১.
ফলোঅন কী? এই প্রশ্নের জবাব একসময় ছিল, ‘অস্ট্রেলিয়া যা তাদের প্রতিপক্ষকে করায়।’
এই কথা বলা হতো স্টিভ ওয়াহ্’র অস্ট্রেলিয়া সম্পর্কে, টানা ১৬টা টেস্ট জিতেছিল সেই দল। তবে সেই রামও নেই, সেই অযোধ্যাও আর নেই। সেই শক্তিশালী অস্ট্রেলিয়ার দিনকালও এখন খুব একটা ভালো যাচ্ছে না।
টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে ফলোঅনে পড়েও কোনো দল জয়লাভ করেছে, এমন ঘটনা ঘটেছে মাত্র তিনবার। এবং এই তিনবারই পরাজিত দলের নাম অস্ট্রেলিয়া। প্রথমবার ঘটেছিল ১৮৯৪ সালে, সেবার ববি পিলের নৈপুণ্যে ফলোঅনে পড়েও ম্যাচ জিতে নেয় ইংল্যান্ড। দ্বিতীয়বার এই ঘটনা ঘটে ১৯৮১ সালের অ্যাশেজে। প্রথম দুই টেস্ট জিতে ৬ টেস্টের সিরিজে ২-০’তে এগিয়ে গিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া। ৩য় টেস্টে ফলোঅনের ফাঁদে ফেলেছিল ইংল্যান্ডকে, কিন্তু সেই টেস্টেই অতিমানব হয়ে উঠলেন ইয়ান বোথাম। সেই টেস্ট তো জেতালেনই, জেতালেন পরের দুই টেস্টও। টানা তিন ম্যাচে ‘ম্যান অফ দ্য ম্যাচ’ হয়ে অ্যাশেজ জেতালেন ইংল্যান্ডকে, যার ফলে এখনও সেই অ্যাশেজের নাম হয়ে আছে ‘বোথামের অ্যাশেজ’।
নব্বইয়ের দশকে জন্ম নেয়া যে সব পাঠকেরা এই লেখাটা পড়ছেন, তৃতীয় ঘটনাটা তাদের মনে না থেকে যায়ই না।
২০০১ সাল, বোর্ডার-গাভাস্কার ট্রফির দ্বিতীয় টেস্ট।
অস্ট্রেলিয়ার ৪৪৫ রানের জবাবে প্রথম ইনিংসে ১৭১ রানে অলআউট হয় ভারত। তারপর যা হয়, তাকে এক কথায় বলা যায়, ইডেন গার্ডেনসের মহাকাব্য। ফলোঅনে নেমে বুক চিতিয়ে দাঁড়ান ভিভিএস লক্ষ্মণ আর রাহুল দ্রাবিড়। দু’জনে মিলে ৫ম উইকেটে যোগ করেন ৩৭৬ রান। তাদের ব্যাটের ঝলকে চোখ এমনই ঝলসে যায় অজিদের, সেই টেস্ট হেরেই বসে তারা।
সে যা-ই হোক। টেস্টে কে কবে ফলোঅন করেও জয়লাভ করেছে, তা এই লেখার উদ্দেশ্য না। এই লেখাটার উদ্দেশ্য, প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটের এক অবিস্মরণীয় ম্যাচ সম্পর্কে জানানো, যে ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়েছিল ওয়ারউইকশায়ার আর হ্যাম্পশায়ারের মধ্যে।
২.
১৯২২ সালের জুন মাসের ১৪ তারিখ।
কাউন্টি ক্রিকেটে ৩ দিনের একটা ম্যাচ খেলার জন্য টস করতে নামলেন দুই দলের অধিনায়ক। ওয়ারউইকশায়ারের ক্যাপ্টেন ছিলেন লর্ড ফ্রেডারিখ ক্যালথর্প, আর হ্যাম্পশায়ারের অধিনায়ক ছিলেন লর্ড লিওনেল টেনিসন। শেষেরজন ছিলেন বিখ্যাত ইংরেজ কবি লর্ড আলফ্রেড টেনিসনের নাতি। প্রচণ্ড দুঃসাহসী ও বেপরোয়া ছিলেন তিনি, শরীরের পুরোটা জুড়েই সম্ভবত কলিজা ছিল তার। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে আহত হয়েছিলেন তিনবার, তারপরও ক্রিকেট খেলায় বিন্দুমাত্র প্রভাব পড়েনি তার। এই ঘটনার বছরখানেক আগে ইংল্যান্ডকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, লিডস টেস্টে আর্থার মেইলিকে ছক্কা হাঁকিয়েছিলেন শুধুমাত্র ডান হাতে। ক্রিকেট ছাড়াও আরও একটা নেশা ছিল তার, সেটা হলো জুয়া। শোনা যায়, কোনো এক সন্ধ্যায় জুয়ায় হেরে নিজের নতুন রোলস রয়েসটা খুঁইয়েছিলেন তিনি। তাতেও তার নাকি তেমন কোনো হেলদোল হয়নি। কতটা বেপরোয়া ছিলেন তা পাঠক হয়তো কিছুটা হলেও বুঝতে পারছেন। তার সাহসিকতার আরও নমুনা সামনে দেয়া হবে, তবে তার জন্য ম্যাচে ফিরতে হবে আমাদের।
টসে জিতলেন টেনিসন, জিতে ব্যাটিংয়ের আমন্ত্রণ জানালেন প্রতিপক্ষকে। অধিনায়ক ক্যালথর্পের ৭০, সাথে আরেক ‘ফ্রেডারিক’ স্যান্টালের ৮৪ রানের কারণে ২২৩ রানে অলআউট হলো ওয়ারউইকশায়ার।
ব্যাটিংয়ে নামলেন হ্যাম্পশায়ারের দুই ওপেনার অ্যালেক্স কেনেডি আর অ্যালেক্স বাওয়েল। ওয়ারউইকশায়ারের ব্যাটসম্যানেরা যেভাবে খেলে গেছে, তাতে পিচকে ব্যাটিং পিচ বলেই মনে হচ্ছিল তাদের কাছে। কিন্তু নিদারুণভাবে ভুল প্রমাণিত হলেন তারা, হঠাৎ করেই ‘আনপ্লেয়েবল’ হয়ে উঠলেন পেসার হ্যারি হাওয়েল! ক্যালথর্পও কম গেলেন না। তাদের মিলিত তোপে হ্যাম্পশায়ার অলআউট হলো মাত্র ১৫ রানে। হ্যাঁ পাঠক, ঠিকই পড়েছেন। ১১৫ নয়, শুধু ১৫। সর্বোচ্চ ৬ রানের ইনিংস ফিল মিড নামের এক ব্যাটসম্যানের ব্যাট থেকে, দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৪ করলেন অধিনায়ক নিজে, আর মিঃ এক্সট্রা। হাওয়েল নিলেন ৬ উইকেট, আর ক্যালথর্প নিলেন ৪টি।
২০৮ রানে পিছিয়ে থাকায় প্রতিপক্ষকে ফলোঅনে নামালেন ক্যালথর্প। আর টেনিসন তার সতীর্থদের কী বললেন?
‘কোনো চিন্তা নেই বন্ধুরা। এবার আমরা ৫০০ রান করব।’
৩.
একই দিনে দ্বিতীয়বারের মতো ব্যাট করতে নামলেন দুই ‘অ্যালেক্স’, কেনেডি আর বাওয়েল। প্রথম ইনিংসের দুঃস্বপ্নের ঘোর তখনও কাটেনি তাদের, তাই খুব সাবধানে ব্যাট করতে শুরু করলেন। তাতেও রক্ষা হলো না, দলীয় ১৫ রানে ক্যালথর্প ঠিকই কেনেডিকে তুলে নিলেন। তিন নাম্বারে নামলেন হ্যারল্ড ডে। দলীয় ৬৩ রানে আবার ছন্দপতন, এবার গেলেন ডে। তিনি আউট হওয়ার পরে নামলেন ফিল মিড। প্রথম ইনিংসের সর্বোচ্চ রানসংগ্রাহক তো ছিলেনই, সেই সাথে ছিলেন অপরাজিতও।
৮১ রানে গেলেন ওপেনার বাওয়েল, পাঁচ নাম্বারে নামলেন অধিনায়ক টেনিসন। দিনের বাকি সময়টা মিডকে নিয়ে কাটিয়ে যখন ফিরছেন, তখন স্কোর ৯৮/৩। ইনিংস পরাজয় এড়াতে তখনও দরকার ১১০ রান।
খেলা শেষে একটা কাণ্ড হলো। ক্যালথর্প এলেন হ্যাম্পশায়ারের ড্রেসিংরুমে, ম্যাচের তৃতীয় দিনে একটা গলফ ম্যাচ আয়োজন করা যায় কি না, সে ব্যাপারে টেনিসনের মতামত জানতে। ইঙ্গিতটা পরিষ্কার, খেলা দ্বিতীয় দিনেই শেষ হয়ে যাবে, তৃতীয় দিনে মৌজমাস্তি হবে। যে দল প্রথম ইনিংসে ১৫ রানে অলআউট হয়, সে দল দ্বিতীয় ইনিংসে এমন কী হাতিঘোড়া করবে শুনি?
কিন্তু ক্যালথর্পের কথা এক বাক্যে নাকচ করে দিলেন টেনিসন। উল্টো তিনি একটা বাজি ধরে বসলেন প্রতিপক্ষ অধিনায়কের সাথে। হ্যাম্পশায়ার দ্বিতীয় ইনিংসে ৫০০ রান করবে এবং ম্যাচ জিতবে, এই মর্মে ১০ পাউন্ডের একটি বাজি ধরলেন। মনে রাখা প্রয়োজন, সে সময়ে ১০ পাউন্ড মানে অনেক টাকার ব্যাপার। তারপরও এমনভাবে বাজি ধরলেন, যেন কোনো ব্যাপারই না। অপ্রসন্ন মুখে সেখান থেকে চলে গেলেন ক্যালথর্প, টেনিসনের কথা ভালো লাগেনি তার।
পাঠক, বলেছিলাম টেনিসনের সাহসের নমুনা সামনে পাবেন। পাচ্ছেন নিশ্চয়ই? তবে একটা কথা আপনারা জিজ্ঞেস করতেই পারেন। এই করবো, সেই করবো, বলতে তো পারে সবাই, করতে পারে কয়জন?
একটু অপেক্ষা করুন। এই প্রশ্নের জবাব অবশ্যই পাবেন। চলুন, পরদিনের খেলাতে যাওয়া যাক।
৪.
পরদিন খেলা শুরু হওয়ার আগে টেনিসনের কাছে একটা পোস্টকার্ড এলো। পোস্টকার্ডে যা লেখা ছিল, তার মূল বক্তব্য হচ্ছে, ঘোড়দৌড়ের মাঠে রঙমিস্ত্রীর আকাল পড়েছে। টেনিসন আর দলের সবার উচিত ক্রিকেট ছেড়ে সেই রঙমিস্ত্রীর কাজ নেয়া।
কঠিন অপমান। টেনিসনের সামনে একটা উপায়ই ছিল এই অপমানের জবাব দেয়ার। কিন্তু পথটা ছিল অত্যন্ত দুর্গম। ম্যাচ জয় তো পরের কথা, চোখ রাঙাচ্ছে তখন ইনিংস পরাজয়।
দলীয় ১২৭ রানে গেলেন ফিল মিড, ১৫২ রানে গেলেন টেনিসন নিজেই। ৬ষ্ঠ উইকেট হিসেবে ১৭৭ রানে ফিরলেন জ্যাক নিউম্যান, ইনিংস পরাজয় বাঁচাতে তখনও লাগে ৩১ রান, হাতে আছে মাত্র ৪ উইকেট। ৫০০ রান কিংবা ম্যাচ জয় তো সুদূর পরাহত।
ফিল মিড আউট হওয়ার পর নেমেছিলেন জর্জ ব্রাউন নামের এক ক্রিকেটার। প্রথম ইনিংসে তার রান ছিল ০। সেই রাগ থেকেই হোক, অথবা অধিনায়কের সম্মান বাঁচানোর তাগিদ থেকেই হোক, রুখে দাঁড়ানোর শুরুটা করলেন তিনিই। জ্যাক নিউম্যান আউট হওয়ার পর ক্রিজে আসেন উইলিয়াম শার্লি, তার সাথে ব্রাউন যোগ করলেন ৮৫ রান। ইনিংস পরাজয়ের শঙ্কা দূর হলো বটে, কিন্তু ম্যাচ জেতা বহুদূর তখনও।
দলের রান যখন ২৬২, তখন আউট হন শার্লি। তিনি আউট হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে ফিরে যান আরেক ব্যাটসম্যান ম্যাকিন্টায়ারও। স্বয়ং টেনিসনও হয়তো তখন ভাবছেন, আর বোধহয় হলো না।
কিন্তু এই ম্যাচ যে কতটা রোমাঞ্চ জমা রেখেছিল, তা তিনি নিজেও জানতেন না।
৫.
নবম উইকেট হিসেবে মাঠে নামলেন উইকেটকিপার ওয়াল্টার লিভসি। ক্যালথর্প যেখানে আর বাকি দুটো উইকেট তুলে নিয়ে হ্যাম্পশায়ারকে গুটিয়ে দেয়ার কথা ভাবছেন, সেখানে তাকে চূড়ান্ত রকমের হতাশ করে নবম উইকেটে পাকা ১৭৭ রানের জুটি গড়লেন ব্রাউন আর লিভসে!
ব্রাউন আউট হলেন ব্যক্তিগত ১৭২ রানে, দলের রান তখন ৪৫১। ম্যাচ জেতার হিসেব পরে, ৫০০ হতেও ৪৯ রান লাগে তখন। কিন্তু শেষ উইকেট হিসেবে নামা জর্জ বয়েসের কী হলো, কে জানে! সম্ভবত সতীর্থদের পারফরম্যান্স চরম অনুপ্রাণিত করেছিল তাকে। লিভসি’র সাথে ৮০ রানের একটা জুটি গড়ে ৫০০ রানের কোটা পার করালেন দলকে।
জর্জ বয়েস আউট হলে থামে হ্যাম্পশায়ারের ইনিংস। বাজির একটা অংশ ততক্ষণে জিতে গেছেন টেনিসন, কারণ দলের রান তখন ৫২১। লিভসি’কে আর আউট করা গেল না, তিনি অপরাজিতই থেকে গেলেন ১১০ রানে। আর জেতার জন্য ওয়ারউইকশায়ারের সামনে জয়ের লক্ষ্য দাঁড়াল ৩১৩ রানের।
৬.
লিভসি আর বয়েস দ্বিতীয় দিন শেষ করেছিলেন ৪৭৫ রানে। পরদিন কিছুক্ষণ ব্যাট করার পরই থেমে যায় তাদের ইনিংস। ওয়ারউইকশায়ারের সামনে জয়ের জন্য প্রায় সারাটা দিনই পড়ে ছিল। কিন্তু যখন তারা ব্যাট করতে নামল, তখন ইনিংস ব্যবধানে জিততে পারেনি, এই আক্ষেপ আর নেই তাদের। তার বদলে জায়গা করে নিয়েছে প্রবল বিস্ময়। বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে তারা ভাবছে, এই দলটাই কি প্রথম ইনিংসে ১৫ রানে অলআউট হয়েছিল?
প্রথম ইনিংসে ৪ উইকেট নিয়েছেন হ্যাম্পশায়ারের জ্যাক নিউম্যান, কিন্তু সতীর্থদের ব্যাটিং ব্যর্থতায় তা কোনো কাজে আসেনি। দ্বিতীয় ইনিংসে আরেকবার জ্বলে উঠলেন তিনি, ৫ উইকেট নিয়ে প্রায় একাই ধসিয়ে দিলেন ওয়ারউইকশায়ারকে। ১৫৮ রানে অলআউট হয় ওয়ারউইকশায়ার, হ্যাম্পশায়ার ম্যাচ জেতে ১৫৫ রানে।
হ্যাঁ পাঠক, সেই হ্যাম্পশায়ার, প্রথম ইনিংসে যারা অলআউট হয়েছিল মাত্র ১৫ রানে। সর্বকালের সেরা কামব্যাক বললে খুব বেশি অত্যুক্তি বোধহয় করা হবে না।
শুধু কথা বলেই থামেননি লর্ড লিওনেল টেনিসন, কাজেও পুরোপুরি করে দেখালেন। সেই সাথে জিতলেন বাজিটাও। ম্যাচশেষে ক্যালথর্পের কাছ থেকে পাওনাটা বুঝে নিতে ভোলেননি তিনি।
এরকম একটা ম্যাচে জয়ের পরে উদযাপনটা বড় হয় স্বাভাবিকভাবেই। শ্যাম্পেইনের বন্যা বয়ে যায়, হইহুল্লোড়ে মেতে ওঠে হ্যাম্পশায়ারের সবাই। শ্যাম্পেনের কর্ক খোলার সময় হাসতে হাসতে টেনিসন বললেন,
‘যে মানুষটা আমাকে পোস্টকার্ড পাঠিয়েছিল, তার সাথে পরিচিত হতে পারলে খুবই খুশি হতাম।’
ক্রিকেটকে বলা হয় ‘গৌরবময় অনিশ্চয়তার খেলা’।
আসলেই তাই। অনিশ্চয়তা শব্দটিকে ক্রিকেটের মতো আর কোন খেলা বোঝাতে পেরেছে?