১৯৫৮ সাল। ফুটবল বিশ্বকাপের আরো একটি বছর এসে উপস্থিত। কিন্ত ফুটবল বিশ্বকে কেন্দ্র করে সব দেশের পরিস্থিতি পরিবর্তন হয়ে গেলেও ব্রাজিলিয়ানদের কাছে একটি ব্যর্থতা সবসময়ই কষ্ট দিয়ে যায়। যে দেশের সকল ধ্যান ধারণা ফুটবলকে ঘিরে। ফুটবলকে যারা ভালোবেসে নিজের জীবনের একটি অংশ বানিয়ে ফেলেছে তারা কখনো বিশ্বকাপ জিততে পারেনি! সেই বছর ছিলো বিশ্বকাপ ফুটবলে ৬ষ্ঠ আসর। আর সেবারই প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ জিতেছিলো ব্রাজিল। আর্বিভাব হয়েছিলো সর্বকালের সেরা ফুটবলার পেলের। কিংবদন্তী পেলেকে সবাই চেনে, শ্রদ্ধা করে সেই ঐতিহাসিক পেলে-গারিঞ্চা জুটিকে। সেই ব্রাজিল দলে জিতো, নিল্টন সান্তোস বা জাগালো পরিচিত নাম। কিন্ত ভাভা! তাকে ক’জন সব সময় শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে? অথচ ভাভা টানা দুই বিশ্বকাপ ফাইনালে গোল করেছিলেন। পেলে, গারিঞ্চা, জিতোর পাশাপাশি ভাভা ছিলেন নিশ্চুপ আস্থার নাম।
এদভালদো জিসদিতো নেতো অথবা ভাভার জন্ম হয়েছিলো ব্রাজিলের রিফিফিতে ১৯৩৪ সালের ১২ নভেম্বর। আর সব ব্রাজিল ফুটবলারদের মতো তিনিও খুব সহজে ফুটবলের মঞ্চে উঠে আসেননি। তার ফুটবল ক্যারিয়ার শুরু ব্রাজিলের স্থানীয় ক্লাব ভাস্কো দ্য গামাতে। ভাস্কো দ্য গামাতে ভাভা যখন পরিণত খেলোয়াড় হয়ে উঠছেন, সান্তোসেও তখন বেড়ে উঠছেন পেলে, জিতো, গারিঞ্চারা। ব্রাজিলের সময়টা খুব একটা ভালো নয় তখন। ছয় বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হবার পর সবগুলোতে অংশগ্রহণ করেও শিরোপা ছুঁতে পারেনি সেলেসাওরা। ১৯৫০ বিশ্বকাপ নিজেদের মাঠে অনুষ্ঠিত হলেও সেবার রানার্সআপ হয় দলটি। পরের বিশ্বকাপ হতাশায় পার হলেও দৃশ্যপট দ্রুত পরিবর্তন হতে থাকে ১৯৫৮ বিশ্বকাপের আগে।
সে বিশ্বকাপে প্রায় আনকোরা এক দল নিয়ে সুইডেনে হাজির হয় ব্রাজিল। বিশ্বকাপ জেতার জন্য সম্ভাব্য সকল প্রস্তুতি নিয়েই সুইডেনে হাজির হয়েছিলো দলটি। একটি পূর্ণাঙ্গ দলের জন্য যা কিছু প্রয়োজন তার সবই ছিলো সেই দলে। কোচ ভিনসেন্ট ফিউলা নিজেই একজন পরামর্শদাতা, একজন চিকিৎসক, একজন ট্রেনার, একজন মনোবিদের ভূমিকায় হাজির হন। দলের জন্য সঠিক হোটেল নির্বাচনের জন্য দায়িত্ব দেয়া হয় দলের মূল চিকিৎসক হিলটন গসলিংয়ের কাঁধে।
কথিত আছে, খেলোয়াড়দের মনোযোগে নষ্ট হতে পারে এই ভয়ে হোটেলের সকল নারী কর্মী হটিয়ে পুরুষ কর্মী নিয়োগ দেয়া হয়। ব্রাজিলের সকল পরিকল্পনা সবাই বুঝতে পারলেও ভিনসেন্ট ফিউলার দলের ভেতরের অবস্থা বোঝার সাধ্য কারও ছিলো না। পেলে এবং গারিঞ্চার দক্ষতা বিশ্বমঞ্চের কাছে ছিলো অজানা। রক্ষণভাগে অভিজ্ঞ অধিনায়ক হিলডারেলডো বেল্লিনির নেতৃত্বে জালমা সান্তোস এবং নিল্টন সান্তোস। মিডফিল্ড সাজানো হয় দিদি ও জিতোর নেতৃত্বে। আর আক্রমণভাগে পেলে আর গারিঞ্চার সাথে অন্যতম ভূমিকা দেওয়া হয় ভাভাকে। সাথে ছিলেন কিংবদন্তী জাগালো।
১৯৫৮ বিশ্বকাপ
১৯৫৮ বিশ্বকাপের মিশন শুরু হয় অস্ট্রিয়ার বিপক্ষে। মাজ্জোলার জোড়া গোল এবং নিলটন সান্তোসের গোলে পেলে ও গারিঞ্চা বাদেই সহজ জয় পায় ব্রাজিল। দ্বিতীয় ম্যাচেও পেলে বা গারিঞ্চা নামেননি। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সেই ম্যাচে ভুগতে হয়েছিলো ব্রাজিলকে। ইংল্যান্ডের যান্ত্রিক ফুটবল ও ব্রাজিলের শৈল্পিক ফুটবল মিলেমিশে হয়েছিল গোলশূন্য ড্র। তৃতীয় ম্যাচ পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপক্ষে। সেই কঠিন ম্যাচে কোচ ফিউলা আর পেলে বা গারিঞ্চাকে বসিয়ে রাখতে পারেননি। পাশাপাশি প্রথম পছন্দের স্ট্রাইকার জোসে আলতাফিনির (মাজ্জোলা) নিয়ে সন্তুষ্ট না হবার কারণে প্রথমবারের মতো ভাভাকে নামানোর সিদ্ধান্ত নিলেন ব্রাজিল কোচ। বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো ভাভা, পেলে ও গারিঞ্চা নামার পর প্রথম ৩ মিনিট পার হবার আগেই গোল করেন ভাভা। ৭৭ মিনিটে করেন নিজের ও দলের হয়ে দ্বিতীয় গোল। সেলেসাওরা যেন নতুন করে পেলে-ভাভা-গারিঞ্চাত্রয়ীর ভেতর আবিষ্কার করলো জোগো বনিতোর পূর্ণরুপ।
পেলের একমাত্র গোলে ওয়েলসকে হারিয়ে ব্রাজিল কোয়ার্টার ফাইনালে মুখোমুখি হয় উড়তে থাকা জাঁ ফন্টেইনের ফ্রান্স দলের সাথে। ফ্রান্সের সাথে ২ মিনিটেই গোলমুখ খোলেন ভাভা। প্রথমার্ধে দিদি আরো একটি গোল যোগ করেন। দ্বিতীয়ার্ধে পেলে করেন বিশ্বকাপ ইতিহাসের দ্বিতীয় হ্যাটট্রিক। ৫-২ গোলে ফ্রান্সকে হারিয়ে দ্বিতীবারের মতো ফাইনালে যায় ব্রাজিল। ফাইনাল ম্যাচ বাদেই ভাভা করে ফেলেছিলেন ৩ গোল। তবে তার আসল গল্প এখনো বাকি।
২৯ জুন, ১৯৫৮। স্বাগতিক সুইডেনের মুখোমুখি ব্রাজিল। পুরো বিশ্বকাপে জাত চিনিয়ে দেওয়া সুইডেন ফাইনাল ম্যাচেও ফেভারিট। সেই ফেভারিটের জোরেই সুইডেনের স্ট্রাইকার লাইহোম গোল করে বসেন। সবার মনে শঙ্কা, তাহলে কি ১৯৫০ বিশ্বকাপের স্মৃতি ফিরে আসছে? কিন্ত হাল না ছাড়া ব্রাজিল নিজের স্বভাবত ফুটবল খেলে যেতে থাকে। এবং এর ফলেই ৮ম মিনিটে গারিঞ্চার দুর্দান্ত থ্রু পাস থেকে দারুণ এক গোল করে ব্রাজিলকে সমতায় ফেরান ভাভা। ৩২ মিনিটে আবার গারিঞ্চা ও ভাভা জুটির জাদু। মাঝমাঠ থেকে একাই বল বের করে এনে এগিয়ে দিয়েছিলেন ভাভাকে। ভাভা সহজ সুযোগকে জালে জড়াতে বিন্দুমাত্র ভুল করেননি।
ব্রাজিলকে সমতায় ফেরানোর পর ৩২ মিনিটে জোড়া গোল করে শিরোপা জয়ের এক ধাপ এগিয়ে নেন ভাভা। সেই ম্যাচে পেলের জোড়া গোল আর মারিও জাগালোর গোলে সুইডেনকে ব্রাজিল হারিয়েছিলো ৫-২ গোলে। প্রথম বিশ্বকাপ জয়ে সেরা খেলোয়াড় অবশ্যই ছিলেন পেলে। কিন্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপক্ষে এবং ফাইনালে জোড়া গোল না করে ভাভা যদি ব্রাজিলকে আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে না দিতেন, তাহলে ব্রাজিল কি এত পথ পাড়ি দিতে পারতো? এবং আশ্চর্যের একটি কথা এখনো বাকি থেকে যায়, ভাভা সেই বিশ্বকাপে খেলেছিলের পায়ের ইনজুরি নিয়ে।
১৯৬২ বিশ্বকাপ
১৯৫৮ বিশ্বকাপে ব্রাজিলের হয়ে সকল আলো কেড়ে নিয়েছিলেন পেলে। ৫ গোল করা ভাভা এবং প্রায় ম্যাচে অ্যাসিস্ট করা গারিঞ্চার অবদান ম্রিয়মান হয়ে গিয়েছিলো পেলের দাপটে। চিলি বিশ্বকাপেও ব্রাজিলের ভরসা ছিলো পেলের উপর। কিন্ত সেই পেলের যখন দুই ম্যাচ পরেই ইনজুরিতে বিশ্বকাপ শেষ হয়ে যায়, তখন ব্রাজিল দলকে একটাই টেনেছেন গারিঞ্চা। পাশাপাশি ছিলেন ভাভা, যার কাজ গারিঞ্চার বানিয়ে দেওয়া বলকে গোলে পরিণত করানো। ভিনসেন্ট ফিউলা ব্রাজিলকে প্রথম বিশ্বকাপ এনে দিয়েছিলেন ৪-২-৪ পজিশনে। পেলের ইনজুরিতে কোচ মরেইরা ব্যবহার করলেন ৩-৩-৪ পজিশন। যেখানে জাগালো খেলতেন মধ্যমাঠে। তাই গোল করার ক্ষেত্রে ব্রাজিল দল অনেকটা ভাভার উপর নির্ভরশীল ছিলো।
মেক্সিকোর বিপক্ষে দারুণ শুরু করেছিলো ব্রাজিল। প্রথম ম্যাচেই গোল পেয়েছিলেন পেলে। দ্বিতীয় ম্যাচে চেকাস্লোভাকিয়ার বিপক্ষে শুধু ড্র নয়, সেই ম্যাচে ইনজুরিতে পড়েছিলেন পেলে। পরের ম্যাচে পেলেবিহীন দল নামে স্পেনের বিপক্ষে। সেই ম্যাচে ব্রাজিলের ত্রাণকর্তা পেলের পরিবর্তে নামা আরমানদিলো। তিনি করলেন জোড়া গোল। তখনো গারিঞ্চা বা ভাভার কোনো জাদুর ঝলক চিলি বিশ্বকাপ দেখেনি। কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে জ্বলে উঠলেন তারা। বাঁকা পায়ের জাদুতে মুগ্ধ করলেন গারিঞ্চা। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৩-১ জয়ের অন্য গোলটি করলেন ভাভা। চিলির বিপক্ষেও এ জুটি গোলধারা বজায় রাখলেন। গারিঞ্চা ও ভাভা উভয়েই জোড়া গোল করে ব্রাজিলকে টানা দ্বিতীয়বারের মতো তুললেন ফাইনালে।
ফাইনালে মাত্র ১৫ মিনিটে গোল করে চেকোস্লোভাকিয়াকে এগিয়ে দিলেন মিডফিল্ডার জোসেফ মাসোপুসত। ১৯৫৮ বিশ্বকাপেও এভাবেই প্রথমে এগিয়ে গিয়েছিলো সুইডেন। কিন্ত ভাভার দৌলতে সমতায় আসতে পেরেছিলো ব্রাজিল। এবার ভাভা নয়, মাসোপুসতের গোল করার ২ মিনিট পরেই ব্রাজিলের হয়ে গোল করেন পেলের পরিবর্তে নামা আরমানদিলো। চেকোস্লোভাকিয়া আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। ৬৯ মিনিটে জিতো করেছিলেন দ্বিতীয় গোল আর শেষ পেরেকটি ঠুকে দিয়েছিলেন ভাভা। ৭৮ মিনিটে করা তার গোল ছিলো শিরোপা নির্ধারণী ও সকল সংশয় দূর করানোর।
জাতীয় দলের হয়ে মাত্র ২০টি ম্যাচ খেলা কোনো এক খেলোয়াড়কে তার ক্যারিয়ারকে তুলে ধরে না, বানিয়ে দেয় না কিংবদন্তীর খেতাব। তবে এত অল্প ম্যাচ খেলেও ভাভা তার দক্ষতা আর গোল করার ক্ষমতা প্রমাণ করেছিলেন। বিশ্বকাপে ৯ গোল, পরপর দুটি শিরোপা, টানা দুই বিশ্বকাপ ফাইনালে গোল প্রমাণ করে দেয় কেন ভাভা ব্রাজিলের সেরা স্টাইকারদের মধ্যে অন্যতম।
১৯৫৮ বিশ্বকাপে ব্রাজিলের হয়ে করেছিলেন ৫ গোল। ১৯৬২ বিশ্বকাপেও ভাভা করেছিলেন ৪ গোল। এবং প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে তিনি পরপর দুটি বিশ্বকাপ ফাইনালে গোলের দেখা পেয়েছিলেন। ১৯৫৮ বিশ্বকাপে তার জায়গার পাওয়ার কথা ছিলো না। মাজ্জোলার খামখেয়ালিপনা তাকে এনে দিয়েছিলো বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ। সেই সুযোগকে ব্যবহার করে ভাভা দুটো বিশ্বকাপে ফাইনালে গোল করলেন।
১৯৭০ বিশ্বকাপের আগে ব্রাজিলের এ দলটি ছিলো সবথেকে সেরা। কিন্ত পেলে, ভাভা ও গারিঞ্চাত্রয়ীর অবদান অনন্য সেরা। ১৯৬২ বিশ্বকাপে পেলের অবর্তমানে সবথেকে দরকার ছিলো গোলের। কারণ গারিঞ্চা সবসময়ই প্রস্তুত থাকতেন বলের জোগান দিতে। কিন্ত ভাভা যদি চিলি ও ইংল্যান্ডের বিপক্ষে গোল না করতেন? ১৯৫৮ বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ অবদান পেলের ঝুলিতে গেলেও ১৯৬২ সালে দ্বিতীয় বিশ্বকাপ জয়ের সর্বোচ্চ অবদান অবশ্যই ভাভা ও গারিঞ্চা জুটির। তবে ব্রাজিলের সোনালী সেই যুগে শ্রেষ্ঠ গোলদাতার খেতাব সবসময় রিফিফি অঞ্চলে বেড়ে ওঠা সেই ব্রাজিলিয়ান সিংহের।
Featured image: Sports Illustrated