আর্নল্ড শোয়ার্জেনেগারকে আমরা কে না চিনি? তবে ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের ৩৮ তম গভর্নর হিসেবে তিনি যতটা না চেনা আমাদের কাছে, তার চাইতেও ব্লক ব্লাস্টার মুভি টার্মিনেটরের “I’ll be back” ডায়লগের জন্য স্মরণীয় হয়ে আছেন তিনি। যদিও আমরা ভুলেই যাই, তার প্রথম পরিচয় ছিল বডিবিল্ডার হিসেবে ৭ বার ‘মিস্টার অলিম্পিয়া’ এবং ৪ বার ‘মিস্টার ইউনিভার্স’ খেতাবপ্রাপ্তি।
বডি বিল্ডিংয়ের প্রসঙ্গ আসলে আমাদের সব সময় পুরুষদের কথা মনে আসে। অথচ ১৯ শতকের প্রথম থেকে নারীরা শরীরচর্চাভিত্তিক প্রতিযোগিতা ও পেশী প্রদর্শনীর সাথে যুক্ত হতে শুরু করে। এ সময় নারী বডি বিল্ডারের আবির্ভাব হয়। তবে এ নিয়ে তেমন প্রচার সে সময় হয়নি। সার্কাসে অমানুষিক শারীরিক শক্তি প্রদর্শন করার পাশাপাশি বিভিন্ন ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় সবলদেহী নারীরা সে সময় থেকেই উপস্থিত হতে শুরু করে। ধীরে ধীরে বডিবিল্ডিং ও রেসলিংয়ের মতো অপ্রথাগত প্রতিযোগিতায় নারীদের অংশগ্রহণ বাড়তে শুরু করে। আমরা সে সময় সুঠাম দেহের অধিকারিণী লুইস লিরস, আইভি রাসেলদের সরব উপস্থিতি দেখতে পাই। যদিও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতামূলক আয়োজন শুরু হয় অনেক দেরিতে, ১৯৭৭ সালে।
প্রথমদিকের নারী বডি বিল্ডারদের ভেতর কেটি ব্র্যামবাখ এবং কেট রবার্টসের নাম বেশ স্মরণীয়। অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকে শরীরচর্চাকারী নারীদের ‘বডিবিল্ডার’ বলা হতো না। তাদের বলা হত ‘স্ট্রং উইমেন’। স্ট্রং উইমেনদের জন্য বিভিন্ন প্রতিযোগিতাও এ সময় আয়োজন করা হত। ‘ফিমেল ইতালিয়ান স্যামসন’ বা ‘লিটল ওম্যান ফ্রম জেনেভা’ নামে যেসব প্রতিযোগিতা হতো, তা পরবর্তী শতকে সার্কাসের নারীদের সরব উপস্থিতির প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে। যদিও এগুলোর একটিকেও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা বলা যাবে না।
মূলত সার্কাসের দলগুলো ‘স্ট্রং উইমেন’ খেতাবধারী নারীদের সাধারণ আশ্রয়স্থল ছিল। অন্য অনেক কিছুর মতোই নারীদের সার্কাসে এমন উপস্থিতির ব্যাপারটি শুরুতে মোটেই স্বস্তিকর ছিল না। তখন সার্কাসে এমন মহিলাদের অ্যাথলেট বা জিমন্যাস্ট হিসেবে বিবেচনা করার চেয়ে হাস্যরসের খোরাক হিসেবে উপস্থাপন করা হত।
তখনকার সময়ে অমানুষিক শক্তিমত্তা সম্পন্ন নারী ছিলেন ‘গ্রেট স্যান্ডউইনা’ নামে খ্যাত কেটি ব্র্যামবাখ। ভিয়েনার অধিবাসী এই মহিলার বাবা-মা দুজনই সার্কাসে কাজ করতেন । তিনি তার বাবা (যার উচ্চতা ছিল সাড়ে ৬ ফুট) ও মা (যিনি ছিলেন ১৫ ইঞ্চি বাইসেপ পেশীর অধিকারী শক্তিশালী নারী) উভয়েরই মিলিত অবয়বের উত্তরাধীকারী হয়েছিলেন।
তার ১৪ ভাই বোনের মতো তিনিও বাবা-মায়ের সাথে সার্কাসে কাজ করতেন। তাদের সার্কাসে অন্যান্য ইভেন্টের মধ্যে একটি ছিল রেসলিং, যেখানে একটি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়া হত। চ্যালেঞ্জটি ছিল, ওপেন রিং রেসলিংয়ে কোনো পুরুষ যদি তাকে পরাস্ত করতে পারে, তবে নগদ ১০০ গোল্ড মার্ক পুরষ্কার দেওয়া হবে। বলা বাহুল্য, কোনো পুরুষ সেই চ্যালেঞ্জে সফল হতে পারেননি।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, রেসলিং রিংয়ের একটি ঘটনাই পরবর্তীতে তার জীবনের গতি আমূল বদলে দেয়। ম্যাক্স হেইম্যান নামের এক জার্মান ভদ্রলোক তখন বেশ নামডাকওয়ালা সার্কাসের অধিকারী ছিলেন। তিনি এমনই এক চ্যালেঞ্জ নিয়ে স্যান্ডউইনার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে রিংয়ে নামেন এবং যথারীতি পরাজিত হন। তবে হেরে গিয়েও তিনি দমে গেলেন না। বরং ভাবলেন, তার নিজের সার্কাসে অভিনব অধ্যায়ের সূচনা করতে এই নারীর কলাকৌশল আরো বেশি সাহায্য করবে। বৈষয়িক চিন্তা ছাড়াও রোমান্টিক ভাবনাও হেইম্যানকে আচ্ছন্ন করেছিল। পরবর্তীতে হেইম্যান-ব্র্যামবাখ বিয়ে করেন এবং দীর্ঘ ৫২ বছরের এক চমৎকার বিবাহিত জীবন পার করেন।
১৯০০ সালের দিকে ব্র্যামবাখ ও তার স্বামী আরো বৃহৎ কর্মপরিসরের আশায় মার্কিন যু্ক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান। নিউ ইয়র্ক শহর তখন পৃথিবীর সব প্রান্তের সুযোগ সন্ধানী মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের স্থান। এ শহরেই ১৯০২ সালে ব্র্যামবাখের সাথে ইউজিন স্যান্ডোর ভারোত্তলন প্রতিযোগিতা হয়। ব্র্যামবাখ যেখানে ৩০০ পাউন্ড ওজন একহাতে মাথার উপর ওঠাতে সক্ষম হন, সেখানে স্যান্ডো দু’হাতে সমপরিমাণ ওজন বুকের চেয়ে উঁচুতে তুলতেই পারেননি। উল্লেখ্য, ইউজিন তখন অবধি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ‘স্ট্রংম্যান’ ছিলেন। এমন একজন স্ট্রংম্যানের এহেন শোচনীয় পরাজয় তখনকার পৃথিবীতে শুধু উল্লেখযোগ্যই নয়, রীতিমতো ভিত নাড়িয়ে দেবার মতো। প্রাচীন গ্রিস ও ভারতে পরাজিত যোদ্ধার উপাধি ও শিরোপা কেড়ে নেবার রীতি ছিল। তারই পুনরাবৃত্তি করে পরাজিত ইউজিনের নামের শেষাংশ দখল করে ব্র্যামবাখ হয়ে উঠলেন ‘গ্রেট স্যান্ডউইনা’।
৫৭ বছর বয়সেও তিনি তার স্বামীকে একহাতে উত্তোলন করার মতো শক্তির অধিকারী ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি রিঙ্গলিং ব্রাদার্স ও বার্নাম অ্যান্ড বেইলি সার্কাসে যোগ দেন, যেখানে তিনি খালি হাতে আয়রন বার ভেঙে সবাইকে অবাক করে দিতেন। এই কালজয়ী নারী ১৯৫২ সালে ক্যান্সারে মৃত্যুবরণ করেন।
সবলদেহী মহিলারা তৎকালীন ক্রীড়াঙ্গনের মহিলাদের চেয়ে বিশালদেহী ছিলেন। কোমল শরীরের অধিকারী হলেও পুরুষদের তুলনায় তাদের এমন দেহাবয়ব বেশ বিরল। তবে শুধু আকৃতি বা অবয়বের জন্য তারা আলোচিত ও জনপ্রিয় হননি। বরং তাদের অমানুষিক শক্তিই তাদের ব্যতিক্রম করে তুলেছিল। সবলদেহী নারী হিসেবে আকৃতি ও পেশী সৌষ্ঠবের চেয়ে নারীদের শক্তিমত্তা প্রাধান্য পেত।
সমগ্র ১৯ ও ২০ শতকের শুরুতেও সাধারণ মানুষের দৃষ্টিতে নারীদের শরীরচর্চা নিন্দনীয় ছিল। এমন স্ট্রং উইমেন থাকার পরও অনেক দিন পর্যন্ত নারীর শক্তিমত্তা তাদের প্রাপ্ত মূল্য থেকে বঞ্চিত ছিল। নারীদের বরাবরাই দুর্বল ও ঠুনকো শরীরের অধিকারী হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। দুর্বল দেহের অধিকারী নারীরা দেহের সামান্য শক্তি ঘর-কন্না ও সন্তান পালনে ব্যবহার করবে এমনটাই ছিল তখনকার কাম্য রীতি। ঘরের কাজই ছিল একমাত্র শরীরচর্চা। এর চেয়ে নিয়ম করে অধিক শরীরচর্চা করে পেশীর বর্ধন নারীদের ভেতর পুরুষালি বৈশিষ্ট্য আনে বলে মনে করা হতো। সেসময় মহিলারা সবরকম গঠনমূলক শারীরিক পরিশ্রম থেকে দূরে থাকতেন এবং শক্তিমত্তার অধিকারী হিসেবে পরিচিত হতে অপছন্দ করতেন।
বডি বিল্ডার মহিলারা তখনকার দিনে কেবল মঞ্চেই যে নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করছেন তা নয়। বরং একাধিক উপায়ে তারা সমাজসেবাও করেছেন। এমনই একজন ছিলেন ওয়েলসের অধিবাসী কেট রবার্টস। তবে ‘ভলকানা’ নামেই তিনি সবচেয়ে বেশি পরিচিত ছিলেন। সে সময় বডিবিল্ডিং জগতে ‘ভলকানা ও অ্যাটলাস’ যুগল বেশ পরিচিত নাম ছিল। কেট রবার্টস তার প্রদর্শনীর কাজে অস্ট্রেলিয়া ভ্রমণ করে খ্যাতি কুড়ালেও কর্মজীবনে জনপ্রিয়তা পান ফ্রান্সে প্রদর্শনীর পর। তার পারফরমেন্সে খুশি হয়ে ফরাসি বডি বিল্ডিংয়ের পথিকৃৎ এডমন্ড দেসবোঁনে তাকে পদক দেন। এই খবর তখন ফ্রান্সের সব বিনোদন পত্রিকার শীর্ষ সংবাদ ছিল। এছাড়া বেন্ট প্রেস প্রতিযোগিতায় (এক হাতে নির্দিষ্ট পরিমাণ ওজন মাথার উপর তুলে ধরা) ভলকানা ডান হাতে ১২৪ পাউন্ড ওজন উঠিয়ে রেকর্ড করেন।
সমাজে তার কর্মের মাহাত্মের জন্য তাকে একরকম সুপারহিরোর মর্যাদায় দেখা হতো। পানিতে ডুবন্ত বাচ্চাদের উদ্ধার করা, নিজের প্রাণ বিপন্ন করে নিশ্চিত দুর্ঘটনায় পড়তে যাওয়া ওয়াগনকে রক্ষা করা, ছিনতাইকারীর হাত থেকে নিরীহ পথিকদের রক্ষা করাসহ আরো অনেক হিতকারী ও সম্মান জাগানো কাজের সাথে তার নাম জড়িয়ে আছে। এমনকি ১৮৮৮ সালে ব্রিস্টলে লাগামছাড়া দৌড়ানো অবস্থায় এক স্ট্যালিয়ন ঘোড়াকে স্বীয় শক্তিবলে থামিয়ে অনেক মানুষকে হতাহত হওয়া থেকে রক্ষা করেন।
১৯ শতকের তুলনায় বর্তমানে নারীদের বডি বিল্ডিং অনেক অগ্রসর হয়েছে। সেরন ব্রুনেই, কিম চিজেভস্কি, বেভ ফ্রাঞ্চিসের নাম কম বেশি অনেকেই শুনে থাকবে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতও পিছিয়ে নেই, নিয়মিত আয়োজন হচ্ছে নারী বডি বিল্ডিং প্রতিযোগিতার। যদিও সামাজিকভাবে এখনো তাদের অনেক বাধার সম্মুখীন হতে হয়, যা কি না আইবিবিএফ (ইন্ডিয়ান বডি বিল্ডার্স ফেডারেশন) ২০১৮ এর চ্যাম্পিয়ন ভরসার কথাতে স্পষ্ট, “আমার পরিবার বডি বিল্ডিংয়ের বিপক্ষে ছিল, অথচ সেটাই আমাকে আজ সম্মান এনে দিল।“