৯ নভেম্বর ২০১৯। জার্মানির সেরা দুই দল বায়ার্ন মিউনিখ আর বরুশিয়া ডর্টমুন্ডের ‘ডার ক্লাসিকার’ শুরু হতে আর কিছুক্ষণ বাকি। এমন সময় বায়ার্নের ট্রেবলজয়ী ম্যানেজার ইয়ুপ হেইংকেসের মোবাইল ফোন বেজে উঠল। ফোন করেছেন বায়ার্নের সহকারী কোচ থেকে হেড কোচ হিসেবে সদ্য দায়িত্ব নেওয়া হান্স-ডিটার ফ্লিক। নার্ভাস ফ্লিক তার একসময়ের গুরুকে প্রশ্ন করলেন, ‘আমি কি পারবো?’ হেইংকেসের উত্তর ছিল, ‘আরে, চিন্তা করো না। ৩-০ বা ৪-০ গোলে জিতবে। আমি আমার বায়ার্নকে চিনি।’ লেভানডস্কির জোড়া গোলে সেই ম্যাচ বায়ার্ন জিতে নিল ৪-০ গোলে।
এর ঠিক এক সপ্তাহ আগে দলের পরিস্থিতি ছিল ঠিক উল্টো। কোচ নিকো কোভাচের সাবেক দল আইনট্র্যাখ্ট্ ফ্রাঙ্কফুর্টের কাছে বিধ্বস্ত হয়েছে বায়ার্ন। ম্যাচ শুরু হওয়ার ৯ মিনিটের মধ্যেই জেরোম বোয়াটেং লালকার্ড দেখে বিদায় নেওয়ার পর গুনে গুনে ৫ বার বায়ার্নের জালে বল জড়িয়েছে তারা। বুন্দেসলিগায় এর আগে কখনোই এত গোল হজম করার দুর্ভাগ্য হয়নি অধিনায়ক ম্যানুয়েল নয়্যারের। টেবিলের ৪ নাম্বারে থাকা বায়ার্নের খেলোয়াড়দের বডি ল্যাঙ্গুয়েজও পরিষ্কারভাবে জানান দিচ্ছে সেই জয়ের ক্ষুধার লেশমাত্রও নেই তাদের মধ্যে।
এই হতাশাজনক পারফরম্যান্সের বোঝা মাথায় নিয়েই পরদিন নিকো কোভাচ স্বেচ্ছায় ম্যানেজার হিসেবে পদত্যাগ করলেন, অথচ তার গড়ে তোলা ফ্রাঙ্কফুর্টের কাছেই ডিএফবি কাপ ফাইনালে ইয়ুপ হেইঙ্কেসের বায়ার্ন হেরে যাওয়ার পর মনে হয়েছিল তিনিই বায়ার্নের হাল ধরার যোগ্য। মাঝখানের এক মৌসুম লিগ আর কাপ জিতলেও গার্দিওলা আর কার্লো আনচেলোত্তির মতো তিনিও ইউরোপের বড় দলগুলোর কাছে ধরাশায়ী হয়ে পড়লেন। লিগও জিতেছেন খুব কম ব্যবধান রেখেই। শেষমেশ ফ্রাঙ্কফুর্টের কাছে হারার পরদিনই ক্লাব ছাড়ার সিদ্ধান্ত পাকাপোক্ত করলেন তিনি। এদিকে মৌসুমের মাঝপথে হেইঙ্কেসের পরামর্শে কোভাচের সহকারী ফ্লিকের উপরেই আস্থা রেখে তাকে অন্তর্বর্তীকালীন হেড কোচ হিসেবে নিয়োগ দিলেন বায়ার্ন সিইও কার্ল হেইন রুমেনিগা। ফলটাও এলো খুব দ্রুত।
মাঝমাঠ থেকে ডাগআউটে
নিকো কোভাচের সহকারী হিসেবে আসলেও হান্সি ফ্লিক বায়ার্নে একেবারে অপরিচিত মুখ নন। জার্মানির থার্ড ডিভিশনে খেলা স্যান্ডহাউজেনের ২০ বছর বয়সী মিডফিল্ডার ফ্লিক নজর কাড়েন তৎকালীন বায়ার্ন ম্যানেজার উডো লাটেকের। উডো লাটেক এবং তার পরবর্তী ইয়ুপ হেইংকেসের দলে অনেকটা নিয়মিতই ছিলেন তিনি, ৫ বছর বায়ার্নে থাকাকালীন জিতেছেন ৪টি বুন্দেসলিগাসহ ৫টি ঘরোয়া শিরোপা। ১৯৮৭-এর ইউরোপিয়ান কাপের ফাইনালে পোর্তোর কাছে শেষ ১৫ মিনিটে ২ গোল হজম করে খেলোয়াড় হিসেবে ইউরোপসেরা হওয়ার স্বপ্ন অধরা থেকে যায় ফ্লিকের।
বায়ার্ন ছেড়ে কোলনে গিয়ে আরো ৩ বছর কাটানোর পর ভয়াবহ ইঞ্জুরিতে পড়ে নিজের পেশাদার খেলোয়াড়ি ক্যারিয়ারের ইতি টানেন ২৮ বছর বয়সী ফ্লিক। এরপর যোগ দেন নিজের স্থানীয় ক্লাব ভিক্টোরিয়া বামেন্টালে একইসাথে ম্যানেজার এবং খেলোয়াড় হিসেবে। ৭ বছর বামেন্টালে কাটানোর পর ২০০০ সালে জার্মানির ফোর্থ ডিভিশনের ক্লাব টিএসজি হফেনহেইম তাকে ম্যানেজার হিসেবে নিয়োগ দেয়। প্রথম সিজনেই দলকে নিয়ে থার্ড ডিভিশনে ওঠার পর পরবর্তী ৪ বছরে সেকেন্ড ডিভিশনে উঠতে ব্যর্থ হলে ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব ছেড়ে দেন। এরপর কিছুদিন স্টুটগার্টে ইতালির কিংবদন্তি ম্যানেজার জিওভান্নি ত্রাপাত্তোনির সহকারী হিসেবে কাজ করেন। আর তার কাছ থেকেই আয়ত্ত্ব করেন দলের খেলোয়াড়দের সাথে ম্যানেজারদের সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিৎ, সাথে ট্যাকটিক্সের বিস্তারিত জ্ঞান। তবে ত্রাপাত্তোনির ‘ডিফেন্স-ফার্স্ট’ দর্শনের বিরোধী ছিলেন তিনি। আর এই সময়েই তার কাছে আসে ক্যারিয়ারের মোড় ঘুরানো এক সুযোগ।
২০০৬ বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল হেরে ইয়ুর্গেন ক্লিন্সম্যানের বিদায়ের পর জার্মানির জাতীয় ফুটবল দলের কোচ হিসেবে নিয়োগ পান ইওয়াখিম লো। লো তার সহকারী হিসেবে ডেকে নেন ফ্লিককে। এই সুযোগ হাতছাড়া করেননি ফ্লিক। একে একে ২০০৮ ইউরোর রানার্সআপ, ২০১০ বিশ্বকাপের তৃতীয় স্থান, ২০১২ ইউরোর সেমিফাইনালের পর অবশেষে ব্রাজিলে সাফল্য ধরা দেয় হাতের মুঠোয়। জার্মানিকে চতুর্থ বিশ্বকাপের স্বাদ পাইয়ে দিয়ে জাতীয় দলের সহকারী ম্যানেজার থেকে সরে দাঁড়ান তিনি, দায়িত্ব পান স্পোর্টিং ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করার। আড়াই বছর সেখানে থাকার পর আরো ৭ মাস হফেনহাইমের স্পোর্টিং ডিরেক্টর হিসেবে ছিলেন তিনি। এরপর প্রায় ১৬ মাসের দীর্ঘ বিরতিতে ছিলেন ফ্লিক। যখন ফিরে আসেন, তখন তার সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ; বায়ার্নে ১ মৌসুম ধরে ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করা নিকো কোভাচের সহকারী হিসেবে কাজ করা, লক্ষ্য ইউরোপ জয়।
কোভাচের ব্যর্থতা
হেইংকেসের উত্তরসূরি হিসেবে আসা ক্রোয়েশীয় নিকো কোভাচ ট্যাকটিশিয়ান হিসেবে বেশ দুর্বল ছিলেন। গার্দিওলা কিংবা আনচেলত্তির মতো পজেশন-নির্ভর ফুটবল খেললেও কোভাচের দর্শনের সবচেয়ে বড় ফাঁক ছিল তার মাঝমাঠে। হাই-লাইন ডিফেন্স এবং আরো হাই-লাইন আক্রমণভাগের মাঝখানের অংশটুকু ছিল পুরোটাই ফাঁকা। এই দুই লাইনের মাঝখানের একমাত্র যোগসূত্র ছিল দুই উইং। কিন্তু প্রতিম্যাচে একই পদ্ধতিতে খেলানো কোভাচের এই ট্যাকটিক্স অনুমান করেই মাঝমাঠের স্পেসকে কাজে লাগিয়ে এই আক্রমণ প্রতিহত তৈরি করার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে রাখতো প্রতিপক্ষের দল। এছাড়াও উইঙ্গারদের সাথে তাল মিলিয়ে ফরোয়ার্ডরাও ঠিক সময়ে জায়গামতো পৌঁছাতে না পারায় বেশিরভাগ আক্রমণ ব্যর্থ হতো। ম্যুলারের ‘রাউমডয়টার’ স্কিল ব্যবহার করতেও ব্যর্থ হয়েছেন কোভাচ।
তবে এই ইউ-আকৃতির ফরমেশনের কারণে সবচেয়ে ঝুঁকিতে ছিল বায়ার্নের রক্ষণভাগ। বায়ার্নের হাই-লাইন ডিফেন্স আর মাঝের ফাঁকা অংশকে কাজে লাগিয়ে প্রতিপক্ষ কাউন্টার অ্যাটাক করলেই বায়ার্নের ডিফেন্ডাররা নিজেদেরকে খুঁজে পেত প্রতিপক্ষের একঝাঁক ফরোয়ার্ড আর মিডফিল্ডারদের মধ্যে। আর এর ফলে ২০১৪ সালে গার্দিওলা দায়িত্ব নেওয়ার পর লিগে এক মৌসুমে সর্বোচ্চ ৩২ গোল হজম করতে হয়েছে বায়ার্নকে। পয়েন্টের দিক থেকেও সবচেয়ে নিচে ছিল কোভাচের বায়ার্ন।
কোভাচের আমলে বায়ার্নের বড় সমস্যা ছিল তার সাথে খেলোয়াড়দের সম্পর্ক। অতিমাত্রায় রোটেশন করার কারণে কোভাচের প্রতি অসন্তুষ্ট ছিল বায়ার্নের খেলোয়াড়েরা। হামেস, বোয়াটেং বা দলের যেকোনো খেলোয়াড়ই কোনো ম্যাচে ভালো পারফর্ম করলেও তারপরের ম্যাচে বসিয়ে রাখা হতো। গ্যানাব্রিকে পরপর ৩ ম্যাচে ৩ পজিশনে খেলিয়েছেন কোভাচ, পাভার যদি এক ম্যাচ রাইটব্যাক হিসেবে খেলেন, তবে পরবর্তী ম্যাচে তার জায়গা হয়েছে লেফটব্যাক কিংবা সেন্টার ডিফেন্ডার হিসেবে। বায়ার্ন প্রেসিডেন্ট উলি হোয়েনেসও কোভাচের এই নিয়মের সমালোচনা করেছিলেন।
তবে বায়ার্নে কোভাচের দর্শনের সবচেয়ে বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল কোভাচের নিজের ট্যাকটিক্সের সমালোচনা উড়িয়ে দেওয়া এবং খেলোয়াড়দেরকে ছোট করে ট্যাকটিক্সের ব্যর্থতার দায় তাদের ওপর চাপানো। বায়ার্ন ক্লপের লিভারপুলের মতো খেলতে পারবে কিনা জিজ্ঞাসা করা হলে তার উত্তর ছিল,
‘১০০ কি.মি. গতিতে চলতে পারা সামর্থ্যের গাড়ি দিয়ে আপনি ২০০ কি.মি. গতিতে গাড়ি চালাতে পারবেন না’।
বোখামের মতো দুর্বল দলের সাথে কোনোমতে জয়ের পরও তিনি খেলোয়াড়দের মনোভাবকে দায়ী করেছিলেন।
“এখানে একটু বেশিই খেলোয়াড় আছে, যারা বেশি ভুল পাস খেলে। আপনার সেই ধরনের খেলোয়াড় দলে থাকতে হবে, যারা এ ধরনের প্রেসিং গেম খেলতে অভ্যস্ত।”
চ্যাম্পিয়নস লিগের রাউন্ড অফ সিক্সটিনে প্রথম লেগে গোলশূন্য ড্র করে দ্বিতীয় লেগে ৩-১ গোলে হারার পর লেভানডস্কি কোভাচের ট্যাকটিক্সকে সমালোচনা করে বলেছিলেন,
‘আমার মনে হয় আমরা একটু বেশি ডিপে খেলেছি, বেশি ঝুঁকি নিতে চাইনি, এবং আমি জানি না কেন।’
এদিকে আক্রমণ না করে চুপচাপ রক্ষণ সামলানো কোভাচের জবাব ছিল,
“আমরা আমাদের চেয়ে ভালো প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে খেলেছি, যারা এই জয়ের যোগ্য।”
একদিকে খেলোয়াড়দের অসন্তুষ্টি, অন্যদিকে লিগে ক্রমাগত ব্যর্থতা কোভাচের পদত্যাগের জন্য যথেষ্ট ছিল। ফ্রাঙ্কফুর্টের কাছে ৫-১ গোলের হার সেই সত্যকেই বাস্তবে পরিণত করলো। পদত্যাগের পর বায়ার্ন সিইও রুমেনিগা মন্তব্য করেছিলেন,
“তার সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল নিজের ভুলগুলো না দেখা।”
ফ্লিক: দ্য রেকর্ড ব্রেকার
অন্তর্বতীকালীন কোচ হিসেবে নিয়োগ পাওয়া ফ্লিকের প্রথম চার ম্যাচের স্কোরবোর্ড ছিল এমন: ২-০, ৪-০, ৪-০, ৬-০। এর মধ্যে প্রথম ও শেষটি চ্যাম্পিয়নস লিগের ম্যাচ। তবে এর ঠিক পরই যখন বায়ার্ন বুন্দেসলিগায় টানা ২ ম্যাচ ২-১ ব্যবধানে হারল, তখন অনেকেই ভেবেছিল ফ্লিক কিছুদিনের জন্য ডাগআউটের সিট গরম করতে এসেছেন। তবে সেটাই ছিল সমালোচকদের শেষ সমালোচনা। এরপর ফ্লিক শুধু রেকর্ড ভেঙেছেন।
মৌসুমশেষে ফ্লিকের বায়ার্ন ৩৫ ম্যাচের ৩২টিতে জয়লাভ করেছে, হেরেছে ঐ দুটো ম্যাচই। বায়ার্নের ইতিহাসে এর আগে আর কোনো কোচই এত ভালো শুরু করতে পারেনি, এমনকি প্রথম ট্রেবল-জেতা হেইংকেসও না। পয়েন্টের দিক থেকেও হেইংকেসের ম্যাচপ্রতি ২.৭ গড় পয়েন্টের রেকর্ড ভেঙে দিয়েছেন ফ্লিক, যেখানে তার ম্যাচপ্রতি পয়েন্ট ২.৭৮। চ্যাম্পিয়নস লিগের ইতিহাসে প্রথম দল হিসেবে সবগুলো ম্যাচে জয় নিয়ে লিসবন থেকে ষষ্ঠবারের মতো ইউরোপসেরা হওয়ার ট্রফি নিয়ে মিউনিখে ফিরেছে বায়ার্ন, একইসাথে ১১ ম্যাচে ৪৩ গোল করে ম্যাচপ্রতি ৩.৯ গোল নিয়ে রেকর্ড গড়েছে। লিগেও ম্যাচপ্রতি গোল ৩-এর বেশি। বায়ার্নকে এত ক্ষুধার্ত দল হিসেবে পরিণত করতে পারেনি এর আগের কোনো কোচই, বার্সেলোনার ৮-২ গোলের ভরাডুবিই এর প্রমাণ।
ফ্লিকের অধীনে বায়ার্নের খেলোয়াড়েরাও হয়ে উঠেছে অপ্রতিরোধ্য। ৪৭ ম্যাচে ৫৫ গোল করা লেভানডস্কি ৩টি টুর্নামেন্টেই সর্বোচ্চ গোল করেছেন, বুন্দেসলিগার ইতিহাসে এক মৌসুমে সর্বোচ্চ ২১ অ্যাসিস্ট করার রেকর্ড গড়েছেন ম্যুলারও। গোলবার রক্ষা করা নয়্যারও রয়েছেন তার সেরা ফর্মে। কিন্তু বায়ার্নকে দ্বিতীয়বার ট্রেবল এনে দেওয়া ফ্লিক কোনোরকম নতুন খেলোয়াড় না এনেই কীভাবে দলকে সম্পূর্ণ পাল্টিয়ে দিয়েছেন? মৌসুমের শেষ পর্যন্ত অন্তর্বর্তীকালীন কোচ হওয়ার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে কীভাবেই বা ২০২৩ সাল পর্যন্ত বায়ার্নের ম্যানেজার হিসেবে কন্ট্রাক্ট বাগিয়ে নিয়েছেন?
হান্সি ‘দ্য ট্যাকটিশিয়ান’ ফ্লিক
ফ্লিক কোভাচের মতো প্রতি ম্যাচে দলে রোটেশন করেননি। প্রায় প্রত্যেক খেলোয়াড়েরই পজিশন নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। হাতেগোনা কয়েকজন খেলোয়াড়কে এদিক-ওদিক করেছেন। গোলবার সামলানোর জন্য অধিনায়ক নয়্যারের উপরই আস্থা রেখেছেন, তার সামনে সেন্টারব্যাক হিসেবে আলাবা আর বোয়াটেং-এরও পরিবর্তন করেননি, মাঝেমধ্যে তাদের পরিবর্তে হার্নান্দেজ আর নিকোলাস শ্যুলে’কে খেলিয়েছেন। বুন্দেসলিগায় গতির রেকর্ড ভেঙে দেওয়া ডেভিস বায়ার্নের বামপাশের রক্ষণ থেকে আক্রমণভাগ সবই সামলিয়েছেন। রাইটব্যাক হিসেবে বেঞ্জামিন পাভার, আর তার অনুপস্থিতিতে ইয়োশুয়া কিমিখকেই কাজে লাগিয়েছেন ফ্লিক।
৪-২-৩-১ ফরমেশনে মাঝমাঠের ডাবল পিভট পজিশনে ফ্লিক একজনকে রক্ষণের দায়িত্বে আরেকজনকে আক্রমণ করার দায়িত্বে খেলিয়েছেন। থিয়াগো আর গোরেৎজকাকে দিয়েই এই দুই পজিশন ভরাট করেছেন ফ্লিক, মাঝেমধ্যে হাভি মার্তিনেজ সুযোগ পেলেও ফ্লিকের মূল পরিকল্পনায় মার্তিনেজের জায়গা ছিল না। মৌসুমের মাঝমাঝি সময়ে ম্যুলারকেও এই পজিশনে খেলতে দেখা গেছে, তবে শেষদিকে ম্যুলারের জায়গা হয়েছে লেভানডস্কির ঠিক পেছনে।
লেফট উইঙ্গার হিসেবে পেরিসিচ, কোমান আর কৌতিনহো – ৩ জনকেই সমানভাবে ব্যবহার করেছেন ফ্লিক। ম্যুলার পিভোট পজিশনে খেললে সেন্ট্রাল অ্যাটাকিং মিডফিল্ডারের জায়গা পূরণ করেছেন তোলিসো, কোমান আর ন্যাব্রি। লিগ ম্যাচে কিমিখকে রাইট উইঙ্গার হিসেবে অনেকগুলো ম্যাচ খেলিয়েছেন ফ্লিক, তবে মৌসুমে শেষদিকে সে জায়গায় নিজেকে পাকাপোক্ত করেছেন ন্যাব্রি।
মিডফিল্ডে ফ্লিক বেশ কিছু রোটেশন আনলেও রক্ষণভাগের মতো আক্রমণভাগও অপরিবর্তিত ছিল লেভানডস্কির অসাধারণ পারফরম্যান্সের কারণে। মাঝেমধ্যে দলের তরুণ তুর্কি জার্কজি কিছু ম্যাচ খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন, সেটি না হলে ইউরোপিয়ান গোল্ডেন বুট হয়তো লেভানডস্কির কাছেই আসতো।
ফ্লিক বিল্ড-আপকে নতুনভাবে বায়ার্নে ফিরিয়ে এনেছেন। বায়ার্নের আক্রমণ শুরু হয় রক্ষণভাগ থেকেই। দুই সেন্টারব্যাক হয় তাদের সামনে থাকা ডিফেন্ডিং পিভটের কাছে বল পাস করেন, অথবা দুই ফুলব্যাকের কাছে পাস করে উইং দিয়ে আক্রমণের চেষ্টা করেন। ফুলব্যাককে ফাঁকা না পেলে উইঙ্গারের কাছে লং-পাস দিয়ে আক্রমণের শুরু করেন। এছাড়াও ফ্লিকের বায়ার্নের আরেকটি পদ্ধতি হলো ভার্টিক্যাল পাস, যেখানে সেন্ট্রাল ডিফেন্ডাররা সরাসরি ফরোয়ার্ডদের কাছে বল পাঠিয়ে দেন। ঝুঁকিপূর্ণ হলেও ফ্লিক তার দলের খেলোয়াড়দের অসাধারণ পাসিং দক্ষতার কারণে এই ঝামেলা উতরে গেছেন। নিচের ছবিতে গোরেৎজকা কিছুটা সরে গিয়ে বোয়াটেংকে লেভানডস্কির কাছে সরাসরি বল পাচার করে দেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন প্রতিপক্ষ দলের মাঝমাঠের একেবারে ভেতর দিয়ে!
বায়ার্নের আক্রমণের আরেকটি পদ্ধতি হলো: যদি প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়রা মাঠের মাঝখানে লেভানডস্কি বা আক্রমণভাগের অন্যান্য খেলোয়াড়কে বল পাস করার রাস্তা আটকে রাখে, তবে দুই উইঙ্গারের সামনে বল ক্রস করে উইং থেকে আক্রমণের চেষ্টা করা। নিচের ছবিতে উইংয়ে ন্যাব্রিকে একা পেয়ে তার দিকে বল ক্রস করছেন কিমিখ।
ফ্লিক আক্রমণভাগকে আরো শাণিত করার জন্য প্রতিপক্ষ যাতে ম্যান-মার্কিং করে খুব বেশি সুবিধা না করতে পারে, এজন্য খেলোয়াড়দের নিজেদের পজিশন অদল-বদল করার পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন। নিচের ছবিতে ম্যুলার মাঝমাঠ থেকে বামপাশে চলে এসেছেন, নাব্রি রাইট উইং থেকে মাঝে চলে এসেছেন, অন্যদিকে লেভানডস্কি ন্যাব্রির ফাঁকা জায়গা পূরণ করতে চলে গিয়েছেন ডানপাশে।
উইঙ্গার আর উইংব্যাক পজিশনেও এই পাল্টাপাল্টি পরিবর্তনকে ব্যবহার করেছেন ফ্লিক। উইংব্যাক উইঙ্গারের কাছে পাস না দিয়ে নিজেই সরাসরি আক্রমণের সুযোগ রেখেছেন ফ্লিক। ফলে উইংব্যাক নাকি উইঙ্গারকে সামলাবে, তা নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগা প্রতিপক্ষের ফুলব্যাকের দেরি হওয়ার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে আক্রমণ করে বসেন দু’জনের যেকোনো একজন।
হাই-লাইন ডিফেন্স থাকা সত্ত্বেও কোভাচের বায়ার্নের তুলনায় ফ্লিকের বায়ার্নের গোল হজম করার হার প্রায় অর্ধেক। এর কারণ হলো বায়ার্নের আক্রমণভাগের খেলোয়াড়দের করা প্রেসিং। বল হারালেই অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার প্রতিপক্ষের দুই সেন্টার ডিফেন্ডারের কাছে চলে যান, লেভানডস্কি গোলকিপারের কাছে ব্যাকপাস করার পথ আটকে রাখেন। উইংয়ে থাকা খেলোয়াড়রা প্রতিপক্ষের ফুলব্যাকদের কাছে পাস দেওয়ার পথে বাধা তৈরি করেন। এছাড়াও প্রতিপক্ষের ফুলব্যাকদের কাছে বল চলে গেলে ওদিকে আরো ২-১ জন খেলোয়াড় চলে গিয়ে বল দখলের চেষ্টা করেন।
বায়ার্নের ভবিষ্যৎ
টানা ৮ বার লিগ জেতা বায়ার্ন ঘরোয়া কাপ শিরোপাও জিতেছে বেশ কয়েকবার। একমাত্র ইউরোপিয়ান শিরোপাই বারবার হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছিলো বায়ার্নের। শেষমেশ ৭ বছর পর ফ্লিকের হাত ধরে সেটিও চলে এলো। অসাধারণ এক মৌসুম কাটানোর পর ফ্লিককে হারাতে হচ্ছে মাঝমাঠের প্রাণভোমরা থিয়াগোকে। নতুন চ্যালেঞ্জের জন্য থিয়াগো সম্ভবত লিভারপুলে পাড়ি জমাবেন। লোনের সময়সীমা শেষ হয়ে যাওয়ার পর আক্রমণভাগের দুই ট্রাম্পকার্ড পেরিসিচ আর কৌতিনহোও নিজেদের ক্লাব ইন্টার মিলান আর বার্সেলোনায় পাড়ি জমাবেন। আক্রমণভাগের এই ফাঁকা জায়গা পূরণ করতে বায়ার্ন ইতঃমধ্যেই জার্মান ইয়াং ট্যালেন্ট লেরয় সানেকে প্রায় ৬০ মিলিয়ন ইউরো খরচ করে দলে ভিড়িয়েছে। থিয়াগোর জায়গা পূরণ করতে ফ্লিক ইন্টার মিলানের মার্সেলো ব্রোজোভিচকে দলে টানতে পারে এমন গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে।
“আমরা কিছু অসাধারণ মানের খেলোয়াড়কে হারাচ্ছি, আমাদেরকে এটিকে সামলাতে হবে। আমি যদি এই দল নিয়েই আরো কাজ করতে পারতাম, তবে সেটা আরো ভালো হতো, কিন্তু সেটা হচ্ছে না।” – হান্সি ফ্লিক
প্রথম মৌসুমেই দলকে ট্রেবল এনে দেওয়ার পর ম্যানেজার হান্সি ফ্লিকের ওপর আশার পারদ বেশ খানিকটা বেড়ে গেছে দলের ম্যানেজমেন্ট-খেলোয়াড় থেকে শুরু করে ভক্তদের মাঝেও। প্রতিটি দলকেই সাফল্য আসার পর একসময় মুখ থুবড়ে পড়তে হয়, কোনো ট্যাকটিক্সের সাফল্যের পর তাকে থামাতে আবিষ্কার হয় নতুন ট্যাকটিক্সের কিংবা পুরনো ট্যাকটিক্সই ভিন্নরূপে ফিরে আসে। হাঙ্গেরিয়ান ডব্লিউ-ডব্লিউ, ব্রাজিলিয়ান ফ্ল্যাট-ব্যাক-ফোর, ইতালিয়ান কাতেনাচ্চো কিংবা ডাচ টোটাল ফুটবল থেকে শুরু করে গেগেনপ্রেসিং, টিকিটাকা কিংবা পার্ক দ্য বাস, সব ট্যাকটিক্সকেই একসময় থামতে হয়েছে। ইউরোপিয়ান ফুটবলে বায়ার্নের নতুন যুগের সূচনা হয়েছে। তবে ফ্লিকের এই বায়ার্ন কয়েক মৌসুম ধরে রাজত্ব করবে, নাকি কিছুদিনের মধ্যেই মুখ থুবড়ে পড়বে, তা সময়ই বলে দেবে।