বিশ্বকাপে রোনাল্ড ক্যোমান ও ইয়োহান ক্রুইফের দল হল্যান্ডের ব্যতিক্রমধর্মী একটি রেকর্ড আছে, যে রেকর্ড একাধারে তাদের তিক্ত স্মৃতি মনে করায়, পাশাপাশি বিশ্বকাপে তারা কতটা ধারাবাহিক তারও প্রমাণ দেয়। কারণ, ডাচরা একমাত্র দেশ, যারা তিনবার বিশ্বকাপ ফাইনালে গেলেও কোনোবার শিরোপা জিততে পারেনি। বিশ্বকাপে এমন নিয়মিত দল যদি কোন বিশ্বকাপে না অংশগ্রহণ করে, তার থেকে অবাক করা বিষয় আর কিছু হতে পারে! আর এমন ঘটনা ঘটেছিল রাশিয়া বিশ্বকাপে।
২০১৮ সালের রাশিয়া বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে হল্যান্ড ছিল গ্রুপ ‘এ’তে। গ্রুপে হল্যান্ড বাদে একমাত্র বড় দল ছিল ফ্রান্স। কিন্তু সে বাছাইপর্বে চমক দেখায় স্লাতান ইব্রাহিমোভিচের দেশ সুইডেন। হল্যান্ডকে টপকে দ্বিতীয় হয়ে সরাসরি জায়গা করে নেয় প্লে-অফে। আর তৃতীয় হওয়ায় কোনো সুযোগ বেঁচে থাকে না হল্যান্ডের জন্য। আর সুইডেন প্লে-অফে গিয়ে হারিয়ে দিয়েছিল আরেক বড় শক্তি, ইতালিকে। ফলে এক পুঁচকে সুইডেনের জন্য রাশিয়া বিশ্বকাপে খেলা হয়নি হল্যান্ড ও ইতালির মতো দেশগুলোর।
বিশ্বকাপ প্রসঙ্গ থাক। ইউরো কাপের কথা বলি। ২০১৬ এর ইউরো কাপ বাছাইপর্বে হল্যান্ড ছিল গ্রুপ ‘এ’-তে। খালি চোখে সে গ্রুপে হল্যান্ডের বিপক্ষে লড়াই করার মতো অন্য কোনো দেশ ছিল না। কিন্তু চেক প্রজাতন্ত্র, আইসল্যান্ড ও তুরস্ক টপকে যায় হল্যান্ডকেও। আর ১০ ম্যাচ খেলে মাত্র ১৩ পয়েন্ট অর্জন করা হল্যান্ডের সামনে কোনো সুযোগই ছিল না ইউরো কাপের মূলপর্বে যাওয়ার। তাই ২০১৪ বিশ্বকাপের পর এ পর্যন্ত আসলে বড় দু’টি প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হলেও হল্যান্ড সবসময় ছিল দর্শক হয়ে। কিন্তু ২০১০ ও ২০১৪ বিশ্বকাপে চমক দেখানো দলে কেন এমন অধঃপতন?
ইতালি যে কারণে মাঝে পথ হারিয়েছিল, হল্যান্ডের কারণও প্রায় এক। হুট করে দলের তারকাদের হারিয়ে ফেলা এবং যোগ্য নেতৃত্বের অভাব। রোনাল্ড ক্যোমান বা ইয়োহান ক্রুইফের পর তাদের স্বর্ণালী সময় ছিল ২০১০ থেকে ২০১৪ এর সময়গুলো। দলে তখন ক্যারিয়ারের সেরা সময় অতিক্রম করা রবিন ফন পার্সি, আরিয়েন রোবেন, ওয়েসলি স্নেইডার, ফন বোমেল বা মার্টিন স্টেকেলেনবার্গরা। এদের সংমিশ্রণে ২০১০ সালের হল্যান্ড খেলেছেও নান্দনিক ফুটবল। ২০১৪ ব্রাজিল বিশ্বকাপে ২০১০ এর ফাইনালে তোলা নায়করা না থাকলেও গোটা দল ছিল দুর্দান্ত। কিন্তু এরপরই হল্যান্ড রং হারাতে শুরু করে। রোবেন ও ফন পার্সির ঐ বিশ্বকাপের পর খুব বেশি খেলেননি। স্নেইডার, হান্টেলার বা ডিক কার্টরাও বিদায় নিয়েছেন একে একে। কিন্তু তাদের স্থানে হল্যান্ডের উত্তরসূরী হিসেবে কেউ আসতে পারেননি। ফলে হল্যান্ডও তাদের জৌলুস হারিয়ে ফেলে, ছিটকে যায় বিশ্বকাপ ও ইউরোতে।
হল্যান্ডের নিদারুণ ব্যর্থ সময়ে দলকে গড়ে তুলতে পারেননি কোনো কোচও, যতটা পেরেছিলেন ব্রাজিল বিশ্বকাপের সময় লুই ফন গাল। কিন্তু বিশ্বকাপের পর ফন গাল বিদায় নিলে হল্যান্ড জাতীয় দল আর উন্নতির মুখ দেখেনি। কোচ গাস হিডিঙ্কের ফর্মেশনে খাপ খাওয়াতে না পারাতে ডাচদের এই বেহাল দশা। ব্রাজিল বিশ্বকাপে তৃতীয় হওয়া দলটিকে সাবেক কোচ লুই ফন গাল খেলাতেন ৫-৩-২ ফরম্যাটে। কিন্তু, হিডিঙ্ক চেষ্টা করলেন ক্ল্যাসিক ডাচ ফর্মেশন ৪-৩-৩ এ খেলানোর।
তবে নতুন ফর্মেশনে খাপ খাওয়াতে পারেনি স্নেইডার বাহিনী। জুলাইয়ে পদত্যাগ করলেন হিডিঙ্ক, দায়িত্ব নিলেন সহকারী কোচ ড্যানি ব্লাইন্ড। তবে ব্লাইন্ডেও শেষ রক্ষা হয়নি ডাচদের। তাই তিন বছর ব্যর্থতার সাগরে ভেসে বেড়ানোর পর অবশেষে দলটির হর্তাকর্তারা একটি সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে অগ্রসর হন। ২০১৮ সালে দলটির দায়িত্ব নেন রোনাল্ড ক্যোমান। যিনি একসময় খেলোয়াড় হয়ে হল্যান্ড মাতিয়েছেন। তবে ততদিন নিশ্চিত হয়ে গেছে, ডাচবাহিনী থাকবে না বিশ্বকাপে। তাই সে বছরের মার্চে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে প্রীতি ম্যাচ দিয়ে হল্যান্ডে কোচিং জীবন শুরু করেন ক্যোমান।
শুরুটা তার ভালো হয়নি, প্রথম ম্যাচে হেরেছিলেন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। কিন্তু ক্যোমানের পরিকল্পনা ছিল দীর্ঘমেয়াদী। তাই সামনে উয়েফা নেশনস লিগকে লক্ষ্য রেখে ক্যোমান শুরু করলেন আসন্ন ইউরোর জন্য দল গোছানো। আর মেঘ না পেতেই জলের মতো তার হাতে থাকল নেশনস লিগে বড় দেশের বিপক্ষে খেলার সুযোগ।
ডাচবাহিনীর অন্যতম কঠিন এবং গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ ছিল বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে ফ্রান্সের বিপক্ষে। সেখানে ৪-০ গোলে বিধস্ত হয়েছিল তারা। দলের অবস্থা তখন থেকেই নড়বড়ে, স্নেইডার ও রোবেন দলে থাকলেও ক্যারিয়ারের সায়াহ্নে উপস্থিত। তাই বাছাইপর্বে ব্যর্থতার পর দু’জনই অবসর নিলে দল একদমই এলোমেলো হয়ে যায়। আর প্রথমেই ক্যোমান এই এলোমেলো দল সাজানোর পরিকল্পনা করেন। তার অধীনে সুযোগ পেতে থাকে এমন সব খেলোয়াড়, যারা আগে দলে ডাক পেলেও নিয়মিত একাদশে থাকার সুযোগ মিলত না।
গোলরক্ষক পজিশনে ক্যোমান ইয়াসপার সিলেসেনের উপরই ভরসা রাখলেন, কিন্তু রক্ষণ পুরোপুরি বদলে ফেলেন। তার অধীনে নতুন দুই রক্ষণ-জুটি হয় ফন ডাইক ও ডি লিটকে ঘিরে, যারা আগে কখনোই নিয়মিত ছিলেন না। আর বেঞ্চে নাথান আইক ও স্টিফেন ডি ভ্রাই থাকার কারণে বর্তমানে হল্যান্ডের রক্ষণ কতটা শক্তিশালী, তা বর্তমানের ম্যাচগুলো দেখলেই বোঝা যায়।
ডাচদের হয়ে বর্ষীয়ান খেলোয়াড় ব্লিন্দ খেলতেন ভার্সেটাইল খেলোয়াড় হিসেবে। ক্যোমান তাকে স্থায়ী পজিশন দেন – লেফটব্যাক, যার বদলি খেলোয়াড় প্যাট্রিক ফন আর্নহল্ট। রাইটব্যাকে ডেঞ্জেন দুমফ্রাইস ও আয়াক্সের জোয়েল ভেন্টমান। আর ৪-৩-৩ ফর্মেশনে খেলা ক্যোমান নিয়মিত খেলান ব্লিন্দ, ডি লিট, ভ্যান ডাইক ও দুমফ্রাইসকে। আর এখানেই ক্যোমানের বড় সাফল্য। অথচ এই প্রক্রিয়ার কথা ফন গালের পর, আর কোনো কোচ কেউ ভাবেননি।
রক্ষণ ছাড়াও বর্তমান হল্যান্ডের মধ্যমাঠ আরও আকর্ষণীয়। ৪-২-৩-১ এ খেললে ডাবল পিভটে দে রুন ও ডি ইয়ং অটো চয়েজ। আর মধ্যমাঠের অন্যতম ট্রাম্পকার্ড হচ্ছে জর্জিনো ভাইনালদুম ও ফন দি বিক। মধ্যমাঠ শাসনের পাশাপাশি এদের অন্যতম দক্ষতা গোল করা, যেখানে ভাইনালদুম বেশি সফল। সেন্টার-মিডফিল্ডার বা অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার; যে পজিশনেই ভাইনালদুমকে নামানো হয়, তিনি পুরো মধ্যমাঠ যেন চষে ফেলবেন। প্রতিপক্ষের আক্রমণ নষ্ট, গোল সুযোগ তৈরি বা গোল করা সবখানেই তার প্রতিপত্তি। এজন্য একজন মিডফিল্ডার হয়েও ভাইনালদুম ইউরো বাছাইপর্বের ৭ ম্যাচে করেছেন ৮ গোল।
ভাইনালদুম নিজেও বক্স-টু-বক্স মিডফিল্ডার। কিন্তু তিনি এমন স্বস্তিতে ওঠানামা করতে পারেন বার্সেলোনার মিডফিল্ডার ফ্রেঙ্কি ডি ইয়ংয়ের দৌলতে। বার্সেলোনা ডি ইয়ংকে দলে ভিড়িয়েছিল সার্জিও বুসকেটসের উত্তরসূরী হিসেবে। এই দলবদলই বলে দেয় ডি ইয়ংয়ের দক্ষতা। ‘গেম রিড’ করার যে ব্যাপারটা আছে, ডি ইয়ং জন্মেছেন এই বিরল শক্তি নিয়ে। আর মধ্যমাঠ থেকে ডিফেন্সচেরা পাস তার কাছে জলভাত। একাদশে এই ডি ইয়ং থাকার দৌলতে ক্যোমান পেয়েছেন কিছু বাড়তি স্বাধীনতা। ব্রাজিল বিশ্বকাপে ফন গালের ৫-৩-২ ফর্মেশনে না গিয়ে তিনি ব্যবহার করছেন ৪-২-৩-১, ৪-৩-৩ কিংবা ৩-১-৪-২ এর মতো ক্লাসিক ফর্মেশন।
দুর্দান্ত রক্ষণ ও ভয় জাগানো মধ্যমাঠ থাকলেও আক্রমণভাগে কোনো তারকা খেলোয়াড় নেই হল্যান্ড দলে। মেম্ফিস ডিপাই ও প্রমেস সবসময় দলে নিয়মিত। ২৯ বছর বয়সী লুক দি ইয়ং সুযোগ পান কালেভদ্রে। তাই আক্রমণে ডিপাই ব্যতীত ভরসা করার আর কোনো অস্ত্র নেই ক্যোমানের ঝুলিতে। তবে তিনিও বসে নেই, আক্রমণের জন্য খুঁজে চলেছেন নতুন মুখ। পিএসভির হয়ে গত মৌসুমে গোলবন্যা ছোটানো দনওয়েল মালেন ও জাস্টিন ক্লুইভার্ট তারই প্রমাণ। তাই আশা করা যায়, আগামী ইউরোর আগে মালেন অথবা ক্লুইভার্ট থেকে কোনো একজন নিয়মিত দলের আক্রমণভাগে জায়গা করে নেবার মতো পরিণত হয়ে উঠবেন।
সেই ২০১০ বিশ্বকাপের আগে থেকে একটা জিনিস হল্যান্ড দলে বেশ পরিচিত। কোনো সময়ই তাদের পূর্ণ শক্তিশালীর একাদশ থাকে না। কয়েকজন তারকা খেলোয়াড়কে কেন্দ্র করে মধ্যমমানের খেলোয়াড় নিয়ে সবসময় একাদশ সাজিয়ে এসেছে দলটির কোচ। কিন্তু এইরকম একাদশই মোক্ষম সময়ে হয়ে উঠত পরাশক্তিতে। কারণ, সবকিছু ছাপিয়ে ফুটবল একটি দলগত খেলা।
ক্যোমান নামেই বেশ শক্তিশালী একটি দল পাচ্ছেন। ডিপাই, ভাইনালদুম, দি বিক, ডি লিট, ভ্যান ডাইক ও ডি ইয়ং প্রত্যেকে হল্যান্ড দলের শক্তির কেন্দ্রবিন্দু। আর ক্যোমানও কোচ হিসেবে যে জাদু দেখাচ্ছেন, হয়তো প্রাক্তন খেলোয়াড়ের ফুটবল দর্শন এবং তরুণ শক্তিতে ভর করে ‘ফ্লায়িং ডাচ’রা আবারও জেগে উঠবে, ঠিক প্রমাণ করার মঞ্চে।
খেলাধুলার চমৎকার, জানা-অজানা সব বিষয় নিয়ে আমাদের সাথে লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: https://roar.media/contribute/
ফুটবল নিয়ে আরও জানতে পড়তে পারেন এই বইগুলোঃ