“লুইস এনরিকের অধ্যায় শুরু সময়ই আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি যে বার্সেলোনা ছাড়ব। একটা মিটিং ডেকে ক্লাবের সবাইকে আমি জানাই যে দল ছেড়ে দেবার জন্য আমি প্রস্তুত। এরপর লুইস এনরিকের কথা হয় আমার সাথে। আমি তাকে ফোন করি, এবং সে আমাকে জোর গলায় বলে বার্সাতে থেকে যেতে। আমি ভেবেছিলাম ডিসেম্বর পর্যন্ত থাকব, কারণ নিউ ইয়র্ক সিটির সাথে আমার চুক্তি তখন হয়ে গিয়েছিল। চাইছিলাম আর কয়েকটা ম্যাচ খেলে ডিসেম্বরে সবাইকে বিদায় জানাতে।
কিন্তু লুইস এনরিকে শেষে গিয়ে সব বদলে দিলেন। তার অফিসে দেখা করার সময় তিনি বললেন, অবশ্যই আমরা শুরু থেকে সবকিছু শুরু করব, আর তোমার প্রত্যেক ম্যাচ তো খেলা লাগবে না। কারণ আমার বয়স তখন ৩৪ বছর, পরের বছরই ৩৫-এ পা দেব। তবে এনরিকের কথা আমার ভালো লাগল। আমি বাড়ি এলাম, পেপকে কোচ বানানোর সময় আমার যেমন লেগেছিল, ঠিক তেমন অনুভূতি হতে লাগল। কারণ উপযুক্ত মানুষই কোচের আসনে বসেছে। সে মৌসুমের শুরুটা ভালো ছিল না; কিন্তু এরপর যা হলো, এক কথায় দুর্দান্ত। আমরা ট্রেবল জিতলাম। যখন বললাম এটাই আমার বার্সার সাথে শেষ মৌসুম, সবাই একসাথে আমাকে গ্যালারিভর্তি দর্শকের সামনে বিদায় জানাল। ক্যাপ্টেন হিসেবে সম্ভাব্য সব শিরোপা জিতলাম আমি।
যদিও সেবার আমার ভূমিকা তেমন ছিল না, কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে আমরা একটা দল। শেষ সময়ে এটাই আমি করতে চেয়েছিলাম। যেহেতু মাঠে আর আমার সেভাবে দরকার নেই, কিন্তু মাঠের বাইরে বিশেষ করে ড্রেসিংরুমে আমার প্রয়োজনীয়তা ছিল। এজন্যই আমি মনে করি, ট্রেবল জেতায় আমার বেশ খানিকটা ভূমিকা ছিল।”
বার্সেলোনার হয়ে খেলোয়াড় জাভির শেষ সময়ের গল্প এটা। বলা যায় বার্সার শেষ সুখস্মৃতি মিশে রয়েছে এই গল্পের সাথে। অথচ সেদিনের কথা, ‘১৪-‘১৫ মৌসুম ছিল সেটা। কিন্তু কাতালান ক্লাবের বর্তমান হাল দেখে মনে হয়, এ স্মৃতি যেন অনেক দিনের পুরনো।
ঐ মৌসুম শেষ করে ক্লাব থেকে বিদায় নিয়েছিলেন ক্যাপ্টেন জাভি, যে মিডফিল্ডারকে ঘিরে এখনও আবর্তিত হয় কাতালানদের সুখস্মৃতি। তবে জাভির ক্লাব ছেড়ে যাওয়া কখনোই চিরদিনের জন্য ছিল না। অন্য কোনো ভুমিকায় জাভি একদিন ফিরবেন, সেটা ক্লাব জানত, জানত প্রত্যেক কাতালান সমর্থক। বিদায়বেলাতে জাভি ক্যাম্প ন্যুতে গ্যালারিভর্তি সমর্থকের সামনে বলে গেলেন, এই ক্লাব তার ঘরবাড়ি। শৈশবের স্মৃতিবিজড়িত এই ক্লাবে একদিন তিনি অবশ্যই ফিরবেন।
জাভি কাতারের আল-সাদ ক্লাবে গেলেন খেলোয়াড় হয়ে। এরপর বুটজোড়া তুলে রেখে সে দলের কোচ হিসেবে নিজেকে মেলে ধরলেন। ২০১৯ সাল তার এক সময়ের সতীর্থ এবং কোচ পেপ গার্দিওলা মন্তব্য করলেন, জাভি কোচ হয়ে আছেন অনেক আগে থেকেই, একদিন তিনি অবশ্যই বার্সার কোচের আসনে বসবেন।
গার্দিওলার বলা সেই কথা ঘটে গেল খুব দ্রুত। ২০১৯ সাল থেকে মাত্র কোচের ভূমিকা পালন করছেন তিনি। আর মাত্র তিন বছর পর তিনি দায়িত্ব নিলেন বার্সেলোনার। তাও মৌসুমের মাঝপথে, যখন ক্লাবটি সবচেয়ে বাজে সময় পার করছে। সাথে অপরিপক্ক এবং মেরুদণ্ডহীন একটি দল।
বার্সেলোনার বর্তমান অবস্থা যে শুধুই খারাপের দিকে, তেমনটা নয়। দলের আর্থিক অবস্থা সংকীর্ণ, স্কোয়াডে নেই পর্যাপ্ত খেলোয়াড়। এমনিতেই দলে ছিল বেশ কিছু ফাঁকফোকর। মেসি চলে যাওয়াতে সেসব আরও বৃদ্ধিই পেয়েছে। এসব হতাশার ভীড়ে একমাত্র আশার আলো ক্লাবে আসা কয়েকজন তরুণতুর্কি। আনসু ফাতি, পেদ্রি, রিকি পুইগ, গাভি, ইউসুফ দেমির, নিকো, রোনাল্ড আরাউহো, সার্জিনো দেস্ত, এরিক গার্সিয়া, আলেহ্যান্দ্রো বালদের মতো বেশ কয়েকজন প্রতিভাবান তরুণকে ক্লাব আবিষ্কার করেছে খুব কম সময়ের ব্যবধানে।
তবে এই তরুণ খেলোয়াড়দের প্রসঙ্গ আসলে বলতে হয় প্রাক্তন কোচ রোনাল্ড ক্যোমানের কথা। বলতে গেলে এই তরুণদের মূল দলে সুযোগ তিনিই করে দিয়েছেন। তবে সবাইকে সুযোগ করে দিলেও তাদের ঠিকমতো ব্যবহার করতে পেরেছেন কি না, সেটা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। তাই বর্তমানে ক্লাবটির প্রয়োজন তথাকথিত ‘ভালো কোচ’।
জাভি কি সেই ভালো কোচের কাতারে? সাফ্যলের দিক দিয়ে না হোক, কৌশলগত দিক দিয়ে?
আল-সাদে কোচ হিসেবে জাভি কাটিয়েছেন মোট তিন মৌসুম। তার ফুটবল কৌশল অনেকটা তার খেলোয়াড়ি জীবনের মতোই। দক্ষতা এবং সৃষ্টিশীল ফুটবল, সাথে গার্দিওলা ঘরানার তিকি-তাকা। কিন্তু আল-সাদের হয়ে জাভির কারিশমা এই বাঁধাধরা কথার অনেক বাইরে।
আল-সাদে জাভি যেমন খেলোয়াড় পেয়েছেন, বার্সাতে সেখান থেকে পরিস্থিতি একেবারেই আলাদা। যদিও এই কথাটা দুইভাবে বলা সম্ভব। কারণ, কাতারের এই ক্লাবটি বেশ ধনী। জাভিকে কোচের দায়িত্ব দিয়ে তারা বেশ কয়েকজন ভালো খেলোয়াড়কে ক্লাবে এনেছিলেন। কিন্তু বার্সেলোনাতে এমন কিছু খুব দ্রুত সম্ভব হবে না। আবার অন্যদিকে আল-সাদে যেমন খেলোয়াড় আগে থেকে ছিল, সে তুলনায় বার্সেলোনার একাদশ বেশ শক্তপোক্ত এবং জাভির চাহিদা অনুযায়ী।
প্রথম দিকে ক্লাবের দায়িত্ব নিয়ে জাভি ৪-৩-৩ ছকে তার একাদশ নামাতেন। কিন্তু পরবর্তীতে তার ছক পালটে যায় ৩-৪-৩ এ। তবে খেলার ধরনে ছক তেমন মুখ্য নয়। কারণ, ম্যাচভেদে তার কৌশল মোটামুটি একই থাকত এবং পজেশনের প্রতি তার ঝোঁকের কথা বলাই বাহুল্য। তবে ফরমেশন বুঝিয়ে দেয় খেলোয়াড়দের অবস্থান। যেমন, ৪-৩-৩ ছকে একাদশ যখন তিনি গঠন করেছেন, রক্ষণভাগে খেলোয়াড় থেকেছে দু’জন। আর মিডফিল্ডে তিনজন থেকে একজন নেমে এসেছেন সেন্টারব্যাকদের ঠিক উপরে, যেখানে নিচ থেকে বল নিয়ে মিডফিল্ডার আর আক্রমণের খেলোয়াড়দের কাছে পাঠানো এবং প্রতিপক্ষের আক্রমণ মাঝমাঠে গুড়িয়ে দেয়া তার অন্যতম মুখ্য কাজ। বার্সেলোনায় এই দায়িত্ব বুসকেটস অনেক আগে থেকেই পালন করে আসছেন। জাভি তার ১১ জন খেলোয়াড়কে মাঠের বেশ বড় একটা অংশজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকতে বলেন। যাতে বল পায়ে রেখে নিজেদের ভেতর পাস দেবার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়।
কিন্তু ৪-৩-৩ ছকে জাভি মূলত করেছেন দুটো কাজ।
প্রথমত, দলের আক্রমণভাগের উইংগারদের একটু ভেতরে খেলিয়েছেন, যাতে উইং থেকে আরও বেশি জায়গা বের হয়ে যায় দলের ফুলব্যাকদের জন্য। সেই শূন্যস্থান থেকে প্রতিপক্ষের ডি-বক্সে মাপা ক্রস দেওয়া সম্ভব। আর দ্বিতীয় কৌশল উইংগারদের নিয়ে, যেখানে উইংগাররা থাকেন মাঠের সাইডলাইনের কাছাকাছি; সেখান থেকে ড্রিবল করে ভেতরে ঢোকা থাকে তাদের অন্যতম দায়িত্ব, আর মাঝে তৈরি হওয়া ফাঁকা স্থানে ঢুকে পড়েন দলের ফুলব্যাক। এক্ষেত্রে যেমন ডি-বক্স বা তার আশেপাশে থেকে পাস এবং শট নেবার সুযোগ বেড়ে যায়, তেমনই ক্রসও হতে পারে গোলের উৎস।
৩-৪-৩ ছকে একাদশ নামানোর ক্ষেত্রে জাভির একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল আক্রমণের সময় খেলোয়াড়ের দক্ষতা আরও বেশি কাজে লাগানো। কারণ, এই ছক ধরে আক্রমণে যাবার সময় যেমন আক্রমণভাবে আরও বেশি খেলোয়াড় পাওয়া যায়, তেমনই প্রতিপক্ষ যদি কাউন্টার অ্যাটাকেও আসে, সেক্ষেত্রে সামলে নেওয়াও সহজ। তবে দুই পদ্ধতিতে একটি জায়গায় বেশ মিল রয়েছে। জাভির পজেশনভিত্তিক অ্যাটাকিং ফুটবলে মিডফিল্ডারদের একটা বাড়তি ভূমিকা তো থাকছেই। কিন্তু দলের উইংগার এবং ফুলব্যাকদের দায়িত্ব আরও বেশি। মাঠে যেমন তাদের ভেতরের যোগসুত্রের প্রয়োজন হয়, তেমনই দরকার হয় তাদের গতি ও সঠিক সময়ে উচিত সিদ্ধান্ত নেবার দক্ষতা।
তবে আল-সাদে এ সকল মৌলিক ফুটবল কৌশল ছাড়াও ফুলব্যাকদের একটু অন্যরকম কৌশল দেখা গেছে। আক্রমণের সময় জাভি হাইলাইনে রক্ষণ এনে ফুটবলারদের টেনে নিয়ে গেছেন নির্দিষ্ট এক অংশে। সেখানে সে পাশের ফুলব্যাক, মিডফিল্ডার এবং উইংগারদের দেখা গেছে সরে এসে এক অংশে পাসিং ফুটবল খেলতে। এভাবে একপাশে সরে আসার জন্য অন্যপাশে হয়ে গেছে একদম ফাঁকা। এবং সেই ফাঁকা অংশে ভোঁ-দৌড় মেরেছেন দলের ফুলব্যাক। আর একদিকে সরে আসা অংশে পাস দেয়া-নেয়া করতে করতে হুট করে একটা থ্রু বল বা লং পাস চলে গেছে তার কাছে। এবং একপাশ থেকে বল বের করার পর বাকি খেলোয়াড়রা বসে থাকেনি। তারাও চোখের পলকে ছুটে গেছেন আক্রমণের আরও গভীরে। কারণ, ফুলব্যাক যে পাস বা ক্রস বের করবেন, সেটাকে ধরে গোলে পরিণত করা এখন মুখ্য বিষয়।
আল-সাদের ম্যাচের কয়েকটি দৃশ্যের ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়াগুলোতে বেশ জনপ্রিয়। তাতে দেখা যায়, আল-সাদ বল দেয়া-নেয়া করে দ্রুততার সাথে পাসিং ফুটবল খেলে আক্রমণে যাচ্ছেন। তবে এ সকল ভিডিওর সমালোচনাও রয়েছে। কাতার থেকে বেরিয়ে ইউরোপের মঞ্চে জাভি কি এমন ফুটবল খেলে যেতে পারবেন, যেখানে বিভিন্ন ধরনের মার্কিং এবং প্রেসিং দিয়ে নাজেহাল করে তোলে এমনকি নিচের সারির ক্লাবগুলোও?
প্রেসিং ফুটবলের বিপরীতে জাভির নিজস্ব কৌশল রয়েছে। এমন ক্লাবের ক্ষেত্রে আল-সাদ খেলেছে ৩-২-২-৩ ছকে একাদশ নিয়ে, যেখানে আক্রমণে উইংগাররা থাকেন সাইডলাইনের খুব কাছে। এবং এভাবে ছক তৈরি করে খেলা শুরু হয় গোলরক্ষকের কাছ থেকে। সেন্ট্রারব্যাক তিনজন থাকেন গোলকিপারের বেশ কাছে। আর দুইপাশের মিডফিল্ডার কিছুটা নিচে নেমে আসেন বল নেবার জন্য। আর বাকি দু’জন মিডফিল্ডার থাকেন মাঠের উপরের অংশে, প্রায় আক্রমণভাগের ফুটবলারদের কাছাকাছি। এক্ষেত্রে মাঠে থাকা ১১ জন ফুটবলারকে যেন দুই অংশে ভাগ করা যায়। ৫ জন ঠিক উপরে এবং ৬ জন ঠিক নিচে। মাঝে থাকে বেশ লম্বা-চওড়া একটা শূন্যস্থান। এই শূন্যস্থানে থাকেন উপরের অংশে থাকা দু’জন মিডফিল্ডার। প্রতিপক্ষ এখানে মার্ক বা প্রেসিং করবে ঠিকই, তবে এদের মাঝে একজন হবেন ‘ফ্রি ম্যান’, যিনি থাকবেন মার্ক বা প্রেসিং এর আওতার বাইরে। তিনি যদি মার্ক বা প্রেসিং এর আওতায় চলে আসেন, তখন এই ‘ফ্রি ম্যান’ হবেন অন্য কেউ। আর মাঠে থাকা আল-সাদের সকলে জানেন ‘এই ফ্রি ম্যান’ কে! প্রেসিংয়ের চরম মুহূর্তে অথবা কড়া মার্কিংয়ের বাইরে মাঠে কে আছেন, সেটা বুঝে ফেলার ক্ষমতা তাদের রয়েছে।
আল-সাদে জাভি কখনও নির্দিষ্ট কোনো কৌশলের ভেতর থাকেননি। প্রতিপক্ষের খেলার ধরন বুঝে তিনি তার দলের খেলার কৌশল বদলে ফেলতে পারেন এক নিমিষে। এজন্য স্কাই স্পোর্টসের ম্যাচ বিশ্লেষক বিয়ার্কি মার ওলফাসন জাভির এই দক্ষতাকে তুলনা করেছেন বয়ে চলা নদীর সাথে। তিনি বলেন,
“তার দলের খেলার ধরন দ্রুত বয়ে চলা নদীর মতো। পানি বয়ে যাওয়ার পথে আপনি পাথর ফেলে আটকাতে চাইলে পানি অন্য রাস্তা খুঁজে নেবে। তার দলের আক্রমণের কৌশল এমনই।”
তবে এমন কাগজে-কলমে এমন কৌশলের কথা বলা গেলেও মাঠে তা করে দেখানো মুখের কথা নয়। হাই প্রেসের দলের বিপক্ষে এমন পজেশন ধরে পাসিং ফুটবল খেলাও কম ঝক্কির কাজ নয়। তবে, আল-সাদের খেলোয়াড়রা কীভাবে আয়ত্তে আনলেন এমন কৌশল?
আসলে জাভির বার্সার ঘরানার ফুটবলের বাইরে তার নিজের দক্ষতার স্থান এখানেই।
জাভির যে মানসিকতা এবং দক্ষতা আল-সাদের ফুটবলাদের থেকে সেরাটা বের করে আনতে পেরেছে, বর্তমান বার্সার শূন্যতা এখানেই। রোনাল্ড ক্যোমান গাভির মতো খেলোয়াড়কে দলে সুযোগ দিলেও তার পজিশনে তাকে খেলাতে পারেননি। পারেননি প্রত্যেক খেলোয়াড়ের সব থেকে শক্ত জায়গাটাকে আবিষ্কার করতে, তাদের সেরা দিকটা খুঁজে বের করতে। ক্যোমান যেটা বার্সাতে করতে পারেননি, জাভি আল-সাদে সেটা করে দেখিয়েছেন। নিজের দলের প্রত্যেক খেলোয়াড়ের সেরাটা বের করে আনতে পেরেছেন, খুঁজে পেয়েছেন তাদের দক্ষতার স্থান। পজেশন রেখে আক্রমণ যাওয়া, প্রেসিং এবং মার্কের সময় তাদের “ফ্রি ম্যান” কৌশল; এছাড়াও কখন ঠিক কোথায় পাস দিতে হবে বা কখন কোথায় কোন খেলোয়াড় বলের অপেক্ষায় রয়েছে, এসব কিছুই তাদের নখদর্পণে। আর এমন খেলার ধরন কিন্তু প্রথম মৌসুম থেকেই দেখা যায়নি। জাভি অপেক্ষা করেছেন, ট্রেনিংয়ে শিখিয়েছেন হাতেকলমে, একই জিনিস অনুশীলন হয়েছে বারবার।
ওলফাসন জাভির এই দিক নিয়ে বলেছেন,
“আল-সাদে তার অধীনে সেরা খেলোয়াড়েরা ছিল। কিন্তু দলকে একটা দল হিসেবে তিনি খেলাতে পেরেছেন তিনি। প্রত্যেক খেলোয়াড়ের সেরাটা বের করে আনতে জানেন। তিনি বোঝেন, কীভাবে প্রত্যেক খেলোয়াড়ের সেরা বৈশিষ্ট্যগুলোকে দলের কাজে লাগাতে হয়। তার এই দিকটা আমার খুব ভালো লেগেছে।”
তবে অনেকে এখানে দ্বিমত পোষণ করতে পারেন। বলতে পারেন, আল-সাদ এবং বার্সেলোনা এক ক্লাব হলো? এই যুক্তিও একদম ফেলনা নয় বৈকি। কাতালান ক্লাবের দায়িত্ব নিয়ে ক্লাবের আবহাওয়া পালটে দেবেন, বদলে ফেলবেন কৌশল, এটা একদমই আকাশ-কুসম কল্পনা। কিন্তু যে ক্লাব ছিল জাভির এই ফুটবল কৌশলের আঁতুড়ঘর, যে ক্লাব পাসিং ও পজেশন ফুটবলে বিশ্বাসী, সে ক্লাবে ফিরে এসে জাভি যে তার ফুটবল দর্শন প্রয়োগ করবেন না, সেটা তো হতেই পারে না! এজন্য জাভির কৌশল খাটবে না, সেটা জোর গলায় বলার সময় এখনও আসেনি। আর কথায় আছে না, ‘ঢেকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে’!
এবার একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে আসি। জাভি বলেছেন,
“যখন আপনার কোচের কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই, তখন হয়তো ৫/১০ অথবা ৫.৫/১০ গোছের ফুটবল খেলবেন। কিন্তু যখন আপনার কোচ সবথেকে সেরাটা আপনার কাছে চেয়ে বসে, তখন হয়তো আপনি ৮/১০ ধরনের পারফরম্যান্স করতে পারবেন। আর এমন পারফরম্যান্স শিরোপা জেতাতে যথেষ্ট।”
কিন্তু বার্সেলোনায় আসার পর জাভি কি এমন কাউকে পাবেন যার কাছ থেকে তিনি সেরাটা চেয়ে বসবেন। অথবা যারা তার ফুটবল কৌশলকে বুঝে ফেলবে খুব সহজে? আসলে হাতেগোনা কয়েকজন ছাড়া তেমন কেউ নেই বর্তমান বার্সাতে। মধ্যমাঠ নিয়ে জাভির সমস্যা হবে না। কিন্তু যে কৌশলে তিনি আক্রমণের জোয়ার তুলতে চান, সেখানেই তো খেলোয়াড়ের অপর্যাপ্ততা।
ফুলব্যাক হিসেবে আছেন অস্কার, ডেস্ত, রবার্তো এবং আলবা। ২০১৭ সালের পর থেকে আলবা এবং রবার্তো ছন্দে নেই। এবং অস্কার ও ডেস্ত একদমই আনকোরা। দলে প্রথাগত নাম্বার নাইন নেই। উইংগার হিসেবে আছেন আনসু ফাতি, যিনি বড় একটা ইনজুরি কাটিয়ে মাত্রই মাঠে ফিরেছেন। অন্যজন দেম্বেলে, যিনি বার্সাতে আসার পর ইনজুরির কোপে পড়ে দলেই নিয়মিত হতে পারেননি। রয়েছে রক্ষণের সমস্যাও। পিকে বুড়িয়ে গেছেন অনেকটা, সেরা সময় ফেলে এসেছেন বহু আগে। ম্যানসিটি থেকে আসা এরিক এখনও শিক্ষানবীশ, ম্যাচের ভেতর চোখে লাগার মতো ভুল করেন, বেশ কিছু দিকে এখনও বেশ দুর্বলতা রয়ে গেছে। আর রক্ষণের একমাত্র ভরসার পাত্র আরাউহোও বেশ ইনজুরিপ্রবণ। এত সমস্যার ভিড়ে জাভি পারবেন তার ফুটবল কৌশলকে বাস্তবায়ন করতে?
প্রথম থেকে সেটা সম্ভবও নয়। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে বার্সার এই তরুণতুর্কিরা যদি নতুন কৌশলে অভ্যস্ত হয়ে যান এবং বার্সা বোর্ডও ক্লাবের শূন্যস্থানগুলো পূরণ করে দিতে পারে, তাহলে কি সুদিন ফিরতে পারে?
উত্তর হতে পারে, সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু অতি দ্রুত সেটা চেয়ে বসা লাভের থেকে বরং ক্ষতিই হবে। কারণ ক্লাবের বর্তমান যে আর্থিক অবস্থা, তাতে জাভির কৌশলের সাথে মানানসই ফুটবলার চোখের পলকে এনে দেওয়া অবিশ্বাস্য ব্যাপার। আর বর্তমান দল নিয়ে জাভির কতদূর এগোতে পারেন, সেটা দেখার জন্যও দরকার ধৈর্য ও অপেক্ষা। কিন্তু সাফল্যের তুঙ্গে থেকে অভ্যস্ত বার্সার কী ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে পারবে?
এজন্য, সকল আলোচন বা সমালোচনার শেষে প্রশ্ন ঘুরেফিরে একটাই। জাভি পর্যাপ্ত সময় কি পাবেন? যদি না দেওয়া হয়, তাহলে পরিবর্তনের আশা না করাই শ্রেয়। কারণ রূপকথা বারবার আসে না, সবাই পেপ গার্দিওলা হন না। বাস্তব জীবনে যেমন ধৈর্য ও অপেক্ষা সাফল্য বয়ে আনে, ফুটবলের মঞ্চেও তার অন্যথা হয় না। সাফল্যের দেখা পাওয়ার রাস্তা সবক্ষেত্রেই এক।