বিভিন্ন খেলায় পাইওনিয়ারিং কৃষ্ণাঙ্গ অ্যাথলেট সংক্রান্ত যেকোনো আলোচনায় অবধারিতভাবেই উঠে আসবে মানুষগুলোর জাতিগত বৈষম্যের বেড়াজাল, যুগ যুগ ধরে চলা আসা পক্ষপাতিত্ব, এবং শুধুমাত্র গাত্রবর্ণের জন্য ব্যক্তিগত ও পেশাদার জীবনে অকারণ ভোগান্তির শিকার হওয়া ও সেগুলোর সাথে যুদ্ধ করে টিকে থাকার নানান টুকরো টুকরো গল্প। অনেকের গল্পই ঢাকা পড়ে গেছে, আবার অনেকের গল্পই আলোর মুখ দেখেছে দীর্ঘ সময় পর। সেই সময় অনেকের অনেক অবদান-অর্জন সেভাবে নথিবদ্ধ হয়নি, প্রচারের আলোয় আসেনি। আজকের যুগের ক্রীড়া ইতিহাসবিদরা ধৈর্য্য ধরে, ধুলোপড়া নথিপত্র ঘেঁটে তবু চেষ্টা করে যাচ্ছেন সেই হারিয়ে যাওয়া গল্পগুলো খুঁজে বের করতে, তাদের প্রাপ্য মর্যাদাটুকু বুঝিয়ে দিতে। আজকের আলোচনা বিশ্ব ফুটবলের ইতিহাসের প্রথমদিকের কৃষ্ণাঙ্গ ফুটবলারদের নিয়ে, যাদের হাত ধরে ফুটবলে যুক্ত হয়েছিল বৈচিত্র্য।
আধুনিক ফুটবল খেলার আঁতুড়ঘর ইংল্যান্ডকেই ধরা হয়। যদি জিজ্ঞেস করা হয় যে, ব্রিটিশ ফুটবলের ইতিহাসের প্রথম পেশাদার কৃষ্ণাঙ্গ ফুটবলার কে? অনেকেই কোনো দ্বিধা ছাড়াই বলবেন, আর্থার হোয়ার্টন। এমনকি তাকেই অনেকে বিশ্বের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ ফুটবলার হিসেবে মেনে নেন। ইংল্যান্ড ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের ওয়েবসাইটে গেলেই লেখা দেখা যাবে,
“The Ghana-born goalkeeper is widely considered not only England’s but the world’s first black footballer”.
তবে অনেক ক্রীড়াবিশেষজ্ঞ দীর্ঘদিনের এই ‘একমেবাদ্বিতীয়ম’ দাবিকে প্রশ্নের সম্মুখে দাঁড় করিয়েছেন আজ।
আর্থার হোয়ার্টনেরও প্রায় এক দশক আগে আরেকজন কৃষ্ণাঙ্গ ফুটবলার কাঁপিয়েছেন স্কটল্যান্ডের মাঠ। তার নাম অ্যান্ড্রু ওয়াটসন, ঊনবিংশ শতাব্দীর সেরা লেফটব্যাকদের একজন ছিলেন তিনি। অ্যান্ড্রু ওয়াটসনকে ধরা হয় ফুটবল ইতিহাসের আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ম্যাচ খেলা প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ ফুটবলার। তিনি ইতিহাসের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ অধিনায়ক হিসেবেও বিবেচিত।
১৮৮১ সালে স্কটল্যান্ড জাতীয় দলে খেলার জন্য ডাক পান ওয়াটসন। অভিষেক ম্যাচেই তিনি অধিনায়কত্বের সুযোগ পান। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তার নেতৃত্বেই স্কটল্যান্ড ৬-১ গোলের জয় পায়। স্কটিশদের বিপক্ষে এটি ইংলিশদের সবচেয়ে বড় ব্যবধানে হারগুলোর একটি। (স্কটিশদের বিপক্ষে সবচেয়ে বড় ব্যবধান ৭-২ গোলে ইংল্যান্ড হেরেছিল ১৯৭৮ সালে। সেই খেলাটি গ্লাসগোতে হয়েছিল।)
১৮৫৬ সালে যখন তার জন্ম হয়, তার বাবা পিটার মিলারের বয়স ততদিনে পঞ্চাশ ছাড়িয়েছে। পিটার মিলার ওয়াটসন ছিলেন স্কটিশ। তিনি ব্রিটিশ গায়ানায় (বর্তমানে গায়ানা) চিনির কলের মালিক ছিলেন। অ্যান্ড্রু ওয়াটসনের মা আনা রোজ ছিলেন সেখানকারই স্থানীয় নারী। ১৮৬০ সালের দিকে অ্যান্ড্রু ও তার আরেক মেয়ে এনেটাকে নিয়ে পিটার ইংল্যান্ডে চলে আসেন। ইংল্যান্ডে তখন ফুটবল বিপ্লব চলছে বললেও ভুল হবে না। ইংল্যান্ডের প্রথম অফিশিয়াল রুলবুক এই দশকেই রচিত হয়, এই দশকেই জন্ম নেয় ইংলিশ ফুটবলের সর্বোচ্চ সংস্থা এফএ, তথা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন। অর্থাৎ, ফুটবলকে এখন যেভাবে আমরা চিনি, তার সূত্রপাত এই দশকেই।
দুর্ভাগ্যজনক হলেও ফুটবলের উন্মাদনা ছোট্ট অ্যান্ড্রুকে তখনও সেভাবে ছুঁয়ে যেতে পারেনি। ছোটবেলাটা তার কাটে বোর্ডিং স্কুলের কঠোর নিয়মকানুনে। অল্প কিছু বছর পর ১৮৬৯ সালে পিটার ওয়াটসন মারা গেলে অ্যান্ড্রু আরো একা হয়ে পড়েন। তবে মারা যাওয়ার আগে পিটার ওয়াটসন দুই ছেলেমেয়ের জন্য ৩৫,০০০ স্টার্লিং পাউন্ড রেখে গিয়েছিলেন, যার মূল্য আজকের হিসেবে হয়তো কয়েক মিলিয়নে পৌঁছাবে। অর্থের অভাব না থাকায় ওয়াটসন সিদ্ধান্ত নেন, তিনি স্কটল্যান্ডের বিখ্যাত গ্লাসগো ইউনিভার্সিটিতে পড়তে যাবেন। সেখান থেকেই অ্যান্ড্রু ওয়াটসন গণিত, দর্শন এবং সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং – এই তিন বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করেন। তবে তিনি পড়াশোনা শেষ না করেই তিনি ওয়্যারহাউজের ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন এবং বিয়ে করে থিতু হন।
পড়াশুনার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয়ে ওয়াটসন গ্লাসগোরই স্থানীয় ক্লাব ম্যাক্সওয়েল এফসিতে যোগ দেন ফুটবল খেলার জন্য। মূলত সময় কাটানো এবং স্বাস্থ্য ধরে রাখতেই তিনি ফুটবল খেলা শুরু করেছিলেন। তার দৌড়ের দুরন্ত গতি ও নিখুঁত পায়ের কাজের প্রশংসা অল্প কিছুদিনের মধ্যেই পুরো শহরে ছড়িয়ে পড়ে। ১৮৭৪ সালে পার্কগ্রুভ এফসি নামের আরেকটি ক্লাব থেকে ফুটবল খেলার আমন্ত্রণ পান ওয়াটসন। ম্যাক্সওয়েল এফসি’র তুলনায় পার্কগ্রুভ এফসি’র শরীরচর্চার বিভিন্ন সরঞ্জামাদির সহজলভ্যতাসহ নানারকম সুযোগ-সুবিধা বেশি থাকায় তিনি দ্রুতই সেখানে যোগ দেন।
কিছুদিনের মধ্যেই তিনি পার্কগ্রুভ এফসি’র ম্যাচ সেক্রেটারি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করতে শুরু করেন। এতে করে তিনিই হয়ে যান ফুটবল ইতিহাসের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ অ্যাডমিনিস্ট্রেটর। খেলাধুলার প্রতি নিজেকে তিনি উজাড় করে দিয়েছিলেন। প্রতি সপ্তাহান্তে ফুটবল ম্যাচ খেলা ছাড়াও শহরের বিভিন্ন প্রান্তে যে অ্যাথলেটিক প্রতিযোগিতাই হতো, তিনি তাতে অংশ নিতেন।
ওয়াটসনের পারফরম্যান্সের গুণগান এতটাই ছড়িয়ে পড়ে যে, ১৮৮০ সালে ২৩ বছর বয়সে গ্লাসগোর হয়ে শেফিল্ডের বিপক্ষে খেলার সুযোগ পান। গ্লাসগোর সতীর্থদের সাথে মানিয়ে নিতে সময় লাগেনি, চমকপ্রদ পারফরম্যান্স দিয়ে ব্রামাল লেন থেকে গ্লাসগোতে ফিরে আসেন ১-০ গোলের জয় নিয়ে। সেদিনের ম্যাচে শেফিল্ড ইউনাইটেডের প্রত্যেকটা শট ঠেকিয়েছেন অবিশ্বাস্য দক্ষতায়। গ্লাসগোর সেই দলটা শহরের বিভিন্ন ক্লাবের নির্বাচিত খেলোয়াড়দের নিয়ে তৈরি হয়েছিলো। গ্লাসগো সিলেক্ট টিম, পার্কগ্রুভ এফসি – দুই দলেই তিনি খেলে যাচ্ছিলেন সমানে।
সে বছরই স্কটল্যান্ড জাতীয় দলের হয়ে খেলার সুযোগ এসে যেত, কানাডা ট্যুরের জন্য সিলেক্টও হয়েছিলেন। কিন্তু স্কটিশ ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি উইলিয়াম ডিক মারা গেলে সেই ট্যুর বাতিল হয়।
তবে ১৮৮০ সাল ওয়াটসনের ক্যারিয়ারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বছর, সেই গ্রীষ্মেই স্কটল্যান্ডের সবচেয়ে বিখ্যাত ও অভিজাত ক্লাব কুইন্স পার্ক তাকে খেলার আমন্ত্রণ জানায়। সেখানেও তিনি ম্যাচ খেলার পাশাপাশি ম্যাচ সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করেন।
১৮৮০ সালে কুইন্স পার্ককে গ্লাসগো চ্যারিটি কাপ জেতাতে মুখ্য ভূমিকা রাখেন ওয়াটসন, ১৮৮১ সালে স্কটিশ কাপও জেতেন। এরপরই জাতীয় দলের দরজা আবার খুলে যায়, ১৮৮১ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে খেলার জন্য লন্ডনে যাওয়ার সুযোগ পান।
ওয়াটসন এতই জনপ্রিয় ছিলেন এবং ওয়াটসনের প্রতি দলের অন্য খেলোয়াড়দের এতই শ্রদ্ধা ছিল যে, অন্য কেউই দলের অধিনায়ক হতে চাননি, একবাক্যে মত দিয়েছিলেন অ্যান্ড্রু ওয়াটসনই অধিনায়ক হওয়ার জন্য সবচেয়ে যোগ্য। তাই অভিষেক ম্যাচেই অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারার মতো বিরল সম্মানের অধিকারী হয়েছিলেন তিনি। তার নেতৃত্বে লন্ডনে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৬-১ গোলে জয় পায় স্কটল্যান্ড। ঘরের মাটিতে স্কটিশদের কাছে এটিই ইংল্যান্ডের সবচেয়ে বড় ব্যবধানে হার।
এর দুইদিন পর রেক্সহামে ওয়েলসকে ৫-১ গোলে হারায় স্কটল্যান্ড। ঘরোয়া এবং আন্তর্জাতিক পারফরম্যান্স দেখে ১৮৮০-৮১ সালে স্কটিশ ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন বক্তব্য দেন,
“One of the very best backs we have; since joining Queen’s Park has made rapid strides to the front as a player; has great speed and tackles splendidly; powerful and sure kick; well worthy of a place in any representative team.’
১৮৮২ সালে আবারও ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তিনি স্কটল্যান্ডের হয়ে অধিনায়কত্ব করেন, এবারে ইংল্যান্ডকে ৫-১ গোলে হারায় স্কটিশরা। এই ম্যাচটিই তার স্কটল্যান্ড জাতীয় দলের হয়ে খেলা শেষ ম্যাচ ছিল। এই ৩টি ম্যাচই তিনি অধিনায়ক ছিলেন।
১৮৮২ সালে ওয়াটসন দ্বিতীয়বারের মতো স্কটিশ কাপ জেতেন। সে বছরই তার স্ত্রী জেসি নিম্মো আর্মোর মারা গেলে তিনি ছেলেমেয়েদের স্কটল্যান্ডে রেখে আসেন। তিনি তার খেলার সময় লন্ডন ও গ্লাসগো দুই শহরে ভাগাভাগি করে নেন। কিন্তু যেহেতু তিনি স্কটল্যান্ডে পুরো বছর ধরে বা পাকাপাকিভাবে থাকতেন না, তাই তিনি স্কটল্যান্ড জাতীয় দলের হয়ে খেলার সুযোগ চিরতরে হারিয়ে ফেলেন। জাতীয় দলের হয়ে ক্যারিয়ার জলাঞ্জলি দিলেও ফুটবলের প্রতি প্যাশনটা মরে যায়নি। লন্ডনে এসেই তিনি সে বছরই সুইফটস ক্লাবে যোগে দেন। সুইফটসের হয়ে তিনি দুই মৌসুম খেলেছিলেন। কুইন্স পার্কের মতো অতটা সাফল্য পাননি, কিন্ত প্রথম সিজনেই এফএ কাপের কোয়ার্টার ফাইনালে উঠেছিল সুইফটস। অ্যান্ড্রু ওয়াটসনই এফএ কাপের ইতিহাসের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ খেলোয়াড়।
দুই মৌসুম পার হওয়ার পর ১৯৮৪ সালে তিনি ইংল্যান্ডের সবচেয়ে বিখ্যাত অ্যামেচার ক্লাব করিন্থিয়ান্সের হয়ে খেলার আমন্ত্রণ পান। সে সময় করিন্থিয়ান্স কোনো প্রতিযোগিতামূলক টুর্নামেন্টে অংশ নিচ্ছিল না। কিন্তু তবুও ইংল্যান্ডের অত্যন্ত সমীহ-জাগানিয়া ক্লাব ছিল এটি। সেসময়কার আরেক বিখ্যাত ক্লাব ব্লাকবোর্ন রোভার্সকে এক ম্যাচে ৮-১ গোলে হারিয়েছিল করিন্থিয়ান্স। পিলগ্রিম, ব্রেন্টউড, লন্ডন ক্যালেডোনিয়ানের মতো কিছু অ্যামেচার ক্লাবের হয়েও খেলেছিলেন অ্যান্ড্রু ওয়াটসন।
১৮৮৫ সালে তিনি আবার স্কটিশ ক্লাব কুইন্স পার্কে খেলতে আসেন। ১৮৮৬ সালে তিনি আবারও স্কটিশ কাপ জেতেন। কুইন্স পার্কের হয়ে ১৮৮১, ১৮৮২ এবং ১৮৮৬ – এই তিন বছরে তিনবার স্কটিশ কাপ জিতেছিলেন।
দিন গড়াতে থাকে, অ্যান্ড্রু ওয়াটসনের বয়স ততদিনে ত্রিশের কোঠায় পা দিয়েছে, খেলায় বয়সের ছাপ পড়তে শুরু করেছে। ফুটবল ক্যারিয়ার যখন শেষ বলেই ধরে নিয়েছিলেন, ১৯৮৭ সালের ঠিক সেই সময়েই লিভারপুলের একটি স্থানীয় ক্লাব বুটল এফসি তাকে খেলার অনুরোধ জানায়। তিনি শেষ সুযোগ হিসেবে প্রস্তাবটি লুফে নেন, বুটলে যোগ দেন। এ সময় তিনি এলিজা কেট টেইলরকে বিয়ে করে আবারও লন্ডনে থিতু হন।
বুটল সেসময় খেলোয়াড়দের সাথে অর্থনৈতিক ব্যাপারে আনুষ্ঠানিকভাবে, অর্থাৎ কাগজে কলমে চুক্তি করতো এবং চুক্তিপত্র অনুযায়ী বেতন দিত বলে জানা যায়। সুইফটস-করিন্থিয়ান্সের মতো নামকরা ক্লাব না হলেও এই ক্লাবটি অ্যামেচার নয়, বরং প্রফেশনাল ক্লাব হিসেবেই পরিচিত ছিল। অল্পবিস্তর যাই হোক না কেন, খেলোয়াড়দের বেতন ও সাইনিং ফি দিতো ক্লাবটি। কিন্তু গ্লাসগো থেকে লিভারপুলে আসায় ক্ষতিপূরণ বাবদ কোনো টাকা ক্লাবটি ওয়াটসনকে দিয়েছিল কি না, কত টাকা বেতন নির্ধারিত হয়েছিল, কিংবা তিনি আদৌ নিয়েছিলেন কি না, এখনও পর্যন্ত তার কোনো লিখিত নথিপত্র বা প্রমাণ পাওয়া যায়নি। কিন্তু যেহেতু ক্লাবটি সব খেলোয়াড়দেরই বেতন দিত, তাই অনেকেই মনে করেন যে ওয়াটসনকেও তার প্রাপ্য পারিশ্রমিক দেওয়া হয়েছে।
টনি অনস্লো তার বই ‘The Forgotten Rivals: A History of Bootle Club’ বইতে এ ব্যাপারে আলোকপাত করেন। অনস্লো আরো লেখেন, সেবার বুটলের সাথে গ্রেট ব্রিজ ইউনিটি এফসি নামের এক ক্লাবের সাথে খেলা পড়ে। ম্যাচের আগে আগে কেউ সেই ক্লাবটিকে ‘স্মিথ অফ ওকসফিল্ড’ নামের কেউ টেলিগ্রাম পাঠায় এই লিখে যে, অ্যান্ড্রু ওয়াটসন এবং আরেকজন স্কটিশ খেলোয়াড় অ্যান্ডারসনকে টাকার বিনিময়ে খেলাচ্ছে বুটল। সেই ম্যাচে বুটল ইউনিটিকে ২-১ গোলে হারায়। ম্যাচ হারার পর (রাগবশতই হবে হয়তো) ইউনিটি এফএ’র কাছে বুটলের ব্যাপারে অভিযোগ জানায়। এফএ তদন্ত করে ঘটনার সত্যতা পায়। তবে তেমন বড় কোনো শাস্তি হয়নি তাদের।
মূলত সেসময় ব্যাপারটা এরকম ছিল যে, কোনো খেলোয়াড়কে কোনো ফুটবল ক্লাব পারিশ্রমিক দিতে চাইলে আগে সেই খেলোয়াড়টিকে টানা কয়েক বছর নির্দিষ্ট এলাকায় থাকতে হতো। কেবল তাহলেই তিনি পারিশ্রমিকের উপযুক্ত হতেন। অ্যান্ড্রু গ্লাসগো থেকে সরাসরি বুটলে যোগ দিয়েছিলেন। তাই তাকে পারিশ্রমিক দেওয়া হয়েছিল কি না, সে নিয়ে এখনো ধোঁয়াশা আছে। তবে অনেকেই দাবি করেন, স্কটল্যান্ড জাতীয় দলের সাবেক খেলোয়াড়কে বিনে পয়সায় খেলায়নি বুটল।
যদি এসব ঘটনা সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে আর্থার হোয়ার্টন নয়, অ্যান্ড্রু ওয়াটসনকেই ইতিহাসের প্রথম পেশাদার কৃষ্ণাঙ্গ ফুটবলারের স্বীকৃতি দিতে হয়। কিন্তু যথেষ্ট প্রমাণাদির অভাবে ইতিহাস এখানে নিশ্চুপ।
টাকাপয়সা সংক্রান্ত ব্যাপারটা বাদ দিলে বুটলের হয়ে যে স্বল্প সময় খেলেছিলেন, তা সফলই বলা যায়। বুটলের অধিনায়ক ছিলেন তিনি। তার অধিনায়কত্বে প্রথম মৌসুমেই বুটল এফএ কাপের পঞ্চম রাউন্ডে উঠতে পেরেছিল। এরপর খেলতে গিয়ে অ্যান্ড্রু ওয়াটসন ইনজুরিতে পড়েন, বাধ্য হয়ে ১৮৯২ সালে তাকে অবসরে যেতে হয়।
খেলা ছেড়ে দিয়ে ওয়াটসন বাকি জীবন মেরিন ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করেন। ১৯২১ সালে নিউমোনিয়ায় ভুগে লন্ডনেই তিনি মারা যান।
১৯২৬ সালে ওয়াটসনের বুটল এফসি’র হয়ে খেলা প্রথম ম্যাচের প্রায় ৪০ বছর পর ‘Tityrus’ নামের একজন ক্রীড়া লেখক অ্যান্ড্রু ওয়াটসনকে স্কটল্যান্ডের সর্বকালের সেরা লেফটব্যাক হিসেবে আখ্যা দেন অ্যাথলেটিক নিউজ ম্যাগাজিনের এক প্রতিবেদনে। (Tityrus মূলত অ্যাথলেটিক নিউজের এডিটর জে. এ. এইচ. ক্যাটোনারই ছদ্মনাম ছিল।)
তাহলে স্কটল্যান্ডের ইতিহাসের সেরা খেলোয়াড়দের একজন যিনি, তাকে ইতিহাস কেন ভুলে গিয়েছে? কেন ফুটবল কমিউনিটি এই মানুষটির অস্তিত্ব সম্পর্কে উদাসীন, জেনেও না জানার ভান করে আছে কেন ইংল্যান্ড ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন?
দশকের পর দশক ধরে ইতিহাসবেত্তারা বলেছেন, ইতিহাসের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ ফুটবলার আর্থার হোয়ার্টন। আর্থারেরও প্রায় ১১ বছর আগে থেকে খেলা শুরু করা অ্যান্ড্রু ওয়াটসনের কথা কোথাও আসেনি। এই ভ্রান্তির একটা কারণ হতে পারে, ১৮৮৮ সালের আগে, অর্থাৎ যে বছর ইংলিশ ফুটবল লিগের জন্ম হয় (যা আজকের ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের পূর্বসূরী), এর আগে যদি পৃথিবীর কোথাও কোনো লিগে কোনো কৃষ্ণাঙ্গ ফুটবলার খেলেও থাকেন, তারা অবশ্যই প্রফেশনাল কোনো লিগ বা প্রফেশনাল কোনো ক্লাবের হয়ে খেলেননি। সবই ছিল অ্যামেচার ক্লাব বা লিগ। কারণ, ইংল্যান্ডের আগে সেভাবে কোথাও ফুটবল লিগের অবকাঠামো গড়েই ওঠেনি। তাই তারা ১৮৮৮ সালের আগের অনেক ইতিহাস ধর্তব্যের মধ্যেও আনতে চান না। নইলে ১৮৮৭ সালে খোদ ইংল্যান্ডের বুকেই লিভারপুলের বুটল এফসি’র কথা বা অ্যান্ড্রু ওয়াটসনের কথা এভাবে এতদিন অগোচরে থাকত না।
আরেকটা ব্যাপার হতে পারে, ওয়াটসনের গায়ের রঙ তার অন্য সতীর্থদের থেকে খুব একটা আলাদা করে বোঝা যেতো না। Scottish Athletic Journal-এর ১৮৮৫ সালের এক সংখ্যায় রেসিজম নিয়ে কিছুটা ইঙ্গিত দেওয়া হয়,
“Although on more than one occasion subjected to vulgar insults by splenetic, ill-tempered players, he uniformly preserved that gentlemanly demeanour”.
ধনী,ভদ্র এবং উচ্চশিক্ষিত হওয়ায় সম্ভবত ভয়ানক ধরনের কোনো রেসিস্ট আচরণের শিকার হননি তিনি।
একমাত্র যে লিখিত ম্যাচ রিপোর্ট পাওয়া গেছে, তা যে বিষয়টিকে কেন্দ্র করে লেখা হয়েছিল, সেটি হলো ওয়াটসনের বাদামি জুতো পরে খেলতে নামা। সে সময় সব ফুটবলাররা কালো বুট পরে খেলতেন। কেন ওয়াটসন বাদামি জুতো পরে খেলতে নেমেছিলেন, জানা যায়নি। কিন্তু ব্যতিক্রমী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বলে ইতিহাসের কোনো একটা লিখিত ম্যাচ রিপোর্টে তো অন্তত তার নাম লেখা হয়েছে! এছাড়া অন্য পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত বিভিন্ন লেখায় তার গতি ও দক্ষতার প্রশংসাই করা হয়েছে বারবার।
এই অসঙ্গতিগুলো নিয়ে প্রায়ই আলোচনা ও গবেষণা হচ্ছে। ২০১২ সালে স্কটিশ হল অফ ফেইম প্রথম এই প্রসঙ্গ তুলে ধরেন। সে বছরই স্কটিশ হল অফ ফেইমে তার নাম যুক্ত করা হয়। এরপর আরেক ক্রীড়া ঐতিহাসিক অ্যান্ডি মিশেল লম্বা সময় এ নিয়ে গবেষণা করেন। দীর্ঘ সময় পর্যন্ত মানুষ জানতেন অ্যান্ড্রু ওয়াটসন অস্ট্রেলিয়ায় চলে গেছেন এবং সেখানেই মৃত্যুবরণ করেছেন। ২০১৩ সালে অ্যান্ডি মিশেল মিডিয়ার সামনে প্রমাণসহ সত্যিকার তথ্য তুলে ধরেন।
২০১৯ সালে হ্যাম্পডেন বোলিং ক্লাবে অ্যান্ড্রু ওয়াটসনের একটি ম্যুরাল আঁকা হয় ১৮৮২ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে স্কটল্যান্ডের ৫-১ গোলের জয়কে স্মরণ করে।
২০২০ সালে দক্ষিণ গ্লাসগোর শ’ল্যান্ডে আরো একটি ম্যুরাল আঁকা হয়, যা ইন্টারনেট দুনিয়ায় ব্যাপক আলোড়ন তোলে।
এখানে আরো একজন ফুটবলারের কথা স্মরণ করতে হয়। তিনি রবার্ট ওয়াকার। রবার্ট ওয়াকারও পার্কগ্রুভ এফসিতে খেলতেন। ১৮৭৭-৭৮ মৌসুমে অ্যান্ড্রু ওয়াটসন ও রবার্ট ওয়াকার প্রথম একসাথে খেলেছিলেন। সেই মৌসুমসহ তিন মৌসুমে তারা বেশ কিছু ম্যাচ একসাথে খেলেছেন। এরপর অ্যান্ড্রু ওয়াটসন কুইন্স পার্কে চলে যান, কিন্তু রবার্ট ওয়াকারের ক্যারিয়ারের কী হলো তা নিয়ে আর তেমন কিছু জানা যায়নি। তবে এতটকু জানা যায় যে, পার্কগ্রুভের হয়ে খেলার আগে তিনি থার্ড ল্যানার্ক নামের স্কটিশ ক্লাবে খেলতেন। এই ক্লাবের হয়ে ১৯৭৫-৭৬ মৌসুমে স্কটিশ কাপের ফাইনাল খেলেছিলেন কুইন্স পার্কের বিপক্ষে। প্রথম ফাইনাল ১-১ গোলে ড্র হলে রিপ্লে ম্যাচে ২-১ গোলে জয় পায় কুইন্স পার্ক।
Scottish Referee নামের এক ম্যাগাজিনের ১৯০৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে রবার্ট ওয়াকারের জন্মপরিচয় ও জাত সম্পর্কে ইঙ্গিত দেওয়া হয়। সেখানে রবার্ট ওয়াকারকে ‘ডার্কি ওয়াকার’ (Dark-ey Walker) বলে উল্লেখ করে বলা হয়, অ্যান্ড্রু ওয়াটসন ছাড়াও মিশ্র জাতিসত্তার এই আরেকটি খেলোয়াড়ই স্কটিশ কোনো ক্লাবে খেলার সুযোগ পেয়েছেন। স্কটিশ ফুটবল মিউজিয়ামের কিউরেটররা ১৮০০ শতাব্দীর বিভিন্ন নথিপত্র উদ্ধার করে এসব তথ্য পান।
আর্থার হোয়ার্টনকে যেরকম অবর্ণনীয় কষ্টের ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছিল মাঠ ও মাঠের বাইরে, সেরকমটা হয়নি অ্যান্ড্রু ওয়াটসনের সাথে। বরং তিনি স্কটল্যান্ডের হয়ে খেলেছেন, অধিনায়কত্ব করেছেন, ইংল্যান্ডে এসেও ভালো কিছু ক্লাবের সাথে খেলার সুযোগ পেয়েছেন। আর্থার হোয়ার্টনের জীবন থেকে আমরা যেমন শিক্ষা পাই রেসিজম ফুটবলে শুরু থেকেই ছিল, তেমনি ওয়াটসনের গল্প শুনে আমাদের আশা জাগে, স্পোর্টসে বা ফুটবলে রেসিজম দূর করার উপায় হলো সহানুভূতিশীল হওয়া, যোগ্যতাকে সম্মান করতে শেখা। কোনো ফুটবলারকে বিচার করার একটাই মাপকাঠি, তা হলো তার ফুটবলিং টেকনিকস ও অ্যাবিলিটি। একইসাথে এটিও বলা যায় যে, ইংল্যান্ডের তুলনায় স্কটল্যান্ড মিশ্র বা ভিন্ন জাতিসত্তার মানুষের প্রতি বরাবরই সহনশীল ও উদার ছিল। রবার্ট ওয়াকার, অ্যান্ড্রু ওয়াটসন ছাড়াও আরো কোনো কৃষ্ণাঙ্গ ফুটবলার সেসময় ছিলেন কি না, সেসব আরো গবেষণার দাবি রাখে। ধীরে ধীরে নিশ্চয়ই সব সঠিক তথ্য একদিন আমরা জানতে পারবো।