১২ আগস্ট, ২০১৭। লন্ডন বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের ৪ X ১০০ মিটার রিলে ইভেন্টের জন্য ক্যারিয়ারে শেষবারের মতো ট্র্যাকে নামলেন উসাইন বোল্ট। চারদিকে হঠাৎ এক মুহূর্তের জন্য শুনশান নীরবতা, সবাই যেন হঠাৎ বুঝতে পেরেছে, আজকের পর আর তাঁকে ট্র্যাক মাতাতে দেখতে পাবে না গোটা বিশ্ব!
বোল্ট খুব সম্ভবত ধরতে পারলেন নস্টালজিয়াটা। কেন পারবেন না? গত এক দশক ধরে অ্যাথলেটিকসে যে তিনিই হয়ে উঠেছেন মুকুটবিহীন সম্রাট! তিনি ট্র্যাকে নামতেই গোটা মাঠের আবহটাই একদম বদলে যায়; আরও সহজ করে বলতে গেলে, তিনিই বদলে দেন। সেখানে বর্ণাঢ্য এক ক্যারিয়ারের অন্তিম লগ্নে এসে দাঁড়িয়েছেন যখন, বুঝতে পারবেন না সেই অশ্রুমণ্ডিত আবেগটুকু?
সেটাই হয়তো কাল হলো বোল্টের। শেষবারের মতো ১০০ মিটার দৌড়ানোর জন্য জুলিয়ান ফোর্টের হাত থেকে যখন ব্যাটন নিয়ে দৌড় শুরু করলেন, ঠিক সামলে উঠতে পারলেন না। শেষ ল্যাপ, জ্যামাইকা তখন তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে। কিছুটা যেন গতি বাড়াতে চাইলেন বোল্ট, জিততে হবে তো!
কিন্তু প্রকৃতি যে বড্ড বেখেয়ালি, পূর্ণতা দিতে যেন বরাবরই কিছুটা বিতৃষ্ণা তাঁর! তাই হয়তো সেটাই আজ আর করতে পারলেন না বোল্ট, যেটাতে তিনি ছিলেন সর্বকালের সেরা। হঠাৎই বাম হ্যামস্ট্রিংয়ে তীব্র ব্যথা অনুভব করলেন, বুঝতে পারলেন আর পারবেন না। কিছুটা কেঁপে উঠলেন যেন বোল্ট, ব্যাটনটা হাত থেকে পড়ে গেলো, তিনি নিজেও মুখ থুবড়ে পড়ে গেলেন ট্র্যাকে। ঠিক সেই সময়টাতে গোটা বিশ্বের আরো সহস্র-নিযুত দর্শকদের হৃদয়ও তাতে হলো ক্ষতবিক্ষত। বোল্টের জ্যামাইকান সতীর্থ এবং ১০০ মিটার স্প্রিন্টের সাবেক চ্যাম্পিয়ন ইয়োহান ব্লেক খুব সম্ভবত বলেছেন সবচেয়ে সত্যি কথাটাই, “তাঁর মতো একজন সত্যিকারের লেজেন্ডকে এভাবে কষ্ট পেতে দেখলে মনটা একেবারে ভেঙে যায়!”
বেইজিং অলিম্পিক, ২০০৮। বার্ডস নেস্টে বসেছে এগারো হাজার অ্যাথলেটের বিশাল এক মিলনমেলা। আর আসর জমতে না জমতেই গোটা আয়োজনের পুরো স্পটলাইট কেড়ে নিয়ে বসে আছেন ২১ বছর বয়সী এক তরুণ, ১০০ ও ২০০ মিটার ব্যক্তিগত স্প্রিন্টে শুধু স্বর্ণপদকই নয়, রীতিমত বিশ্বরেকর্ড গড়ে পদক জিতেছেন। শুধু কি তাই? মাইকেল জনসনের ১২ বছরের পুরোনো রেকর্ড ভেঙে দিয়েছেন এত অনায়াসে। তাঁকে দেখলে এটা মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক যে দৌড়ানো হলো বিশ্বের সবচেয়ে সহজ কাজ! মনে হবেই না বা কেন? একটা মানুষ কিছুটা ধীরগতিতে শুরু করার পরও ১০০ মিটার দৌড়ের শেষ ২০ মিটার যদি নাচতে নাচতেই বিশ্বরেকর্ড গড়তে পারেন, তাহলে সেই মানুষের সামর্থ্যের সীমা নিয়ে প্রশ্ন না ওঠাটাই অস্বাভাবিক বৈকি!
যাকে নিয়ে কথা হচ্ছে, তিনি উসাইন ‘দ্য লাইটনিং’ বোল্ট, তাঁর সামর্থ্য নিয়ে গবেষণা কম হয়নি। রীতিমত ‘পাগলামি’ পর্যায়ের গবেষণাও চলেছে তাঁর গতিময়তা নিয়ে। ঠিক কতটা পাগলামি? গবেষণাতে উঠে এসেছিলো, উসাইন বোল্ট ১০০ মিটার স্প্রিন্টে সেকেন্ডে প্রায় ২৭ মাইল গতিতে ছুটতে পারেন, যার ফলে প্রায় ২৬১৯.৫০ ওয়াট ক্ষমতা ব্যয় করতে হয় এবং প্রায় ৮১.৫৮ কিলো জুল পরিমাণ শক্তি উৎপন্ন করতে হয়। যদি আরেকটু পরিষ্কার করতে হয় হিসেবটা, একটি ম্যাগনাম হ্যান্ডগান থেকে একটি বুলেট বেরোতে উৎপন্ন শক্তির পরিমাণের তুলনায় সেটা প্রায় ৫০ গুণ! রীতিমত ‘অমানবীয়’ কিংবা ‘অতিমানবীয়’ এক তথ্য। তবে বিশ্ব অ্যাথলেটিকসে স্প্রিন্টের গত এক দশকব্যাপি একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে যিনি নিজেকে ‘জীবন্ত কিংবদন্তী’ হিসেবে অধিষ্ঠিত করেছেন, ২০০৮ সালের ওই অলিম্পিকের আগে তিনি ছিলেন ততটাই অপরিণত। তাই প্রশ্নটা থেকেই যাচ্ছিলো। ‘ট্রিপল’ জয়ের পথে তখন একমাত্র বাধা ৪ X ১০০ মিটার রিলে, যেখানে তিনি ছাড়াও জ্যামাইকার হয়ে দৌড়াবেন আরও তিনজন। চারদিকে জল্পনাকল্পনার শুরু, ইতিহাস গড়তে পারবেন তো তিনি?
ট্র্যাকে যখন নামলেন, চারদিকে মুহুর্মুহু উল্লাসধ্বনি এবং ‘উসাইন, উসাইন’ শংসাধ্বনিতে মগ্নমুখরিত বার্ডস নেস্ট। তাতেই যেন আরও কিছুটা উদ্বুদ্ধ হলেন বোল্ট, পজিশন নেওয়ার আগে একবার যেন হাত উঠাতে চাইলেন। পরে আবার কি মনে করে হাতটা নামিয়ে নিলেন, হয়তো ভাবলেন ‘ভিক্টোরি ল্যাপ’ দেওয়ার সময়ই একবারে তুলবেন হাত!
রিলের হিটেই বাদ পড়ে গিয়েছিলো জ্যামাইকার সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী যুক্তরাষ্ট্র, ফলে সম্ভাবনার পাল্লাটা আরও কিছুটা ঝুঁকে পড়লো জ্যামাইকার দিকেই। তাছাড়া জ্যামাইকা দলেই রয়েছেন বিশ্বের প্রাক্তন দ্রুততম মানব এবং গতি-তারকা আসাফা পাওয়েল। তবু কিছুটা যেন সন্দেহের অবকাশ থেকেই যায়; দৌড়টা তো আর শুধু বোল্টের একার নয়, দলে আরও তিনজন আছেন যে! হবে তো?
রিলে ফাইনালে শুরু করলেন নেস্তা কার্টার, বেশ ভালোভাবেই শুরু হলো জ্যামাইকার। এরপরের ল্যাপে কিছুটা যেন পিছিয়ে পড়লো জ্যামাইকা, মাইকেল ফ্র্যাটার কিছুটা পিছিয়ে থেকেই শেষ করলেন নিজের ১০০ মিটার দৌড়টা। তৃতীয় লেগের জন্য প্রস্তুত ‘ম্যান অফ দ্য মোমেন্ট’ উসাইন বোল্ট, ব্যাটন কোনোমতে হাতে নিয়েই বিদ্যুৎগতিতে ছুটলেন সবাইকে ছাড়িয়ে। সবাই অবাক হয়ে দেখলো, প্রতিদ্বন্দ্বীদেরকে অবিশ্বাস্য দূরত্বে পিছনে ফেলে এগিয়ে গেলো জ্যামাইকা। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা জাপানকে প্রায় পাঁচ মিটার পিছনে ফেলে যখন শেষ লেগের জন্য আসাফা পাওয়েলের হাতে তুলে দিলেন ব্যাটন, ততক্ষণে তিনি নিশ্চিন্ত হয়ে গিয়েছেন, স্বর্ণটা আর মিস হচ্ছে না। আসাফা ভুল করেননি কোনো, বরং অত্যন্ত সুনিপুণভাবে শেষ করলেন স্প্রিন্ট। টাইমিং দেখার জন্য বোর্ডে তাকিয়ে বোল্ট খেয়াল করলেন, গড়ে ফেলেছেন আরেকটি বিশ্বরেকর্ড!
সেই শুরু তাঁর রাজত্বের, অলিম্পিকের মতো ‘দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’ নামে পরিচিত বৈশ্বিক টুর্নামেন্টে নিজের অংশগ্রহণ করা তিনটি ইভেন্টেই বিশ্বরেকর্ড গড়ে ‘ট্রেবল’ জিতলেন। সাথে গোটা বিশ্বকে জানিয়ে দিলেন, তিনি থাকতেই এসেছেন।
অথচ এই অলিম্পিকের আগে তাঁকে নিয়ে কানাঘুষার বিশেষ অন্ত ছিলো না। টিম মন্টগোমারি, মারিওন জোনস এবং জাস্টিন গ্যাটলিনের ডোপ কলঙ্ক তাড়া করে ফিরছে তখনও। আর ঠিক এমন সময়ে একজন ‘আনকোরা’ স্প্রিন্টার, যার নিজস্ব সর্বোচ্চ টাইমিং ১০.০৩ সেকেন্ড, হুট করেই কিংস্টনে গড়ে ফেললেন ৯.৭৬ সেকেন্ড টাইমিং করে ফেললেন। সবাই এবার দারুণ বিস্ময় নিয়ে তাকালো সেই টগবগে যুবকের দিকে, কে এই ‘উসাইন বোল্ট’?
কিংস্টন ইভেন্টের টাইমিং যদি বিস্মিত করে থাকে, তবে নিউ ইয়র্কে অনুষ্ঠিত ‘রিবক গ্র্যান্ড প্রিক্স’ টুর্নামেন্টের টাইমিং রীতিমত চক্ষু চড়কগাছ করে দেওয়ার কথা। আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে নিজের পঞ্চম দৌড়েই টাইমিং করলেন ৯.৭২ সেকেন্ড, গড়লেন বিশ্বরেকর্ড! সেই প্রথম বুঝতে পারলো গোটা বিশ্ব, আগমন ঘটেছে এক নতুন গতিসম্রাটের।
এই স্প্রিন্টটাই তাঁকে দারুণ সাহস যোগালো, ঘোষণা করলেন ২০০৮ সালের গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকে তিনি ১০০ মিটার এবং ২০০ মিটারে দৌড়াবেন। কিংবদন্তী সাবেক অ্যাথলেট মাইকেল জনসন উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন, “এই কম বয়স ওর জন্য কোনো ব্যাপারই নয়! অভিজ্ঞতা ওর পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়াতেই পারবে না।”
অলিম্পিক মূল ইভেন্টে ১০০ মিটারে নেমেই গড়লেন আর একটি অবিস্মরণীয় কীর্তি, আবারও গড়লেন বিশ্বরেকর্ড! এবার সেটা ৯.৬৯ সেকেন্ড, যা কিনা পূর্বতন রেকর্ড থেকে প্রায় ০.০৩৭ সেকেন্ড কম! শুধু কি তা-ই? শুরুতেই কিছুটা ধীরগতিতে দৌড় শুরু করে পিছিয়ে পড়েছিলেন, এরপর কিছুটা গতি বাড়িয়ে নিজেকে নিয়ে গেলেন পরিষ্কার ব্যবধানে। এরপর শেষ ২০ মিটার রীতিমত নাচতে নাচতে শেষ করলেন, যেখানে অন্যরা অনেকটা পিছন থেকে প্রাণপণ চেষ্টা করে চলেছে তাঁকে ছোঁয়ার! স্প্রিন্ট যখন শেষ হলো, সকলে অবাক বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করলো, গোটা দৌড়টুকুতে তাঁর জুতার ফিতা আসলে বাঁধা-ই ছিলো না!
বিস্ময়টা আরও বাড়লো, যখন বোল্টের কোচ গ্লেন মিলস দাবি করলেন, “প্রথম ৬০ মিটারে তাঁর যে গতি ছিলো, সেটা যদি বজায় রাখতে পারতো, টাইমিং আমার হিসেবে ৯.৫২ হতে পারতো।” এরপর অসলো ইউনিভার্সিটির ইনস্টিটিউট অফ অ্যাস্ট্রোফিজিক্সের অধ্যাপক হ্যান্স এরিকসন এবং তাঁর সহকর্মীরা বিভিন্ন নিয়ামকসহ সম্ভাব্যতা হিসেব করে দেখেন, বোল্ট সত্যিই এই দৌড়টি ৯.৫৫ (±০.০৪) সেকেন্ডে শেষ করতে পারতেন!
রীতিমত অবিশ্বাস্য এই কীর্তির রেশ কাটতে না কাটতেই ২০০ মিটারে নেমে পড়তে হলো বোল্টকে, লক্ষ্য ১৯৮৪ অলিম্পিকে কার্ল লুইসের গড়া ‘ডাবল’-জয়ের কীর্তি স্পর্শ করা। মাইকেল জনসন তখন ২০০ মিটারের রেকর্ডধারী, তিনিই বললেন, “সে সহজেই এই দৌড়েও জিতবে।” তবে সঙ্গে এটাও বলেন যে, তাঁর বিশ্বরেকর্ড ভাঙাটা এখনই বোল্টের পক্ষে সম্ভব নয়।
খুব সম্ভবত জনসনের কথাটা খুব সিরিয়াসলিই নিয়ে নিয়েছিলেন বোল্ট। তাই জন্মদিনের ঠিক আগের দিনটা স্বর্ণালী আভায় রাঙিয়ে ২০০ মিটার ফাইনালটা যেন জিতলেন আরও হেলেদুলে, তবু এবার টাইমিং ১৯.৩০ সেকেন্ড। সবাই স্তম্ভিত হয়ে দেখলো, ২২ বছরের পুরাতন এক বিশ্বরেকর্ড, যা এর আগে কেউ ভাঙার কথা চিন্তাও করতে পারেনি, কতটা অনায়াসে ভেঙে দিলেন এই বিস্ময়বালক! শুধু কি তা-ই? তাঁর শারীরিক ভাষায় মনে হচ্ছিলো বিশ্বরেকর্ড যেন ছেলের হাতের মোয়া, চাইলেন আর টুপ করে হাতে এসে পড়লো! বিস্ময়টা বাড়লো আরও, যখন বোল্ট বললেন, তিনি আসলে রেকর্ডের জন্য দৌড়াননি। তাঁর ভাষায়, “এটা জাস্ট হয়ে গেছে আরকি!”
লুইসের কীর্তি ছোঁয়ার পর বোল্ট এবার পাখির চোখ করলেন ৪ X ১০০ মিটার রিলেকে। এরপর গড়লেন ইতিহাস, গতির ঝড় তুলে প্রথমবারের মতো অলিম্পিক আসরে তিনটি স্বর্ণপদক জিতলেন। শুধু এই একবারই নয়, বরং পরে আরও দু’বার গড়েছেন এই কীর্তি। যদিও পরে সতীর্থ নেস্তা কার্টারের ডোপ-কেলেংকারিতে একটি স্বর্ণপদক ফেরত দিতে হয়েছে বোল্টকে।
তবে ২০০৮ অলিম্পিকের এই অভূতপূর্ব সাফল্য দেখে কপাল কুঁচকালেন ভিক্টর কন্তে সহ আরও বেশ কয়েকজন ধারাভাষ্যকার, গ্যাটলিন-জোন্স-মন্টগোমেরির কলঙ্কিত ডোপ-অধ্যায়ের পর এই অভিযোগ ওঠাটাও ছিলো অত্যন্ত অনুমিত। আর সেই অভিযোগের উত্তরটা বেশ ঝাঁঝালো কণ্ঠেই দিয়েছিলেন বোল্টের কোচ, “আমরা যেকোনো সময় শরীরের যেকোনো অংশে যেকোনো টেস্ট দিতে প্রস্তুত…। আরে, এই ছেলেকে একটা ভিটামিন পর্যন্ত জোর করে খাওয়াতে হয়!” পরে বোল্ট জানান, ১০০ মিটারে স্বর্ণজয়ের পরের দিন তাঁকে চারবার ডোপটেস্ট দিতে হয়েছে! বলা বাহুল্য, প্রতিবারই প্রমাণিত হয়েছে তাঁর নিষ্কলুষতা। বোল্ট বলেছিলেন, “আমরা কঠোর পরিশ্রম করি আর পারফর্ম করি ; আমরা জানি যে আমরা নিরপরাধ এবং আমাদের দিক থেকে পরিষ্কার আছি।”
এরপর জুরিখ ১০০ মিটার ইভেন্টে অন্যদের তুলনায় অনেকটাই ‘স্লো স্টার্ট’ করার পরও তাঁর টাইমিং ছিলো ৯.৮৩ সেকেন্ড। এরপর সুপার গ্র্যান্ড প্রিক্স টুর্নামেন্টে করলেন তৎকালীন সময়ে তাঁর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ টাইমিং, ১৯.৬৩ সেকেন্ড। তবে ওই টুর্নামেন্টে আসাফা পাওয়েল ১০০ মিটারে ৯.৭২ সেকেন্ড টাইমিং করে নিজেকে বোল্টের যোগ্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দাবি করেন। সেটাই যেন কিছুটা তাতিয়ে দিয়েছিলো বোল্টকে, ঐ বছরের শেষ দৌড়ে আসাফা পাওয়েলকে অনেকটা পিছনে ফেলে দিয়ে জিতে নিলেন ব্রাসেলস চ্যাম্পিয়নশিপ।
কিন্তু তাতেই যেন শান্তি পেলেন না বোল্ট, আরও কিছু দেওয়ার যে বাকি ছিল! তাই ২০০৯ সালে বার্লিনে অনুষ্ঠিত বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে মানুষের সামর্থ্যের সর্বোচ্চ সীমা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিয়ে টাইমিং করে বসলেন ৯.৫৮ সেকেন্ড! গোটা পৃথিবী ততদিনে জেনে গেছে বোল্টের নাম, তবে এই টাইমিং ছিল রীতিমত অবিশ্বাস্য! বিশ্ব রেকর্ডকে এক সেকেন্ডের দশ ভাগের এক ভাগ উপরে নিয়ে যাওয়াটাও ছিলো অভূতপূর্ব এক রেকর্ড। এই দৌড়ের পর আর কোনো সন্দেহ রইলো না, আজ পর্যন্ত যত স্পিডস্টারের আগমন ঘটেছে পৃথিবীতে, তাঁদের মধ্যে তিনিই সেরা। বোল্ট সেই স্প্রিন্টে ঠিক কতটা ভয়াবহ ছিলেন, সেটা বোঝা যায় ২০০৪ এথেন্স অলিম্পিকে স্বর্ণজয়ী দৌড়বিদ এবং ওই ইভেন্টের অন্যতম প্রতিযোগী শন ক্রফোর্ডের একটি কথাতেই, “ট্র্যাকে নামার পর মনে হচ্ছিলো যেন আমি ভিডিও গেমে আছি, আর এই ছেলেটা শোঁ শোঁ করে দৌড়ে এগিয়ে যাচ্ছে!”
তবে সেখানেই থামেননি বোল্ট। ২০০ মিটার ফাইনালে রীতিমত ওয়ার্ল্ড রেকর্ড ব্যাপারটিকে ছেলেখেলা বানিয়ে নিজের গড়া মাইলফলকটিকেই আবারও টপকালেন, মাইকেল জনসনের ১৯.৩২ সেকেন্ড টাইমিংটিকে তিন নম্বরে ঠেলে দিয়ে এবার টাইমিং করলেন ১৯.১৯ সেকেন্ড! ঠিক কতটা অবিশ্বাস্য ছিলো এই কীর্তি? এই ইভেন্টে যে রৌপ্যপদক জিতেছিলেন, তিনি ১৯.৯০ সেকেন্ডও টাইমিং করতে সক্ষম হননি! বার্লিন চ্যাম্পিয়নশিপের শেষ দিনে বার্লিনের মেয়র ক্লস ভভেরিট বলেছিলেন, “বার্লিনের দেওয়ালকে বলা হয় অনতিক্রম্য। অথচ সে যেই গতিতে দৌড়েছে, সেই গতিতে এই দেওয়াল ভেঙে ফেলাটাও এমন কোনো ব্যাপার বলে মনে হচ্ছে না!”
এরপর আর পিছনে তাকাতে হয়নি বোল্টকে, ধীরে ধীরে নিজেকে নিয়ে গেছেন অবিশ্বাস্য উচ্চতায়। এমনই এক শিখরে আরোহণ করেছেন, যেখানে অন্য কোনো অ্যাথলেট স্বপ্নেও পৌঁছানোর সাহস পায় না। তিন তিনবার অলিম্পিকে ২০০ মিটার স্প্রিন্ট জিতেছেন, যা এর আগে কারও ছিল না। তাঁর আগে সর্বোচ্চ দু’বার জিতেছিলেন মাইকেল জনসন এবং কেলভিন স্মিথ। স্প্রিন্টে সর্বোচ্চ স্বর্ণপদকজয়ী হিসেবে নাম লিখিয়েছেন কার্ল লুইস এবং মাইকেল জনসনের পাশে; নেস্তা কার্টারের ডোপ-কলঙ্ক বাধা হয়ে না দাঁড়ালে তিনিই হতেন সর্বোচ্চ স্বর্ণজয়ী।
সেই বোল্ট আজ শেষবারের মতো ট্র্যাকে নামলেন, নিজের ক্যারিয়ারের শেষবারের মতো ভালোবাসার ১০০ মিটার দৌড়ানোর জন্য। চোখে স্বপ্ন নিয়ে নেমেছিলেন, জয় দিয়েই লিখবেন ক্যারিয়ারের এপিটাফ। কিন্তু অদৃষ্টের লিখন হয়তো ছিলো অন্যরকম! নতুবা গোটা ক্যারিয়ারে যে ট্র্যাককে নিজের আলোয় উদ্ভাসিত করেছেন, শেষ দৌড়ে এসে আবারও হ্যামস্ট্রিংয়ের ইনজুরিতে মুখ থুবড়ে পড়বেন কেন?
ক্যারিয়ারটা যখন শুরু করেছিলেন, বিশ্ব অ্যাথলেটিকস তখন অন্ধকার এক যুগ অতিক্রম করছিলো। একের পর এক ডোপ কেলেংকারি, দুর্নীতি এবং নানারকম কলঙ্কে বিদ্ধ হচ্ছে খেলাটি, দুর্নীতি ঢুকে গিয়েছিলো অ্যাসোসিয়েশনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। বিশ্ব তখন অপেক্ষায় ছিল এমন এক মহামানবের, যে একা হাতে বদলে দিতে পারেন গোটা অ্যাথলেটিকসের মানচিত্র। আর ঠিক এমন সময়েই ত্রাতা হিসেবে আবির্ভাব ঘটেছিলো বোল্টের, এসেই নিজেকে চেনাতে শুরু করেছিলেন তিনি।
ক্যারিয়ারে শেষের টান শুনতে পাচ্ছিলেন অনেকদিন ধরেই, এমনকি একবার সিদ্ধান্ত নিয়েও ফেলেছিলেন রিও ডি জেনেইরো অলিম্পিক থেকেই অবসর নিয়ে নেবেন। ট্র্যাকে দৌড়ানোর শুরু থেকেই, অর্থাৎ সেই ১৬ বছর বয়স থেকেই তাঁর স্পন্সর ছিলো পুমা, অন্যদিকে গত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে দায়িত্ব পালন করে আসা পিতৃতুল্য কোচ, এদের অনুরোধ দূরে ঠেলে দেওয়াটাও কঠিন ছিলো বৈকি। তাই সিদ্ধান্ত বদলাতে বাধ্য হন বোল্ট; দর্শক, কোচ এবং স্পন্সরদের পরামর্শ গ্রহণ করে তিনি ঠিক করেন, অবসর নেবেন লন্ডন বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ শেষেই।
আর এতদিন পর যখন তাঁর যাওয়ার সময় ঘনিয়ে এসেছে, ঠিক এমন সময় এই ইনজুরিই তাঁর মন একেবারে গুঁড়িয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। ১০০ মিটার স্প্রিন্টে ডোপ-পাপে কলঙ্কিত জাস্টিন গ্যাটলিনের কাছে পরাজয়টাও মেনে নিয়েছিলেন, তাতে কিছুটা কষ্ট হলেও অন্তত কিছুটা আশা ছিলো, হয়তো শেষটা সুন্দরই হবে। কিন্তু এই ইনজুরি তাঁকে শুধু শারীরিক নয়, মানসিক দিক থেকেও ভেঙে দেওয়ারই কথা।
কিন্তু তিনি যে ‘দ্য লাইটনিং’ বোল্ট! ইনজুরির কারণে ট্র্যাক থেকে উঠতে পারছিলেন না, রীতিমত যুঝছিলেন নিজের শরীরের সঙ্গে। তবু হুইলচেয়ারে করে ট্র্যাক ছাড়ার পরামর্শ মেনে নেননি, নিজের পায়ে উঠে দাঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে মাঠ ছেড়েছেন। তাঁর মানসিক শক্তি দেখে অবাক হয়েছেন মাঠের সকলে, আর সিক্ত হয়েছে অশ্রুজলে। এতকিছুর মধ্যেও বোল্ট ভুলতে পারেননি দলের পরাজয়ের কথা, বারবার ক্ষমাপ্রার্থনা করেছেন সতীর্থদের কাছে। কিছুতেই যেন মানতে পারছিলেন না, তাঁর এই ইনজুরিই দলকে ছিটকে দিয়েছে দৌড় থেকে!
তবু দিনশেষে জাস্টিন গ্যাটলিনের একটা কথাই সত্য, “আজকের দৌড়ে যা-ই হয়ে থাকুক না কেন, উসাইনই সেরা। সে জিতুক বা না জিতুক, তাঁর চেয়ে ভালো আর কেউ নেই!” বোল্ট তাঁর দীর্ঘ এই ক্যারিয়ারে অলিম্পিককে করেছেন আরও মহিমান্বিত, অ্যাথলেটিকসের পুনর্জাগরণ ঘটিয়েছেন। তিনি দেখিয়েছেন, মানুষ তাঁর স্বপ্নের সমান বড়। তিনিই বুঝিয়েছেন, মানুষের সামর্থ্যের সীমা বেঁধে দেওয়া কোনো বিজ্ঞানের পক্ষেই সম্ভব নয়!
হয়তো যেমন পরিকল্পনা ছিলো, সেভাবে রাঙাতে পারেননি সন্ধ্যাটিকে। হয়তো জয়ের স্বর্ণালী আভা ছড়াতে পারেননি লন্ডন বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের এই আসরে, হয়তো নিজের সেরাটাও দিতে পারেননি। তবু সর্বকালের সর্বসেরা অ্যাথলেট হিসেবে পৃথিবী এক বাক্যে স্মরণ করবে তাঁর নাম। বোল্ট – উসাইন সেন্ট লিওঁ ‘দ্য লাইটনিং’ বোল্ট! আমরাও গর্ব করে বলতে পারবো, বেঁচে ছিলাম উসাইন বোল্টের যুগে!
ধন্যবাদ উসাইন বোল্ট, শুভ বিদায়! ইউ উইল বি মিসড।