ক্রিকেট মাঠে এগারোজন ফিল্ডিং করলেও আউটফিল্ডের পজিশন অনুযায়ী মূলত নয়জন ফিল্ডারকেই এদিক-সেদিক করা হয়। দুজনের পজিশনে তেমন পরিবর্তন করার সুযোগ থাকে না – একজন তো অবশ্যই বোলার, আর অন্যজন উইকেটরক্ষক। বোলারদের নিয়ে আলাদা করে তো বলার কিছু নেই, যে যখন বোলিংয়ে আসবে, তখন সে তার সাধ্যমতো জায়গা কাভার করে ফিল্ডিং করে। কিন্তু উইকেটরক্ষক পজিশন নিয়ে কিছু কথা আছে, মাঠে সবচেয়ে বেশি বল সাধারণত উইকেটরক্ষকদের হাতেই যায়। এ কারণে এ পজিশনে খেলানোর জন্য একজন বিশেষ খেলোয়াড়কে দলে রাখতেই হয়, যার উইকেটের পেছনে দাঁড়ানোর মতো যথাযথ যোগ্যতা আছে।
আগে তো উইকেটরক্ষকদের ব্যাটিং গুণটা তেমন বিবেচ্যই হতো না। গ্লাভস হাতে অসাধারণ কেউ কাজ চালানোর মতো ব্যাট চালাতে পারলেই তাকে উইকেটরক্ষক হিসেবে দলে জায়গা করে দেওয়া যেত। কিন্তু সময় বদলেছে, আরো পরিষ্কার করে বলা ভালো, একজন অ্যাডাম গিলক্রিস্ট বদলে দিয়েছেন। শুধু উইকেটরক্ষণের জন্য একজনকে দলে রাখাটা বিলাসিতা বৈ আর কিছু নয়। দুনিয়ার সব দেশেই উইকেটরক্ষকদের ভালো ব্যাটসম্যান হওয়ার চাহিদাটা বেড়ে গেছে। এ কারণে ভারতের সেরা উইকেটরক্ষক হওয়া সত্ত্বেও ব্যাটিংয়ে অফ ফর্মের কারণে রিশাভ পান্তের কাছে জায়গা হারিয়েছিলেন ঋদ্ধিমান সাহা।
তবে ব্যাটিং গুণটাকে যতই প্রাধান্য দেয়া হোক না কেন, যাদের উইকেটরক্ষক হিসেবে দলে নেয়া হয়, তাদের এ কাজ করার জন্য মোটামুটি একটা প্রশিক্ষণ থাকেই। আসলে একদম শুরু থেকে উইকেটরক্ষক হিসেবে অনুশীলন না থাকলে এ কাজ সামাল দেয়া বেশ দুরূহ কাজ। গ্লাভস হাতে বোলারের বল ডেলিভারি ঠিকঠাক বুঝে পজিশন নেয়া, মাথা ঠাণ্ডা করে ক্যাচ ধরা কিংবা স্ট্যাম্পিং করা – এগুলো শুনতে যতটা সহজ শোনায়, বলাই বাহুল্য, ব্যাপারটা অন্তত ‘জলবৎ তরলং’ নয়। তবে এগুলো থেকেও সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ খুব সম্ভবত ফোকাস ধরে রাখা। ক্রিকেটটা আর যা-ই হোক, ক্ষণস্থায়িত্বের জন্য ঠিক বিখ্যাত নয়। আর এহেন লম্বা খেলায় পুরোটা সময় বলের দিকে নজর রাখাটা যে কী প্রচণ্ড অধ্যবসায়ের ব্যাপার, সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
এখন এই কঠিন কাজের জন্য উইকেটরক্ষণে পারদর্শী একজনকে না হয় দলে নিলেন, কিন্তু খেলার মাঠে কোনো কারণে যদি সে আহত হয়ে যায়, তখন কী হবে?
সাধারণত দলের কোনো খেলোয়াড় ইনজুরির কারণে ফিল্ডিং করতে না পারলে বদলি হিসেবে আরেকজনকে নামানো যায়, কিন্তু উইকেটরক্ষকদের জন্য এ নিয়ম প্রযোজ্য ছিল না! অর্থাৎ আপনার উইকেটরক্ষক ইনজুরড হলে আপনি তার বদলে আরেকজন খেলোয়াড়কে দিয়ে ফিল্ডিং করাতে পারবেন, কিন্তু উইকেটরক্ষক হিসেবে আপনার একাদশে থাকা কাউকেই দায়িত্ব পালন করতে হবে। ঠেকায় পড়ে উইকেটকিপিং গ্লাভস হাতে নেয়া এ মানুষগুলোকে বলা হয় ‘স্ট্যান্ড-ইন উইকেটরক্ষক’। এই আইনের কারণে উইকেটের পেছনে গ্লাভস হাতে এমন অনেক মানুষকেই দেখা গেছে, যাদের নাম কোনোভাবেই উইকেটরক্ষক সত্তার সাথে যায় না। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়, চলুন দেখে নেয়া যাক টেস্টে বাংলাদেশের এমনই কিছু স্ট্যান্ড-ইন উইকেটরক্ষকের গল্প।
শাহরিয়ার হোসেন বিদ্যুৎ
নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশের অন্যতম সম্ভাবনাময় ব্যাটসম্যান ছিলেন শাহরিয়ার হোসেন বিদ্যুৎ। স্টাইলিশ এ ব্যাটসম্যান অবশ্য তার প্রতিভার প্রতি সুবিচার করতে পারেননি, পুরো ক্যারিয়ারে সব মিলিয়ে খেলেছিলেন মাত্র তিনটি ম্যাচ, ছিলেন বাংলাদেশের অভিষেক টেস্টেও।
ভারতের বিপক্ষে সেই ঐতিহাসিক টেস্টেই স্ট্যান্ড-ইন উইকেটরক্ষকের দেখা পেয়েছিল বাংলাদেশ! নিয়মিত উইকেটরক্ষক খালেদ মাসুদ পাইলট হাঁটুতে আঘাত পাওয়ায় ভারতের ইনিংসে ৩৫-৮৫ ওভার পর্যন্ত উইকেটরক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন বিদ্যুৎ। প্রক্সি দিতে এসে অবশ্য একটা ডিসমিসালও করেন তিনি, অধিনায়ক নাইমুর রহমানের বলে সাবা করিমকে স্ট্যাম্পড করে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিজের একমাত্র ডিসমিসালের দেখা পান বিদ্যুৎ।
রাজিন সালেহ
ছয় বছর পর আবারও স্ট্যান্ড-ইন কিপারের দেখা পায় বাংলাদেশ, এবারও প্রতিপক্ষ ভারত। ২০০৭ সালে ভারত-বাংলাদেশের সেই ঢাকা টেস্টে ভারতের টপ অর্ডারের প্রথম চার ব্যাটসম্যানই সেঞ্চুরির মাইলফলক স্পর্শ করেছিল। বিপক্ষ দলের এমন রানোৎসবের সাথে মরার ওপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে যোগ হয়েছিল ইনজুরির হানা। ভারতের ইনিংসের মাঝপথে ইনজুরড হন সে টেস্টের উইকেটরক্ষক খালেদ মাসুদ। তাই গ্লাভস হাতে উইকেটের পেছনে দাঁড়াতে হয়েছিল রাজিন সালেহকে, সৌরভ গাঙ্গুলির ক্যাচ লুফে নিয়ে নামের পাশে একটি ডিসমিসালও যোগ করেন তিনি।
সাকিব আল হাসান
ক্রিকেটে যে ক’জন পরিপূর্ণ অলরাউন্ডার এসেছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম সাকিব আল হাসান। ব্যাটিং, বোলিং, ফিল্ডিং – তিন বিভাগেই সমান পারদর্শী ক্রিকেটার ক্রিকেট ইতিহাসে খুব বেশি পাওয়া যায় না। নিন্দুকেরা অবশ্য মজা করে বলতে পারেন, সাকিব যখন সবকিছুই পারে, তো পারলে তাকে উইকেটকিপিং করতে বলো! মজার ব্যাপার হচ্ছে, বিশ্বসেরা এই অলরাউন্ডারকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে গ্লাভস হাতেও দেখা গেছে। অবশ্য সে স্মৃতিটা নেহায়েতই পানসে, তেমন কোনো ঘটনা-দুর্ঘটনা কিছুই যে ঘটেনি!
২০০৭ সালে ভারতের বিপক্ষে ওই টেস্টে ভারতের ইনিংসের একদম শেষদিকে রাজিন সালেহর বদলে গ্লাভস হাতে তুলে নেন সাকিব আল হাসান। অবশ্য খুব বেশি সময় সাকিবকে গ্লাভস পরে উইকেটের পেছনে থাকতে হয়নি। ২ ওভার পরই ভারতের ইনিংস ঘোষণা দিয়ে দেন তৎকালীন অধিনায়ক রাহুল দ্রাবিড়। এই স্বল্প সময়ে গ্লাভস হাতে কোনো ডিসমিসালের সাক্ষীও হতে পারেননি সাকিব।
শামসুর রহমান শুভ
২০১৪ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে চট্টগ্রাম টেস্টের দ্বিতীয় দিনে ইনজুরিতে পড়েন নিয়মিত উইকেটরক্ষক মুশফিকুর রহিম। ফলে উইকেটরক্ষকের দায়িত্ব সামলানোর ভারটা গিয়ে পড়ে শামসুর রহমান শুভর ঘাড়ে। গ্লাভস হাতে কোনো ডিসমিসাল করতে না পারলেও সেই টেস্ট স্মরণীয় হয়ে থাকবে শুভর জন্য। প্রথম ইনিংসে ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরির দেখা পেয়েছিলেন তিনি, এখন পর্যন্ত যা তার একমাত্র আন্তর্জাতিক সেঞ্চুরি।
ইমরুল কায়েস
সাল ২০১৫। ওয়ানডেতে পাকিস্তানকে হোয়াইটওয়াশ করার পর টেস্টে তাদের বিপক্ষে বেশ আত্মবিশ্বাস নিয়েই মাঠে নেমেছিল বাংলাদেশ। খুলনার ব্যাটিং স্বর্গে আগে ব্যাট করতে নামলেও ৩৩২-এর বেশি করতে পারেনি স্বাগতিকরা। জবাব দিতে নেমে বেশ দাপুটে সূচনা পায় পাকিস্তান। এদিকে বিকেলে নিয়মিত উইকেটরক্ষক মুশফিকুর রহিম ইনজুরিতে পড়ায় বাংলাদেশের বিপদ আরো ঘনীভূত হয়।
অগত্যা গ্লাভসজোড়া হাতে তুলে নিতে হয় ইমরুল কায়েসকে। বলাই বাহুল্য, এর আগে কোনোদিন উইকেটরক্ষকের ভূমিকায় উইকেটের পিছনে দাঁড়াতে হয়নি তাঁকে। নিজের সামর্থ্যের চূড়ান্ত পরীক্ষা দিয়ে উইকেটরক্ষক ভূমিকায় প্রথম ম্যাচেই টানা ১২০ ওভার উইকেটকিপিং করেন চতুর্থ দিন প্রথম সেশন পর্যন্ত। এত দীর্ঘ সময় কিপার হিসেবে থাকলেও সে ম্যাচে কোনো ডিসমিসাল করতে পারেননি তিনি।
বিস্ময়ের শেষটা সেখানেই নয়। তামিম ইকবালের সঙ্গে জুটি বেঁধে ব্যাটিংয়ে যখন নামছেন, ইনিংস পরাজয় তখন চোখ রাঙাচ্ছে। এরপর বাকিটা ইতিহাস; ১২০ ওভার উইকেটকিপিংয়ের পর ওপেনিংয়ে নেমে খেলে ফেললেন ২৪০ বলে ১৫০ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংস। তার এবং তামিমের অনবদ্য সেই ওপেনিং জুটির বদৌলতেই ইনিংস পরাজয়ের দোরগোড়ায় থাকা ম্যাচটি ড্র করে মাঠ ছাড়ে বাংলাদেশ।
এরপর তাকে আবারও স্ট্যান্ড-ইন উইকেটরক্ষক হিসেবে দাঁড়াতে হয় ২০১৭ সালে নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়েলিংটন টেস্টে। দ্বিতীয়বার দায়িত্ব পেয়ে এবার দারুণ খেল দেখান তিনি, উইকেটের পেছনে এবার মোট পাঁচটি ক্যাচ ধরে প্রক্সি উইকেটকিপারদের মধ্যে এক ইনিংসে সবচেয়ে বেশি ডিসমিসালের রেকর্ড গড়ে ফেলেন ইমরুল কায়েস!
মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ
২০১৫ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে সেই টেস্টে ইমরুল কায়েস ওপেনিং করবেন বলে কিছুক্ষণের জন্য গ্লাভস মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের হাতে দিয়ে মাঠ ছেড়ে যান। ফলে একই ম্যাচে দ্বিতীয় স্ট্যান্ড-ইন উইকেটকিপার হিসেবে গ্লাভসজোড়া হাতে নেন মাহমুদউল্লাহ।
অবশ্য মাত্র দশ ওভারের জন্য উইকেটকিপারের দায়িত্ব নিয়েই পৃথিবীর সবচেয়ে অদ্ভুতুড়ে স্ট্যাম্পিংয়ের মালিক হয়ে যান মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ। জুলফিকার বাবরকে সেই অদ্ভুত স্ট্যাম্পিংয়ের মাধ্যমে ফেরান তিনি, ফলে নিউজিল্যান্ডের অলরাউন্ডার জন রিডের পর মাত্র দ্বিতীয় খেলোয়াড় হিসেবে টেস্ট ক্রিকেটে সেঞ্চুরি, পাঁচ উইকেট ও স্ট্যাম্পিং – এই তিনটিই করার অনন্য রেকর্ড গড়ে ফেলেন রিয়াদ।
সাব্বির রহমান
কায়েসের রেকর্ড গড়া সেই ওয়েলিংটন টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে এবার প্রক্সি উইকেটরক্ষক হিসেবে গ্লাভস হাতে নামেন সাব্বির রহমান। আসলে কায়েসের ইনজুরির কারণে তাকে নিয়ে আর বাড়তি কোনো ঝুঁকি নিতে চাচ্ছিল না ম্যানেজমেন্ট, যে কারণে উইকেটরক্ষকের দায়িত্বটা সাব্বিরের ঘাড়েই পড়ে। প্রায় ৪০ ওভার উইকেটকিপিং করলেও কোনো ডিসমিসাল অবশ্য তার নামের পাশে যোগ হয়নি।
এছাড়া ২০০১ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে হারারে টেস্টে নিয়মিত উইকেটরক্ষক না হলেও একাদশে উইকেটরক্ষক হিসেবে খেলেছিলেন মেহরাব হোসেন অপি। সে ম্যাচে গ্লাভস হাতে একটি ক্যাচও নিয়েছিলেন তিনি। তবে যেহেতু তিনি একাদশে উইকেটরক্ষক হিসেবেই খেলেছিলেন, তাই তাকে আমাদের এই তালিকার বাইরেই রাখা হলো।
অবশ্য ২০১৭ সালের অক্টোবরে উইকেটরক্ষক নিয়ে এ কড়াকড়ি কিছুটা শিথিল করা হয়। নতুন নিয়ম ২৪.১.২ অনুযায়ী উইকেটরক্ষক ইনজুরড হলে আম্পায়ারের অনুমতি সাপেক্ষে বদলি খেলোয়াড়কে উইকেটরক্ষকের দায়িত্ব দেওয়া যাবে। যে কারণে এখন প্রায় প্রতিটি দলই তাদের ১৫ সদস্যের স্কোয়াডে একজন বাড়তি উইকেটরক্ষক দলে রাখে। ফলে, ক্রিকেটে স্ট্যান্ড-ইন উইকেটরক্ষক দেখা সুযোগ এখন আর নেই বললেই চলে।