দর্শকদের গ্যালারিমুখী করার জন্য বর্তমানে টি-টুয়েন্টি হলো ক্রিকেটের সবচেয়ে জনপ্রিয় সংস্করণ। সব দেশই এখন টি-টুয়েন্টি লীগ আয়োজন করার দিকে ঝুঁকে পড়েছে। এতে করে আর্থিক লাভ এবং অধিক দর্শক দুটোই পাওয়া যায়। দর্শকরা এখন মাঠে আসেন ধুমধাড়াক্কা ম্যাচ দেখার জন্য। এতে করে দিন দিন কমে যাচ্ছে টেস্ট ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা।
খুব কম ক্রিকেটারেরই পাঁচ দিনের টেস্ট ম্যাচ খেলার শারীরিক শক্তি থাকে। বর্তমানে অনেক ক্রিকেটার ইনজুরির ভয়ে টেস্ট ম্যাচ থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নিয়ে নেন এবং সীমিত ওভারের ক্রিকেটে মনোনিবেশ করেন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সময়সূচীতেও টেস্ট ম্যাচের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। টেস্ট ম্যাচের চেয়েও টাকার ছড়াছড়ি আছে এমন বিভিন্ন প্রিমিয়ার লীগই এখন বেশি জমজমাট।
পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে বোঝা যাবে বর্তমানের ক্রিকেটাররা লম্বা সময় ধরে টেস্ট ক্রিকেট খেলার ফিটনেস রাখেন না। এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ৬৬ জন ক্রিকেটার শতাধিক টেস্ট ম্যাচ খেলেছেন। এর মধ্যে ক্রিকেটের আধুনিক যুগে অর্থাৎ শেষ ১৭ বছরে মাত্র ১৫ জন ক্রিকেটার শতাধিক টেস্ট ম্যাচ খেলেছেন।
ক্রিকেট আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃতি পাওয়ার বহু আগে বিভিন্ন দেশে ঘরোয়াভাবে বর্তমান টেস্ট ম্যাচের আদলে ক্রিকেট ম্যাচ অনুষ্ঠিত হত, যাকে প্রথম শ্রেণীর ম্যাচ বলা হয়। বিশেষ করে ১৮৯৫ সালের পূর্বে অনুষ্ঠিত ম্যাচসমূহকে প্রথম শ্রেণীর মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে সকল প্রতিযোগিতামূলক টেস্ট ম্যাচকে প্রথম শ্রেণীর মর্যাদা দেয় আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল (আইসিসি)।
আধুনিক ক্রিকেটের পথচলা শুরু হয় কাউন্টি ম্যাচের মাধ্যমে। ১৭১৯ সালে ইংল্যান্ড জাতীয় দল এবং কেন্ট দলের মধ্যে প্রথম কাউন্টি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। তখনো ক্রিকেট আধুনিক ছিল না, কারণ তখন ক্রিকেটের সে যুগের প্রচলিত নিয়মকানুন অনুযায়ী ম্যাচ অনুষ্ঠিত হত। আধুনিক নিয়মকানুন অনুযায়ী আন্তঃকাউন্টি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয় ১৭৪৪ সালে। তবে ১৮৯০ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে কাউন্টি চ্যাম্পিয়নশিপের প্রচলন ঘটে।
আজকের লেখাটি ক্রিকেটের আদি সংস্করণ প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটের মহামানবদের নিয়ে, যারা যুগের পর যুগ নিরলসভাবে কাটিয়ে দিয়েছেন বাইশ গজে। ক্রিকেটই ছিল যাদের ধ্যানজ্ঞান।
উইলফ্রেড রোডস
বর্তমানে ১০০টি টেস্ট ম্যাচ খেলতে ক্রিকেটাররা হিমশিম খেয়ে যান। কিন্তু যদি বলা হয় এককালে একজন ক্রিকেটার হাজারের অধিক প্রথম শ্রেণীর ম্যাচ খেলেছেন, তখন সবাই নড়েচড়ে বসবে। এটাও সম্ভব! একজন ক্রিকেটার একাই হাজারের উপর প্রথম শ্রেণীর ম্যাচ খেলেছেন!
ইংল্যান্ড এবং ইয়র্কশায়ারের সাবেক অলরাউন্ডার উইলফ্রেড রোডস ১৮৯৮ সাল থেকে ১৯৩০ সাল পর্যন্ত প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে খেলেছেন ১,১১০টি ম্যাচ!
তার ক্রিকেট ক্যারিয়ারকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে বোলার হিসাবে দলে জায়গা পান রোডস। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর নিজের ব্যাটিংয়ের উপরও মনোযোগ দেন তিনি। বয়স বাড়ার সাথে সাথে তার ব্যাটিংয়ের প্রতিভা আরো বাড়তে থাকে। শেষ পর্যন্ত ইংল্যান্ডের উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান হিসাবে তাকে দেখা যায়।
উইলফ্রেড রোডসের প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে অভিষেক হয় ১২ মে, ১৮৯৮ সালে। ঐ ম্যাচে ৬ উইকেট শিকার করেন তিনি। নিজের দ্বিতীয় ম্যাচে কাউন্টি চ্যাম্পিয়নশিপে অভিষেক ঘটে তার। নিজের অভিষেক ম্যাচে ৪৫ রানে ১৩ উইকেট শিকার করেন, এরপর আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি। নিজের প্রথম মৌসুমে ১৫৪ উইকেট শিকার করে উইজডেন বর্ষসেরা ক্রিকেটারের পুরস্কার জিতে নেন রোডস।
রোডসের সবচেয়ে সফল মৌসুম কাটে ১৯০০ সাল থেকে ১৯০২ সাল পর্যন্ত। এই তিন মৌসুমে ১৪.০৭ গড়ে ৭২৫ উইকেট শিকার করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন তিনি। ১৯০৩ সালে রোডস প্রথমবারের মতো এক মৌসুমে ১,০০০ রান এবং ১০০ উইকেট শিকার করেন। নিজেকে পুরোদস্তুর অলরাউন্ডার হিসাবে ঐ বছরেই প্রমাণ করেন। এরপর বোলিংয়ের পাশাপাশি ব্যাট হাতেও নিয়মিত সফলতা পেতে থাকেন তিনি। তার ক্যারিয়ারে রেকর্ডসংখ্যক ১৬ বার এক মৌসুমে একই সাথে এক হাজারের বেশি রান এবং একশোর বেশি উইকেট নেবার কৃতিত্ব রয়েছে।
১৯১০ সালে ইংল্যান্ড জাতীয় দলে স্যার জ্যাক হবসের সাথে ইনিংস উদ্বোধন করার সুযোগ পেয়ে যান রোডস। ওপেনার হিসাবে নিজের প্রথম সিরিজে জ্যাক হবসের সাথে প্রথম উইকেট জুটিতে বেশ কয়েকবার বড় জুটি গড়েন তিনি। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ঐ সিরিজে ২২৬ রান করেন।
রোডস ক্রিকেট ইতিহাসে এমন সব কীর্তি গড়ে গেছেন যেগুলো এখন ভাঙা প্রায় অসম্ভব। টানা ৩২ বছরের প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে ক্যারিয়ারে তিনি খেলেছেন ১,১১০টি ম্যাচ, যা এখন সবার কাছে কল্পনাতীত। প্রথম শ্রেণীর ম্যাচে ৪,২০৪টি উইকেট শিকার করেছেন, যা অবধারিতভাবেই বিশ্বরেকর্ড। গোটা ক্যারিয়ার জুড়ে তিনি ২৮৭ বার ইনিংসে ৫ উইকেট এবং ৬৮ বার ম্যাচে ১০ উইকেট শিকার করেছেন।
ব্যাট হাতেও সমান সফল রোডস। ৫৮টি শতক এবং ১৯৭টি অর্ধশতকের সাহায্যে ৩৯,৯৬৯ রান করেছেন প্রথম শ্রেণীর ক্যারিয়ারে।ইংল্যান্ড জাতীয় দলের হয়ে ৫৮টি টেস্ট ম্যাচ খেলে ২,৩২৫ রান এবং ১২৭ উইকেট শিকার করে অলরাউন্ডারের ভূমিকা পালন করেন তিনি। উইলফ্রেড রোডস যখন ক্রিকেট থেকে অবসর নেন, তখন তার বয়স ছিল ৫২ বছর ১৬৫ দিন। সবচেয়ে বেশি বয়সে টেস্ট খেলা ক্রিকেটারও তিনি।
ফ্রাঙ্ক এডওয়ার্ড ওলি
উইলফ্রেড রোডসের পর প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে এমন আরেকজন অলরাউন্ডারের নাম হলো ফ্রাঙ্ক ওলি। ১৮৮৭ সালের ২৭শে মে ইংল্যান্ডের কেন্ট শহরে জন্মগ্রহণ করেন তিনি।
১৯০৬ সালে কেন্টের হয়ে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে অভিষেক হয় ওলির। কাউন্টি ক্রিকেটের পুরো ক্যারিয়ারে নিজ জন্মশহর কেন্টের হয়ে খেলেছেন তিনি। তিন বছর ঘরোয়া ক্রিকেট খেলার পর ১৯০৯ সালে ইংল্যান্ড জাতীয় দলে সুযোগ পান ওলি। রোডসের মতো তার প্রথম শ্রেণীর ক্যারিয়ারও ৩২ বছরের। আর এ সময় জুড়ে এমনসব কীর্তি তার আছে যা অক্ষত থাকবে ক্রিকেটের ইতিহাসে।
তাকে নিয়ে লিখতে গেলে বিশেষণগুলো ঠিকমতো দেওয়া যাবে না। চোখের দেখা না দেখে শুধুমাত্র পরিসংখ্যান অনুযায়ীও তিনি ছিলেন অনন্য।
ইংল্যান্ডের হয়ে টেস্ট ক্রিকেটে ৬৪ ম্যাচে ৩৬.০৭ ব্যাটিং গড়ে করেছেন ৩,২৮৩ রান। ৫টি শতক এবং ২৩টি অর্ধশতকের সাহায্যে এই রান করেছেন তিনি। বাঁহাতি স্পিন এবং বাঁহাতি পেস দুই ধরনের বলই করতে পারতেন তিনি। আন্তর্জাতিক টেস্ট ক্রিকেটে তার ঝুলিতে আছে ৮৩টি উইকেট।
প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটের তার পরিসংখ্যান আরো বেশি ঈর্ষণীয়। প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৯৭৮টি ম্যাচ খেলে স্যার জ্যাক হবসের পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৫৮,৯৫৯ রান করেছেন ওলি। এই ক্যারিয়ার জুড়ে হাঁকিয়েছেন ১৪৫টি শতক এবং ২৯৫টি অর্ধশতক।
শুধুমাত্র ব্যাট হাতে নয়, বল হাতেও প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে দাপট দেখিয়েছেন ৩২ বছর ধরে। ১৯.৮৭ গড়ে শিকার করেছেন ২,০৬৬টি উইকেট। ক্রিকেটে দুর্দান্ত সব কীর্তির জন্য ২০০৯ সালে আইসিসি ক্রিকেট হল অফ ফেইমে জায়গা করে নেন ওলি।
উইলিয়াম গেলবার্ট গ্রেস
১৮৪৮ সালের ১৮ জুলাই ব্রিস্টলের পাশের শহর ডুনেডনে পিতৃভূমিতে জন্মগ্রহণ করেন ডব্লিউ জি গ্রেস। আধুনিক ক্রিকেটের রূপকার বলা হয় তাকে, বিশ্বজুড়ে তিনি পরিচিত ডব্লিউ জি নামে। লম্বা দাড়ি আর সুঠাম দেহ ছিল তার, যা দেখে সহজেই তাকে চেনা যেত। ব্যক্তি ডব্লিউ জি গ্রেসের ডাকনাম ছিল বেশ কয়েকটি। দ্য ডক্টর, দ্য চ্যাম্পিয়ন নামেও ডাকা হত তাকে।
তার ক্রিকেট ক্যারিয়ারের পরিসংখ্যান নিয়ে অনেক মতানৈক্য ছিল। অধিকাংশ মানুষের ভাষ্যমতে, ১৮৬৫ সালে তার প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে অভিষেক হয় এবং ১৯১৪ সাল পর্যন্ত খেলেন।
গ্রেস তার ক্যারিয়ারে ২৯টি ভিন্ন দলের প্রতিনিধিত্ব করেন, যার মধ্যে বেশিরভাগ দলেই অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন। ক্রিকেট আন্তর্জাতিকভাবে যখন স্বীকৃতি পায়, তখন গ্রেসের বয়স চল্লিশের কোঠায়, হয়তো তার এটা নিয়ে আফসোস ছিল। আর কিছু সময় আগে ক্রিকেট আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত পেলে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও তার অসাধারণ প্রতিভার নিদর্শন রেখে যেতে পারতেন।
তবুও তার কীর্তি অম্লান হয়ে থাকবে ইতিহাসে। শুরুটা করেছিলেন ইংল্যান্ড অল স্টার দলের হয়ে সারি’র বিপক্ষে। নিজের প্রথমবারের প্রথম শ্রেণীর শতককে ২২৪ রানের ইনিংসে পরিণত করেন। এরপর এমসিসির হয়ে খেলেন গ্রেস। ১৮৬৯ সালের জুলাই মাসেই করেন ৪টি শতক। তার মধ্যে দুটি শতক করেছিলেন ব্যাটসম্যানদের জন্য মৃত্যুকূপ স্বরূপ এক পিচে।
গ্রেসের কাউন্টি দল গ্লৌচেস্টাশায়ার ১৮৭০ সালে কাউন্টি স্ট্যাটাস পেলে তার কাউন্টি ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে। বিশ বছর বয়সী গ্রেসের তখন ওজন ছিল ৯৫ কেজি। তখন থেকেই তিনি লম্বা দাড়ি রাখা শুরু করেন। ধূমপায়ী না হলেও ভালো খাবার এবং মদের প্রতি দুর্বলতা ছিল তার, যার কারণে শরীরে অতিরিক্ত মেদ জমে যায়।
১৮৭৩ সালে গ্রেস প্রথম ব্যাটসম্যান হিসাবে মধ্যাহ্ন বিরতির আগে শতক তুলে নেন জেন্টলম্যান অফ সাউথের হয়ে। ঐ একই মৌসুমে তিনি প্রথম ব্যাটসম্যান হিসাবে এক হাজারের অধিক রান এবং একশোর বেশি উইকেট শিকারের কীর্তি গড়েন।
পুরো ক্যারিয়ারে মোট ৮ বার এই কীর্তি গড়েন গ্রেট ডব্লিউ জি।
গ্রেস ইংল্যান্ডের হয়ে ২২টি টেস্ট ম্যাচে ৩২.২৯ ব্যাটিং গড়ে ১,০৯৮ রান করেন। কিন্তু ঘরোয়া ক্রিকেটের মতো আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তার বোলিংয়ের প্রতিভা দেখাতে পারেননি। হয়তো বয়স আর শরীরের অতিরিক্ত মেদ প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ২২ টেস্টের ক্যারিয়ারে মাত্র ৯টি উইকেট শিকার করেছেন। যেখানে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে তার উইকেট ২,৮০৯টি। প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে গ্রেস ৮৭০ ম্যাচে ৩৯.৪৫ ব্যাটিং গড়ে ৫৪,২১১ রান করেছেন ১২৪টি শতক এবং ২৫১টি অর্ধশতকের সাহায্যে।
দীর্ঘ দাড়িওয়ালা এই লোকটি ব্যক্তি জীবনে ছিলেন বেশ মজার। একবার এক বোলারের বলে বোল্ড হওয়ার পর বলটি আবার সেই বোলারের কাছে নিক্ষেপ করে বলেছিলেন, “লোকজন পয়সা খরচ করে আমার ব্যাটিং দেখতে এসেছে, তোমার বোলিং নয়।” আরেকবার তো কাঠের ব্যাটের বদলে অ্যালুমিনিয়ামের ব্যাট হাতে ক্রিজে চলে এসেছিলেন!
শুধুমাত্র ক্রিকেট নয়, গ্রেস ক্রিকেট ছাড়া অ্যাথলেটিকস, ফুটবল, গলফেও নিজের অসাধারণ প্রতিভার আলো ছড়িয়েছেন। ৪৪০ মিটার হার্ডলসে জাতীয় চ্যাম্পিয়ন, ওয়ান্ডারার্স ফুটবল ক্লাবের খেলোয়াড়, ইংল্যান্ডের বোলিং অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠালগ্নের সদস্য এবং প্রথম আন্তর্জাতিক বোলিং ম্যাচে ইংলিশ অধিনায়ক ছিলেন ক্রিকেটের এই অমর বুড়ো।
প্রায় ৫০ বছরের দীর্ঘ ক্রিকেট ক্যারিয়ারের বেশিরভাগ সময় জুড়ে গ্রেস ব্যস্ত ছিলেন ক্রিকেটের প্রসারে। জীবনের কাছে পরাজয় মেনেই তবে ক্রিকেট থেকে বিদায় নিয়েছেন ১৯১৫ সালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করা ডব্লিউ জি গ্রেস।
স্যার জ্যাক হবস
এই কিংবদন্তীর পুরো নাম জন বেরি হবস। আধুনিক যুগের শচীন, লারা, পন্টিংদের জন্মের বহু আগে ব্যাটিংয়ের সব ধরনের শট খেলে অনন্য কীর্তি গড়ে গেছেন হবস।
তার প্রথম শ্রেণীর পরিসংখ্যান দেখে যে কেউ চমকে উঠবে। ক্রিকইনফো অনুযায়ী, তার ক্যারিয়ারে রয়েছে ১৯৯টি শতক! কোথাও কোথাও ১৯৭টি শতক লিখে উপরে স্টার (*) চিহ্ন দিয়ে রাখা হয়েছে। তার মানে, শতকের সংখ্যা ঠিক কতটি সেটা তাদের জানা নেই।
ইতিহাসের প্রথম পরিপূর্ণ ব্যাটসম্যান, সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যান এবং সেরা ওপেনারদের একজন জ্যাক হবস। তার প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটের পরিসংখ্যান ঠিক এমন- ৮৩৪টি ম্যাচে ৫০.৭০ ব্যাটিং গড়ে এবং ১৯৯টি শতক এবং ২৭৩টি অর্ধশতকের সাহায্যে ৬১,৭৬০ রান! আর তার শতকগুলোর অধিকাংশই এসেছে বয়স চল্লিশের কোঠা অতিক্রম করার পর। শতকের ক্ষেত্রে তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী প্যাটসি হেনড্রেন। তার শতকের সংখ্যা ছিলো ১৭০টি।
মাঝখানে যদি বিশ্বযুদ্ধের জন্য ৫ বছর ক্রিকেট থেকে দূরে না থাকতেন কিংবা তার শতক হাঁকানোর পর অন্যদের ব্যাটিং করার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য স্বেচ্ছায় উইকেট বিলিয়ে দিয়ে না আসতেন, তাহলে তার পরিসংখ্যান কেমন হত, একবার ভাবুন তো!
আন্তর্জাতিক টেস্ট ক্রিকেটে ৪৬ বছর বয়সে শতক হাঁকিয়ে সবচেয়ে বেশি বয়সে শতকের রেকর্ডটি আজ পর্যন্ত নিজের দখলে রেখেছেন। ঐ ম্যাচে শুধুমাত্র ১০০ করেই থেমে থাকেননি, অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ১৯২৯ সালে ৪৬ বছর ৮২ দিন বয়সে খেলেছিলেন ২৪২ রানের মহাকাব্যিক ইনিংস।
প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে এত এত শতক হাঁকানোর পরেও হবসের প্রথম আন্তর্জাতিক শতক পেতে অপেক্ষা করতে হয়েছে ১২টি ম্যাচ। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ১৮৭ রান করে প্রথম টেস্ট শতকের দেখা পান হবস।
হবস ইংল্যান্ডের হয়ে ৬১টি টেস্ট ম্যাচে ১৫টি শতক এবং ২৮টি অর্ধশতকের সাহায্যে ৫৬.৯৪ ব্যাটিং গড়ে ৫,৪১০ রান করেছেন। প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে ঝুলিতে ১০৮টি উইকেট থাকলেও টেস্ট ক্রিকেটে শিকার করেছেন মাত্র ১টি উইকেট। নিজের প্রথম টেস্ট শতক পাওয়া ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকার ৯ নম্বর ব্যাটসম্যানকে আউট করে টেস্ট উইকেটের স্বাদ গ্রহণ করেন হবস।
জ্যাক হবস অন্য সব ক্রিকেটারের চেয়ে কতটা এগিয়ে আছেন তা বর্তমানকালের সেরা ব্যাটসম্যান শচীন টেন্ডুলকারের পরিসংখ্যানের দিকে তাকালেই বুঝা যাবে। শচীন টেন্ডুলকারের প্রথম শ্রেণীর রানসংখ্যা ২২,৩৩৬। যদিও শচীন তার সমান ম্যাচ খেলেননি তাই তুলনাটা ঠিক যুতসই জুতসই হয়ে উঠেনি। কিন্তু ক্রিকেটের ইতিহাসে তার সাথে তুলনা দেওয়ার মতো ব্যাটসম্যান খুম কমই এসেছে।
প্যাটসি হেনড্রেন
ইংল্যান্ডের কাউন্টি ক্রিকেটের আরেকজন কিংবদন্তী প্যাটসি হেনড্রেন। ১৮৮৯ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারি ইংল্যান্ডের মিডলেসেক্স শহরে জন্মগ্রহণ করেন হেনড্রেন।
১৯০৭ সালে মিডলেসেক্সের হয়ে কাউন্টি ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে তার। বিশ্বযুদ্ধের আগে নিজের ব্যাটিং প্রতিভা ততটা মেলে ধরতে পারেননি তিনি। কিন্তু যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর নিজেকে চেনাতে শুরু করেন হেনড্রেন। ১৯১৯ সালে ঘরোয়া ক্রিকেটে ১,৬৫৫ রান করেছেন ৬০ এর উপর ব্যাটিং গড়ে। এই কারণেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হওয়ার প্রথম বছরেই ‘উইজডেন ক্রিকেটার অফ দ্য ইয়ার’ পুরস্কার জিতে নেন ১৯২০ সালে।
মাত্র দুই সিরিজ খেলেই জাতীয় দল থেকে বাদ পড়ে যান হেনড্রেন। কিন্তু অগাধ আত্মবিশ্বাস আর টইটম্বুর প্রতিভা থাকার কারণে ১৯২৩ সালে আবারও জাতীয় দলে সুযোগ পেয়ে যান তিনি। সেই বছর প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে ১৩টি শতকের সাহায্যে ৩,০১০ রান করেছেন। জাতীয় দলে পুনরায় সুযোগ পাওয়ার পর দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ১৩২.৬৬ ব্যাটিং গড়ে রান করেছেন, এরপর আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি।
১৯২২ সাল থেকে ১৯২৮ পর্যন্ত প্রত্যেক মৌসুমে ৫৬ গড়ে রান করেছেন, ১৯২৭-২৮ মৌসুমে আবারো ১৩টি শতকের সাহায্যে করেছেন ৩,৩১১ রান। হেনড্রেন ১৯২৯-৩০ মৌসুমে ইংল্যান্ড জাতীয় দলের সাথে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে যান। ঐ সফরে ১১৫.৫০ ব্যাটিং গড়ে ৬৯৩ রান করেছেন। টেস্ট ক্রিকেটে তার সর্বোচ্চ ২০৫ রানের ইনিংসটিও এসেছে ঐ সিরিজে।
সেই সিরিজে হেনড্রেন টানা ৬ ইনিংসে অর্ধশতক করে ইংল্যান্ডের নতুন রেকর্ড গড়েন তিনি, যা পরবর্তীতে স্পর্শ করেন টেড বেক্সটার, কেন ব্যারিংটন এবং অ্যালিস্টার কুক। আরেকটি ঘটনার জন্য ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন হেনড্রেন। ১৯৩৩ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে নিজে হেলমেট বানিয়ে মাঠে নেমেছিলেন তিনি। প্রথম ব্যাটসম্যান হিসাবে হেলমেট মাথায় মাঠে নামার কীর্তিটাও তার।
প্যাটসি হেনড্রেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর দুর্দান্ত ব্যাটসম্যানদের মধ্যে একজন ছিলেন। জ্যাক হবসের ১৯৯টি শতকের পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৭০টি শতক হাঁকান তিনি। এছাড়া ৮৩৩টি প্রথম শ্রেণীর ম্যাচে ৫০.৮০ ব্যাটিং গড়ে ৫৭,৬১১ রান করেছেন। যা প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে জ্যাক হবস এবং ফ্রাঙ্ক ওলির পর তৃতীয় সর্বোচ্চ।
হেনড্রেন ইংল্যান্ডের হয়ে ৫১ টেস্টে ৪৭.৬৩ ব্যাটিং গড়ে ৩,৫২৫ রান করেছেন ৭টি শতক এবং ২১ টি অর্ধশতকের সাহায্যে।
প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে এই পাঁচজন ছাড়াও আরো অনেক ক্রিকেটারই আছেন যাদের জীবনের সিংহভাগ সময় কেটেছে বাইশ গজে। কিন্তু এই ক’জন খেলোয়াড় প্রাতঃস্মরণীয় হয়ে আছেন, কারণ তারা প্রথমশ্রেণীর ক্রিকেটের সিংহভাগ বিশ্বরেকর্ডই রেখেছেন নিজেদের দখলে। জীবন তাদের কেটে গেছে বাইশ গজের ভেতরে। আজকের পৃথিবীতে ক্রিকেটের জনপ্রিয়তার ভিত নির্মাণ করেছিলেন এই অদম্য ক্রিকেটাররাই।
তথ্যসূত্র
১) en.wikipedia.org/wiki/W._G._Grace
২) en.wikipedia.org/wiki/Patsy_Hendren
৩) en.wikipedia.org/wiki/Jack_Hobbs
৪) en.wikipedia.org/wiki/Frank_Woolley
৫) en.wikipedia.org/wiki/Wilfred_Rhodes
৬) stats.espncricinfo.com/c/engine/records/index.html?class=4