খ্রিষ্ট পঞ্জিকার হিসাব অনুযায়ী, তখন ২০১৪ সালের জুলাই মাস।
ব্রাজিলের মাটিতে তখন অনুষ্ঠিত হচ্ছে বিশ্বকাপ নামক ফুটবলীয় মহাযজ্ঞ। পুরো ফুটবলবিশ্বের নজরও সেদিকে। সারাবছর ফুটবলপ্রেমীদের নিখাদ বিনোদনের উৎস হয়ে থাকা ইউরোপীয় ক্লাব ফুটবলে তখন নতুন মৌসুম শুরুর প্রস্তুতি চলছে ঢিমেতালে। নীরবে-নিভৃতে কিছু খেলোয়াড়ের দলবদল ঘটছে, সেগুলোও মানুষের নজরকে খুব বেশি আকর্ষণ করতে ব্যর্থ। এমনই একজন খেলোয়াড়ের নাম দিবু। দিবু তখন শেফিল্ড ওয়েন্সডে ক্লাবে ধারে খেলার মেয়াদ শেষ করে মূল ক্লাব আর্সেনালে ফেরার অপেক্ষায়।
সুদূর আর্জেন্টিনা থেকে আর্সেনালের বয়সভিত্তিক দল দিয়েই ইউরোপের ফুটবলের সাথে পরিচয় ঘটেছিল দিবুর। তবে সময়ের সাথে বয়সভিত্তিক দল থেকে মূল দলে উন্নীত হলেও খেলার সময় খুব একটা পাচ্ছিলেন না তিনি। প্রতি মৌসুমে প্রিমিয়ার লিগ, এফএ কাপ বা লিগ কাপে হাতেগোনা দু-চারটি ম্যাচ পাচ্ছিলেন দিবু। ক্লাব আর্সেনালও বোধহয় তার সক্ষমতা নিয়ে সন্দিহান ছিল, তাই নিজেকে প্রমাণের জন্য দিবুকে একবার পাঠানো হলো শেফিল ওয়েন্সডেতে, এরপর রথারহ্যামে, এরপর উলভারহ্যাম্পটন ওয়ান্ডারার্স, গেতাফে আর রিডিংয়ের মতো ক্লাবে।
আপাতত আমরা ফিরে যাই ২০১৪ এর জুলাইয়েই, শেফিল্ড ওয়েন্সডে থেকে যখন মাত্রই আর্সেনালে ফিরেছেন দিবু।
২.
বক্সের বাইরে ফ্রি-কিক পেয়েছে আর্জেন্টিনা। অনুমিতভাবেই বল বসিয়ে প্রস্তুত হচ্ছেন লিওনেল মেসি। তার থেকে আনুমানিক দশ গজ দূরে প্রস্তুত হচ্ছে জার্মান দেয়াল, দেয়ালের পেছনে অপেক্ষা করছেন ম্যানুয়েল নয়্যার। ফাইনাল ম্যাচের তখন ১২১তম মিনিট চলছে, আর্জেন্টিনা ১-০ গোলে পিছিয়ে। পুরো ফুটবলবিশ্ব শ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করছে, আর্জেন্টিনার ঐ দশ নম্বর জার্সি পরা মানুষটার দিকে তাকিয়ে অজান্তেই সবার দুই হাত হয়েছে একত্র। মেসি প্রস্তুত হলেন, দুই পা পিছিয়ে দাঁড়ালেন। রেফারির বাঁশি শুনে একটা দম নিলেন, এরপর দৌড়ে বাম পায়ে শট নিলেন, যেমনটা নিয়েছিলেন একই বিশ্বকাপে নাইজেরিয়ার বিপক্ষে, মধ্যমগতির বাঁকানো নিঁখুত শট। তবে এবারের ফলাফলটা হলো ভিন্ন। মেসির ফ্রি-কিকটা চলে গেল পোস্টের উপর দিয়ে, সাথে চলে গেল আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্নটাও। মারিও গোৎজের একমাত্র গোলে আর্জেন্টিনার হাত থেকে শিরোপা ছিনিয়ে নিলেন জার্মানরা।
৩.
ঐ ফাইনাল ম্যাচটা নিজের আর্জেন্টিনার বাড়িতে বসেই দেখেছিলেন দিবু। অঝোরে কেঁদেছিলেন, আর দশজন আর্জেন্টাইন সমর্থকের মতোই। হয়তো কাঁদতে কাঁদতে নিজেকে বসিয়েছিলেন গোলরক্ষক সার্জিও রোমেরোর জায়গায়, হয়তো ঐ দস্তানাজোড়া তার হাতে থাকলে তাতে আটকে যেত গোৎজের শটটা, হয়তো শিরোপাজয়ী দলটার নাম হতো আর্জেন্টিনা। একজন পেশাদার আর্জেন্টাইন গোলরক্ষক হিসেবে তার এ ভাবনা পুরোপুরি অযৌক্তিকও ছিল না, কিন্তু বাস্তবতা থেকে অনেকটাই দূরে ছিল। বয়স বাইশ হয়ে গেছে, এখনো কোনো ক্লাবে নিজের পায়ের তলার মাটি খুঁজে পাননি; সেই দিবু নাকি সামলাবেন আর্জেন্টিনার গোলপোস্ট!
এরপর প্রকৃতির নিয়মে সময় গড়াল। ২০১৪ পেরিয়ে ’১৫, ’১৬ এলো; কিন্তু ভাগ্য বদলালো না আর্জেন্টিনার, ভাগ্য বদলালো না দিবুর। আকাশি-সাদারা বজায়ে রাখল তাদের ফাইনাল হারের ধারা, দিবু ধারে ঘুরতে লাগলেন ক্লাব থেকে ক্লাবে। কিন্তু এভাবে আর কত দিন?
২০১৮ সালে, ছাব্বিশ বছর বয়সেও যখন পায়ের তলায় শক্ত জমিন পেলেন না, দিবু তখন হতাশ হয়ে পড়লেন। একবার ভেবেছিলেন ফুটবলটাই ছেড়ে দেবেন কি না। ভাগ্যিস, ছেড়ে দেননি! ছেড়ে দিলে কি আর এমন রূপকথার মতো গল্পটা তৈরি হতো?
২০১৮ বিশ্বকাপের শেষ ষোল’তেই শেষ হয় আর্জেন্টিনার যাত্রা। দুই গোলরক্ষক উইলি কাবায়েরো আর ফ্রাঙ্কো আরমানি করেছিলেন মোটামুটি সম্ভাব্য সব ধরনের ভুল। ফলাফল হিসেবে বিশ্বকাপের পর নতুন কোচ লিওনেল স্কালোনি নেমে পড়েন নতুন গোলরক্ষকের সন্ধানে। এই সন্ধানেই তার সামনে এল দিবুর নাম। ২০১৯ থেকে দিবু নিয়মিত সুযোগ পেতে থাকলেন আর্জেন্টিনার স্কোয়াডে। তবে মূল একাদশে নয়, বেঞ্চে। মূল গোলরক্ষকের দস্তানাটা তখনও ফ্রাঙ্কো আরমানির নিয়ন্ত্রণে, আর এদিকে দিবু তখনও ক্লাবেই নিয়মিত নন।
চোট-আঘাতকে সাধারণ অর্থে বিবেচনা করা হয় দুর্ভাগ্যের প্রতীক হিসেবে, অন্তত যে চোটে পড়ে তার জন্য তো বটেই। কিন্তু চোট-আঘাত হয়ে উঠতে পারে সৌভাগ্যও, চোটাক্রান্ত ব্যক্তির জায়গাটা যিনি দখল করছেন তার জন্য। দিবুর জন্য সৌভাগ্য বয়ে আনল দুটো চোট; একটা ক্লাব পর্যায়ে, আরেকটা জাতীয় দলে।
২০১৯-২০ মৌসুমের দ্বিতীয়ার্ধে চোটে পড়েন আর্সেনালের নিয়মিত গোলরক্ষক বার্নড লেনো, সেই জায়গায় সুযোগ মেলে দিবুর। খুব বেশি ম্যাচ যে খেলতে পেরেছেন, তেমনটা নয়। প্রিমিয়ার লিগে নয় ম্যাচ খেলেছেন, আর জিতেছেন কমিউনিটি শিল্ড। তবে শিরোপার চেয়ে তিনি বেশি বেশি অর্জন করেছিলেন সাহস, আর ছায়া থেকে বেরিয়ে আসার মানসিক শক্তি।
আর্সেনালের ছায়া থেকে বেরিয়ে ২০২০-২১ মৌসুমে তিনি যোগ দিলেন অ্যাস্টন ভিলায়। প্রথম মৌসুমেই বাজিমাত, আটত্রিশ ম্যাচের লিগে পনেরোটা ক্লিনশিট আর অসাধারণ সব মুহূর্ত উপহার দিয়ে দিবু হয়ে গেলেন সমর্থকদের চোখে ক্লাবের মৌসুমের সেরা খেলোয়াড়। দিবু থেকে ‘এমিলিয়ানো মার্টিনেজ’ হয়ে ওঠার শুরুটাও সেখানেই।
তবে ক্লাবে অসাধারণ মৌসুম কাটালেও জাতীয় দলের হয়ে প্রাপ্য সুযোগটা আসছিল না। যখন এলো, সেটাও ফ্রাঙ্কো আরমানির কোভিড সংক্রমিত হওয়ার কারণে; আর সেটা এলো কোপা আমেরিকার মাত্র দুই ম্যাচ আগে। চিলি আর কলম্বিয়ার বিপক্ষে অনুষ্টিত বিশ্বকাপ বাছাইয়ের ঐ দুই ম্যাচে আহামরি ভালো করেননি, তবে আরমানি তখনও সুস্থ না হওয়ায় প্রথম পছন্দের গোলরক্ষক ছিলেন এমিলিয়ানোই। এরপর যা ঘটল, তাকে রূপকথা ছাড়া আর কী বলা যায়!
খেলাধুলার ক্ষেত্রে অতিব্যবহারের ফলে ‘রূপকথা’ শব্দটিকে ক্লিশে মনে হতে পারে, কিন্তু এমিলিয়ানোর জীবনের বাকি অংশটা রূপকথার চেয়ে কম কিছু নয়। কোপা আমেরিকার প্রথম ম্যাচেই ভিদালের পেনাল্টি সেভ করলেন, এরপর উরুগুয়ে-প্যারাগুয়ে-ইকুয়েডরের বিপক্ষে ক্লিনশিট রাখলেন, সেমিফাইনালের টাইব্রেকারে তো তিনটা পেনাল্টি ঠেকিয়ে নায়কই বনে গেলেন। আর যে আসল পরীক্ষা ছিল পরাক্রমশালী ব্রাজিলের বিপক্ষে, সেটাতেও তিনি পাস করলেন ক্লিনশিটসহ। আনহেল ডি মারিয়ার গোলের পর নেইমার-বারবোসাদের একের পর এক শট ঠেকালেন অবিশ্বাস্যভাবে। আর শেষ বাঁশি বাজার সাথে সাথে নিশ্চিত করলেন, নিজের গোল্ডেন গ্লাভসের সাথে অর্জন করেছেন আজন্মলালিত স্বপ্ন পূরণের গৌরবটাও, আর্জেন্টিনার জার্সিতে শিরোপা জয়! শুধু নিজের স্বপ্ন নয়, বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা কোটি আর্জেন্টিনা-সমর্থকের স্বপ্ন; এবং অবশ্যই, লিওনেল মেসির স্বপ্ন।
রূপকথার শেষ নয় এখানেই। এরপর থেকেই আর্জেন্টিনার প্রথম পছন্দের গোলরক্ষক হয়ে গেছেন এমিলিয়ানো, আকাশি-সাদাদের হয়ে জিতেছেন ফিনালিসিমার ট্রফি। নিয়মিত খেলেছেন বাছাইপর্ব আর প্রীতি ম্যাচে, আর এক নম্বর গোলরক্ষক হিসেবেই উড়ে গেছেন কাতারে। বাকিটা তো পাঠক জানেনই।
৩৬ ম্যাচের অপরাজিত-দৌড় নিয়ে সৌদি আরবের বিপক্ষে মুখোমুখি হয়েছিল আর্জেন্টিনা। কিন্তু রক্ষণের ভুল এবং সৌদি ফরোয়ার্ডদের অসাধারণ ফিনিশিংয়ে পরাজয় দিয়েই বিশ্বকাপ-যাত্রা শুরু হয়েছিল আকাশি-সাদাদের। আর্জেন্টিনার জার্সিতে কখনো পরাজয়ের স্বাদ না পাওয়া এমিলিয়ানো মার্টিনেজও মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলেন না এমন কিছুর জন্য, ম্যাচের পর নিজেকে ফিরে পেতে তাই তাকে শরণাপন্ন হতে হয়েছিল মনোবিদেরও। তবুও মেক্সিকোর বিপক্ষে ম্যাচের আগে টেলিভিশন ক্যামেরায় ধরা পড়েছিল তার দুশ্চিন্তাগ্রস্ত চেহারাটা। আর তখনই এমিলিয়ানোকে সান্ত্বনা দিয়েছিলেন তার সবচেয়ে কাছে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটি, লিওনেল মেসি। ঐ ম্যাচের প্রথমার্ধে মেক্সিকোর অসাধারণ একটা ফ্রি-কিক ঠেকিয়ে দিয়ে আর্জেন্টিনাকে ম্যাচে রেখেছিলেন এমিলিয়ানো, দ্বিতীয়ার্ধে মেসি-ম্যাজিকের কথা আর নতুন করে না বললেও চলছে।
এমিলিয়ানোর অসাধারণ কিপিং চলেছে পোল্যান্ড আর অস্ট্রেলিয়া ম্যাচেও। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচের শেষ মুহূর্তে তাঁর সেভটা দর্শকেরা বহুকাল মনে রাখতে বাধ্য; ওটা না হলে যে ম্যাচ গড়াত অতিরিক্ত ত্রিশ মিনিটে!
নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষের ম্যাচটা কিন্তু অতিরিক্ত সময়ে গড়াল, গড়াল ডাচ খেলোয়াড়দের দারুণ বুদ্ধিদীপ্ত ফ্রি-কিকের কল্যাণে। পৃথিবীর সেরা গোলরক্ষকটাও ঐ গোলটা ঠেকাতে পারতেন কি না সন্দেহ! এমিলিয়ানোও পারেননি। কিন্তু এমিলিয়ানো যেটা পেরেছিলেন, সেটাই বা কয়জন পারেন! টাইব্রেকারে ভার্জিল ফন ডাইক আর স্টিফেন বার্গউইসের দুটো শট ঠেকিয়ে আর্জেন্টিনার জয়ের ভিত্তিটা তো তিনিই গড়ে দিয়েছিলেন।
মধ্যরেখায় দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মুখে দাঁড়িয়ে থাকা অধিনায়ক লিওনেল মেসিও সেটা জানতেন। তাই লাউতারো মার্টিনেজের জয়সূচক গোলের পরে যখন পুরো দলটাই ছুটছে তার পেছনে, মেসি ছুটে এলেন এমিলিয়ানোর কাছে, যেন সবার অলক্ষ্যেই একটা আন্তরিক ধন্যবাদ দিলেন তার বিশ্বকাপ-স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য।
লিওনেল মেসির জন্য এই আর্জেন্টিনা দলটা যুদ্ধে যেতে পারে, রদ্রিগো ডি পল সেটা আগেই বলেছেন। মেসির দীর্ঘদিনের সতীর্থ আনহেল ডি মারিয়া, অথবা বয়সে মেসির অনুজ আলেক্সিস ম্যাকঅ্যালিস্টার, লিসান্দ্রো মার্টিনেজরাও বিভিন্ন সময়ে প্রশংসা করেছেন মেসির অধিনায়কত্বের। এমিলিয়ানো মার্টিনেজ এক্ষেত্রে এক ধাপ এগিয়ে; তিনি তো মেসির জন্য নিজের জীবনও উৎসর্গ করতে রাজি। অবশ্য তিনি তেমনটা বলবেন না-ই বা কেন! একটা পুরো প্রজন্মকে নতুনভাবে উদ্বুদ্ধ করা লিওনেল মেসির জন্য এটুকু তো করা-ই যায়!
মাঠে আর মাঠের বাইরে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে দলের মধ্যে যে বিশ্বাসের যোগান মেসি দেন, সেই বিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে আকাশী-সাদার প্রতিটা খেলোয়াড়ই তো যেন একেকজন যোদ্ধারূপে নামেন যুদ্ধের ময়দানে।
আর যুদ্ধের ময়দানে তো অধিনায়কের কথাই শেষ কথা, নাকি?