এ বিশ্বে প্রতিনিয়ত প্রয়োজনের খাতিরে পরিবর্তন এসেছে অনেক ক্ষেত্রেই। ফুটবলও এর ব্যতিক্রম নয়। সময়ের সাথে সাথে এর আইন-কানুনে যেমন পরিবর্তন এসেছে, সবাই এর সাথে সেভাবেই মানিয়ে নিয়েছে। একদম বাঁধাধরা নিয়মগুলো ঠিক রেখে বাকি কিছু আইনের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা অনুযায়ী সুবিধামত পরিবর্তন করে নেয়া হয়েছে। এই প্রতিযোগিতাগুলোতেও আবার বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নিয়মকানুনে পরিবর্তন এসেছে।
সম্প্রতি ফুটবলে নতুন কিছু আইন যোগ করা আর কিছু আইনের পরিবর্তন নিয়ে বেশ কিছু প্রস্তাবনা উঠে এসেছে। এর মধ্যে একটি হল অ্যাওয়ে গোলের হিসাব বাদ দেয়া। ফুটবলে এই অ্যাওয়ে গোলের এই ব্যাপারটি দুই লেগের যেকোনো খেলায় দারুণ প্রতিদ্বন্দিতা ও নাটকীয়তা নিয়ে আসতে পারে। কিছু বিতর্ক থাকলেও সাধারণ লিগ ফুটবল বা এক লেগের কাপ খেলার চেয়ে এই দুই লেগের ফুটবলের প্রতি দর্শকদের আকর্ষণ তুলনামূলক বেশিই থাকে।
অ্যাওয়ে গোলের নিয়ম নিয়ে আমাদের সবারই ধারণা রয়েছে। এটি ফুটবলে সমতায় শেষ হওয়া খেলার ফলাফল নির্ধারণের একটি পদ্ধতি। কোনোরকম অতিরিক্ত সময় বা টাইব্রেকার ছাড়া ফলাফল নির্ধারণে এটি কাজ করে। দুই লেগের কোনো খেলা শেষে যদি গোলের সংখ্যা সমান থাকে, তবে দেখা হয় অ্যাওয়ে গোল কাদের বেশি। অর্থাৎ দুটি খেলায় কোন দল প্রতিপক্ষের মাঠে বেশি গোল করেছে। এরপর যদি দেখা যায় অ্যাওয়ে গোলও সমান, তখন আবার ৩০ মিনিটের অতিরিক্ত সময় দেয়া হয় খেলার জন্য। সেখানেও যদি খেলা সমতায় শেষ হয় এবং অ্যাওয়ে গোলও সমান থাকে, তবে শেষ পদ্ধতি টাইব্রেকারে যাওয়া হয়।
অ্যাওয়ে গোলের নিয়মটি প্রথম আনা হয়েছিল ১৯৬৫-৬৬ সালের ইউরোপীয়ান কাপ উইনার্স কাপে। এরপর ১৯৬৭ সালে এই নিয়ম নিয়ে আসা হয় তৎকালীন ইউরোপীয়ান কাপে, যেটিকে আমরা এখন চিনি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ নামে।
এই অ্যাওয়ে গোলের ধারণা আসার পেছনে ছিল ওই মৌসুমের কাপ উইনার্স কাপ প্রতিযোগিতার কোয়ার্টার ফাইনালে হওয়া ইংলিশ ক্লাব লিভারপুল ও জার্মান ক্লাব কোলনের মধ্যকার খেলাটি। ঐ খেলার ১ম লেগ শেষ হয় 0-0 গোলে। অ্যানফিল্ডের দ্বিতীয় খেলাটিও শেষ হয় এভাবে। এরপর নিরপেক্ষ ভেন্যু হিসেবে নেদারল্যান্ডের ফেইনুর্দ ক্লাবের মাঠে হওয়া খেলাটিও শেষ হয় ড্র’তে, ২-২ গোলে। লিভারপুল শুরুতেই ২-০ গোলে এগিয়ে গেলেও কোলন আবার দুই গোল করে খেলায় সমতা নিয়ে আসে। মোটামুটি ৩০০ মিনিট খেলে, ৩টি দেশে খেলে অতিরিক্ত সময়ে খেলেও রটারডামের সেই কর্দমাক্ত মাঠে খেলার ফলাফল কোনো একটি দলের পক্ষে যায়নি। তাদের হাতে তখন বিকল্প ছিল একটি দল না জেতা পর্যন্ত খেলা চালিয়ে যাওয়া। তাই ফলাফল নির্ধারণের ব্যাপারটি সঁপে দেয়া হয় বেলজিয়ান রেফারি রবার্ট শাউটের হাতে। তখন টাইব্রেকারের নিয়ম তখন না থাকায় তিনি খেলার ভাগ্য নির্ধারণ করেন টস করে। সেখানেও টস করতে হয় দুইবার। প্রথমবার লিভারপুল অধিনায়ক রন ইয়েটস টেইল নিলে কয়েন ঘাসের উপর এমনভাবে পড়ে যে তা হেড না টেইল কিছুই বুঝা যাচ্ছিল না। দুই অধিনায়কের সম্মতিতে আবার টস হয়, এবার টেইল ওঠে। লিভারপুল টসে জিতে সেমিফাইনালে চলে যায়।
ফুটবলে টাইব্রেকারে বাদ পড়াকে মন্দভাগ্য হিসেবে দেখা হয়, সেখানে টস ভাগ্যে বাদ পড়াকে আপনি কীভাবে দেখবেন? সেটিও যদি হয় আবার কোনো প্রতিযোগিতার কোয়ার্টার ফাইনালে? কোলনের জন্য ব্যাপারটি ছিল এমনই। বিতর্ক শুরু হয় এখানেই।
পরের মৌসুমে এই অ্যাওয়ে গোলের সুবিধা প্রথম পায় বুদাপেস্ট হনভেড। ডুকলা প্রাগের সাথে দ্বিতীয় পর্বে অ্যাওয়ে খেলায় ৩-২ গোলে জিতলে নিজেদের মাঠে হারে ২-১ গোলে। একটি অ্যাওয়ে গোল বেশি থাকায় পরের পর্বে চলে যায় বুদাপেস্ট।
অ্যাওয়ে গোল এ পর্যন্ত অনেকগুলো ঐতিহাসিক মুহূর্তের জন্ম দিয়েছে। যেমন, ২০১৯ সালে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের সেমিফাইনালে লুকাস মৌরার হ্যাটট্রিকে আয়াক্সকে অ্যাওয়ে গোলে হারিয়ে স্পার্সের ফাইনালে উঠে যাওয়া, কিংবা ২০০৯ সালের আন্দ্রেস ইনিয়েস্তার করা চেলসির বিরুদ্ধে ৯৩ মিনিটের সেই সমতাসূচক গোল। ২০১৯ সালে স্পার্স কোয়ার্টার ফাইনালে ম্যানচেস্টার সিটিকেও হারায় এই অ্যাওয়ে গোলের হিসেবেই।
এইবারের ২০২১-২২ মৌসুম থেকে ইউরোপিয়ান ক্লাব প্রতিযোগিতাগুলো যেমন চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, ইউরোপা লিগ, কনফারেন্স লিগের নকআউটে এই অ্যাওয়ে গোলের হিসাব বাদ নকআউট পর্বের খেলাগুলো হবে। উয়েফা তাদের অফিসিয়াল বিবৃতিতে এই নিয়মকে বাতিল করে দিয়েছে।
উয়েফার এই নতুন নিয়মটি কার্যকর করা হবে তাদের সব প্রতিযোগিতার জন্য। হোক সেটি বয়সভিত্তিক বা মহিলা দল। এই নিয়মটি বাতিলের ক্ষেত্রে উয়েফার বিবৃতি ছিল এমন,
“পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে দেখা যায় ১৯৭০ সাল থেকে হোম আর অ্যাওয়ে খেলায় জেতার শতকরা যে পার্থক্য ছিল, তা আস্তে আস্তে কমে আসছে। ১৯৭০ সালে হোম দল জিতেছে ৬১% খেলায়, আর অ্যাওয়ে দল ১৯% খেলায়। এটি বর্তমানে হোম দল জেতে ৪৭% খেলায় আর অ্যাওয়ে দল জেতে ৩০% খেলায়। এমনকি গড় গোলের যে পার্থক্য ছিল, তাও এখন অনেক কমেছে (২.০২টি হোম গোলের বিপরীতে ০.৯৫টি অ্যাওয়ে গোল থেকে ১.৫৮টি গেম গোলের বিপরীতে ১.১৫টি অ্যাওয়ে গোল)। সেই সাথে ২০০৯-১০ মৌসুম থেকে মহিলা দলগুলোর খেলায় হোম দলগুলোর গড় গোল ১.৯২টি আর অ্যাওয়ে দলগুলোর ১.৬টি।”
উয়েফার প্রেসিডেন্ট আলেক্সান্দার ক্যাফেরিন বলেন,
“এই অ্যাওয়ে গোলের নিয়ম বাতিল করার ব্যাপারটি নিয়ে অনেকদিন ধরেই তর্ক-বিতর্ক চলছে। অ্যাওয়ে গোলের নিয়ম যে কারণে আনা হয়েছিল, তার চেয়ে এই নিয়মটি এখন খেলাকে অন্যভাবে প্রভাবিত করছে। হোম দলগুলো এখন গোল দেওয়ার চেয়ে গোল যাতে না খায় সেদিকেই বেশি মনোযোগী হচ্ছে। প্রথম লেগের ক্ষেত্রে এটি আরো বেশি হয়। এতে খেলার স্বাভাবিক ফ্লো নষ্ট হয়। দেখা যায়, আক্রমণগুলো একপাক্ষিক হচ্ছে। হোম দলগুলো পুরা সময়টাতেই চিন্তায় থাকে এই অ্যাওয়ে গোল হজম করা নিয়ে, কারণ এতে প্রতিপক্ষ একটি বড় সুবিধা পেয়ে যায়।
আবার যদি অতিরিক্ত সময়ে কোনো অ্যাওয়ে দল এক গোল দিয়ে ফেলে, তখন ওই স্বল্প সময়ে হোম দলকে কমপক্ষে ২টি গোল পরিশোধ করতে হয় খেলায় ফিরতে। এটি হোম দলগুলোর জন্য একরকম অবিচার হয়ে যায়। আর আগে যেমন হোম অ্যাডভান্টেজ একটি বড় ফ্যাক্টর ছিল, এখন এটির প্রভাব অনেক কমেছে।”
এদের সাথে নতুন একটি বড় সমস্যা ছিল করোনা মহামারি। এই মহামারির জন্য গত মৌসুমের প্রায় সবগুলো খেলাতেই মাঠে দর্শক নিষিদ্ধ ছিল। এতে হোম দলের কিছু বাড়তি সুবিধা আরো কমে যায়।
এই অ্যাওয়ে গোলের ব্যাপারে দুই লেজেন্ডারি ম্যানেজার অ্যালেক্স ফার্গুসন ও আর্সেন ওয়েঙ্গার আপত্তি প্রকাশ করে আসছিলেন অনেকদিন ধরেই। ওয়েঙ্গার ২০১৪ সালের এক সাক্ষাৎকারে বলছিলেন যে এই রুলটি খেলায় কাউন্টার এফেক্ট নিয়ে আসছে। এবং তিনিও উল্লেখ করেন ঐ হোম দলগুলোর ডিফেন্সিভ খেলার দিকটিকে। ২০১৫ সালে আর্সেনাল মোনাকোর কাছে অ্যাওয়ে গোলে হেরে বাদ পড়ায় তিনি এই নিয়মকে সেকেলে আখ্যায়িত করেন। তিনি বলেন,
“অ্যাওয়ে গোল যদি হিসেবেই আনা হয়, তবে সেটি যেন হয় অতিরিক্ত সময় খেলার পর। এই নিয়মের ধারণাই এসেছিল ষাটের দশকে। তখন অ্যাওয়ে দলগুলোকে গোল করায় অনুপ্রাণিত করতে এর দরকার ছিল। কিন্তু ষাটের দশকের তুলনায় ফুটবল এখন অনেক পরিবর্তিত। অ্যাওয়ে গোলের প্রভাব এখন অনেক বেশি।”
বলা বাহুল্য, গত ২০১৯-২০ মৌসুমেও আর্সেনাল গ্রিক দল অলিম্পিয়াকোসের কাছে অ্যাওয়ে গোলে হেরে ইউরোপা লিগ থেকে বাদ পড়ে।
অন্যদিকে অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের কোচ সুর দিয়েছিলেন অন্য দিকে। তিনি দ্বিতীয় লেগে যারা হোমে খেলে তাদের অসুবিধাগুলো নিয়ে আসেন। সেখানে অতিরিক্ত সময়ে প্রতিপক্ষের ১ গোল, দ্বিগুন হিসেবে ধরা হয়। সেই ১ গোলের জবাবে হোম দলগুলো ১ গোল দিলেও অ্যাওয়ে গোলে হারতে হয় তাদের, যেখানে সময় মাত্র ৩০ মিনিট!
এখন যেহেতু অ্যাওয়ে গোলের হিসাব বাদ হচ্ছে, তাহলে ড্র খেলাগুলোর ফলাফল কীভাবে নির্ধারিত হবে? বর্তমানে অন্যান্য প্রতিযোগিতাগুলোয় অতিরিক্ত সময়, এরপর টাইব্রেকারের যে সাধারণ নিয়ম রয়েছে, সেটিই অনুসরণ করা হবে।
২০১৮-১৯ মৌসুমের আগে ইংলিশ কারাবো কাপে (লীগ কাপ) দুই লেগের সেমিফাইনালে অ্যাওয়ে গোলের হিসাব করা হতো, তবে সেখানে আগে অতিরিক্ত সময়ের খেলা শেষ করত স্বাভাবিকভাবে। এরপর অ্যাওয়ে গোলের হিসাব আসত। বর্তমানে এরকম পরিস্থিতিতে সরাসরি টাইব্রেকারে যাওয়া হয়।
নতুন এই নিয়মের পক্ষে বিপক্ষে অনেক মতামতই রয়েছে। অনেকেই আশংকা করছেন যে এই নতুন নিয়মে ছোট দলগুলো সমস্যায় পড়বে। তবে সেই সাথে অনেকেই আশাবাদী এই নিয়ে যে এখন হোম দলগুলো একটি বাড়তি চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে খেলতে পারবে। এতে খেলায় হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে আগের তুলনায় অনেক বেশি। দলগুলোর নতুন এই পরিকল্পনায় মানিয়ে নিতে কিছু সময় লাগলেও আশা করা যাচ্ছে তারা দ্রুতই খাপ খাইয়ে নেবে।