নিজেদের ইতিহাসে অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে প্রথম টেস্ট সিরিজ জিতেছে ভারত। উপমহাদেশের প্রথম কোনো দল হিসেবে এই কীর্তি করেছে বিরাট কোহলির দল। এই জয়ের পর ভারতীয় অধিনায়ক কোহলি বলেছেন, এই সিরিজ জয় তার কাছে বিশ্বকাপ জয়ের চেয়েও বড়।
কেন অস্ট্রেলিয়ায় এই সিরিজ জয়কে এতো বড় করে দেখছেন, সেটা সিরিজ শেষে বিস্তারিত বলেছেন কোহলি। সেই কথোপকথনের কিয়দংশ রইলো এখানে।
সবচেয়ে বড় অর্জন
‘গত দশ বছরে আমি যত ক্রিকেট খেলেছি, এটাই তার মধ্যে আমার অভিজ্ঞতায় সবচেয়ে গর্বের মুহূর্ত। আমি আমার দল নিয়ে খুব গর্বিত। কারণ, আমরা এক ঝাঁক তরুনের একটা দল। আমাদের এই বিশ্বাসটা ছিল, এবং আমরা প্রতিনিয়ত আরও ভালো করার জন্য পরিশ্রম করে গেছি। এর ফলে এরকম একটা পুরষ্কার পাওয়ার পর আমরা নিঃসন্দেহে দারুণ খুশি। যদিও ইতিহাস বদলে দেওয়া বা ইতিহাস তৈরি করার মতো ব্যাপার নিয়ে আমি এখনও চিন্তা করছি না। আমাদের এই সন্তুষ্টি হলো গত ১২ মাসের পরিশ্রমের ফল পাওয়ায়। আমরা বুঝতে পারছি যে, আমরা যা বিশ্বাস করেছি, সেটা সঠিক বলে প্রমাণিত হয়েছে; তাতে পুরো বিশ্বও যদি আমাদের বিপক্ষে থেকে থাকে।’
‘আপনি যদি সঠিক পথে, সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে পরিশ্রম করতে থাকেন, তাহলে ঈশ্বর অবশ্যই একসময় তার প্রতিদান দেবেন। আর এজন্যই আমি বেশি খুশি।’
বিশ্বকাপের চেয়েও বড় কেন?
‘দেখুন, আমি যেটা বলেছি যে, আমি ২০১১ বিশ্বকাপ (জয়ী) দলের অংশ ছিলাম। কিন্তু আমার মধ্যে আগে বিশ্বকাপ না জেতার ফলে যে আবেগটা, সেটা ছিলো না। আমি ঘরের মাটিতে বিশ্বকাপ খেলেছি এবং শেষ অবধি জিতেছি। হ্যাঁ, দলের অনেক সিনিয়র খেলোয়াড়ের সেই আবেগটা ছিলো। ফলে ওটা তাদের জন্য বিশেষ কিছু ছিল। আপনারা জানেন, তাদের জন্য ‘অবশেষে জিততে পারলাম’ অবধি পৌঁছানোটা খুব কষ্টের ছিলো। হ্যাঁ, আমার জন্যও ওটা খুব গর্বের একটা মুহূর্ত ছিল। তবে আপনি যদি জিজ্ঞেস করেন, কোন মুহূর্তটা বেশি আবেগের। আমি এই সিরিজের কথাই বলবো। কারণ, এটা এখানে (অস্ট্রেলিয়ায়) আমার তৃতীয় সফর। আমি আমার অভিজ্ঞতা থেকে এবং মাঠে থাকার ফলে বুঝতে পেরেছি যে, এখানে এসে জিতে যাওয়াটা কতটা কঠিন। সেই সাথে একটা দল হিসেবে গত ১২ মাস ধরে আমরা যে সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে গেছি, সেটাও একটা ব্যাপার। ফলে এই দৃষ্টিকোণ থেকে এটা আমার জন্য বেশি আবেগের ব্যাপার।’
‘এটা অবশ্যই আমার জন্য আরও বিশেষ কিছু। এর প্রকৃত কারণ হলো, আমরা খুব করে চেয়েছিলাম, দেশের বাইরে যেন আমরা একটা সিরিজ জিততে পারি। আমরা এক ম্যাচের বিস্ময় হয়ে থাকতে চাইনি। ফলে আমরা আমাদের কাজে মনোযোগী ছিলাম, এবং আমরা যা করতে চেয়েছি মাঠে সেটা প্রয়োগ করেছি। শেষ অবধি ফলটাও পেয়েছি। ফলে একটা দল হিসেবে আমরা এখন নিজেদের সম্পূর্ণ মনে করছি। আমাদের যা করার ছিল, আমরা সেটা করতে চেয়েছি। আমরা কাউকে কিছু দেখিয়ে দিতে চাইনি। কিন্তু হ্যাঁ, নিজেদের অবশ্যই প্রমাণ করতে চেয়েছি। আমরা এটা করতে পারি এবং আমরা এটা করেছি। এই দৃষ্টিকোণ থেকে এই সিরিজটা আমার জন্য আসলেই বিশেষ কিছু।’
টেস্ট ছড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ
‘আমি এই সিরিজটাকে দলের জন্য এগিয়ে যাওয়ার একটা পদক্ষেপ হিসেবে দেখতে চাই। এই সিরিজটা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অনেক টেস্ট ক্রিকেটারকে অনুপ্রাণিত করবে। তারা টেস্ট ক্রিকেট নিয়েই আরও বেশি আবেগী হবে। ভারতীয় দল যদি টেস্ট ক্রিকেটকে সম্মান দেখাতে শুরু করে, অবশ্যই ভারতীয় দর্শকরাও আরও বেশি মাঠে আসবেন এবং টেস্ট ক্রিকেট দেখবেন। ফলে এখানে ভিশনটা হলো, টেস্ট ক্রিকেটকে দেশে আরও একটু ছড়িয়ে দেওয়া এবং বাচ্চাদের এটা উপলব্ধি করানো যে টেস্ট ক্রিকেটের চেয়ে বড় কিছু, এমন একটা সিরিজ জয়ের চেয়ে বড় কিছু হতে পারে না। এরকম একটা সিরিজ জয় আপনাকে শুধু ক্রিকেটার হিসেবে নয়, মানুষ হিসেবেই আরও উন্নত করে তুলবে।’
‘এমন একটা দুনিয়ায় আমরা আছি, যেখানে অধিকাংশ মানুষ সবকিছু সহজে পেতে চায়, সন্ধ্যার আগে ম্যাচ শেষ হয়ে যাওয়া চায়। আমি মনে করি, তাদের জন্য এই বার্তাটা ছড়িয়ে দেওয়া দরকার। যতদিন অবধি এই অকৃত্রিম ফরম্যাট (টেস্ট) টিকে থাকবে, ক্রিকেটও ততদিন সুস্থ থাকবে। এটা বলা দরকার যে, আমাদের সেই ধরণের ক্রিকেট খেলতে হবে, যে ধরণের ক্রিকেট এখানে আমরা খেলেছি। আমরা যদি সেই বিরক্তিকর ড্রয়ের জন্য, কোনো ফলাফল না আনার জন্য খেলতে থাকি, তাহলে খেলার কোনো উন্নতি হবে না। সেটা বিশ্বজুড়ে টেস্ট ক্রিকেটের ভাগ্যে কোনো পরিবর্তন আনবে না। আমি সবসময়ই এটা মনে করি যে, আমাদের কাজ হলো এটা তুলে ধরা যে, টেস্ট ক্রিকেট এই খেলাটার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং সবচেয়ে দামী ফরম্যাট। অত্যন্ত যৌক্তিকভাবেই এটা সঠিক। আমরা এজন্য গর্বিত যে, আমরা এই সঠিক বার্তাটা ছড়িয়ে দেওয়ার একটা সুযোগ পেয়েছি।’
বোলারদের কীর্তি
‘তাদের (বোলারদের) ব্যাপারে আমরা একটা কথাই বলার আছে – আমি গর্বিত। স্লিপ কর্ডনে দাড়িয়ে এই বোলারদের দেখাটা একটা অসাধারণ অনুভূতি ছিলো। আমার বুমরাহকে বলে দিতে হয়নি যে, ১১ নম্বর ব্যাটসম্যানকে ১৪৯ কিলোমিটার গতিতে বল করো। এটা ওর নিজের সিদ্ধান্ত ছিল। আপনি ওদের মধ্যে সেই ক্ষুধাটা, সেই আবেগটা দেখতে পাবেন। আর রবি ভাই (রবি শাস্ত্রী) যেমনটা বলেছেন, আমরা দলের জয়ের জন্য যেকোনো কিছু বাজি রাখতে প্রস্তুত ছিলাম। আর এ জন্যই এই সংখ্যাগুলো (বড় বড় রান ও উইকেট) বোর্ডে দেখা যাচ্ছিলো।’
‘এই ছেলেদের আপনার কখনোই জোরে দৌড়ে এসে পুরো শক্তি দিয়ে বল করার কথা বা সবটুকু চেষ্টা করার কথা বলে দিতে হয় না। তারা নিজেদের সামর্থ্যটা উপলব্ধি করে। আপনি দেখবেন, তারা যখন বল করে, নিজেরাই ফিল্ডিং সেট করে নেয়। তারা কর্তৃত্ব স্থাপন করার চেষ্টা করে। আর একজন বোলারের কাছ থেকে, বিশেষ করে ফাস্ট বোলারের কাছ থেকে এটা দেখাটা সবচেয়ে আনন্দের ব্যাপার।’
দলীয় এক প্রচেষ্টা
‘এটা সর্বার্থেই একটা দলীয় প্রচেষ্টার ফল ছিলো। আমরা এরকম একটা কিছুর জন্যই অপেক্ষায় ছিলাম। আমরা একটা দল হিসেবে ভালো করতে চেয়েছিলাম। একটা একক স্পেল বা একক ইনিংস কখনো ম্যাচ, বিশেষ করে টেস্ট ম্যাচ জেতাতে পারে না। আর এটা সেই দল, যেটা কখনো একটা একক ইনিংস বা একক ভালো স্পেলের জন্য ক্রিকেট খেলে না।’
‘আপনি যদি আমাকে একক কোনো ইনিংসের কথা বলতে বলে, আমি বলবো (হনুমা) বিহারি এমসিজিতে যে নতুন বলে ৭০ বলের একটা ইনিংস খেলেছিলো, সেটা যে কারো একটা সেঞ্চুরি বা ৭০-৮০ রানের মতোই বড় ব্যাপার। আমরা এভাবেই অবদানকে স্বীকৃতি দেই। আমরা সেই অবদানগুলোর দিকেই কেবল চেয়ে থাকি না, যেগুলো অনার্সবোর্ডে ঠাই পায়। আর আপনি যদি এই ধরণের সিরিজ জিততে চান, আপনাকে একটা দল হিসেবেই ভালো খেলতে হবে।’
টস জয়েই সিরিজ জয়?
‘আমি একটা ব্যাপার বলতে চাই, গত ১২ মাসে আমরা যেসব ম্যাচে টসে হেরেছি, সেখানে আমাদের পারফরম্যান্স দেখুন। আপনি বুঝতে পারবেন, আমরা কী মানের ক্রিকেট খেলেছি। আর যেসব ম্যাচে আমরা টসে জিতেছি, সেখানে প্রতিপক্ষ আমাদের কাছে আসতে পারেনি। আমি এটা ঔদ্ধত্য দেখাতে বলছি না। যেটা সত্যি, সেটাই বলছি। আমাদের নিজেদের উপর এতটাই বিশ্বাস আছে যে, আমরা এখন যেকোনো দলকে যেকোনো জায়গায় হারাতে পারি। আমরা এতটাই খুশি যে, সেটা ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না।’