‘জোসে মরিনহো’– নামটি শুনলেই বেশিরভাগ ফুটবল দর্শকের মনে এমন একজন ফুটবল কোচের প্রতিচ্ছবি ভেসে ওঠার কথা, যিনি নানান কিসিমের বিতর্কিত মন্তব্য করে গণমাধ্যমের শিরোনাম হতে ভালোবাসেন। সাংবাদিকদের প্রয়োজন বিখ্যাত মানুষদের কাছ থেকে এমন ধরনের সব মন্তব্য, যেগুলো সহজেই পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হবে, পত্রিকার কাটতি বাড়িয়ে দেবে বহুগুণে। জোসে মরিনহোর বিতর্কিত মন্তব্যগুলো তাদের প্রত্যাশা পূরণ করতে শতভাগ সফল হয় বেশিরভাগ সময়ই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এই সময়ে তাকে নিয়ে, তার মন্তব্য নিয়ে বিস্তর আলোচনা-সমালোচনা হয়ে থাকে।
গণমাধ্যমে জোসে মরিনহো যতই উল্টাপাল্টা মন্তব্য করুক কিংবা গণমাধ্যম তাকে যতই ‘পাগলাটে’ হিসেবে চিত্রায়িত করুক না কেন, তিনি যে দুর্দান্ত একজন ফুটবল কোচ, এই বিষয়ে তার সমালোচকেরাও দ্বিমত করবেন না। তিনি গণমাধ্যমে যেমন উদ্ভট মন্তব্য করে শিরোনাম হতে ভালোবাসেন, মাঠের খেলায়ও শক্তিশালী প্রতিপক্ষকে আটকে দিয়ে প্রায়ই শিরোনাম হয়ে থাকেন, তার উপর মিডিয়ার স্পটলাইট ফেলতে বাধ্য করেন। পর্তুগিজ ক্লাব পোর্তোকে নিয়ে উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতে রীতিমতো হইচই ফেলে দিয়েছিলেন কোচিং ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে, এরপর ইতালিয়ান ক্লাব ইন্টার মিলানকে নিয়েও ইউরোপীয় শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট মাথায় দিয়েছেন। চেলসিকে টানা দুটো প্রিমিয়ার লিগসহ তিনটি প্রিমিয়ার লিগ শিরোপা জিতিয়ে তাদের ইতিহাসে কিংবদন্তি কোচের আসনে জায়গা করে নেয়ার মতো কৃতিত্ব রয়েছে তার।
ইউরোপের তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ভিন্ন ভিন্ন লিগগুলোতে নিজেকে প্রমাণের মতো সাহস করেছেন কিংবা সুযোগ পেয়েছেন খুব অল্প কিছু কোচ, যাদের মধ্যে জোসে মরিনহো একটি অনন্য নাম। তার পছন্দের স্কোয়াড নিয়ে তিনি কেমন ভয়ংকর ও অপ্রতিরোধ হয়ে উঠতে পারেন, এটি ইউরোপের সব শীর্ষ ক্লাব টের পেয়েছে। আলাদা আলাদা লীগের শীর্ষ প্রতিযোগিতাগুলোতে তার ঈর্ষণীয় সাফল্য সে কথার পক্ষেই সমর্থন জোগায়।
জোসে মরিনহো যেভাবে সাংবাদিকদের সব প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে বিতর্ক বাঁধিয়ে ফেলেন, কিংবা ম্যাচের আগে-পরে প্রেস কনফারেন্সে প্রতিপক্ষ কোচ বা গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়কে কথার মাধ্যমে সুক্ষ্ম আক্রমণ করার চেষ্টা করেন, তার পেছনে কিন্তু যথেষ্ট কারণ রয়েছে। গত পর্বেই বলা হয়েছিল, বাইরে থেকে মনে হতে পারে তিনি গণমাধ্যমের শিরোনাম হতে চাচ্ছেন, কিন্তু বাস্তবে তিনি এভাবেই মাইন্ড গেম খেলে থাকেন।
রিয়াল মাদ্রিদ থেকে পুনরায় চেলসিতে যোগ দেয়ার পর একবার তিনি বলেছিলেন, শুধু খেলার ফলাফল বাদ দিয়ে যা করা হয় (মিডিয়ায় যা বলা হয়), তা পুরোপুরি তার মাইন্ডগেমের অংশ।
লিভারপুল বস ইয়ুর্গেন ক্লপের মতো ‘সেফ সাইডে থাকার নীতি’ অনুসরণ না করে স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের মতো ‘কথার মাধ্যমে আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণের নীতি’ অনুসরণ করে আসছেন কোচিং ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই। বেশিরভাগ সময় মাইন্ডগেমটা শুরু করেন নিজ থেকেই, ম্যাচ-পূর্ববর্তী প্রেস কনফারেন্সেই কিছু বলার মাধ্যমে প্রতিপক্ষের মনোযোগ আসন্ন ম্যাচ থেকে সরিয়ে দিতে চেষ্টা করেন।
প্রিমিয়ার লিগের এই মৌসুমে ইয়ুর্গেন ক্লপের লিভারপুলের সাথে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচের আগে ঠিক এ ধরনেরই মাইন্ড গেম খেলার চেষ্টা করেছিলেন জোসে মরিনহো। ম্যাচ-পূর্ববর্তী প্রেস কনফারেন্সে লিভারপুলের ইনজুরি সমস্যা নিয়ে তার মন্তব্য জানতে চাওয়া হলে তিনি সোজাসাপ্টা উত্তর দেন, একজন ভার্জিল ভ্যান ডাইক ছাড়া ইনজুরিতে থাকা বাকি খেলোয়াড়দের অনুপস্থিতি লিভারপুলের জন্য কোনো সমস্যা হবে না। বড় ম্যাচের আগে এই ধরনের সপাট জবাব অবশ্য পর্তুগিজ এই কোচের কাছ থেকে অনুমিতই ছিল। কারণ, তার মাইন্ডগেমের অন্যতম কৌশল হচ্ছে খেলার আগেই কথার লড়াইয়ে প্রতিপক্ষকে একচোট দেখে নেয়া, তাদের উপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করা।
স্প্যানিশ ফুটবলের অন্যতম সেরা ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদের দায়িত্বে থাকার সময়ে তার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল বার্সেলোনার দায়িত্বে থাকা কাতালান কোচ পেপ গার্দিওলা। পেপ গার্দিওলার সাথে সে সময় নিয়মিত কথার লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়তেন৷ জোসে মরিনহো প্রেস কনফারেন্সের রুমে কথার লড়াইয়ে যে একজন ‘মাস্টারমাইন্ড’ এবং অপ্রতিদ্বন্দ্বী, এই কথা তিনি সরাসরি গণমাধ্যমে বলেছেন। বার্সেলোনার পর পেপ গার্দিওলা বায়ার্ন মিউনিখের দায়িত্বে কিছুদিন থেকে প্রিমিয়ার লিগের কাপ ম্যানচেস্টার সিটির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। অপরদিকে রিয়াল মাদ্রিদের পর মরিনহো আবার প্রিমিয়ার লিগে ফিরে আসেন, চেলসির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। চেলসি, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ও সর্বশেষ টটেনহ্যাম — এই তিন ক্লাবের দায়িত্বে থাকার কারণে স্পেনের পর ইংল্যান্ডেও পেপ গার্দিওলার সাথে মরিনহোর আবার দেখা হয়েছে, পর্তুগিজ এই কোচ আবারও মাইন্ডগেম খেলেছেন তার পুরনো প্রতিদ্বন্দ্বীর সাথে। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের দায়িত্বে থাকার সময়ে ম্যানচেস্টার ডার্বি আলাদা মাত্রা লাভ করতো দুই বিখ্যাত কোচের মাইন্ডগেমের কারণে।
কোচ জোসে মরিনহো ম্যাচের আগে মাইন্ড গেম তো খেলেনই, বলতে গেলে আসল মাইন্ডগেম খেলেন ম্যাচের আগের প্রেস কনফারেন্সে। কিন্তু ম্যাচের পরও মাইন্ডগেম খেলতে কখনও ক্লান্ত হন না তিনি। বড় ম্যাচগুলোতে হেরে গেলেও তিনি তার দলের খেলোয়াড়দের মানসিকতা ঠিক রাখার জন্য মিডিয়ায় মাইন্ডগেমের শেষ পর্ব শুরু করেন। বেশিরভাগ সময়ই বড় ম্যাচগুলোতে মরিনহো হার পুরোপুরি মেনে না নিয়ে হারের পেছনে সজ্ঞানেই কোনো হাস্যকর অজুহাত দাঁড় করাতে চান। এটি করার অর্থ হলো, মিডিয়া তার হাস্যকর অজুহাতটি নিয়ে মেতে থাকবে, ফলে তার দলের হারার কারণ কিংবা খেলোয়াড়দের ব্যর্থতা নিয়ে বেশি আলোচনা হবে না। ফলে খেলোয়াড়দের উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হবে না, তারা পরবর্তী ম্যাচের জন্য নির্বিঘ্নে প্রস্তুতি নিতে পারবে।
লিভারপুলের সাথে এই সিজনে টটেনহ্যামের ম্যাচটিকেই আবার উদাহরণ হিসেবে নেয়া যাক। স্পার্সদের কোচ জোসে মরিনহো হারার পর লিভারপুল বস ক্লপকে বলেছিলেন, “সেরা দলটিই হেরেছে।” পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে বুঝতে পারা যাবে, টটেনহ্যাম আসলে সব দিক থেকেই লিভারপুলের চেয়ে পিছিয়ে ছিল। কিন্তু তারপরও এ ধরনের মন্তব্য করার কারণেই টটেনহ্যামের দলীয় ব্যর্থতার দিকে স্পটলাইট না ফেলে মিডিয়া তার অপ্রাসঙ্গিক মন্তব্য নিয়েই মেতে ছিল।
মরিনহোর সমালোচকেরা ‘সবসময় শিরোনাম হতে চাওয়া ব্যক্তি’, ‘পাগলাটে’, কিংবা ‘অপ্রকৃতস্থ’ হিসেবে প্রচারিত করলেও তিনি যে নেহায়েত শখের বসেই প্রতিপক্ষের প্রতি লক্ষ্য করে অপ্রাসঙ্গিক কিংবা হাস্যকর মন্তব্য ছোড়েন না, তা কিন্তু একটু খেয়াল করলেই বোঝা যায়। ভিন্ন ভিন্ন ক্লাবের হয়ে অর্জনগুলো তাকে এমনই একজন কোচ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে যে, তিনি উদ্ভট মন্তব্য না করলেও গণমাধ্যমের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতেই থাকেন সবসময়। তিনি মাইন্ডগেম খেলে একটু এগিয়ে থাকতে চান সবসময়ই, প্রতিপক্ষের উপর কৃত্রিম চাপ সৃষ্টি করে তাদের সেরাটা দেওয়া থেকে বিরত রাখতে চান; কিন্তু মিডিয়া থেকে শুরু করে কেউই সেটি ধরতে পারে না। অবশ্য গণমাধ্যম কিংবা প্রতিপক্ষ দলের সমর্থকদের সমালোচনাকে তিনি থোড়াই কেয়ার করেন। নইলে প্রতিটা বিতর্কের পর বিপুল পরিমাণ সমালোচনার পরও তিনি রণে ভঙ্গ না দিয়ে আবার নতুন কোনো বিতর্কের রসদ জোগান দিতেন না। সাবেক ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড কোচ স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের পর সবচেয়ে বেশি কার্যকরী মাইন্ডগেম যে খেলছেন পর্তুগিজ কোচ জোসে মরিনহো, এই ধরনের কথা বলা হলে সেটি মোটেই অতিশয়োক্তি হবে না।