সময়টা আশির দশকের, দেশের ক্রীড়াঙ্গনে তখন ফুটবলের জয়জয়কার। এই দশকে বাংলাদেশে ফুটবল এতটাই জনপ্রিয় ছিল যে ঘরোয়া ফুটবলে আবাহনী-মোহামেডানের খেলার সময় গোটা স্টেডিয়াম এলাকায় যানজট লেগে যেত। ফুটবলের সেই স্বর্ণযুগে ক্রিকেটের মতো একটি সময় অপচয়ী এবং ব্যয়বহুল খেলাকে এদেশের মানুষের কাছে জনপ্রিয় করে তুলতে যে কয়েকজন মানুষের বিশেষ অবদান রয়েছে তাদের মধ্যে আকরাম খান একটি উল্লেখযোগ্য নাম।
বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক ও ব্যাটসম্যান মোহাম্মদ আকরাম হুসেইন খানের জন্ম ১৯৬৮ সালের ১ নভেম্বর চট্টগ্রামের বিখ্যাত খান পরিবারে। চট্টগ্রামের এম. এ. আজিজ স্টেডিয়াম থেকে হাতেগোনা সময়ের দূরত্বে তার বাড়ি। আর এখানেই ক্রিকেটচর্চার মাধ্যমে বেড়ে উঠেছেন চট্টগ্রামের খান পরিবারেরই বাংলাদেশ ক্রিকেটের তিন উজ্জ্বল নক্ষত্র আকরাম খান, তামিম ইকবাল খান এবং নাফিস ইকবাল খান। ক্রিকেটার হিসেবে আকরাম খানের ক্যারিয়ার শুরু হয় চট্টগ্রাম বিভাগীয় দলের হয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অংশগ্রহণের মাধ্যমে। এছাড়াও ঘরোয়া ক্রিকেটে বেশিরভাগ সময়ই খেলেছেন ঢাকা আবাহনীর হয়ে। ঘরোয়া ক্রিকেটে সাফল্য পাওয়ায় ১৯৮৮ সালে দেশের হয়ে একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে ডাক পান। পরবর্তীতে বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক ও অলরাউন্ডার গাজী আশরাফ হোসেন লিপুর নির্দেশনায় ও নিবিড় পরিচর্যায় তিনি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার হিসেবে গড়ে ওঠেন। ১৯৮৮ সালের ২৯ অক্টোবর পাকিস্তানের বিপক্ষে অভিষেক হয় আকরাম খানের। দেশের জার্সিতে তিনি ৪৪টি একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার পাশাপাশি খেলেছেন ৮টি টেস্ট ম্যাচও। ২০০০ সালের ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশের অভিষেক টেস্ট ম্যাচের দলেও ছিলেন তিনি। এছাড়াও বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন প্রায় ৫ বছর। এখন প্রশ্ন আসতে পারে- এত ছোট ক্রিকেটীয় ক্যারিয়ারে দেশের ক্রিকেটে বিশেষ কী ভূমিকা রাখতে পেরেছিলেন যা, ক্রিকেট ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকার মতো?
মূলত আকরাম হুসেইন খানদের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট অঙ্গনে পরিচিত ‘আকরাম খান’ হয়ে ওঠার পথটা ছিল অনেক জটিল। তখনকার ক্রিকেটারদের ছিল না তেমন কোনো সামাজিক মর্যাদা।ছিল না এখনকার খেলোয়াড়দের মতো পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা। এমনকি ক্রিকেটের অবকাঠামোও এতটা দুর্বল ছিল যে ক্রিকেট বোর্ডকে মাঝে মাঝে খেলোয়াড়দের বেতন-ভাতা দিতে হিমশিম খেতে হতো। একজন প্রতিষ্ঠিত ক্রিকেটার হিসেবে পরিচিতি লাভ করাই তখনকার ক্রিকেটারদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল না, পাশাপাশি দেশে ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা বাড়ানোর জন্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের ক্রিকেটের স্বীকৃতি লাভও ছিল তাদের অন্যতম লক্ষ্য। আর বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দল বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করার প্রথম সুযোগ অর্থাৎ বিশ্বকাপে খেলার সুযোগটিই পেয়েছিল আকরাম খানের হাত ধরে।
বাংলাদেশ ১৯৭৭ সালে আইসিসির সহযোগী সদস্যপদ লাভ করে এবং ১৯৭৯ সালে ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত আইসিসি ট্রফিতে অংশগ্রহণ করার মাধ্যমে বিশ্বক্রিকেটে আত্মপ্রকাশ করে। তখন ক্রিকেট ছিল এদেশের জনগণের কাছে অনেকটাই অপরিচিত একটি খেলা। ১৯৮৬ সালে শ্রীলংকায় অনুষ্ঠিত এশিয়া কাপে পাকিস্তানের বিপক্ষে বাংলাদেশ প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলে। এরপর ১৯৮৮ সালে আয়োজক দেশ হিসেবে এশিয়া কাপে অংশগ্রহণ করে বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দল, এবং এই দুই টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের কোনো জয়ই ছিল না। বাংলাদেশ ক্রিকেটের এমনই এক ক্রান্তিকালে ১৯৮৮ সালের ২৯শে অক্টোবর চট্টগ্রামের এম. এ. আজিজ স্টেডিয়ামে এশিয়া কাপে বাংলাদেশের শেষ ম্যাচে পাকিস্তানের বিপক্ষে অভিষেক হয় আকরাম খানের, এবং অভিষেক ম্যাচেই আট নম্বরে নেমে ৩৫ বলে খেলা ২১ রানের ইনিংসে সবার নজর কাড়েন, যদিও দল হেরেছিল ১৭৩ রানের বিরাট ব্যবধানে।
এরপর আর কখনো পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি ডানহাতি এই ব্যাটসম্যানকে। শুরু হয় জাতীয় দলের নিয়মিত সদস্য হিসেবে আকরাম খানের পথচলা। তিনি ছিলেন মূলত একজন ডানহাতি মারকুটে ব্যাটসম্যান। তার ব্যাটিং স্টাইলেও ছিল যথেষ্ট বৈচিত্র্য। ওয়ানডে ক্রিকেটে কিছুদিন পার্ট টাইমার হিসেবে বল করলেও কোনো উইকেট পাননি।
১৯৯০ সালে শারজায় অনুষ্ঠিত অস্ট্রাল-এশিয়া কাপে অংশগ্রহণ করে বাংলাদেশ। টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের হয়ে তৃতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক ছিলেন আকরাম খান। যদিও গ্রুপ পর্বের দুই ম্যাচ হেরেই টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় নিতে হয়েছিল বাংলাদেশকে। এরপর ১৯৯০ সালে হল্যান্ডে অনুষ্ঠিত আইসিসি ট্রফিতে সেমিফাইনাল পর্যন্ত খেলেছিল বাংলাদেশ। সেমিফাইনালে জিম্বাবুয়ের কাছে হেরে বিশ্বকাপের স্বপ্ন শেষ হয় বাংলাদেশের। টুর্নামেন্টের সাত ম্যাচে ১৭৯ রান করেছিলেন আকরাম খান। ১৯৯০ সালে ভারতে অনুষ্ঠিত এশিয়া কাপে তৃতীয়বার আইসিসির সহযোগী সদস্য হিসেবে এশিয়া কাপে অংশগ্রহণ করে বাংলাদেশ। এই টুর্নামেন্টে হঠাৎ করেই আকরাম খানের ব্যাটিং অর্ডার চার থেকে সাতে নামিয়ে আনা হয়। টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের দুই ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে ১০ এবং শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে অপরাজিত ৪ রান করেন তিনি। ১৯৯০ সালে আইসিসি ট্রফি জয়ের পর জিম্বাবুয়ে আইসিসির সদস্যপদ পায়। ফলে প্রথমবারের মতো দক্ষিণ এশিয়ায় অনুষ্ঠিতব্য ১৯৯৬ এর বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্ন নিয়েই ১৯৯৪ সালের আইসিসি ট্রফিতে অংশগ্রহণ করে বাংলাদেশ, কিন্তু স্বপ্নভঙ্গ হয় দ্বিতীয় রাউন্ডে কেনিয়ার কাছে ১৩ রানে হেরে। মাত্র তিন ম্যাচে ব্যাটিং করার সুযোগ পেয়েও টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের তৃতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক ছিলেন আকরাম খান। আইসিসি ট্রফিতে বাংলাদেশের চরম ব্যর্থতার পর পরই অধিনায়কত্বের দায়িত্ব দেওয়া হয় আকরাম খানকে।
অধিনায়ক আকরাম ছিলেন একেবারেই অন্যরকম। বিপর্যস্ত একটি দলের আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে তার অবদান বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ১৯৯৪ সালে দ্বিতীয়বারের মতো ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় সার্ক কোয়াড্রেংগুলার ট্রফি। এই টুর্নামেন্টেই প্রথমবারের মতো আকরাম খান বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলকে নেতৃত্ব দেন। টুর্নামেন্টের গ্রুপ পর্বে ভারত এবং শ্রীলংকাকে হারিয়ে ফাইনালে খেলার গৌরব অর্জন করে বাংলাদেশ। ফাইনালে ভারতের কাছে ৫২ রানে হারলেও ক্রিকেটপ্রেমীদের মন জয় করতে পেরেছিলেন আকরাম খানের বাংলাদেশ দল । এরপর ১৯৯৫ সালের এশিয়া কাপে দলকে নেতৃত্ব দেওয়ার পাশাপাশি টুর্নামেন্টে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকও ছিলেন আকরাম খান, যদিও বাংলাদেশ হেরেছিল সবগুলো ম্যাচেই। ১৯৯৬ সালে মালয়েশিয়ায় অনুষ্ঠিত এসিসি ট্রফিতে আকরাম খানের অধিনায়কত্বে চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ। টুর্নামেন্টে দলকে অসাধারণ নেতৃত্ব দেওয়া আকরাম খান ব্যাট হাতেও করেছিলেন ১০৬ রান।
আকরাম খানের অধিনায়কত্বে বাংলাদেশ ক্রিকেটের ইতিহাসে সবচেয়ে স্মরণীয় জয় আসে ১৯৯৭ সালের আইসিসি ট্রফিতে। পুরো টুর্নামেন্টে অপরাজিত বাংলাদেশ সেবার ফাইনালে কেনিয়াকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় এবং ১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপে অংশগ্রহণের সুযোগ পায়। এরই মাধ্যমে বিশ্ব-ক্রিকেটকে বাংলাদেশ জানান দেয় এক নতুন শক্তির আগমনী বার্তা। আকরাম খান টুর্নামেন্টে নেতৃত্ব দেওয়ার পাশাপাশি ব্যাট হাতে কয়েকটি দাপুটে ইনিংস খেলেও আত্মবিশ্বাস জুগিয়েছিলেন বাংলাদেশ শিবিরে। তার নেতৃত্বেই ১৯৯৮ সালে কেনিয়ার বিরুদ্ধে প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচে জয় পায় বাংলাদেশ। ম্যাচে ব্যাট হাতে তিনি করেছিলেন গুরুত্বপূর্ণ ৩৯ রান। ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ জাতীয় দলকে নেতৃত্ব দেন তিনি।
১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপে বাংলাদেশ পাকিস্তানের বিপক্ষে এক ঐতিহাসিক জয় পায়, সেই ম্যাচেও ৪২ রানের গুরুত্বপূর্ণ একটি ইনিংস খেলেন আকরাম খান। একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তার গড় ২৩.২৪ এবং দেশের হয়ে খেলা ৮ টেস্টে তার গড় ১৬.১৯। একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তার ক্যারিয়ার সর্বোচ্চ ৬৫ রান এসেছিল ১৯৯৭ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে। আকরাম খান ২০০৩ সালের মে মাসে দক্ষিণ আফ্রিকার সাথে শেষ টেস্ট খেলে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর নেন।
শুধু মাঠের ক্রিকেটেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না আকরাম খান। বাংলাদেশ ক্রিকেটের দুই উজ্জ্বল নক্ষত্র তামিম ইকবাল খান এবং নাফিস ইকবাল খানকে ক্রিকেটার হিসেবে গড়ে তুলতেও রেখেছেন অসামান্য অবদান। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের প্রধান নির্বাচক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
সময়ের আবর্তে বাংলাদেশ ক্রিকেট এখন এগিয়ে গেছে অনেকটা। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট অঙ্গনে নিজেদের সামর্থ্য প্রমাণ করে বিশ্বক্রিকেটে নিজেদের একটি পরাশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে। সেই পরাশক্তি হওয়ার ক্ষেত্রে কালজয়ী অবদান রেখে যাওয়া একজন আকরাম খান বাংলাদেশ ক্রিকেটের ইতিহাসে যুগের পর যুগ স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।