বিশ্বকাপ খেলা প্রতিটি ফুটবলারের আজন্ম লালিত স্বপ্ন। দেশের হয়ে বিশ্বমঞ্চ কাঁপানোর মতো রোমাঞ্চ নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হয় চার বছর ধরে। চড়াই উৎরাই পার হয়ে চার বছর পর অনেকেরই স্বপ্ন বিসর্জন দিতে হয়। হালের গ্যারেথ বেল কিংবা অবামেয়াংরা যেমন বাছাই পর্বই পেরোতে পারেননি, তেমনি ইনজুরির জন্যও প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ খেলা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন ম্যানুয়েল লানজিনি, দিমিত্রি পায়েতের মতো তারকারা। চলুন দেখে নেওয়া যাক এমন কিছু গ্রেট খেলোয়াড়দের, যারা কখনোই বিশ্বকাপে খেলতে পারেননি।
এরিক ক্যান্টোনা (ফ্রান্স)
ম্যানচেস্টার ইউনাইডেট কিংবদন্তী এরিক ক্যান্টোনা মাঠের পারফর্মেন্সের জন্য যেমন সুপরিচিত ছিলেন তেমনি মাঠের বাইরের কর্মকান্ডের জন্যও পত্রিকার শিরোনাম হতেন। তবে ক্যান্টোনার বিশ্বকাপ না খেলা ফুটবলের একটি ট্র্যাজিক অধ্যায় হয়েই থাকবে। ১৯৯৪ আসরের আগে ফ্রান্স দলের ক্যাপ্টেনের আর্মব্যান্ড ছিলো রেড ডেভিলদের হয়ে সাত নাম্বার জার্সি পরে মাঠ মাতানো এরিক ক্যান্টোনার হাতেই।
বাছাইপর্বের দুই ম্যাচ আগে কোয়ালিফাইয়ের জন্য ফ্রান্সের প্রয়োজন ছিলো মাত্র একটি পয়েন্ট। প্রথম ম্যাচে গ্রুপ টেবিলে শেষে থাকা ইসরাইলের সাথে শেষ দশ মিনিটে দুই গোল খেয়ে পার্ক দে প্রিন্সে হেরে বসে লা ব্লুজরা। শেষ ম্যাচেও ভাগ্য সহায় ছিলো না ক্যান্টোনাদের পক্ষে। বুলগেরিয়ার সাথে ড্র করতে নামা ফ্রান্সের কপাল পোড়ে ৯০ মিনিটের অন্তিম গোলে। শেষ মূহুর্তের গোলে ম্যাচটি ফ্রান্স হেরে যায় ২-১ ব্যবধানে। সেবার আর বিশ্বকাপেই খেলতে পারেনি ক্যান্টোনার দল।
১৯৯৮ বিশ্বকাপের আগেও ক্যাপ্টেন ছিলেন এরিক ক্যান্টোনা। কিন্তু ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের হয়ে ক্রিস্টাল প্যালেসের বিপক্ষে খেলতে নামার আগে বিতর্কিত এক ফাউলে সমালোচনার মুখে পড়েন তিনি, যার ফলস্বরুপ ফরাসি কোচ আইমে জ্যাকুঁয়ে ক্যান্টোনাকে দলের বাইরে রেখেই দল ঘোষণা করেন। তার শূন্যস্থান পূরণ করে দলকে শিরোপা জেতান জিনেদিন জিদান।
রায়ান গিগস (ওয়েলস)
আরেক ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড কিংবদন্তী রায়ান গিগস ও দেশের জার্সি গায়ে বিশ্বকাপ খেলতে পারেননি কখনোই। ক্লাব ক্যারিয়ারে সবরকম শিরোপা জেতা এই স্বনামধন্য খেলোয়াড় ছিলেন তার সময়ের সেরা একজন মিডফিল্ডার। ইংল্যান্ডের হয়ে খেলার সুযোগ থাকলেও ওয়েলসের হয়েই খেলতে চেয়েছিলেন রায়ান গিগস। ১৯৯১ এ মাত্র ১৭ বছর বয়সে জার্মানির সাথে আন্তর্জাতিক ফুটবলে অভিষেক হয় রায়ান গিগসের। সেই সময় ওয়েলসের হয়ে সবচেয়ে কম বয়সে অভিষেক হওয়ার রেকর্ড গড়েন গিগস।
গিগসের সময়ে একবারও বিশ্বকাপে কোয়ালিফাই করতে পারেনি ওয়েলস। সবচেয়ে কাছাকাছি গিয়েছিলো ১৯৯৪ বিশ্বকাপ বাছাইয়ে। কার্ডিফের আর্মস পার্ক স্টেডিয়ামে শেষ ম্যাচে রোমানিয়াকে হারালেই বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ মিলতো ওয়েলসের। ১-১ স্কোরলাইন থাকা অবস্থায় পেনাল্টি পায় ওয়েলস। স্পটকিক থেকে পল বডিন গোল করতে না পারার খেসারত দিতে হয় ওয়েলসকে। সব শেষে ম্যাচটি তারা হেরে বসে ২-১ গোলে। সেই সুবাদে রোমানিয়া সুযোগ পায় বিশ্বকাপে খেলার। অন্যদিকে গিগসের ওয়েলস তীরে এসে তরী ডোবায়।
আলফ্রেডো ডি স্টেফানো (আর্জেন্টিনা/কলম্বিয়া/স্পেন)
বিশ্বকাপে না খেলা তারকাদের মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে দুর্ভাগা ছিলেন আলফ্রেডো ডি স্টেফানো। ১৯৫০ ও ১৯৫৪ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা খেলতে অস্বীকৃতি জানালে সেই দুবারের বিশ্বকাপেই খেলা হয়নি স্টেফানোর। তবে কলম্বিয়ার হয়ে আগে চার ম্যাচ খেলায় কলম্বিয়ার হয়ে নামার আবেদন করেছিলেন স্টেফানো। কিন্তু ফিফা সেই আবেদন নাকচ করে দেয়। ১৯৫৮ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা অংশগ্রহণের জন্য সুইডেন গেলেও ডি স্টেফানো যেতে পারেননি। আর্জেন্টাইন ফুটবল ফেডারেশনের সাথে ঝামেলায় জড়িয়ে ততদিনে স্পেনের নাগরিকত্ব নিয়ে স্পেনের হয়ে খেলা শুরু করেন স্টেফানো।
কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, বাছাইপর্বের শেষ ম্যাচে সুইজারল্যান্ডের সাথে ২-২ গোলে ড্র করে কপাল পোড়ে স্পেনের। বিশ্বকাপ বাছাইয়েই ছিটকে যায় ডি স্টেফানোর স্পেন। পরবর্তী ১৯৬২ চিলি বিশ্বকাপে স্পেন সুযোগ পেলেও ডি স্টেফানোর বয়স ছিলো ৩৬। তবুও বিশ্বকাপ খেলতে চেয়েছিলেন ফুটবল বিশ্বের অন্যতম সেরা এই ফুটবলার। কিন্তু বিশ্বকাপের আগমুহূর্তে পেশির ইনজুরিতে পড়ে দল থেকে ছিটিকে যান এই রিয়াল মাদ্রিদ কিংবদন্তী। পরবর্তীতে সেই বছরেই আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার থেকে অবসরের ঘোষণা দেন বিশ্বকাপে খেলতে না পারা স্টেফানো।
জর্জ উইয়াহ (লাইবেরিয়া )
আফ্রিকার সর্বকালের সেরা খেলোয়াড় জর্জ উইয়াহও দেশের হয়ে খেলতে পারেননি কোনো বিশ্বকাপ। ১৯৯৫ সালে প্রথমবারের মতো ইউরোপের বাইরে থেকে ব্যালন ডি অর জেতেন লাইবেরিয়ার এই কিংবদন্তী। দেশের হয়ে ৬০ ম্যাচে ২২ গোল করেও বিশ্বকাপ খেলতে না পারাটা অবশ্য উইয়াহর জন্য চমকে দেওয়ার মতো ঘটনা ছিলো না। লাইবেরিয়া এখন পর্যন্ত বিশ্বকাপ তো দূরে থাক, আফ্রিকান ন্যাশন্স কাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছে মোটে দুবার। তা-ও প্রথমবারের মতো ১৯৯৬ সালে আফ্রিকান ন্যাশন্স কাপ খেলার যোগ্যতা অর্জন করে জর্জ উইয়াহের হাত ধরেই। পরবর্তীতে কোচ হিসেবেও লাইবেরিয়ার সাথে কাজ করেছেন উইয়াহ। তবে লাইবেরিয়াকে বিশ্বকাপে নিয়ে যাওয়া হয়নি তার।
তিনবার আফ্রিকান ফুটবলার অফ দ্য ইয়ার জেতা এই ফুটবলার ক্লাব ক্যারিয়ারে কাটিয়েছেন বর্ণাঢ্য সময়। আর্সেন ওয়েঙ্গারের হাত ধরে খেলতে আসেন ইউরোপে। এরপর একে একে ফ্রান্স, ইতালি, ইংল্যান্ডের ক্লাবগুলোর হয়ে মাঠ দাপিয়ে বেড়িয়েছেন। ১৯৯৪-৯৫ মৌসুমে গোল্ডেন বুট অ্যাওয়ার্ডও বগলদাবা করেন এই কৃতী ফুটবলার। তবে বিশ্বকাপ না খেলার আক্ষেপ আজীবনই পুড়িয়ে বেড়িয়েছে জর্জ উইয়াহকে।
জর্জ বেস্ট (নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড)
সাবেক ম্যানচেস্টার উইঙ্গার জর্জ বেস্ট কারো কারো মতে সর্বকালের সেরা খেলোয়াড়। কিন্তু ফুটবলারদের সবচেয়ে বড় আরাধ্য বিশ্বকাপ মঞ্চেই ওঠা হয়নি এই কিংবদন্তী ফুটবলারের। গতি, স্কিল, ড্রিবলিং সবকিছুতেই ষাটের দশকে অনন্য ছিলেন জর্জ বেস্ট। নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডের হয়ে ৩৭ ম্যাচে ৯ গোল করলেও দেশকে বিশ্বকাপে নিয়ে যেতে পারেননি একবারও।
১৯৬৬ বিশ্বকাপ বাছাইয়ে শেষ ম্যাচে এসে খালি হাতে ফিরতে হয় তাদের। গ্রুপের তলানীতে থাকা আলবেনিয়ার সাথে ১-১ গোলে ড্র করে প্লে-অফ খেলতে হয় নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডকে। সুইজারল্যান্ডের সাথে প্লে অফ ম্যাচে হারায় সেবার আর বিশ্বকাপে যেতে পারেননি জর্জ বেস্ট। ১৯৭০ বিশ্বকাপেও প্লে অফের হতাশায় পুড়তে হয় বেস্টের দলকে। সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে হেরে মেক্সিকো বিশ্বকাপে দর্শক হয়েই থাকতে হয় তাকে। ১৯৭৪ সালে নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড বাছাইয়ে বাজে পারফর্ম করে অনেক আগেই বাদ পড়ে। ১৯৭৭ সালে আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার থেকে বিদায়ের ঘোষণা দেন বেস্ট।
১৯৮২ সালে এসে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপে কোয়ালিফাই করে নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড। দেশের হয়ে বিশ্বকাপ খেলার জন্য অবসর ভেঙে ফিরতে চাইলেও সেই সময়ের নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড কোচ বিলি বিংহাম বেশি বয়স হওয়ায় বিশ্বকাপ দলে বেস্টকে নেওয়ার সম্ভাবনা নাকচ করে দেন। সেই সময়ে তার বয়স ছিলো ৩৬ বছর। শুধুমাত্র বিশ্বকাপ নয়, জর্জ বেস্টের নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড তার সময়কালে কখনো ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপও খেলতে পারেনি। তাই দেশের হয়ে বড় কোনো টুর্নামেন্ট না খেলেই অবসরে যেতে হয় ফুটবল বিশ্বের অন্যতম সেরা এই ফুটবলারকে।
১৯৭৪ বিশ্বকাপজয়ী জার্মান অধিনায়ক ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার একবার বলেছিলেন, জর্জ বেস্ট হচ্ছেন সময়ের সেরা প্রতিভাবান কিংবা সম্ভবত সময়ের সেরা খেলোয়াড়, যিনি কিনা কখনো বিশ্বকাপ খেলতে পারেননি।