তাসকিন আহমেদের জন্যই কিছুটা আক্ষেপ ছিল। এবং তা শুধু সমর্থকদের মাঝেই নয়, খোদ দলের অভ্যন্তরেও বিরাজমান ছিল। তার বাইরে বাংলাদেশের বিশ্বকাপ দলটা সবার কাছেই গ্রহণযোগ্য ছিল। সামর্থ্যের সীমাবদ্ধতা হয়তো ছিল, কিন্তু বাংলাদেশে বিদ্যমান প্রতিভাবানদের সেরা সম্মীলনই ঘটেছিল বিশ্বকাপ দলে। নির্বাচক, সাবেক ক্রিকেটার, বিশ্লেষক-সমালোচক সবাই একবাক্যে মেনে নিয়েছিলেন, এটাই বিশ্বকাপ ইতিহাসে বাংলাদেশের সেরা দল। বলা বাহুল্য, বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে অভিজ্ঞ দল ছিল এটিই।
মাশরাফি বিন মুর্তজার পরীক্ষিত নেতৃত্ব, পাঁচ সিনিয়র ক্রিকেটারের অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার, তারুণ্যের বারুদ, সবই ছিল দলটাতে। দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে স্বপ্নের শুরুও এসেছিল। সাকিব আল হাসানের অসামান্য, ঈর্ষণীয় পারফরম্যান্স স্বপ্নের পালে হাওয়া যুগিয়েছে। দুর্দমনীয় মানসিকতায় টুর্নামেন্টজুড়ে বাংলাদেশ দলকে টেনেছেন বিশ্বসেরা এই অলরাউন্ডার। কিন্তু শেষ অব্দি রাজ্যের হতাশা, স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণা নিয়ে দেশে ফিরেছে বাংলাদেশ। সেমিফাইনালের স্বপ্নের সমাধি হয়ে গিয়েছিল ভারতের কাছে হেরেই। তার আগে কয়েক ম্যাচ সমীকরণের সুতোয় টিকে ছিল টাইগারদের সেমির আশা। অষ্টম স্থানে বিশ্বকাপ শেষ করা বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা ভগ্ন-মনঃরথে ফিরেছেন দেশে।
আগের তিন আসরের মতো এবারও বিশ্বকাপে তিনটি ম্যাচ জয়ের গণ্ডিতেই অবস্থান করেছে বাংলাদেশ। দক্ষিণ আফ্রিকা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, আফগানিস্তানের বিরুদ্ধেই এসেছিল জয়গুলো। তবে চোখে চোখ রেখেই বাংলাদেশ লড়েছিল নিউ জিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, ভারতের সাথে। তারপরও শেষ চারে উঠতে না পারার কারণে টাইগারদের বিশ্বকাপ মিশনের সঙ্গে ‘ব্যর্থ’ ট্যাগটাই মানানসই হয়ে গেছে।
সাকিবের একক বীরত্ব বাংলাদেশের আশার মশাল বয়ে বেড়িয়েছে। ব্যাটিংয়ে তাকে কিছুটা সঙ্গ দিয়েছেন মুশফিকুর রহিম। ৬০৬ রান ও ১১ উইকেট নিয়েও সাকিব বিশ্বকাপের লিগপর্ব থেকেই বিদায় নিয়েছেন। মুস্তাফিজুর রহমান ২০ উইকেট পেলেও তা দলের প্রয়োজনের গুরুত্ব মেটাতে পারেনি। তরুণ মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন খারাপ করেননি। তামিম ইকবাল, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ, মাশরাফি বিন মুর্তজার কাছ থেকে প্রত্যাশিত পারফরম্যান্স আসেনি। বিশেষ করে মাহমুদউল্লাহ, মাশরাফি পুরোপুরিই ব্যর্থ হয়েছেন বিশ্বকাপের মঞ্চে।
লিগপর্ব থেকেই বাংলাদেশের বিদায়ের কারণ, তথা বিশ্বকাপ পারফরম্যান্সের চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছেন অনেকেই। নির্বিষ পেস বোলিং, নাজুক ফিল্ডিং, ওপেনারদের ব্যর্থতার কথা সবাই বলেছেন। তবে পেছন ফিরে তাকালে দেখা যাবে, এসবের বাইরে মূলত বাংলাদেশের ছিটকে পড়ার কারণ: দু’টি ক্যাচ মিস ও একটি রানআউট। পারফরম্যান্সের গভীরে তাকালে এই ছবি স্পষ্ট হবে সবার মনের আয়নায়। নিউ জিল্যান্ডের বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে শিশুতোষ ভুলে কেন উইলিয়ামসনের রানআউট মিস করেছেন মুশফিকুর রহিম। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ১০ রানে থাকা ডেভিড ওয়ার্নারের ক্যাচ ফেলেছেন সাব্বির রহমান, এবং ভারতের বিরুদ্ধে ৯ রানে থাকা রোহিত শর্মার লোপ্পা ক্যাচ ফেলেন তামিম ইকবাল। এই দু’টি ক্যাচ মিসের চড়া মূল্য গুণেছে বাংলাদেশ।
নাগালের কাছে পেয়েও দ্বিতীয় ম্যাচে নিউ জিল্যান্ডকে হারাতে না পারাই বাংলাদেশের সেমি’র স্বপ্নকে দোদুল্যমান করে দিয়েছিল। বলা যায়, সম্ভাবনার নিক্তিতে তখনই কিছুটা সুর কেটে গিয়েছিল। শ্রীলঙ্কার সঙ্গে বৃষ্টিতে পন্ড হওয়া ম্যাচটা আফসোসের অনুরণন তৈরি করেছিল দলের মাঝে। তারপরও অবশ্য সুযোগ ছিল টাইগারদের। কিন্তু সেগুলো কাজে লাগানোর জন্য যেই মুন্সিয়ানা, দলগত নৈপুণ্য দরকার ছিল, তা প্রদর্শন করতে সমর্থ হয়নি মাশরাফি বাহিনী।
ক্যাচ মিস ও রানআউটের চড়া মাশুল
বিশ্বকাপে বাংলাদেশের স্বপ্নভঙ্গের মূলে এই তিন ব্যর্থতাকেই সর্বাগ্রে রাখতে হবে। কারণ, তিনটি ঘটনাই দলকে জয় থেকে যোজন যোজন দূরে ঠেলে দিয়েছে। রানআউট মিস করার বড় ভুলটি মুশফিকের। আর এই শুধু একটি জয় নয়, বাংলাদেশকে বিশ্বকাপের সেমি’র সম্ভাবনাকেই ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর করে দিয়েছিল। দলসূত্রে জানা গেছে, দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে জয়ের পর বাংলাদেশের ড্রেসিংরুমে আইপিএলের দিল্লি ক্যাপিটালসের কম্পিউটার অ্যানালিস্টের কাছ থেকে একটি বার্তা এসেছিল। টাইগারদের অ্যানালিস্ট শ্রী চন্দ্রশেখরনের কাছে আসা ওই বার্তায় লেখা ছিল এমন, এখন তোমাদের সেমি’র পথে সবচেয়ে বড় বাধা নিউজিল্যান্ড। ওদেরকে হারাও, সেমি নিশ্চিত। পাকিস্তান একদম শেষের ম্যাচ। ওইটার ভাবনা বাদ দিয়ে নিউ জিল্যান্ডকে হারাও, পথ পরিষ্কার হয়ে যাবে। স্কোরবোর্ড পুঁজিটা ছোট হলেও ৫৫ রানে কিউইদের দুই উইকেট ফেলে দিয়েছিল বাংলাদেশ, যেখানে ৩ উইকেটও হতে পারতো। এবং আউট হওয়া ব্যাটসম্যান হতে পারতেন নিউ জিল্যান্ডের অধিনায়ক ও ব্যাটিং স্তম্ভ কেন উইলিয়ামসন। শিশুতোষ ভুলে সুযোগ নষ্ট করেছেন মুশফিক। তামিমের থ্রো সোজা স্টাম্পে আসছে দেখেও নিজে বল ধরে স্ট্যাম্পে লাগাতে চেষ্টা করেছেন। স্ট্যাম্প ভেঙেছিলেনও তিনি, কিন্তু তার আগেই কনুই লেগে স্ট্যাম্প ভাঙে। জীবন পাওয়া উইলিয়ামসনের ইনিংসই পরে পার্থক্য গড়ে দিয়েছে।
পরের দু’টি ক্যাচ মিসের ভুল সাব্বির ও তামিমের। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ১০ রানে থাকা ওয়ার্নারের ক্যাচ ফেলেন সাব্বির, ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টে তার দেয়া উপহারকে কাজে লাগিয়ে ওয়ার্নার খেলেন ১৬৬ রানের ইনিংস। জীবন পেয়ে আরও ১৫৬ রান যোগ করেছিলেন ওয়ার্নার। অস্ট্রেলিয়ার স্কোরটা পাহাড়ে চড়ে বসে, যা আর অতিক্রম করা সম্ভব হয়নি বাংলাদেশের পক্ষে।
ভারতের বিপক্ষে বাঁচা-মরার ম্যাচে রোহিত শর্মার লোপ্পা ক্যাচ ফেলে দেন তামিম। ৯ রানে জীবন পেয়ে ১০৪ রান করে ফেরেন রোহিত। জীবন পাওয়ার পর তিনি ৯৫ রান যোগ করেন, আর এই রানগুলোই ভারতের জয়ের পুঁজি গড়ে দেয়। বাংলাদেশ এই ম্যাচ হারে ২৮ রানে।
ওপেনারদের ব্যর্থতা
বিশ্বকাপে বাংলাদেশের ব্যর্থতার দ্বিতীয় প্রধান কারণ হলো, ওপেনারদের ব্যর্থতা। বড় বড় দলগুলোর দিকে তাকালে দেখা যাবে, তাদের বড় স্কোরের মূলে ওপেনাররা। জেসন রয়-বেয়ারস্টো, ওয়ার্নার-ফিঞ্চ, রোহিত শর্মা-লোকেশ রাহুলদের সেঞ্চুরি, বড় জুটিতে ভর করেই বিশাল সব স্কোর গড়েছে তাদের দল। প্রতিপক্ষকে চাপে ফেলার প্রাথমিক কাজটা ব্যাট হাতে করেছেন ওপেনাররাই। সেই তুলনায় তামিম-সৌম্য’র ওপেনিং জুটিকে পুরোপুরি ব্যর্থ বলাই শ্রেয়। কারণ, বিশ্বকাপে তাদের যুগলবন্দিতে এসেছে সর্বোচ্চ ৬০ রান, তাও টুর্নামেন্টের প্রথম ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে।
আয়ারল্যান্ডে ত্রিদেশীয় সিরিজে দারুণ ফর্মে ছিলেন সৌম্য। কিন্তু বিশ্বকাপে গিয়েই আবার তিমিরে হারালেন। ৮ ম্যাচে ১৬৬ রান করেছেন, ছিল না কোনো হাফ সেঞ্চুরি। ৮ ম্যাচে ২৩৫ রান করলেও তামিমের ব্যাটিং ছিল দৃষ্টিকটু। বিশ্বকাপের কন্ডিশন, উইকেট বিবেচনায় তার ব্যাটিংয়ের ধরন ছিল বেমানান। স্বভাবসুলভ ধীরগতিতে ব্যাটিং করেছেন তিনি।
ক্যারিয়ারজুড়ে ৭৭-৭৮ স্ট্রাইকরেটে ব্যাটিং করেছেন তামিম। কিন্তু বিশ্বকাপে তার স্ট্রাইকরেট ছিল মাত্র ৭১.৬৪, যা উল্টো দলের অন্য ব্যাটসম্যানদের চাপে ফেলেছে। একপ্রান্তে তার স্লো ব্যাটিংয়ের কারণে উইকেটে গিয়েই মেরে খেলার ভূমিকা নিতে হয়েছে সৌম্যকে। অনেক সময় এই চেষ্টার কারণেও উইকেটে থিতু হতে পারেননি এই বাঁহাতি ওপেনার।
নতুন বলে নির্বিষ বোলিং
বিশ্বকাপশেষে অধিনায়ক মাশরাফি নিজেই বলেছিলেন, বোলিং আর ফিল্ডিংই তাদের ডুবিয়েছে। আরও স্পষ্ট করে বললে, পেস বোলিংয়ের ব্যর্থতার কথাই বলতে হয়। সেই আলোচনায় আবার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসবে নতুন বলের বোলিং। আট ম্যাচের মধ্যে মাত্র তিন ম্যাচে প্রথম ১০ ওভারে উইকেট নিতে পেরেছিল বাংলাদেশ। বড় বড় দলকে শুরুতে চাপে ফেলতে পারেননি পেসাররা। মাঝের ওভারে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে ব্রেক-থ্রু দেয়ার কাজটাও হয়ে উঠেনি।
নতুন বলে গত ১৮ বছর ধরে বাংলাদেশের বড় ভরসা মাশরাফি। কিন্তু বিশ্বকাপে তার বোলিং ছিল আপাদমস্তক ধারহীন। তিন ম্যাচে নতুন বলে বোলিং করেছিলেন মুস্তাফিজ, উইকেট এনে দিতে পারেননি। দুইবার ৫ উইকেটসহ টুর্নামেন্টে ২০ উইকেট নিয়েছেন মুস্তাফিজ। তবে তার উইকেটগুলো প্রায় সবই পুরাতন বলে। ততক্ষণে রানপাহাড়ে চড়ে গিয়েছিল প্রতিপক্ষ। তাই তার উইকেটগুলো দলের পারফরম্যান্সে বড় প্রভাব ফেলতে পারেনি। তিনি ওভারপ্রতি ৬.৭০ রান দিয়েছেন। লিগপর্বে সবচেয়ে বেশি ৪৮৪ রান দিয়েছেন মুস্তাফিজ। সাইফউদ্দিন আরও খরুচে, ৭ ম্যাচে ১৩ উইকেট নিলেও ওভারপ্রতি ৭.১৮ হারে রান দিয়েছেন। আর মাশরাফি তো পেয়েছেন মাত্র ১ উইকেট।
হাড্ডিসার বোলিং আক্রমণে যা কিছুটা আশার আলো ছিল, স্পিনারদের মাঝে। সাকিব ও মিরাজ ছিলেন দুর্দান্ত। সাকিব ১১ উইকেট নিয়েছেন, রান দিয়েছেন ওভারপ্রতি ৫.৩৯ করে। মিরাজ ৬ উইকেট পেলেও দারুণ বোলিং করেছেন, ওভারপ্রতি ৫.০৮ হারে রান দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন প্রতিপক্ষের রানের লাগাম টেনে দেয়ার ক্ষেত্রে।
দৃষ্টিকটু গ্রাউন্ড ফিল্ডিং
বিশ্বকাপে ৪৩টি ক্যাচ (উইকেটকিপারসহ) নিয়েছেন বাংলাদেশের ফিল্ডাররা। সর্বোচ্চ ৭টি ক্যাচ নিয়েছেন সৌম্য। কিন্ত গ্রাউন্ড ফিল্ডিংয়ে বিবর্ণ ছিল বাংলাদেশ। বোলিংয়ের ঘাটতি কাটাতে ফিল্ডিং হওয়া দরকার ছিল দুর্দান্ত। যদিও বাস্তবতা হলো, এবার টুর্নামেন্টে সবচেয়ে বাজে ফিল্ডিং দলের তালিকায় সর্বাগ্রে থাকবে বাংলাদেশ।
ফিল্ডারদের শরীরী ভাষা ছিল দুর্বল। থ্রো ধরার ব্যাকআপ দিতে চিৎকার করতে দেখা গেছে মুশফিক, মাশরাফিদের। অথচ এটি ক্রিকেটে ফিল্ডিং দলের মৌলিক বিষয়। ক্যাচ পড়েছে, রানআউট করা যায়নি, প্রায়ই দুই পায়ের ফাঁক গলিয়ে বল চলে গেছে, যা ছিল সত্যিই দৃষ্টিকটু। ডাইভ দিয়ে রান বাঁচানোর চেষ্টা, বল আটকানোর সময় ক্ষিপ্রতা চোখে পড়েনি জোরালোভাবে। সিঙ্গেলস, ডাবলস আটকে প্রতিপক্ষকে চাপ প্রয়োগের চেষ্টাই যেন ছিল না ফিল্ডারদের। প্রতি ম্যাচেই বাজে ফিল্ডিংয়ের কারণে বাড়তি রান গুণতে হয়েছে বাংলাদেশকে।
যদিও টানা খেলার কারণে ক্রিকেটারদের মাঝে ক্লান্তিও ভর করেছিল। সঙ্গে ছোটখাটো চোটের ধাক্কাও নাকি কিছুটা প্রভাব ফেলেছিল, টুর্নামেন্টশেষে দাবি করেছিলেন অধিনায়ক মাশরাফি।
উইকেট বুঝতে গিয়ে গলদঘর্ম
ইংল্যান্ডের মাটিতে বিশ্বকাপ, বাংলাদেশের হেড কোচ একজন ইংলিশম্যান। খেলোয়াড়ি জীবন, কোচিং ক্যারিয়ার মিলে পুরোটাই ইংল্যান্ডের আলো-বাতাসে বেড়ে ওঠা রোডস ড্রেসিংরুমে থাকার পরও উইকেট বুঝতে না পারার ব্যর্থতা পুড়িয়েছে বাংলাদেশকে। কৌশলের হেরফের হয়েছে উইকেটের আচরণ ধরতে না পারায়।
দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে দারুণ ছন্দ পেয়েছিল বাংলাদেশ টুর্নামেন্টের প্রথম ম্যাচেই। পরের ম্যাচেই নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে উইকেটের ধরণ নিয়ে দ্বিধায় পড়ে যায় বাংলাদেশের টিম ম্যানেজমেন্ট। দলের বিশ্বস্ত সূত্র জানিয়েছে, ম্যাচের আগে রেডিও কমেন্ট্রি শুনে রোডস বলেছিলেন, এটা খুব ভালো উইকেট।
সাকিব-মুশফিকরা আউট হওয়ার পর ড্রেসিংরুম থেকে মিঠুন-মাহমুদউল্লাহদের কাছে বার্তা গিয়েছে দ্রুত রান তুলতে। কারণ, উইকেট নাকি ৩০০’র বেশি রানের। যদিও ওই উইকেটে ২৬০-২৭০ রানই ছিল জেতার মতো স্কোর। ড্রেসিংরুমের বার্তা পেয়ে তেড়েফুঁড়ে খেলতে গিয়েছিলেন মিঠুনরা, যা ডেকে আনে সর্বনাশ। অথচ মিঠুনরা স্বাভাবিক খেলাটা খেললেও বাংলাদেশ ২৭০ রান করার মতো অবস্থায় ছিল।
জানা গেছে, দ্বাদশ ফিল্ডার রুবেলকে দিয়ে বার্তা পাঠানো হয়েছে। ভালো উইকেট বললেও বার্তাটা পাঠাননি রোডস। সেই বার্তা রুবেলের কানে দিয়েছিলেন ম্যানেজার খালেদ মাহমুদ সুজন! অবশ্য সেটা কোচ-অধিনায়কের সামনেই। তারাও দ্বিমত করেননি তখন। যদিও মাঝপথে এই বার্তা পাঠানোর ঘটনায় মনে ধরেনি ব্যাটিং কোচ নিল ম্যাকেঞ্জির। শেষ পর্যন্ত ২৪৪ রান করে ২ উইকেটের হারটা আরও ২০ রান বেশি করতে না পারার আক্ষেপে পুড়িয়েছে বাংলাদেশকে। টিম ম্যানেজমেন্টের এমন সিদ্ধান্তহীনতা বাংলাদেশের হারে বড় অবদান রেখেছিল।
একাদশ গঠনে রক্ষণশীল মনোভাব
স্বাগতিক ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, ভারতকে হারানো যাবে না ধরেই বিশ্বকাপ শুরু করেছিল বাংলাদেশ। এই তিন ম্যাচের পরাজয়কে অবধারিত মেনেই টার্গেট ঠিক করা হয়েছিল। আফগানিস্তান, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, শ্রীলঙ্কাকে হারানোর সঙ্গে পাকিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকা, নিউ জিল্যান্ডের মধ্যে দু’টি দলের বিরুদ্ধে জয়ের লক্ষ্য স্থির করেছিল টাইগাররা।
বড় দলগুলোর বিপক্ষে তাই রক্ষণশীল মানসিকতা নিয়েই খেলেছে বাংলাদেশ। আক্রমণের চেয়ে রক্ষণেই ভরসা করেছিলেন মাশরাফিরা। যেমনটা ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচের আগে সংবাদ সম্মেলনে অধিনায়ক বলেছিলেন,
‘ইংল্যান্ডের বিপক্ষে আক্রমণাত্মক খেলে কাজ হবে না। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে রক্ষণই হবে আসল আক্রমণ।’
ঠিক এই চিন্তার কারণেই ইংলিশদের বিপক্ষে চার পেসার খেলানোর চেষ্টা করেনি বাংলাদেশ। যদিও বিশ্বকাপের পর দলের একটি বিশ্বস্ত সূত্র জানিয়েছে, ওই ম্যাচে রুবেলকে না খেলানো ছিল মস্ত বড় ভুল।
টুর্নামেন্টজুড়েই প্রায় আট ব্যাটসম্যান নিয়ে খেলেছে বাংলাদেশ। ব্যাটিং সামর্থ্য নিয়ে আত্মবিশ্বাস না থাকায় দুর্বল বোলিং বিভাগে আরও শক্তি সঞ্চারের চেষ্টাই করেনি। অথচ এই রক্ষণশীল চিন্তায় পার পাওয়া যায়নি। স্বপ্নের সেমিতে খেলা হয়নি বাংলাদেশের, যার কারণে বিশ্বকাপে বোলিংটা বরাবরই দুর্বল দিক হয়ে ছিল বাংলাদেশের। ব্যাটিং লাইনে তামিম, সৌম্য, সাকিব, মুশফিক, লিটন/মিঠুন, মাহমুদউল্লাহদের মতো ব্যাটসম্যানদের উপর ভরসা রাখতে পারেনি বাংলাদেশ। তাই নিচের দিকে মোসাদ্দেকের মতো ব্যাটসম্যান, মিরাজের মতো কিছু রান তুলতে পারা একই ক্যাটাগরির দুইজন অফস্পিনার খেলিয়েছে বাংলাদেশ।
উপরে এত এত ব্যাটসম্যান রান এনে দিতে না পারলে, লেজের ব্যাটসম্যানরা আর কতটাই এগিয়ে দিতে পারতেন! বিশ্বকাপশেষে এই মনোভাবের ফলাফলটা নিশ্চয়ই টিম ম্যানেজমেন্টের চোখে ধরা পড়েছে।
চোটাক্রান্ত মাশরাফি
চোটজর্জর ক্যারিয়ারে সব ঝড়-ঝাপটা সামলেছেন, নিজের সেরাটা দিতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন। অধিনায়ক হিসেবে অতুলনীয় তিনি। নতুন বলে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ভরসা ডানহাতি পেসার মাশরাফি। অভিজ্ঞ এই পেসারের সার্ভিসটা পায়নি বাংলাদেশ এই বিশ্বকাপে, যার মূল কারণ তার চোট। আয়ারল্যান্ডের ত্রিদেশীয় সিরিজে পাওয়া চোট নিয়ে বিশ্বকাপ খেলেছেন তিনি। টুর্নামেন্টে মাশরাফির চোটগ্রস্ততা বাংলাদেশের সম্ভাবনাকে অনেকখানি শ্লথ করে দিয়েছে।
মাশরাফি চোট নিয়ে ম্যাচের পর ম্যাচ খেলেন, পাত্তা দেন না ছোটখাটো চোটকে। তাই তো গত দুই মাস ধরে ‘গ্রেড টু টিয়ার’ হ্যামস্ট্রিং বয়ে বেড়ালেও স্ক্যান করাননি। ব্যথা সয়ে খেলার কারণে সচরাচর প্রশংসাও পান তিনি। কিন্তু এই চোট প্রভাব ফেলেছে তার বোলিংয়ে, ভুগিয়েছে দলকে। ক্যারিয়ারে বল হাতে এতটা বিবর্ণ কখনোই ছিলেন না মাশরাফি। বিশ্বকাপে চোটাক্রান্ত থেকেই ৮ ম্যাচে ৫৬ ওভার বল করে ৩৬১ রান দিয়েছেন, উইকেট পেয়েছেন মাত্র একটি।
ভাগ্য সহায় থাকলে ২-১টা ক্যাচ না ফসকালে হয়তো আরও কয়েকটা উইকেট থাকতো মাশরাফির ঝুলিতে। যদিও সেটি তার বোলিং ব্যর্থতাকে ঢেকে দিতে পারতো না। বোলিংয়ে ছিল না ধার, ছিল না নিয়ন্ত্রণ। উইকেট এনে দিতে পারেননি, বুদ্ধিমত্তা বা অভিজ্ঞতারও প্রয়োগ ছিল না তার বোলিংয়ে। এক ম্যাচে মাত্র পুরো ১০ ওভার বোলিং করেছিলেন। অনেক সময়ই তার বোলিংয়ে রান উঠেছে দেদারসে। বিশ্বকাপে ‘আনফিট’ মাশরাফি তাই বাংলাদেশের জন্য বড় ধাক্কাই ছিল।