ওয়ানডে সিরিজটা জিতেই গেল বাংলাদেশ। জয়ের উচ্ছ্বাস এখনও চলছে। মঙ্গলবার টি-টোয়েন্টির আগপর্যন্ত এটা চলবেও। কিন্তু সিরিজ জিতলেও কিছু ব্যাপার ভাবিয়ে তুলছে সবাইকে। ভাবাচ্ছে টিম ম্যানেজমেন্ট, এমনকি দলের জ্যেষ্ঠ ক্রিকেটারদেরকেও। একে তো জুনিয়রদের জ্বলে উঠতে না পারার জ্বালা রয়েছেই, তার উপর মরার ঘা হয়েছে এই যে এসব ক্রিকেটারের বাইরে পাইপলাইনের অবস্থাও বিশেষ সুবিধার নয়।
বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের ওয়ানডে অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা উইন্ডিজের বিপক্ষে সিরিজ খেলতে যাওয়ার আগেই বলে গিয়েছিলেন, এটা হবে ২০১৯ বিশ্বকাপের প্রস্তুতি। সেই প্রস্তুতি হয়েছে কেবল দলের পাঁচ ক্রিকেটার তামিম ইকবাল, সাকিব আল হাসান, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ, মুশফিকুর রহিম ও মাশরাফির। তরুণরা বিশেষ সম্ভাবনা দেখাতে পারেননি। এটাই ভোগাচ্ছে সবাইকে।
সিরিজ জিতেও তাই খুব বেশি খুশি হতে পারছেন না মাশরাফি। এমন একটা জয় অবশ্যই দলের জন্য দরকার ছিল তা মানছেন। এশিয়া কাপের আগে বড় পাওয়া বলেও ভাবছেন। কিন্তু বিশ্বকাপ খুব বেশি দূরে নেই। তাছাড়া মাশরাফির ভাবনা এই সিরিজের পর এটা খুব করে চোখে পড়েছে যে বাংলাদেশ দলের অনেক জায়গায় কাজ করার বাকি আছে। বিশেষ করে ব্যাটিংয়ে। বোলিংয়ে ডেথ ওভার নিয়েও কাজ করতে হবে বাংলাদেশ দলকে। স্লগ ওভার, ডেথ ওভার, মিডল অর্ডারে ব্যাটিং, ফিনিশার, পেসার সংকট, ওপেনিংয়ে তামিমের যোগ্য সমর্থক; অনেক কিছু নিয়েই ব্যবচ্ছেদ হতে পারে।
তার মধ্যে বিশেষ পাঁচটি ইস্যু নিয়ে কপালে দুশ্চিন্তার ভাজ পড়ছে টিম ম্যানেজমেন্টের। সেই পাঁচ বিষয় নিয়েই এই প্রতিবেদন।
১) তামিম ইকবালের সঙ্গে ওপেনিং ঘাটতি মিটবে কবে?
চলতি বছরে ৭ ওয়ানডে ম্যাচে মাত্র ৮৮ রান তুলেছেন এনামুল হক বিজয়। ওপেনার হিসেবে সুযোগ পেয়েও নিজের নামের সঙ্গে সুবিচার করতে পারেননি তিনি। অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা তাকে উইন্ডিজের বিপক্ষে তিন ম্যাচেই সুযোগ দিয়েছেন বটে, কিন্তু ৩ ইনিংসে বিজয়ের ব্যাটে এসেছে মাত্র ৩৩ রান।
চলতি বছরের শুরুতে ঘরের মাঠে ত্রিদেশীয় সিরিজে সুযোগ পান বিজয়। কারণ, ইমরুল কায়েস, সৌম্য সরকার ও লিটন কুমার দাস তামিম ইকবালকে সঠিক সঙ্গ দিতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। এই জায়গায় মোহাম্মদ মিঠুনকেও চেষ্টা করা হয়েছিল, কিন্তু তিনিও ব্যর্থ হয়েছেন।
বিজয়ের ব্যর্থতার কারণে নির্বাচকরা হয়তো আবারও সৌম্য সরকার কিংবা লিটন কুমারের কাছে ফিরে যেতে পারেন। তবে উইন্ডিজের বিপক্ষে চলতি সিরিজের টি-টোয়েন্টি ম্যাচগুলোতে তারা কেমন পারফর্মেন্স করছেন, সেটার উপরই নির্ভর করছে সবকিছু। এসবের বাইরে আরেকজন তালিকায় আছেন। তিনি নাজমুল হোসেন শান্ত। পুরো ওয়ানডে সিরিজে ডাগআউটে থেকেছেন তিনি। এরপর ‘এ’ দলের হয়ে আয়ারল্যান্ড সফরে গিয়েছেন। সেখানে তার পারফরম্যান্স ভালো হলে, বাড়তি পছন্দের জায়গা আসবে নির্বাচকদের হাতে।
২) ফিনিশারের দায়িত্ব কার?
শেষ পাঁচ ওভারে ফিনিশারের দায়িত্বটা মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ পালন করে যাচ্ছেন। মাত্র শেষ হওয়া ওয়ানডে সিরিজে তার স্ট্রাইক রেট ছিল ২১৪.২৯। সাবেক কোচ চান্দিকা হাতুরুসিংহের অধীনেই তিনি টি-টোয়েন্টি ও ওয়ানডেতে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার কাজ করেছেন। এখন সীমিত ওভারের এই দুই ফরম্যাটেই নিজস্ব স্টাইলে দারুণ শক্ত-সামর্থ। সাব্বির রহমান ও মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত দুজনে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের আশেপাশে ব্যাট করেছেন। কিন্তু দুজনেই ছিলেন ব্যর্থ।
সাব্বির ভুগছেন ফর্মহীনতায়। শেষ ১৪ ইনিংসে তার ব্যাটে আসেনি কোনো উল্লেখযোগ্য ইনিংস। অন্যদিকে, মোসাদ্দেক হোসেন মিডল অর্ডারের হিসেবে গতানুগতিক মানের ব্যাটসম্যান, যিনি কি না এখনও বুঝেই উঠতে পারেননি স্লগ ওভারে আসলে কিভাবে খেলা উচিত। এই ইস্যুটি আরও বড় করে সামনে আসে যখন সেন্ট কিটসে সিরিজের শেষ ওয়ানডে ম্যাচে অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা ৩৯ তম ওভারে মোসাদ্দেকের জায়গায় স্লগ ওভারে ব্যাট হাতে মাঠে নেমে যান।
এটা হতে পারে যে, মাহমুদউল্লাহকে পরে নামিয়ে সৈকতকে আগে নামানো যেতে পারে। উদ্দেশ্য, শেষ ৬-৮ ওভার; যেটা কি না মাহমুদউল্লাহর প্রিয়। এক্ষেত্রে দুটি কাজ হবে। মাহমুদউল্লাহ তার পছন্দমতো অবস্থানে খেলতে পারবেন, পাশাপাশি ফিনিশারের কাজটিও করতে পারবেন। তবে এটা পরিষ্কার যে সাব্বিরের আপাতত বিশ্রামের প্রয়োজন।
আরিফুল হক শেষ পাঁচ ওভারের জন্য বাংলাদেশ দলের বড় সম্পদ হওয়ার যোগ্যতা রাখেন। টি-টোয়েন্টি ম্যাচগুলোতে সুযোগ পেলেই হয়তো টিম ম্যানেজমেন্ট বুঝতে পারবে আরিফুল আসলে কোন জায়গায় সবচেয়ে বেশি ফিট।
৩) স্লগ ওভার নিয়ন্ত্রণ করার মতো বোলারের কি আসলেও অভাব বাংলাদেশ দলে?
ওয়ানডেতে গেল ৩ বছর ধরে মুস্তাফিজুর রহমান শেষ পাঁচ ওভারে রান কম দেওয়ার তালিকায় বিশ্বের দ্বিতীয়। রশিদ খান একটুর জন্য মুস্তাফিজুর চেয়ে এগিয়ে আছেন। আফগানিস্তানের এই লেগস্পিনার ওভার প্রতি ৬ রান খরচ করেছেন, যেখানে মুস্তাফিজুর খরচ করেছেন ৬.০৮ রান। বাংলাদেশ দলের জন্য সে এক্ষেত্রে একটা বড় অস্ত্র। বিশেষ করে ডেথ ওভারে। কিন্তু বাংলাদেশ তার দক্ষতার উপর অনেক বেশি নির্ভরশীল।
একই জায়গাতে রুবেল হোসেন খরচ করেন ওভারে ১০.৪০ রান। মাশরাফি ও সাকিব; দলের সবচেয়ে অভিজ্ঞ দুই বোলার শেষ তিন ম্যাচের তিন ইনিংসে স্লগ ওভারে বল করেছেন মাত্র ২ ওভার করে।
তাসকিন আহমেদের জায়গাটা এখানে খালি পড়ে আছে। স্লগ ওভারে উইকেট নিতে পারার দক্ষতা রয়েছে এই ফাস্ট বোলারের। যদিও গেল বছর দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজের পর সেই দক্ষতা যেন ভুলতে বসেছেন এই ক্রিকেটার। পছন্দের তালিকায় রাখা যেতে পারে সাকিবকেও।
৪) মেহেদী হাসান মিরাজ, নতুন বলে লম্বা সময়ের ঘোড়া?
খুব বেশি উইকেট নিতে না পারলেও, মেহেদী হাসান মিরাজ এই ওয়ানডে সিরিজে নজর কেড়েছেন। প্রতি মুহূর্তে প্রতিপক্ষকে লাইন-লেন্থ আর ভ্যারিয়েশন দিয়ে আক্রমণের উপর রেখেছিলেন এই ডানহাতি স্পিনার। প্রথম পাওয়ার প্লে-তে ওভার প্রতি ৩.৭৩ রান খরচ করেছেন মিরাজ। হতে পারে, সে তার এই আক্রমণ আসন্ন এশিয়া সিরিজ ও ঘরের মাঠে জিম্বাবুয়ে-উইন্ডিজের বিপক্ষেও চালিয়ে যাবে।
অর্থাৎ, ২০১৯ বিশ্বকাপেও বাংলাদেশ টিম ম্যানেজমেন্টের সামনে নতুন বলে মাত্র দুজন বোলারই পছন্দের তালিকায় থাকছে। একজন মিরাজ, অপরজন মাশরাফি (২০১৬ সাল থেকে টানা নতুন বলে বল করে আসছেন তিনি)।
বাঁহাতি পেসার মুস্তাফিজের মূল কাজ হয়ে থাকে শেষ ১০ ওভারে। মাশরাফি শুরুটা করে দিয়ে আসেন নতুন বলের। এর মধ্যে প্রথম পাওয়ার প্লে-তে গেল ২ বছরে রুবেল হোসেন, তাসকিন আহমেদ ও শফিউল ইসলাম; এই তিন পেসারকে দিয়ে কাজ চালানো হয়েছে।
৫) সাইডবেঞ্চের অস্ত্র কারা?
আগামী ১০ মাসে অনেক ক্রিকেট খেলবে বাংলাদেশ। ২০১৯ বিশ্বকাপের জন্য নিজেদেরকে প্রস্তুত করবে। এই সময়ের মধ্যে তারা কিছু জায়গায় উন্নতি করতে চাইবে। বিশেষ করে টেস্টে একটি ভালো পেস আক্রমণ, ওয়ানডেতে একজোড়া ওপেনার আর মিডল অর্ডারে অন্তত দুজন আক্রমণাত্মক ব্যাটসম্যানে যে অভাবগুলো আছে সেগুলো সমাধান করতে চাইবে। একটি টেস্ট খেলা শান্তকে চলমান সিরিজের কোনো টেস্ট ম্যাচে অথবা ওয়ানডেতে সুযোগ দেওয়া হয়নি। পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে ‘এ’ দলের হয়ে আয়ারল্যান্ড সিরিজে। অর্থাৎ, টি-টোয়েন্টিতেও পাওয়া যাচ্ছে না তাকে।
সৌম্য, লিটন এবং আরিফুল হক উইন্ডিজের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টিতে ব্যাটিংয়ে সুযোগ পাওয়ার ক্ষেত্রে নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা করবেন। অন্যদিকে, ‘টেস্ট ব্যাটসম্যান’ খেতাব পাওয়া মুমিনুল হক আয়ারল্যান্ড সফরে গেছেন ‘এ’ দলের হয়ে। সেখানে তার ভালো পারফর্মেন্স করার মধ্যেই লুকিয়ে আছে সীমিত ওভারের ক্রিকেটে ফেরার চাবিকাঠি।
ফিচার ইমেজ- CWI