মিনহাজুল আবেদীন নান্নু। অনেকের মতেই বাংলাদেশের সর্বকালের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান। অবসরের পর মূল কোচিং নিয়েই ছিলেন। এরপর যুক্ত হয়েছেন জাতীয় দল নির্বাচনে। গত দুই বছর ধরে প্রধান নির্বাচকের দায়িত্ব পালন করছেন।
বাংলাদেশ জাতীয় দল নির্বাচন, প্রধান নির্বাচকের চ্যালেঞ্জ, ক্রিকেটের ভবিষ্যত- এসব বিষয় নিয়ে রোর বাংলার সাথে একান্ত কথোকথন করেছেন মিনহাজুল আবেদীন নান্নু।
জীবনের বড় অংশ খেলোয়াড় ও কোচ হিসেবে কাজ করেছেন। প্রধান নির্বাচকের এই ভূমিকা কেমন উপভোগ করছেন?
অবশ্যই ভালো লাগছে। দল যখন ভালো করে, তখন কাজটা বেশি ভালো লাগে। দল খারাপ করলে একটু সমালোচনা হয়। সব মিলিয়ে উপভোগ করছি। এটা খুব চ্যালেঞ্জিং একটা কাজ। আমি খেলোয়াড়ী জীবনেও যেমন টিম ওয়ার্কে বিশ্বাস করতাম, এখানেও তা-ই করি। সবার সাথে মিলে সিদ্ধান্ত নেওয়াটা উপভোগ করি। আমাদের একটা প্যানেল আছে; এছাড়া ক্যাপ্টেন আছে, কোচ আছে; সবাই মিলে আমরা ভালো আলোচনা করি। তারপর একটা সিদ্ধান্ত নেই। আমি সবসময় বলি, এটা একটা টিমওয়ার্ক। আমাদের পারস্পরিক বোঝাবুঝি ভালো। তাই কাজটা উপভোগ না করার কোনো কারণ নেই।
আপনি বললেন, এই কাজটাতে চ্যালেঞ্জ আছে। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জটা কী?
সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো, আমরা সঠিক খেলোয়াড়কে বাছাই করতে পারছি কি না। একটা খেলোয়াড়কে আমরা যখন জাতীয় দলে বা অন্য কোনো কাঠামোতে আনি, সে নিজেকে প্রমাণ করতে পারছে কি না, সেটা আমাদের কাজের পরীক্ষা নেয়। আমরা চ্যালেঞ্জ ভাবি যে, আমরা ভবিষ্যতের জন্য সঠিক খেলোয়াড়কে নির্বাচন করতে পারছি কি না। আমরা একটা বা দুটো ম্যাচ বা এক বছরের কথা ভেবে কাউকে দলে নিতে চাই না। আমরা চাই, একজন দলে এলে সে যেন চার-পাঁচ বছর ধরে একটা সার্ভিস দলকে দিতে পারে। এই জায়গাটায় আমরা সঠিক থাকতে পারছি কি না, এটা হলো চ্যালেঞ্জ।
দুই বছরের মতো দায়িত্ব পালন করে ফেললেন। এই সময়ে আপনারা বাংলাদেশের ক্রিকেটে কী উল্লেখযোগ্য সংযোজন করতে পেরেছেন?
এই দুই বছরে আমরা একটা ব্যাপার তৈরি করতে পেরেছি। অন্তত ৬০ জন খেলোয়াড়ের একটা পুল করতে পেরেছি। এখানে আমরা চারটা গ্রেড করে রেখেছি-এ, বি, সি, ডি। এই পুলের ভেতর দিয়েই জাতীয় দল, এ দল, এইচপি ঠিক হয়। এর মধ্যে বয়সভিত্তিক খেলোয়াড়ও আছে। যেটাকে আপনি পাইপ লাইন বললেন, সেটা তৈরি করার একটা ধাপ হয়েছে বলা যায়। এখানে আমরা ধাপে ধাপে খেলোয়াড় বাড়িয়েছি। এখন আমরা যেকোনো দল করার সময় এই পুল থেকেই খেলোয়াড় নিতে পারি।
নান্নু ভাই, আপনাদের কাজটা কী একটা থ্যাংকলেস জব? দল জিতলে তো কেউ আপনাদের প্রশংসা করে না। কিন্তু হারলে সমালোচনা হয়।
হ্যাঁ, এটাকে থ্যাংকলেস জব বলতে পারেন। দল জিতলে কেউ নির্বাচকদের খবরও নেয় না। কিন্তু কোনো একটা খেলোয়াড় খারাপ পারফর্ম করলেই আমাদের দিকে আঙুল ওঠে। এটাকে আমরা অবশ্য এই কাচের চরিত্র হিসেবে মেনে নিয়েছি, এটার সাথে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। একসময় খেলোয়াড় ছিলাম, ক্যাপ্টেন ছিলাম; তখন এক ধরনের অবস্থা ছিলো। এরপর কোচ ছিলাম; তখন জীবনটা একরকম ছিলো। এখন এটাই জীবন। আসলে প্রতিটা পেশার ভিন্ন ভিন্ন চরিত্র থাকে। এটাকেও আমরা সেভাবে মেনে নিয়েছি।
কিন্তু কখনো হতাশ লাগে না যে, কোনো প্রশংসা পান না?
নাহ। দলের পারফর্মেন্সই তো আমাদের পাওয়া। দল যখন ভালো করে, সেটাই আমাদের স্বীকৃতি। দল কম-বেশি ভালো খেলার মধ্যেই আছে। আমরা নিজেরা অন্তত বুঝতে পারি, তার মানে পেছনে আমরা কাজটা ঠিকঠাক করছি।
এখনও অবধি আমরা কোনো ফরম্যাটেই তামিমের একজন যোগ্য ওপেনিং সঙ্গী বের করতে পারিনি। এটাকে আপনারা কীভাবে দেখেন?
দেখেন চেষ্টা তো করা হচ্ছে। লিটনকে আমরা টেস্টেও চেষ্টা করেছি কিছু ম্যাচে। এর বাইরে ওয়ানডেতে বিজয়কে (এনামুল হক) চেষ্টা করা হয়েছে। সৌম্য এখন খেলছে টি-টোয়েন্টিতে। আমাদের কোয়ালিটি ওপেনার নেই, তা নয়। এরা কিন্তু সবাই দারুন পারফর্মার। কিন্তু কোনো একটা কারণে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এখনও ধারাবাহিক হতে পারছে না। এখানে আরও কিছু ব্যাপার থাকে।
আমাদের সকলের মত নিতে হয়। অধিনায়কদের একটা মত থাকে। সেটাকে গুরুত্ব দিতে হয়। ফলে আউট অব ফর্ম থাকলেও অধিনায়কের আস্থার কারণে কেউ কেউ সুযোগ পায়ও। তবে অধিনায়কও চায় যে, একটা ছেলেকে লম্বা সময় সুযোগ দিয়ে তাকে ফর্মে ফেরাতে। সব মিলিয়ে আমরা সবাই মিলেই চেষ্টা করছি। আমি বিশ্বাস করি, এদের যেহেতু কোয়ালিটি আছে, ভালো খেলবে। আমি তরুণদের বলবো, তামিম তোমাদের একটা রাস্তা দেখাচ্ছে, সেটা অনুসরণ করো; ফল আসবেই। আমাদের সামনে এখন অনেক খেলা। আমি বিশ্বাস করি, এই সময়ে আমরা তামিমের ভালো একজন পার্টনার পেয়ে যাবো।
ওয়ানডেতে তিন নম্বরের সমস্যাটা কী সাকিবকে দিয়েই সমাধান করা হলো তাহলে?
হ্যাঁ, বলা যায়। ক্যারিবিয়ান ট্যুরে সে তো তিন নম্বরে দারুন হ্যান্ডেল করলো। এর আগেও সে এখানে ভালো খেলেছে। আমাদের ওপেনিংয়ে যেহেতু একটু সমস্যা হচ্ছে, তিন নম্বরে একটা সিনিয়র ক্রিকেটার দরকার। সে হিসেবে সাকিব এখানে ঠিক আছে। টেস্টে মুমিনুল আছে; ফলে ওখানে সমস্যা হচ্ছে না। ওয়ানডেতে একটু সমস্যা ছিলো। এখানে সিনিয়র কাউকেই রাখতে হবে। সামনে আমাদের বিশ্বকাপ। ফলে এটা নিয়ে আর খুব বেশি পরীক্ষানীরিক্ষা করা যাবে না। এবার টিম দেশে ফিরলে এটা আমরা আলাপ করে ফাইনাল করে ফেলবো।
কিছু সিনিয়র খেলোয়াড় নাকি টেস্ট খেলতে একটু আপত্তি করছে। প্রধান নির্বাচক হিসেবে আপনার কাছে খবরটা কী?
না। আমরা এরকম কারো কাছ থেকে শুনিনি এখনও। আসলে কী হয়, দল খারাপ করলে মনে হয় নানা রকম। দল ওয়েস্ট ইন্ডিজে টেস্টে খারাপ করেছে। আমরা দেশের বাইরে যে টেস্টটা ভালো খেলতে পারছি না, এটা তো আমাদের মানতে হবে। এটা আমরা দেখতে পাচ্ছি। গত নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা সফরেও একই ঘটনা ঘটেছে। উপমহাদেশে আমরা শ্রীলঙ্কাতে গিয়ে ভালো টেস্ট খেলে এসেছি। কিন্তু উপমহাদেশের বাইরে গেলে সমস্যা হচ্ছে।
এটা থেকে বের হওয়ার উপায় কী?
প্রথমত খেলোয়াড়দের মানসিকভাবে আরও শক্ত হতে হবে বলে আমি মনে করি। উপমহাদেশের বাইরে খেলতে গেলে আরও টাফ হতে হবে। সেই সাথে এসব জায়গায় খেলার অভ্যাস বাড়াতে হবে। আমরা যেসব জায়গায় এরকম স্ট্রাগল করছি, এসব জায়গায় ‘এ’ দলের সফর বাড়াতে হবে এবং সেই সফরে অবশ্যই লংগার ভার্শন ম্যাচ থাকতে হবে। এগুলো করতে পারলে আমার মনে হয় পরিস্থিতি বদলাবে।
টেস্টের ফাস্ট বোলার তো আরও একটা বড় সংকট?
ওই একই ব্যাপার। আমরা দেশের ক্রিকেটে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। দেশে আমরা যে ধরনের উইকেটে খেলছি, তাতে ফাস্ট বোলারদের করার কিছু থাকে না। ফলে এদের উন্নতিও হয় না। আমরা বিকেএসপির মতো ফ্লাট ট্র্যাকে খেলছি। এতে ফাস্ট বোলারদের সুযোগই থাকে না। ফলে আমরা দেশের বাইরে গেলে ঐ ধরনের উইকেটে বল করার মতো বোলারই পাই না। এই উইকেট বদলানোটাই এখান থেকে বের হওয়ার একমাত্র উপায়।
উইকেট নিয়ে তো সেই শুরু থেকে কথা হচ্ছে। বদলের তো কোনো লক্ষণ নেই।
না। এবার একটা পরিবর্তন আসছে। আমরা ভারত থেকে বেশ কিছু কিউরেটর এনেছি। ভারতের ঘরোয়া ক্রিকেটে আপনি দেখবেন, গত কয়েক বছরে উইকেটে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। সেই কাজগুলো যারা করেছে, সেরকম অভিজ্ঞ কয়েকজন কিউরেটরকে আনা হয়েছে। আমরা আশা করছি, এবার থেকে ঘরোয়া প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে আপনারা অন্য ধরনের ক্রিকেট দেখতে পাবেন। বেশ কিছু বাউন্সি উইকেট এবং ঘাসের উইকেট দেখেতে পাবেন।
শেষ প্রশ্ন; প্রধান নির্বাচক হিসেবে আপনি কতটা স্বাধীন?
দেখুন, এটা একটা টিম ওয়ার্ক। আমি একা একা কোনো সিদ্ধান্ত নেই না। আমাকে আমার প্যানেলের সাথে আলোচনা করতে হয়। এরপর টিম ম্যানেজমেন্ট থাকে। তারাই মাঠে খেলাটা প্রয়োগ করে। ফলে তাদের মতামতের একটা মূল্য আছে। আমি তাদের কথাও শুনি। কিন্তু কেউ আমার ওপর কিছু চাপিয়ে দেয় না। আমি বারবার বলি, এটা দলীয় কাজ; আমরা সবাই মিলে করি। সেই অর্থে একটা দল হিসেবে আমরা পুরোপুরি স্বাধীন।