ফ্র্যাঞ্চাইজিরা খেলতে চায়নি এমন নয়। কিছু উচাটন অবশ্য তাদের মাঝে ছিল। খেলতে রাজি হলেও বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের (বিপিএল) ফ্র্যাঞ্চাইজিরা কিছু দাবি তুলেছিলেন বিসিবির কাছে। আলোচনার কথা বললেও হুট করে সবকিছু খোলনলচে বদলে ফেলার ঘোষণা দেয় বিসিবি। ফ্র্যাঞ্চাইজিদের বাদ দিয়ে বিপিএল আয়োজনের রূপরেখা চূড়ান্ত হয়ে যায়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে বিপিএলের বিশেষ আসর আলোর মুখ দেখে বিসিবির নিজস্ব ব্যবস্থাপনায়।
‘বঙ্গবন্ধু বিপিএল’ নামকরনের এই আসরে ছয়টি দলের জন্য স্পন্সর পেয়েছিল বিসিবি। কুমিল্লা ওয়ারিয়র্সই শুধু বিসিবির প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধায়নে পরিচালিত হয়েছিল। ৪৬ ম্যাচে ব্যাটে-বলের লড়াই পেরিয়ে বিপিএলের শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট জিতেছে রাজশাহী রয়্যালস। ফাইনালে খুলনা টাইগার্সকে ২১ রানে পরাজিত করে প্রথমবার বিপিএলে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে রাজশাহী।
ক্রিকেটের ক্ষুদে ফরম্যাটে ৩৮ দিনের টুর্নামেন্টে দর্শকদের জন্য চার-ছক্কার বিনোদন ছিল। দর্শকখরা সঙ্গী করেই এগিয়েছে টুর্নামেন্ট। কারো প্রাপ্তির পাল্লা ভারী হয়েছে, কেউ আবার শূন্য হাতে ফিরেছেন। স্বপ্নপূরণ-ব্যর্থতার প্লাবনেও ভেসেছেন অনেকে। আনন্দ-বেদনার এসব মুহূর্ত নিয়ে রঙিন ছিল বঙ্গবন্ধু বিপিএল, যা ক্রিকেটপ্রেমীদের স্মৃতিপটে জ্বলজ্বল করবে অনেক দিন। রোর বাংলার পাঠকদের জন্য বিপিএলের সপ্তম আসরের সামগ্রিক আবহ তুলে ধরা হচ্ছে কিছু খণ্ডচিত্রে।
ক্রিকেট-ক্রিকেটারহীন জমকালো উদ্বোধন
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বাংলাদেশ, এক-অভিন্ন।
বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে সনু নিগম গেয়ে উঠেন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার ও অংশুমান রায়ের সেই কালজয়ী গান। ১৯৭১ সালের এপ্রিলে প্রথমবার আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্র থেকে রাতে ‘সংবাদ পরিক্রমায়’ বাজানো ‘শোনো একটি মুজিবরের থেকে, লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি, আকাশে-বাতাসে ওঠে রণি… বাংলাদেশ, আমার বাংলাদেশ’ গানের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানিয়েছিল গত ৮ ডিসেম্বর মিরপুর স্টেডিয়ামে উপস্থিত থাকা দর্শক ও অতিথিরা। হেমন্তের সন্ধ্যায় সনু নিগমের সুরের মূর্ছনা মোহিত করেছে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের (বিপিএল) উদ্বোধন করা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের দেশাত্মবোধক গান, ‘ধনধান্য পুষ্পভরা আমাদের এই বসুন্ধরা’ গানটিও শোনা গেছে সনু নিগমের কন্ঠে। রাত ১০টার পর সালমান খান, ক্যাটরিনা কাইফের পারফরম্যান্স বিনোদিত করে সবাইকে।
বর্ণাঢ্য আয়োজনে গত ৮ ডিসেম্বর উদ্বোধন হয়েছিল বঙ্গবন্ধু বিপিএলের। বলা বাহুল্য, সে অনুষ্ঠানে ক্রিকেট কিংবা ক্রিকেটারদের লেশমাত্র ছিল না। বড় বাজেটের এই আয়োজনে ক্রিকেট সম্পর্কিত কিছুই ছিল না। যদিও, এটি ছিল একটি টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্টের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। ক্রিকেটারদের উপস্থিতিও ছিল না উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে। অংশগ্রহণকারী সাত দলকেও ডাকা হয়নি অনুষ্ঠানে।
তারকা ক্রিকেটারের খরা
আগের আসরগুলোর তুলনায় এবার বিপিএলে বিদেশি তারকা ক্রিকেটারের উপস্থিতি ছিল খুবই কম। ষষ্ঠ আসরে স্টিভেন স্মিথ, ডেভিড ওয়ার্নার, এবি ডি ভিলিয়ার্স, অ্যালেক্স হেলসরা খেলেছিলেন। সে তুলনায় সপ্তম আসরে সাত দলে ছিল না বড় নাম। খোদ সাকিব আল হাসানই ছিলেন না। ফিক্সিংয়ের প্রস্তাব গোপন করে নিষিদ্ধ হওয়া সাকিব সন্দেহাতীতভাবে বিপিএলের বড় তারকা ও পারফরমার।
বিদেশি ক্রিকেটারদের মধ্যে আন্দ্রে রাসেল, মুজিব-উর রহমান, মোহাম্মদ নবী, মালান, রাইলি রুশো, ওয়াহাব রিয়াজরা খেলেছেন শুরু থেকে। তারকার খরার কারণেই বিপিএল সেভাবে দর্শকদের মাঠে টানতে পারেননি। স্টেডিয়াম চত্বরে মাইকিং করে টিকিট বিক্রি হয়েছে। তারপরও গ্যালারি ফাঁকা থেকেছে নিত্যই। শুধু ফাইনালেই গ্যালারি ভরা দর্শক দেখা গিয়েছিল। পরে অস্ট্রেলিয়ান অলরাউন্ডার শেন ওয়াটসন, ক্যারিবিয়ান ক্রিস গেইলের উপস্থিতি কিছুটা স্বস্তির যোগান হয়েছিল আয়োজকদের জন্য। তাদের অংশগ্রহণে মুখ রক্ষা হয়েছে বিপিএলের।
সান্তোকির ‘নো’ বল
বিপিএলের শুরুতেই ‘সাড়া’ ফেলেছিলেন ক্যারিবিয়ান পেসার ক্রিসমার সান্তোকি। উদ্বোধনী ম্যাচে চট্টগ্রাম চ্যালেঞ্জার্সের বিপক্ষে অদ্ভুত বিশাল ‘নো’ বল, ‘ওয়াইড’ বল করে ক্রিকেটপ্রেমীদের মনে কৌতূহল জাগান তিনি। সিলেট থান্ডারের এই পেসারের বোলিং সন্দেহের উদ্রেক করে সবার মনেই। প্রশ্নবিদ্ধ বোলিংয়ের কারণে রীতিমতো ফিক্সিংয়ের অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে! যদিও তদন্ত, জিজ্ঞাসাবাদ শেষে সান্তোকির বিষয়ে অপরাধমূলক কিছু পায়নি বিসিবির দুর্নীতি দমন বিভাগ। তাই এ যাত্রায় বেঁচে গেছেন সান্তোকি।
টালমাটাল রংপুর রেঞ্জার্স
বিপিএলের শেষ দল হিসেবে রংপুর রেঞ্জার্সের স্পন্সর প্রতিষ্ঠান হিসেবে যুক্ত হয় ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস। দেশীয় ও বিদেশি ক্রিকেটার মিলে দলটা খারাপ ছিল না। কিন্তু ৬৮ রানে অলআউট হয়ে তাদের শুরুটা ভালো হয়নি। পরে টানা চার হারে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে দলটি। এমনকি টানা তিন ম্যাচে তিন অধিনায়ক দেখা গিয়েছিল রংপুর শিবিরে। মোহাম্মদ নবী, টম আবেল দলের অধিনায়কত্ব করেন। শেন ওয়াটসন আসার পর নেতৃত্বের জায়গাটি থিতু হয় তাদের।
এর মাঝে যোগ হয় টিম ম্যানেজমেন্টের ক্ষমতার চর্চা। টুর্নামেন্টের প্রথম ম্যাচেই ইনজুরিতে পড়েন জাকির হাসান। তার সুস্থ হতে সপ্তাহখানেক সময় লাগবে শুনে জাকিরকে স্কোয়াড থেকে বাদ দেয় দলটি। স্কোয়াডে নেয়া হয় আল আমিন জুনিয়রকে। পরে জাকির সুস্থ হওয়ার পর দলের কর্মকর্তাদের মতিভ্রম হয় আবার। এবার জাকিরকে রেখে আল-আমিনকে বাদ দেয়ার খায়েশ জাগে তাদের। কিন্তু তাদের ইচ্ছাপূরণ হয়নি বিপিএলের টেকনিক্যাল কমিটি অনুমোদন না দেয়ায়। শেষ পর্যন্ত আল আমিন জুনিয়র টিকে যান, বিপিএলই আর খেলতে পারেননি জাকির।
দেশীয় লেগ স্পিনাররা ব্রাত্য
বিপিএল শুরুর আগে বিসিবি ঘোষণা করেছিল, টুর্নামেন্টে লেগ স্পিনার তুলে আনার জন্য কাজ করা হবে। প্রতিটি দলে লেগ স্পিনার খেলানো বাধ্যতামূলক। দলগুলো একজন করে লেগ স্পিনারও দলে টেনেছিল। কিন্তু টুর্নামেন্ট মাঠে গড়াতেই দৃশ্যপট বদলে যায়, যেখানে দেশীয় লেগ স্পিনাররা ব্রাত্য হয়ে পড়েন। স্বীকৃত চার লেগ স্পিনার বলার মতো ম্যাচই খেলতে পারেননি।
জুবায়ের হোসেন লিখন চট্টগ্রাম চ্যালেঞ্জার্সের হয়ে কোনো ম্যাচই খেলতে পারেননি। দেশীয় লেগ স্পিনারদের মধ্যে খুলনার হয়ে আমিনুল ইসলাম বিপ্লব সর্বোচ্চ ৬ ম্যাচ খেলেছেন, উইকেট নিয়েছেন চারটি। রংপুরের হয়ে রিশাদ হোসেন খেলেছেন এক ম্যাচ, থেকেছেন উইকেটশূন্য। রাজশাহীর হয়ে দু’টি ম্যাচ খেলার সুযোগ পেয়েছেন মিনহাজুল আবেদীন আফ্রিদি। উইকেটের দেখা পাননি, এক ম্যাচে বোলিংও করতে পারেননি।
দেশীয় ব্যাটসম্যানদের দাপট
ব্যাটিংয়ে এবার দেশীয় ব্যাটসম্যানদের সাফল্য ছিল চোখে পড়ার মতো। টুর্নামেন্টের শীর্ষ পাঁচ ব্যাটসম্যানের দু’জন দেশীয়, তিনজন বিদেশি। শীর্ষ দশ হিসেবে করলে থাকছেন সাত দেশীয় ব্যাটসম্যান। চারটি হাফ সেঞ্চুরিতে ৪৯৫ রান করে সেরা ব্যাটসম্যান হয়েছেন খুলনার রাইলি রুশো। সমানসংখ্যক হাফসেঞ্চুরিসহ ৪৯১ রান করে দ্বিতীয় স্থানে আছেন মুশফিক। ৪৫৫ রান করে তৃতীয় স্থানে রাজশাহীর হয়ে খেলা লিটন দাস। একই দলের শোয়েব মালিক ৪৫৫ রান ও কুমিল্লার মালান ৪৪৪ রান করে চতুর্থ, পঞ্চম স্থানে অবস্থান করছেন।
সেরা দশের বাকি পাঁচটি জায়গায়ই বাংলাদেশিদের দখলে। ইমরুল কায়েস (৪৪২), তামিম ইকবাল (৩৯৬), আফিফ হোসেন (৩৭০), নাঈম শেখ (৩৫৯), মোহাম্মদ মিঠুনদের (৩৪৯) ঠাঁই হয়েছে সেরা দশে।
দেশীয় ক্রিকেটারদের পারফরম্যান্স দেখে খুশি মুশফিকও। ফাইনাল শেষে দেশীয়দের দাপট সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন,
‘আমাদের লোকাল প্লেয়াররা অনেক ভালো করেছে এবারের বিপিএলে। আগের অনেক বিপিএলে দেখা যেত, এক-দুইজন হয়তো ভালো করেছে। এবার অনেক প্লেয়ার ভালো খেলেছে। অনেক অলরাউন্ডার আছে, ব্যাটসম্যান আছে, বোলার আছে। এটা বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য ভালো লক্ষণ। আমি আশা করি, তারা এক বছর খেলেই শান্ত থাকবে না। এটা থেকে অভিজ্ঞতা অর্জন করে পরবর্তীতে যেন আরও ভালো করতে পারে, এটাই চ্যালেঞ্জ। একটা বছর অনেক এফোর্ট দিয়ে কষ্ট করে ভালো খেলতে পারেন, কিন্তু প্রত্যেক বছর ধারাবাহিকভাবে ভালো খেলা অনেক কঠিন।’
চার ছক্কা হজমের পরও শীর্ষে মুস্তাফিজ
বিষম তিক্ততা দিয়ে বিপিএল শুরু হয়েছিল মুস্তাফিজের। ফর্মহীনতায় ভোগা এই বাঁহাতি পেসার টুর্নামেন্টের প্রথম ম্যাচেই বেধড়ক পিটুনি খেয়েছেন। কুমিল্লার দাসুন শানাকা টানা চার বলে ছক্কা মেরেছিলেন তাকে। চার ছক্কা হজমের পর অবশ্য দারুণভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছিলেন ‘কাটার মাস্টার’ খ্যাত এই বোলার। ধীরে ধীরে ছন্দে ফিরেছেন, এবং টুর্নামেন্ট শেষ করেছেন শীর্ষ উইকেটশিকারী হয়ে। যদিও তার দল রংপুর সেরা চারেই উঠতে পারেনি। ১২ ম্যাচে ২০ উইকেট নেন মুস্তাফিজ।
শীর্ষ পাঁচ বোলারের তিনজনই বাংলাদেশি। মুস্তাফিজ ছাড়াও রুবেল হোসেন, শহীদুল ইসলাম সেরা পাঁচে আছেন। রুবেল ২০টি, শহীদুল ১৯টি উইকেট নেন। মোহাম্মদ আমির ২০টি, রবি ফ্রাইলিঙ্ক ২০টি করে উইকেট নেন। সেরা দশের অন্য বোলাররা হলেন: মেহেদী হাসান রানা (১৮), মুজিব-উর রহমান (১৫), লুইস গ্রেগরি (১৫), মোহাম্মদ ইরফান (১৪) ও এবাদত হোসেন (১৪)।
সুপার ওভারের রোমাঞ্চ
সিলেট পর্বের দ্বিতীয় ম্যাচে সুপার ওভারের রোমাঞ্চ উপহার দেয় বিপিএল। কুমিল্লা-সিলেটের ম্যাড়ম্যাড়ে ম্যাচটি নিরুত্তাপ সমাপ্তির দিকেই হাঁটছিল। কুমিল্লা আগে ব্যাট করে ৯ উইকেটে ১৪০ রান করেছিল। জবাবে ৩৩ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে বসা সিলেটকে এগিয়ে নিয়ে যায় সোহাগ গাজীর ৩১ বলে ৫২ রানের ইনিংস। গাজী ফেরার নাভিন উল হক ও মনির হোসেন দলকে জয়ের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যান। কিন্তু শেষ ওভারে দু’জনই রানআউট হলে ম্যাচ টাই হয়ে যায়। সুপার ওভারে গড়ায় ম্যাচ।
সুপার ওভারে কুমিল্লার মুজিবের করা ওভারে ৭ রানের বেশি নিতে পারেনি সিলেট। পরে প্রোটিয়া অলরাউন্ডার ডেভিড ভিসের ব্যাটে এক বল আগেই জয় নিশ্চিত করে কুমিল্লা। সুপার ওভারের আগে চার ওভারে ১২ রান দিয়ে ৪ উইকেট নেয়া মুজিব ম্যাচ সেরা হয়েছিলেন।
রাসেল পাওয়ার
ক্রিকেট বিশেষ টি-টোয়েন্টির বাজারে আন্দ্রে রাসেল বরাবরই বড় নাম। ক্যারিবিয়ান এই অলরাউন্ডারকে পেতে চায় সবাই। টুর্নামেন্টের শুরু থেকে রাজশাহীর নেতৃত্ব দিয়েছেন। কিন্তু ব্যাট হাতে নিজের ধ্বংসযজ্ঞটা যেন জমিয়ে রেখেছিলেন বড় মঞ্চের জন্যই। প্রথম কোয়ালিফায়ারে হেরেছিল রাজশাহী। দ্বিতীয় কোয়ালিফায়ারে তাই হয়তো দলের বিপদের মুহূর্তে অগ্নিমূর্তি ধারণ করে রাসেলের ব্যাট। ২২ বলে অপরাজিত ৫৪ রানের (২ চার, ৭ ছয়) বিস্ফোরক ইনিংসে চট্টগ্রামকে ছিটকে দেন টুর্নামেন্ট থেকে, রাজশাহীকে এনে দেন ফাইনালের টিকিট। রাসেল যখন উইকেটে আসেন তখনও ৪০ বলে ৮৫ রান প্রয়োজন ছিল রাজশাহীর। এক প্রান্তে উইকেট পড়লেও স্ট্রাইক পেলেই তোপ দাগিয়েছেন তিনি। তার ব্যাটিং ঝড়েই হাতের মুঠোয় থাকা ম্যাচ হেরে বিদায় নেয় চট্টগ্রাম।
আমিরের রেকর্ড গড়া স্পেল
মোহাম্মদ আমিরের প্রতিভা, সামর্থ্য সবারই জানা আছে। বল হাতে আগুন ঝরানো স্পেল উপহার দিয়েছেন বিপিএলেও। প্রথম কোয়ালিফায়ারে তার দুরন্ত স্পেলেই রাজশাহীকে হারিয়ে ফাইনালে উঠেছিল খুলনা। সেদিন ১৭ রানে ৬ উইকেট তুলে নিয়েছিলেন এই পাকিস্তানি বাঁহাতি পেসার, যা টি-টোয়েন্টিতে তার ক্যারিয়ারসেরা বোলিং। একইভাবে, বিপিএলের ইতিহাসেও এটি সেরা বোলিংয়ের রেকর্ড।
খুলনা আগে ব্যাট করে ১৫৮ রান তোলে। ১৫৯ রানের টার্গেটে খেলতে নেমে আমিরের বোলিংয়ে চোখে সর্ষে ফুল দেখার যোগাড় হয় রাজশাহীর ব্যাটসম্যানদের। ৩ ওভারের স্পেলে ১২ রান দিয়ে ৪ উইকেট নেন তিনি। লিটন, আফিফ, অলক কাপালি ও আন্দ্রে রাসেলকে ফেরান তিনি। ৩৩ রানে ৬ উইকেট হারানোর ধাক্কা আর কাটিয়ে উঠতে পারেনি রাজশাহী। দ্বিতীয় স্পেলে এসে আরও দুই উইকেট নিয়ে ম্যাচ সেরা হন আমির।
নব্বইয়ে বন্দী মুশফিক
টি-টোয়েন্টিতে কোনো সেঞ্চুরি নেই তার। এবার বিপিএলে সেই আক্ষেপ ঘুচানোর টার্গেট নিয়েছিলেন মুশফিক। সংবাদ মাধ্যমেও বলেছেন, সেঞ্চুরি চাই-ই চাই। কিন্তু ভাগ্যের নির্মমতা এমনই যে, দুইবার সেঞ্চুরির কাছে গিয়েও লক্ষ্য পূরণ করতে পারেননি, ব্যর্থ হয়ে ফিরেছেন। ১৭ ডিসেম্বর রাজশাহীর বিপক্ষে ৯৬ রানে আচমকা মনঃসংযোগ হারান মুশফিক। রবি বোপারার সাদামাটা বলে ক্যাচ তুলে ফিরে আসেন।
এরপর ১০ জানুয়ারি কুমিল্লার বিরুদ্ধে ২ রানের জন্য সেঞ্চুরি বঞ্চিত হন মুশফিক, ৫৭ বলে অপরাজিত ৯৮ রান করেন। শেষ বলে চার মারলেই সেঞ্চুরি হতে পারতো। সৌম্যর করা ফুলটস বল পেয়েও ঠিকমতো ব্যাটে-বলে করতে পারেননি তিনি। তাই সেঞ্চুরি না পাওয়ার আক্ষেপ নিয়েই ফিরতে হয় তাকে।
বড় প্রাপ্তি বিশ্বমানের উইকেট
বিপিএলের গত ছয় আসরে পিচ নিয়ে উইকেট নিয়ে কোচ, ক্রিকেটার, কর্মকর্তাদের অভিযোগের অন্ত ছিল না। টি-টোয়েন্টি ম্যাচে স্লো-লো স্পিননির্ভর উইকেটের সমালোচনায় মুখর ছিল গণমাধ্যমও। তবে বঙ্গবন্ধু বিপিএলের সেই ধারা ভেঙে গেছে। সপ্তম আসরের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি মূলত বিশ্বমানের উইকেট; যেখানে ব্যাটসম্যানরা রান পেয়েছেন, স্পিনাররা কিছুটা সংগ্রাম করলেও পেস বোলাররা উইকেট নিয়েছেন। সবার জন্য সুবিধা ছিল উইকেটে।
বিপিএলে এবার আটবার দুইশ’ ছাড়ানো রান হয়েছে। মিরপুর স্টেডিয়ামে তিনবার, চট্টগ্রামে পাঁচবার দুইশ’র বেশি রান তুলতে দেখা গেছে দলগুলোকে। সংস্কারের পরপরই খেলা গড়ানো সিলেটও খুব পিছিয়ে ছিল না। সিলেট আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামে দলগত সর্বোচ্চ ছিল ৫ উইকেটে ১৯৯ রান।
এই টুর্নামেন্টে ব্যাটসম্যানরা মোট ৬২১টি ছক্কা ও ১১৪৫ টি চার মেরেছেন। সর্বোচ্চ ২৩টি ছক্কা মেরেছেন রাইলি রুশো। সর্বোচ্চ ৫১টি চার মেরেছেন মুশফিক।
সপ্তম আসরে দলগত সর্বোচ্চ স্কোর ছিল চট্টগ্রাম চ্যালেঞ্জার্সের গড়া। গত ২০ ডিসেম্বর কুমিল্লা ওয়ারিয়র্সের বিরুদ্ধে চট্টগ্রামে ৪ উইকেটে ২৩৮ রান তুলেছিল স্বাগতিকরা। যা বিপিএলের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। দলগত সর্বোচ্চ রানের রেকর্ডটি রংপুর রাইডার্সের দখলে। ষষ্ঠ আসরে গত বছর ২৫ জানুয়ারি চট্টগ্রামেই স্বাগতিকদের বিরুদ্ধে ৪ উইকেটে ২৩৯ রান তুলেছিল রংপুর।
এই আসরে সেঞ্চুরি হয়েছে তিনটি। খুলনা টাইগার্সের হয়ে ঢাকা প্লাটুনের বিপক্ষে নাজমুল হোসেন শান্ত ৫৭ বলে অপরাজিত ১১৫ রান (৮ চার, ৭ ছয়) করেছিলেন। খুলনার বিরুদ্ধে সিলেট থান্ডারের আন্দ্রে ফ্লেচার ৫৭ বলে অপরাজিত ১০৩ রান (১১ চার, ৫ ছয়) করেছিলেন। রাজশাহীর বিরুদ্ধে কুমিল্লার মালান ৫৪ বলে ১০০ রান (৯ চার, ৫ ছয়) করেন।
মুশফিক উবাচ
ফাইনাল শেষে মুশফিকও বিপিএলের উইকেটের প্রশংসা করেছেন। মুশফিক বলেছেন,
‘ঢাকা এবং চিটাগংয়ের কিউরেটরদের ধন্যবাদ দিতে চাই। আপনি যদি পুরো বিপিএল দেখেন, স্পিনারদের জন্য অনেক কঠিন ছিল। উইকেট অনেক ফ্ল্যাট ছিল, তাদের ভ্যারিয়েশন অনেক কম ছিল। আগের বিপিএলে অনেক দেখেছি, অনেক হেল্প পাচ্ছিল, তারা পাওয়ার প্লেতে সহজে তিন-চার ওভার বোলিং করতে পারছে। এই রকম উইকেটে যদি বেশিরভাগ সময় খেলা হয়, এসব উইকেটে খেলা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও বাংলাদেশ দলকে সাহায্য করবে।’
মুশফিক বলেছেন,
‘এটা শুধু বাংলাদেশ দলের জন্য না, যেকোনো দলের জন্য টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে অনেক বেটার। আমাদের জাতীয় দলে এমন প্লেয়ার অনেক কম, যারা ১৪০ বা ১৫০-এর বেশি স্ট্রাইক রেটে ব্যাটিং করি। এরকম উইকেটে যখন ১৮০ সেট করবেন, বা চেজ করবেন ২০০, তখন কনফিডেন্সটা বাড়বে। বিশ্বে উইকেট কিন্তু এমনই থাকে, ফ্ল্যাট।’
মুশফিক বোলারদের জন্যও উন্নতির সুযোগ দেখছেন,
‘আমার মনে হয়, তাদেরও কাজ করার বাকি আছে। তারাও চ্যালেঞ্জ নিবে, কীভাবে ভ্যারিয়েশনগুলো বের করা যায় আরও। যেন পাওয়ারপ্লে এবং ডেথ ওভারে যেন আরও কম রান দিতে পারি। এটা খুবই ভালো একটা দিক।’