অর্থনীতিতে একটা সূত্র আছে, চাহিদা এবং যোগান বিষয়ক। কোনো জিনিসের চাহিদা সবসময় তার গুণগত মানের জন্য বাড়ে না। বরং অনেক সময় খুব কম দামী জিনিসেরও অপ্রতুলতার জন্য চাহিদা বেড়ে যায়। আমাদের দেশে পানির কোনো অভাব নেই, অথচ পৃথিবীর অনেক দেশেই অনেক টাকা খরচ করে নিত্যদিনের পানির প্রয়োজন মেটাতে হয়। মোদ্দা কথা হচ্ছে, গুণগত মান বেশি হলেও, যোগান বেশি থাকার কারণে চাহিদা কমে যেতে পারে।
এই লেখায় এমন কয়েকজন ক্রিকেটার সম্পর্কে আলোচনা করা হবে, যারা কিনা যোগ্যতার দিক থেকে চমৎকার ছিলেন, কেউ কেউ স্বল্প সুযোগে নিজেদের প্রমাণও করেছিলেন। কিন্তু পর্যাপ্ত সুযোগ না থাকায় তারা দলে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পারেননি। এজন্য সাধারণ মানুষ তাদের সম্পর্কে খুব ভালোভাবে জানে না।
নরেন্দ্র হিরওয়ানী
একজন বোলার তার ক্যারিয়ারের প্রথম টেস্ট খেলতে নেমে কী আশা করতে পারে? মোটামুটি বোলিং করে ১/২টি উইকেট পেলেই খুশি হওয়া উচিত তার। সর্বকালের অন্যতম সেরা স্পিনার শেন ওয়ার্ন তার প্রথম ইনিংসে ১৫০ রান দিয়ে মাত্র ১টি উইকেট পেয়েছিলেন। অথচ হিরওয়ানী তার প্রথম টেস্টের প্রথম ইনিংসেই পেয়েছিলেন ৮ উইকেট! টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে জীবনের প্রথম টেস্টে এক ইনিংসে এর চেয়ে বেশি উইকেট আর কেউই পায়নি। ৮ উইকেট পেয়েছেন মাত্র আটজন, তবে এই আট উইকেট নিতে তার চেয়েও রান কম দিয়েছেন মাত্র দু’জন।
প্রথম ইনিংসে রেকর্ডের দিক থেকে ৩য় অবস্থানে থাকলেও দ্বিতীয় ইনিংসে সেটা পুষিয়ে দিলেন। দ্বিতীয় ইনিংসে আরো ৮ উইকেট পাওয়ায় তার মোট উইকেট সংখ্যা হলো ১৬। ক্রিকেট ইতিহাসে আজ পর্যন্ত অভিষেক টেস্টে আর মাত্র ১ জন বোলার ১৬টি উইকেট নিতে পেরেছেন। এছাড়া এই পর্যন্ত টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে এক ম্যাচের সেরা বোলিং বিশ্লেষণে হিরওয়ানীর এই কীর্তিটি ৩য় অবস্থানে আছে।
তবে এত বড় কীর্তির পরেও হিরওয়ানীর টেস্ট ক্যারিয়ার ছিল মাত্র ১৭ ম্যাচের। এই ১৭ ম্যাচে ৩০.১০ গড়ে ৬৬টি উইকেটও বলার মতো তেমন কিছু নয়। তবে এই পারফর্মেন্সও হয়তো তাকে দলে জায়গা পাইয়ে দিত। কিন্তু পরবর্তীতে আরেক লেগ স্পিনার অনিল কুম্বলের উত্থান তাকে আর ফিরতে দেয়নি। আর এ কারণে কেবলমাত্র অভিষেকে সবচেয়ে ভালো বোলিং রেকর্ডটা সাথে নিয়েই অবসরে যেতে হয় হিরওয়ানীকে।
আকিব জাভেদ
খুব বেশি গতি ছিল না তার বলে। তবে নিয়ন্ত্রণে খুব পারদর্শী ছিলেন। সাথে মূল অস্ত্র হিসেবে ছিল সুইং। মূলত উইকেট টেকার বোলার না হওয়ায় টেস্টে নির্বাচকদের প্রথম পছন্দের ছিলেন না। কিন্তু রান চেকে দক্ষতা থাকায় ওয়ানডেতে খুবই কার্যকরী ছিলেন। ভারত সেটার সবচেয়ে বড় প্রমাণ পেয়েছিল শারজাহতে। ১৯৯১ সালের সেই ম্যাচে তৎকালীন রেকর্ড পর্যন্ত ওয়ানডে ইতিহাসের দ্বিতীয় বোলার হিসেবে পান এক ইনিংসে ৭ উইকেট। এক ইনিংসে সেরা বোলিং ফিগারের রেকর্ডটা টিকে ছিল ৯ বছর।
সেরা বোলিংয়ের রেকর্ডটা ভেঙে গেলেও দুটো রেকর্ড এখনো রয়ে গেছে। সেগুলো হলো, সবচেয়ে কম বয়সে (১৯ বছর ৮১ দিন) হ্যাটট্রিক করার কীর্তি, আর একমাত্র বোলার হিসেবে হ্যাটট্রিকের তিনটি আউটই এল.বি.ডাব্লিউ এর মাধ্যমে পাওয়া। সেই সময়ে পাকিস্তান বাদে অন্য যেকোনো দলে সুযোগ পেলেই সেই দলের স্ট্রাইক বোলার হতে পারতেন।
কিন্তু তিনি পাকিস্তান দলেই নিয়মিত সুযোগ পাননি। পাবেন কীভাবে? অভাগা যে জন্মেছিলেন টু ডব্লিউ-এর আমলে। সেই সময়ে ওয়াকার আর ওয়াসিম জুটি এতটাই ভীতিকর ছিলেন যে, আকিব জাভেদকে দল নির্বাচন করার সুযোগ দিলেও সম্ভবত তিনি নিজেকে বাদ দিয়ে ওদের দুজনকেই রাখতেন।
পাকিস্তানের নির্বাচকরাও তাই করেছিলেন। আর এ কারণেই ক্যারিয়ারটা পূর্ণতা পায়নি তার। ওয়াসিম কিংবা ওয়াকারের অনুপস্থিতিতেই কেবল দলে জায়গা মিলতো। শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলা হয়েছে ১৯৯৮ সালে মাত্র ২৬ বছর বয়সেই, যে বয়সে কিনা অনেক খেলোয়াড়ের জাতীয় দলে অভিষেক হয়।
অ্যান্থনি স্টুয়ার্ট
মনে করুন, কোনো বোলার তার ৩য় আন্তর্জাতিক ম্যাচেই হ্যাটট্রিক করলেন, ম্যাচ ফিগার ২৬ রানে ৫ উইকেট। এরপর তার ক্যারিয়ার কোন দিকে যেতে পারে?
নিদেনপক্ষে আরো কয়েকটা ম্যাচ খেলার সুযোগ তো পাবেন তিনি। কিন্তু অ্যান্থনি স্টুয়ার্ট সেটাও পাননি। পাবেন কীভাবে? তখন যে অস্ট্রেলিয়ার ফাস্ট বোলিংয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছেন পল রেইফেল, গ্লেন ম্যাকগ্রার মতো বোলার। এদের মাঝে নিজের জায়গা করে নেওয়ার জন্য সুযোগটাই তিনি করে নিতে পারেননি। তাই মাত্র ৩টি আন্তর্জাতিক ম্যাচে ৩.৬৩ ইকোনমি আর ১৩.৬৩ গড়ে ৮টি উইকেট নিয়েও আর দলে জায়গা পাননি স্টুয়ার্ট। পরবর্তীতে ক্রিকেট থেকে সরে গিয়ে অন্য ক্যারিয়ারে মনোযোগী হয়ে পড়েন তিনি।
স্টুয়ার্ট ম্যাকগিল
৪৪টি টেস্ট ম্যাচে ২৯.০২ গড়ে ২০৮ উইকেট। একজন লেগ স্পিনারের জন্য এটা খারাপ পারফর্মেন্স না। তবে আপনি যখন জানবেন, ক্যারিয়ারের প্রথম ৯ টেস্টেই সেই বোলার ২১.৩০ গড়ে ৫০টি টেস্ট উইকেট পেয়ে গিয়েছিলেন, তখন বাকি পারফর্মেন্সটাকে সাদামাটা মনে হওয়াটা স্বাভাবিক। তিনি জন্মেছিলেন সর্বকালের সেরা লেগ স্পিনার (অনেকের মতে সর্বকালের সেরা স্পিনার। পেস/স্পিনারের বিভাজন বাদ দিলেও প্রথম পাঁচে তো থাকবেনই) শেন ওয়ার্নের সময়ে।
অথচ ক্যারিয়ারের অনেক পরিসংখ্যানেই শেন ওয়ার্নের চেয়ে বেশ বড় ব্যবধানেই এগিয়ে ছিলেন ম্যাকগিল। ৫০টি টেস্ট উইকেট পেতে ওয়ার্নকে খেলতে হয়েছিল ১৪টি টেস্ট, প্রথম ৯ টেস্ট শেষে ওয়ার্নের সংগ্রহ ছিল মাত্র ২১টি উইকেট। দুজনেই একত্রে খেলেছেন এমন টেস্টগুলোতে ম্যাকগিলের সংগ্রহ ২২ গড়ে ৭৫ উইকেট; বিপরীতে ওয়ার্নের সংগ্রহ ৩০.৭৩ গড়ে ৬৬টি।
কিন্তু এরপরেও সবসময় অস্ট্রেলিয়ার প্রথম পছন্দ সেই ওয়ার্নই ছিলেন। লোয়ার অর্ডারে ব্যাটিং আর স্লিপে ক্যাচিং দক্ষতা, সাথে ক্ষুরধার ক্রিকেট মস্তিস্ক- ওয়ার্নের এমন সব পরিচয়ের সামনে তার জায়গায় তাই ম্যাকগিল নিজেকে দাবিও করতে পারেননি।
এ তো গেল টেস্ট ক্যারিয়ারের কথা। জীবনের প্রথম ওয়ানডে খেলতে যখন নামলেন ম্যাকগিল, তখন পাকিস্তানি আবদুর রাজ্জাক সুপার ফর্মে। গ্লেন ম্যাকগ্রার ১ ওভারে ৫টি চার মেরে পাকিস্তান দলকে ম্যাচে ফেরানোর চেষ্টায় ছিলেন তিনি। উন্মত্ত আবদুর রাজ্জাককে ফেরালেন ম্যাকগিল। ম্যাচ ফিগার ১৯ রানে ৪ উইকেট, সাথে ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরষ্কার।
৩ ম্যাচে ১৭.৫০ গড়ে ৬ উইকেট, এই ক্যারিয়ার নিয়েই ওয়ানডে ক্যারিয়ারের সমাপ্তি ঘটে ম্যাকগিলের। শেন ওয়ার্ন অবসর নেবার পর অনেকদিন ধরে ওয়ার্নের কাছাকাছি মানের কোনো স্পিনার অস্ট্রেলিয়া পাননি। আফসোস, এই সময়ে যদি ম্যাকগিল জন্মাতেন। আফসোস শুধু ম্যাকগিলের নয়, অস্ট্রেলিয়ারও অবশ্যই।
অমল মজুমদার
তাকে বলা হতো ভারতের সম্ভাবনাময় শচীন টেন্ডুলকার। ১৯৯৪ সালে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে অভিষেক হয় তার এবং অভিষেকেই মুম্বাইয়ের হয়ে ২৬০ রানের একটি ইনিংস খেলেন। পরবর্তী ১৫ বছর ধরে তিনি মুম্বাইয়ের ব্যাটিং অর্ডারের মূল খেলোয়াড়দের মাঝে একজন ছিলেন।
তার টেকনিক এবং ট্যালেন্ট দুটোই দুর্দান্ত ছিল। ১৯৯৫ সালে ইংল্যান্ড ‘এ’ দলের বিপক্ষে তিনি এবং আরেকজন উদীয়মান তরুণ রাহুল দ্রাবিড় সুযোগ পেলেন নিজেদের দেখানোর জন্য। আনঅফিশিয়াল টেস্ট সিরিজে তিনি ব্যর্থ হলেও ওয়ানডে সিরিজে ৭৯ আর ৬৯ রানের দুটো ইনিংস খেললেন। কিন্তু বড় দৈর্ঘ্যের ম্যাচে পারফর্মেন্সের কারণে তুলনামূলক বিচারে দ্রাবিড়ের কাছে হেরে গেলেন। যখন তার ক্যারিয়ার গড়ার সময়, তখন ভারতের মিডল অর্ডারে রাজত্ব করেছেন দ্রাবিড়, টেন্ডুলকার, লক্ষণ আর গাঙ্গুলী। সারা জীবন তাই অপেক্ষা করেই কাটাতে হয়েছে তাকে। অপেক্ষার পালা অবশ্য ক্যারিয়ারে তার নিত্যসঙ্গীই ছিল। শচীন টেন্ডুলকার আর বিনোদ কাম্বলীর রেকর্ড ৬৬৪ রানের পার্টনারশিপের সেই ম্যাচটাতে প্যাড পরে দু’দিন বসে ছিলেন ১৩ বছর বয়সী অমল মজুমদার।
কারো কারো ভাগ্যে অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনো অপশনই হয়তো থাকে না।