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে ওঠার লড়াইয়ে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ব্যাট করতে নামে দক্ষিণ আফ্রিকা। ওপেনিং জুটিতে যোগ হয় ৯০ রান। ৩ নম্বরে ব্যাট করতে নেমে ডি ভিলিয়ার্স খেলেন ২৮ বলে ৬৯ রানের ইনিংস। ২০ ওভার শেষে স্কোরবোর্ডে যোগ হয় ১৯৬ রান। শ্বাসরুদ্ধকর সেই ম্যাচে মাত্র ৩ রানের জয় পায় দক্ষিণ আফ্রিকা। নিশ্চিত হয় সেমিফাইনাল খেলা। ম্যাচ সেরা হন ডি ভিলিয়ার্স ।
“বিরহে যে মন্দির শূন্য হয় সেই মন্দিরের শূণ্যতার মধ্যে বাঁশি বাজে, কিন্তু বিচ্ছেদে যে মন্দির শূন্য হয় সেই মন্দির বড় নিস্তব্ধ, সেখানে কান্নার শব্দও বেসুরো শোনায়।”
আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে তার বিচ্ছেদ যে বড়ই বেমানান। হয়তো সময়ের পরিক্রমায় ভক্তরা এক সময় মেনে নেবে বাস্তবতাকে। একসময় পরিবর্তিত হবে দক্ষিণ আফ্রিকা দলের জার্সি। থাকবেন তিনি, থাকবে তার ১৭ নম্বর জার্সিও, শুধু থাকবে না জার্সির পেছনে তার নাম। তার ভক্তরা জানেন না তার এই আত্মঘাতী সিদ্ধান্তের পেছনের আসল কারণ। হতে পারে ক্লান্তি, হতে পারে অভিমান। তবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তারা ডি ভিলিয়ার্সকে মিস করবে।
ফিচার ইমেজ :India.com