একটা বিশ্বকাপ সফল হওয়ার ক্ষেত্রে সেই বিশ্বকাপের স্বাগতিক দলের অনেক বড় একটা ভূমিকা থাকে। বিশ্বকাপকে বলা হয় দ্য গ্রেটেস্ট শো অফ আর্থ, এই মহাযজ্ঞ সফলভাবে আয়োজন করতে দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা ও কঠোর পরিশ্রমের প্রয়োজন হয়। বিশ্বকাপ আয়োজন করার মতো আর্থিক ও অবকাঠামোগত ক্ষমতা আছে এমন সব দেশই বিশ্বকাপের আয়োজক হওয়ার স্বপ্ন দেখে। তাই প্রতিবারই স্বাগতিক দল নির্বাচনের ক্ষেত্রে ফিফাকে বেশ বেগ পেতে হয়। আজ আমরা প্রতিটি বিশ্বকাপের স্বাগতিক দলগুলোকে নিয়েই জানবো। তারা কিভাবে আয়োজক হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছিলো, তাদের বিশ্বকাপ আয়োজনের বিভিন্ন দিক সাথে সেই বিশ্বকাপে তাদের পারফর্মেন্স নিয়েও আলোচনা করবো।
১৯৩০ বিশ্বকাপ: ঘরের বিশ্বকাপ ঘরেই রেখে দিলো উরুগুয়ে
১৯৩০ বিশ্বকাপের আয়োজক হওয়ার জন্য মোট ছয়টি দেশ আবেদন করলেও বাকি পাঁচ দেশ আয়োজক হওয়ার দৌড় থেকে নিজেদের সরিয়ে নিলে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ইতিহাসের প্রথম বিশ্বকাপের আয়োজক নির্বাচিত হয় উরুগুয়ে। সেসময়ের যোগাযোগ ব্যবস্থা এ যুগের মতো এতটা উন্নত ছিল না। একদেশ থেকে আরেক দেশে যাওয়ার ক্ষেত্রে জাহাজই ছিল মূল ভরসা। এ কারণে বাছাইপর্ব না থাকা সত্ত্বেও ইউরোপের দেশগুলো উরুগুয়েতে বিশ্বকাপ খেলতে আসার ব্যাপারে ঠিক আগ্রহ দেখাচ্ছিলো না। শেষপর্যন্ত তৎকালীন ফিফা প্রেসিডেন্ট জুলে রিমের উদ্যোগে ইউরোপের চারটি দেশ উরুগুয়েতে খেলতে আসতে রাজি হয়। মোট ১৩টি দেশ সেই বিশ্বকাপে অংশ নিয়েছিলো।
মাত্র তিনটি স্টেডিয়ামে প্রথম বিশ্বকাপের সবগুলো ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়েছিলো। আরো অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে তিনটি স্টেডিয়ামই উরুগুয়ের মন্টিভিডিওতে অবস্থিত ছিল অর্থাৎ বলা যায় উরুগুয়ের এক শহরেই পুরো বিশ্বকাপটি আয়োজিত হয়েছিলো! বোঝাই যাচ্ছে, বর্তমানে প্রতিটি বিশ্বকাপে যেমন জাঁকজমক দেখা যায়, প্রথম বিশ্বকাপে এমন কিছুই ছিল না। তবে মাঠের বাইরে পারফর্মেন্স যা-ই হোক, সেবার ফুটবলে মাঠে সবাইকে ছাড়িয়েই গিয়েছিলো স্বাগতিক উরুগুয়ে। মন্টিভিডিওর এস্তাদিও সেন্টানারিও স্টেডিয়ামে আর্জেন্টিনাকে ৪-২ গোলে হারিয়ে প্রথম আসরের চ্যাম্পিয়ন হয় তারা। আর পুরো টুর্নামেন্টে উরুগুয়ের রক্ষণভাগে দৃঢ়ভাবে সামলানোর পুরস্কার হিসেবে সেরা খেলোয়াড় হন উরুগুয়ের অধিনায়ক নাসাজ্জি।
১৯৩৪ বিশ্বকাপ: আবারো চ্যাম্পিয়ন স্বাগতিক দল
১৯৩৪ বিশ্বকাপের আয়োজক হওয়ার জন্য প্রথমে সুইডেন আর ইতালি আবেদন করলেও পরে সুইডেন নাম প্রত্যাহার করে নেয়। ফলে ১৯৩২ সালে ফিফা ১৯৩৪ বিশ্বকাপের আয়োজক হিসেবে ইতালির নাম ঘোষণা করে। এর আগের আসরে বাছাইপর্ব না থাকলেও এই আসর থেকে বাছাইপর্বের প্রচলন শুরু হয়। তবে ফিফার ইচ্ছাতে তখন বেশ কিছু দেশ বাছাইপর্ব না খেলে সরাসরি বিশ্বকাপে অংশ নিতে পারতো। দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে প্রথম আসরের চ্যাম্পিয়ন উরুগুয়ে এই আসর বয়কট করে। কারণ হিসেবে তারা জানায় তাদের মাঠে অনুষ্ঠেয় বিশ্বকাপে মাত্র চারটি ইউরোপের দেশ অংশ নেওয়ার প্রতিবাদ হিসেবে ইউরোপে অনুষ্ঠেয় এই বিশ্বকাপ তারা বয়কট করছে। সব মিলিয়ে মোট ১৬টি দেশ সেই আসরে অংশ নিয়েছিলো। মজার ব্যাপার হচ্ছে স্বাগতিক হওয়া সত্ত্বেও সেবার ইতালিকে বাছাইপর্ব খেলে বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করতে হয়েছিলো!
প্রথম আসরের তুলনায় দ্বিতীয় আসরের পরিসর বেশ বড় ছিল। ইতালির তৎকালীন স্বৈরশাসক বেনিতো মুসোলিনি বিশ্বকাপ আয়োজনে সাফল্য এনে সেটাকে রাজনীতিতে ব্যবহার করার পরিকল্পনা করেছিলেন। সব মিলিয়ে আটটি শহরের আটটি স্টেডিয়ামে দ্বিতীয় বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয়েছিলো। সেই বিশ্বকাপে আয়োজক হিসেবে সফল হওয়ার সাথে মাঠের পারফর্মেন্সেও সফল ছিল ইতালি। চেকস্লোভাকিয়াকে ২-১ গোলে হারিয়ে ট্রফিটা নিজেদের ঘরেই রেখে দেয় তারা। সেই আসরের সেরা খেলোয়াড় হয়েছিলেন স্বাগতিক দলের ফরোয়ার্ড মেয়াজ্জা। তবে স্বৈরশাসক মুসোলিনির অযাচিত হস্তক্ষেপ সেই আসরকে কিছুটা হলেও ম্লান করেছিলো।
১৯৩৮ বিশ্বকাপ: যুদ্ধের দামামার সাথে লাতিনদের বয়কট
১৯৩৮ বিশ্বকাপের আয়োজক হওয়ার জন্য তিনটি দেশ আবেদন করে। এবার আর কেউই নিজেদের নাম প্রত্যাহার করেনি। ফলে ফিফার কংগ্রেসে ভোটাভুটি করেই সেবার আয়োজক ঠিক করতে হয়েছিলো। শেষপর্যন্ত ভোটে জয়ী হয়ে ১৯৩৮ বিশ্বকাপের আয়োজক হওয়ার দায়িত্ব পায় ফ্রান্স। কিন্তু টানা দুবার ইউরোপে বিশ্বকাপ আয়োজিত হওয়ার প্রতিবাদে ব্রাজিল ছাড়া দক্ষিণ আমেরিকার আর কোনো দেশ সেবার বিশ্বকাপে অংশ নেয়নি। এদিকে গৃহযুদ্ধের কারণে স্পেনও অংশ নেয়নি, ওদিকে অস্ট্রিয়ায় জার্মান সেনাদের আগ্রাসনের কারণে অস্ট্রিয়া শেষমুহূর্তে নাম প্রত্যাহার করে নেয়। তাছাড়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার দামামা তখন প্রায় বেজে গিয়েছিলো।
তাই সব মিলিয়ে সেই বিশ্বকাপের অবস্থা বেশ টালমাটালই ছিল। মোট ১৫টি দল সেই আসরে অংশ নেয়। দশটি শহরের এগারটি স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হয় ১৯৩৮ বিশ্বকাপ। আগের দুই আসরে মাঠের পারফর্মেন্সে স্বাগতিক দলের দাপট থাকলেও এই আসরে স্বাগতিক দল তেমন সুবিধা করতে পারেনি। ইতালির কাছে ৩-১ গোলে হেরে কোয়ার্টার ফাইনাল থেকেই বিদায় নিতে হয় স্বাগতিক ফ্রান্সকে। ফাইনালে হাঙ্গেরিকে ৪-২ গোলে হারিয়ে টানা দ্বিতীয়বারের মতো চ্যাম্পিয়ন হয় ইতালি।
১৯৫০ বিশ্বকাপ: স্বাগতিকদের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে ১৯৪২ ও ১৯৪৬ সালে বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হতে পারেনি। যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি অনেক দেশই কাটিয়ে উঠতে না পারায় ১৯৫০ বিশ্বকাপের আয়োজক হতে শুধুমাত্র ব্রাজিলই আগ্রহী হয়েছিলো। তাই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চতুর্থ বিশ্বকাপের আয়োজক হিসেবে নির্বাচিত হয় ব্রাজিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকার কারণে সেই আসরে পশ্চিম জার্মানি ও জাপানকে বাছাইপর্বে অংশ নেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়নি। এছাড়া ব্রাজিলের বোর্ডের সাথে খারাপ সম্পর্কের কারণে সেই আসর থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করেছিলো আরেক পরাশক্তি আর্জেন্টিনা। শেষপর্যন্ত ১৩টি দল সেই আসরে অংশ নিয়েছিলো। ছয়টি শহরের ছয়টি স্টেডিয়ামে সেই বিশ্বকাপের ম্যাচগুলো অনুষ্ঠিত হয়েছিলো।
সেবার ঘরের মাঠের বিশ্বকাপে নিজেদের সেরাটা দিয়ে প্রথমবারের মতো বিশ্বজয়ের স্বপ্ন দেখছিলো ব্রাজিল, আর সেই লক্ষ্যে বেশ ভালোভাবেই এগিয়ে যাচ্ছিলো সেলেসাওরা। সেই আসরে কোনো ফাইনাল ম্যাচ ছিল না, চার গ্রুপের চার শীর্ষ দলকে নিয়ে হয়েছিলো সুপার ফোর। সুপার ফোরে যাদের পয়েন্ট বেশি থাকবে তারাই হবে চ্যাম্পিয়ন। শেষ ম্যাচে মারাকানায় উরুগুয়ের বিপক্ষে ড্র করলেই শিরোপা জিততো ব্রাজিল।
সেই ম্যাচে ব্রাজিলের শুরুটাও বেশ ভালো ছিল, খেলার ৪৭ মিনিটে ফ্রিয়াসার গোলে ১-০ তে এগিয়েও গিয়েছিলো তারা। কিন্তু এরপরই সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেলো। শিয়াফিনো ও ঘিঘিয়ার গোলে ২-১ গোলে ম্যাচটি জিতে নেয় উরুগুয়ে! সেদিন প্রায় দুই লক্ষ দর্শক মাঠে এসেছিলো নিজ দেশকে প্রথমবারের মতো বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হিসেবে দেখতে। নিজ দেশে এমন হারে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে মারাকানার দুই লক্ষ দর্শক। বিশ্বকাপ ইতিহাসে স্বাগতিক দলের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি হিসেবে ১৯৫০ সালের মারাকানাজোর নামই সবার আগে আসবে।
১৯৫৪ বিশ্বকাপ: আয়োজক যখন সুইজারল্যান্ড
১৯৫৪ বিশ্বকাপের আয়োজক হওয়ার জন্য সুইজারল্যান্ড ছাড়া আর কেউ আবেদন করেনি। তাই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ১৯৫৪ বিশ্বকাপের আয়োজক নির্বাচিত হয় সুইজারল্যান্ড। পরাশক্তিদের মধ্যে শুধুমাত্র আর্জেন্টিনাই সেই আসর বয়কট করেছিলো। সেই আসরে মোট ১৬টি দল অংশ নিয়েছিলো। ছয়টি শহরের ছয়টি স্টেডিয়ামে সেবার বিশ্বকাপের ম্যাচগুলো অনুষ্ঠিত হয়েছিলো। খেলার মাঠে স্বাগতিক সুইজারল্যান্ড তেমন সুবিধা করতে পারেনি। অস্ট্রিয়ার সাথে চূড়ান্ত নাটকীয় এক ম্যাচে ৭-৫ গোলে হেরে কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে বিদায় নেয় সুইসরা। বার্নের ফাইনালে পশ্চিম জার্মানির কাছে হাঙ্গেরির অপ্রত্যাশিত হারের মাধ্যমে সেই আসরের পর্দা নামে।
১৯৫৮ বিশ্বকাপ: ১৭ বছরের এক বালকের কাছে স্বাগতিক সুইডেনের হার
১৯৫৮ বিশ্বকাপের আয়োজক হওয়ার জন্য সুইডেনের সাথে আর্জেন্টিনা, চিলি ও মেক্সিকোও আবেদন করেছিলো। কিন্তু শেষপর্যন্ত আয়োজক হওয়ার জন্য আনুষ্ঠানিক আবেদন একমাত্র সুইডেনই করেছিলো। এই আসর থেকে বিভিন্ন পরাশক্তির বিশ্বকাপ বয়কট করাটা মোটামুটি বন্ধ হয়ে যায়। আগের আসরের মতো এই আসরেও ১৬টি দল অংশ নিয়েছিলো। সুইডেনের বারোটি শহরের বারোটি স্টেডিয়ামে সেই আসরের ম্যাচগুলো অনুষ্ঠিত হয়েছিলো। ১৯৫৮ বিশ্বকাপে মোট ৩৫টি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়েছিলো, যা তখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ।
সেই আসরে স্বাগতিক সুইডেনের পারফর্মেন্স বেশ নজরকাড়া ছিল। সেমিফাইনালে আগের আসরের চ্যাম্পিয়ন পশ্চিম জার্মানিকে ৩-১ গোলে হারিয়ে ফাইনালে উঠে যায় সুইডিশরা। ফাইনালে সুইডেনের প্রতিপক্ষ ছিল ব্রাজিল। আট বছর আগে মারাকানায় ফাইনাল হারার ক্ষত তখনো পুরোপুরি শুকোয়নি। ব্রাজিলের সেই ক্ষতে নতুন করে আঘাত দেওয়ার জন্যে পুরোপুরি প্রস্তুত ছিল স্বাগতিক সুইডেন। ফাইনালে শুরুটাও চমৎকার করেছিলো তারা। ম্যাচের চার মিনিটে লিয়েডহোলমের গোলে এগিয়েও গিয়েছিলো তারা। কিন্তু এরপর ১৭ বছর বয়সী পেলের দুরন্ত পারফর্মেন্সে খেই হারিয়ে ফেললো সুইডেন। শেষপর্যন্ত পেলের জোড়া গোল ও এক অ্যাসিস্টে ৫-২ গোলে ব্রাজিলের কাছে হেরে শিরোপা স্বপ্ন বিসর্জন দিতে হয় সুইডেনকে।
১৯৬২ বিশ্বকাপ: চিলির দৃঢ় মনোবলের কাছে হার মানলো ভূমিকম্প
১৯৬২ বিশ্বকাপের আয়োজক হওয়ার ব্যাপারে আগ্রহী ছিল তিনটি দেশ- তৎকালীন পশ্চিম জার্মানি, চিলি ও আর্জেন্টিনা। কিন্তু আয়োজক নির্বাচনের ভোটাভুটির আগেই পশ্চিম জার্মানিকে সরে যেতে হয়, কারণ ১৯৫৪ ও ১৯৫৮ বিশ্বকাপ ইউরোপে হয়েছিলো। তাই কনমেবল চাইছিলো সেবারের বিশ্বকাপ যেন লাতিন আমেরিকাতেই হয়। লাতিনে না হলে বিশ্বকাপ বর্জনের হুমকিও দিয়ে রেখেছিলো কনমেবল। তাই ফিফার অনুরোধে পশ্চিম জার্মানি আয়োজক হওয়ার দৌড় থেকে নিজেদের সরিয়ে নেয়। এরপর আয়োজক হওয়ার দৌড়ে আর্জেন্টিনাই ছিল এগিয়ে। কিন্তু চিলিয়ান ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি কার্লোস ডিটবর্নের বুদ্ধিমত্তার কাছে হার মানতে হয় আর্জেন্টিনাকে। তবে এত লড়াই করে আয়োজক হওয়ার পরেও চিলির লড়াই শেষ হয়নি। চিলির বিশ্বকাপ আয়োজক হওয়ার স্বপ্নে বড় ধাক্কা লাগে ১৯৬০ সালের প্রলয়ঙ্করী ভালদিভিয়া ভূমিকম্প। সেই ভূমিকম্পে তাদের স্টেডিয়ামগুলোতে ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়।
সবাই ধরেই নিয়েছিলো যে, চিলিতে বিশ্বকাপ আয়োজন করা আর সম্ভব না। কিন্তু এক্ষেত্রেও চিলির ত্রাণকর্তা হয়ে হাজির হন কার্লোস ডিটবর্ন। তার নেতৃত্বে চিলি ওই ভয়াবহ ভূমিকম্পের ক্ষতি কাটিয়ে উঠে বিশ্বকাপ আয়োজনের জন্য সমস্ত প্রস্তুতি সম্পন্ন করে। সেসময়ে তার একটি বক্তব্য বিশ্বকাপের আনঅফিসিয়াল স্লোগানে পরিণত হয়। সেটি ছিল, “Because we have nothing, we will do everything” । কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, যে মানুষটি বিশ্বকাপ আয়োজনের জন্য এতকিছু করলেন, তিনিই সেই বিশ্বকাপ দেখে যেতে পারেননি। বিশ্বকাপ শুরু হওয়ার মাত্র ১ মাস ২ দিন আগে পরপারে পাড়ি জমান কার্লোস। তার স্মৃতির প্রতি সম্মান জানিয়ে বিশ্বকাপের একটি স্টেডিয়ামের নামকরণ করা হয় তার নামে। ভূমিকম্পের কারণে মাত্র চারটি স্টেডিয়ামেই বিশ্বকাপের সবগুলো ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। আগের দুই আসরের মতো এই আসরেও অংশগ্রহণকারী দলের সংখ্যা ছিল ১৬টি।
মাঠের বাইরে ভূমিকম্পকে জয় করা চিলির সেই আসরের মাঠের পারফর্মেন্সও ছিল দুর্দান্ত। ঘরের মাঠে অনুষ্ঠেয় বিশ্বকাপে তৃতীয় স্থান অর্জন করে চিলি, যা এখন পর্যন্ত তাদের বিশ্বকাপ ইতিহাসের সর্বোচ্চ অর্জন। তবে এই অর্জনের গায়ে কলঙ্কের দাগ লাগে ব্যাটল অফ সান্তিয়াগোর কারণে। গ্রুপপর্বে অনুষ্ঠেয় এই ম্যাচটিকে অনেকেই বিশ্বকাপের ইতিহাসে নিকৃষ্টতম ম্যাচ হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
ম্যাচটিতে দু’দলের খেলোয়াড়েরা একে অপরের প্রতি ভীষণ আক্রমণাত্মক মনোভাব প্রদর্শন করেন। ম্যাচে চিলিয়ান ফরোয়ার্ড লিওনেল সানচেজ ইতালিয়ান ফরোয়ার্ড হামবার্তো মাসচিওর নাক রেফারির অগোচরে ভেঙ্গে দেন। এর কিছুক্ষণ পর ইতালির মারিও ডেভিড চিলির সানচেজের মাথা লক্ষ্য করে হাই কিক দেন! ম্যাচে ইতালির দুজন খেলোয়াড় লাল কার্ড দেখে মাঠ ছাড়েন, যদিও রেফারি সতর্ক থাকলে এই লাল কার্ডের সংখ্যা দু’দলের শিবিরেই বাড়তো। ২-০ তে ম্যাচটি জিতে নেয় চিলি, কিন্তু খেলা শেষেও অবস্থা এতটাই বেগতিক থাকে যে দুই দলকেই পুলিশি পাহাড়ায় বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়। ব্রাজিলের টানা দ্বিতীয় বিশ্বজয়ের মাধ্যমে ১৯৬২ বিশ্বকাপের সমাপ্তি ঘটে।
১৯৬৬ বিশ্বকাপ: ঘরের মাঠে ইংলিশদের প্রথম বিশ্বজয়
ফুটবলের প্রসারে ইংলিশদের বড় ভূমিকা থাকা সত্ত্বেও বিশ্বকাপ আয়োজন করতে ইংলিশদের ৩৬ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিলো। সেবার আয়োজক হওয়ার জন্য পশ্চিম জার্মানির সাথে ইংল্যান্ডকে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হয়েছিলো। শেষপর্যন্ত ফিফা কংগ্রেসের ভোটে জয়ী হয়ে বিশ্বকাপের আয়োজক হয় ইংল্যান্ড। আগের তিন আসরের ধারাবাহিকতায় এই আসরেও ১৬টি দেশ অংশ নিয়েছিলো। সাত শহরের আটটি স্টেডিয়ামে বিশ্বকাপের ম্যাচগুলো অনুষ্ঠিত হয়েছিলো।
ঘরের মাঠে বিশ্বজয়ের অভিযানেও বেশ ভালোভাবে এগিয়ে যাচ্ছিলো ইংল্যান্ড। কোয়ার্টার ফাইনালে আর্জেন্টিনা ও সেমিফাইনালে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নকে হারিয়ে ফাইনালে চলে যায় ইংলিশরা। ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠেয় সেই ফাইনালে ইংল্যান্ডের প্রতিপক্ষ ছিল পশ্চিম জার্মানি। ফাইনালে দুই দলই তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তোলে, নির্ধারিত সময়ে স্কোরলাইন ২-২ থাকায় খেলা গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে। সেখানে ১০১ মিনিটে জিওফ হার্স্টের গোলে ৩-২ ব্যবধানে এগিয়ে যায় ইংল্যান্ড। কিন্তু এই গোলটি নিয়ে বিতর্কের ঝড় উঠে যায়, কারণ ওই গোলের সময়ে বল পুরোপুরি গোললাইন পার না করা সত্ত্বেও রেফারি গোলের বাঁশি বাজিয়ে দেন। শেষপর্যন্ত হার্স্টের অসাধারণ এক হ্যাটট্রিকে পশ্চিম জার্মানিকে ৪-২ গোলে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় ইংল্যান্ড। আর সেই আসরের সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হন ইংলিশ ফরোয়ার্ড স্যার ববি চার্লটন।
১৯৭০ বিশ্বকাপ: উত্তর আমেরিকায় আয়োজিত প্রথম বিশ্বকাপ
প্রথম আটটি আসরের সবগুলোই ইউরোপ অথবা দক্ষিণ আমেরিকায় অনুষ্ঠিত হয়েছিলো। সেই ধারা ভাঙ্গে ১৯৭০ বিশ্বকাপে। সেই বিশ্বকাপ আয়োজনে মোট সাতটি দেশ প্রথমে আগ্রহ দেখালেও শেষপর্যন্ত অফিসিয়ালি বিড করে আর্জেন্টিনা ও মেক্সিকো। ১৯৬৪ সালে টোকিওতে অনুষ্ঠেয় ফিফার কংগ্রেসে ভোটাভুটিতে আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে উত্তর আমেরিকার প্রথম দেশ হিসেবে বিশ্বকাপের আয়োজক হয় মেক্সিকো। সেই আসরেও মোট ১৬টি দেশ অংশ নেয়। মেক্সিকোর পাঁচটি শহরের ছয়টি স্টেডিয়ামে সেই আসরের ম্যাচগুলো অনুষ্ঠিত হয়। তবে মাঠের পারফর্মেন্সে স্বাগতিক মেক্সিকো তেমন সুবিধা করতে পারেনি। ইতালির কাছে ৪-১ গোলে হেরে কোয়ার্টার ফাইনাল থেকেই বিদায় নেয় তারা। প্রথম দল হিসেবে ব্রাজিলের তৃতীয়বারের মতো বিশ্বজয়ের মাধ্যমে সেই আসরের সমাপ্তি ঘটে।
১৯৭৪ বিশ্বকাপ: টোটাল ফুটবলকে থমকে দিলো স্বাগতিক পশ্চিম জার্মানি
১৯৬৬ সালের ৬ জুলাই অনুষ্ঠেয় ফিফা কংগ্রেসে ১৯৭৪, ১৯৭৮ ও ১৯৮২ বিশ্বকাপের আয়োজক নির্ধারিত হয়। ১৯৭৪ বিশ্বকাপের আয়োজক হতে প্রথমে চারটি দেশ আগ্রহ দেখালেও শেষপর্যন্ত রেসে টিকে ছিল পশ্চিম জার্মানি ও স্পেন। তবে সমঝোতার মাধ্যমে স্পেন ১৯৭৪ বিশ্বকাপের আয়োজক হওয়ার দৌড় থেকে নিজেদের সরিয়ে নেয়। ফলে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের আয়োজক হয় পশ্চিম জার্মানি। এই আসরে ১৬টি দেশ অংশ নিলেও বিশ্বকাপ ফরম্যাটে কিছুটা পরিবর্তন আনা হয়।
গ্রুপপর্ব থেকে উন্নীত আটটি দলকে নিয়ে সেবার কোয়ার্টার ফাইনাল অনুষ্ঠিত হয়নি। আট দলকে দুই গ্রুপে ভাগ করে অনুষ্ঠিত হয়েছিলো দ্বিতীয় রাউন্ড। ফরম্যাটের এই পরিবর্তন আনার ফলে বিশ্বকাপের ম্যাচের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৮ এ। নয়টি শহরের নয়টি স্টেডিয়ামে এই ৩৮টি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়েছিলো। স্বাগতিক পশ্চিম জার্মানি গ্রুপপর্বে রানার্স আপ হলেও দ্বিতীয় রাউন্ডে জ্বলে ওঠে। পোল্যান্ড, সুইডেন ও তৎকালীন যুগোস্লাভিয়াকে হারিয়ে ফাইনালে চলে যায় পশ্চিম জার্মানি। মিউনিখের ফাইনালে ইয়োহান ক্রুইফের নেদারল্যান্ডসের মুখোমুখি হয় স্বাগতিক পশ্চিম জার্মানি। টোটাল ফুটবল দিয়ে সেই আসরে মুগ্ধতা ছড়ানো ক্রুইফের দল খেলা শুরুর দুই মিনিটের মধ্যেই এগিয়ে যায়। কিন্তু তাতে স্বাগতিকরা ঘাবড়ে যায়নি। শেষপর্যন্ত ব্রিটনার ও জার্ড মুলারের গোলে ডাচদের ২-১ গোলে হারিয়ে নিজেদের ঘরেই সেই আসরের শিরোপা রেখে দেয় পশ্চিম জার্মানি।
১৯৭৮ বিশ্বকাপ: অবশেষে বিশ্বকাপের আয়োজক আর্জেন্টিনা
বহু আগে থেকেই আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ আয়োজক হওয়ার চেষ্টা করছিলো, কিন্তু কিছুতেই সফল হচ্ছিলো না। অবশেষে আর্জেন্টিনার সেই স্বপ্ন পূরণ হয় ১৯৭৮ সালে। এই আসরে আয়োজক হওয়ার দৌড়ে আর্জেন্টিনার সাথে কলম্বিয়া ও মেক্সিকোও ছিল, কিন্তু পরের দুই দলই রেস থেকে নিজেদের সরিয়ে নেয়। আগের আসরের মতো এই আসরেও অংশগ্রহণকারী দলসংখ্যা ছিল ১৬টি, ফরম্যাটও ছিল একই রকম। পাঁচটি শহরের ছয়টি স্টেডিয়ামে সেই আসরের ৩৮টি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়েছিলো। তবে বিশ্বকাপ আয়োজনে আর্জেন্টিনার স্বৈরশাসক হুয়ান পেরনের সামরিক সরকারের হস্তক্ষেপ বিশ্বকাপ আয়োজনে বিতর্কের জন্ম দেয়।
মাঠের বাইরে যতই বিতর্ক থাকুক, স্বাগতিকদের মাঠের পারফর্মেন্স কিন্তু বেশ ভালো ছিল। নিজেদের গ্রুপে রানার্স আপ হয়ে দ্বিতীয় রাউন্ডে গেলেও সেখানে ব্রাজিল, পোল্যান্ড ও পেরুকে টপকে ফাইনালে চলে যায় স্বাগতিক আর্জেন্টিনা। ফাইনালে মারিও কেম্পেসের জোড়া গোলে নেদারল্যান্ডসকে ৩-১ গোলে হারিয়ে প্রথমবারের মতো বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয় আর্জেন্টিনা। টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ গোলদাতা ও সেরা খেলোয়াড়- দুটি পুরস্কারই জিতে নেন কেম্পেস।
১৯৮২ বিশ্বকাপ: স্পেনের মাটিতে প্রথম বিশ্বকাপ
স্পেন প্রথমে ১৯৭৪ বিশ্বকাপের ব্যাপারে আগ্রহ দেখালেও পরবর্তীতে একটি সমঝোতার মাধ্যমে ১৯৭৪ বিশ্বকাপের আয়োজক হওয়ার দৌড় থেকে নিজেদের সরিয়ে নেয় তারা। বিনিময়ে পশ্চিম জার্মানিও ১৯৮২ বিশ্বকাপের আয়োজক হওয়ার জন্য বিড করেনি। ফলে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ১৯৮২ বিশ্বকাপের আয়োজক হয় স্পেন। এই আসরে দলসংখ্যা ১৬ থেকে বাড়িয়ে ২৪ এ উন্নীত করে ফিফা। ফলে ম্যাচের সংখ্যাও বেড়ে দাঁড়ায় ৫২-তে। স্টেডিয়াম সংখ্যার দিক থেকে আগের সব আসরকে ছাড়িয়ে যায় এই আসর। ১৪টি শহরের ১৭টি স্টেডিয়ামে এই আসরের ম্যাচগুলো অনুষ্ঠিত হয়! আয়োজনের দিক থেকে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিলেও মাঠের পারফর্মেন্সে সবাইকে হতাশ করে স্পেন। দ্বিতীয় রাউন্ড থেকেই বিদায় নেয় স্বাগতিক দলটি। আর মাদ্রিদের সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে পাওলো রসির ইতালির তৃতীয়বারের মতো বিশ্বজয়ের মাধ্যমে সেই আসরের সমাপ্তি ঘটে।
১৯৮৬ বিশ্বকাপ: প্রথম দেশ হিসেবে দ্বিতীয়বারের মতো স্বাগতিক মেক্সিকো
১৯৮৬ বিশ্বকাপের আয়োজক হিসেবে ১৯৭৪ সালে ফিফা কলম্বিয়ার নাম ঘোষণা করেছিলো। কিন্তু ১৯৮২ সালে আর্থিক সমস্যার কারণ দেখিয়ে বিশ্বকাপের আয়োজক হিসেবে নিজেদের নাম প্রত্যাহার করে নেয় কলম্বিয়া। এদিকে ১৯৮২ বিশ্বকাপের আসর স্পেনে হওয়ায় ১৯৮৬ বিশ্বকাপের আসর ইউরোপের কোনো দেশে হতে পারতো না। কারণ আয়োজক দেশ নিয়ে যাতে আর ঝামেলা না হয় সেজন্য একই মহাদেশে টানা দুই বিশ্বকাপ আয়োজনে বিধিনিষেধ জারি করেছিলো ফিফা। শেষপর্যন্ত ১৯৮৬ বিশ্বকাপের আয়োজক হিসেবে ফিফা মেক্সিকোর নাম ঘোষণা করে। ফলে ইতিহাসের প্রথম দেশ হিসেবে দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বকাপ আয়োজন করার গৌরব অর্জন করে মেক্সিকো।
এই আসরে দলসংখ্যা আগের মতো ২৪টি থাকলেও ফিফা এ আসরে দ্বিতীয় রাউন্ডের নিয়ম বাদ দিয়ে নক আউট সিস্টেমের রাউন্ড অফ সিক্সটিন চালু করে। মেক্সিকোর ৯টি শহরের ১২টি স্টেডিয়ামে সেই আসরের ৫২টি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। মাত্র চার বছর সময় পেলেও আয়োজনের দিক থেকে মেক্সিকোর কোনো ত্রুটি ছিল না। তবে স্বাগতিক মেক্সিকো কোয়ার্টার ফাইনালের বেশি সেবার যেতে পারেনি। কোয়ার্টার ফাইনালে পশ্চিম জার্মানির কাছে টাইব্রেকারে হারে তারা। আর ম্যারাডোনার একক নৈপুণ্যে আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ের মাধ্যমে ওই আসরের পর্দা নামে।
১৯৯০ বিশ্বকাপ: দ্বিতীয়বারের মতো স্বাগতিক ইতালি
১৯৯০ বিশ্বকাপের আয়োজক হিসেবে প্রথমে নয়টি দেশ আগ্রহ দেখালেও শেষপর্যন্ত আয়োজক হওয়ার জন্য অফিসিয়ালি বিড করে ইতালি ও তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন। ১৯৮৪ সালে জুরিখে অনুষ্ঠেয় ফিফা কংগ্রেসের ভোটাভুটিতে সোভিয়েত ইউনিয়নকে হারিয়ে ১৯৩৪ সালের পর আবারো বিশ্বকাপের আয়োজক হয় ইতালি। বিশ্বকাপের ফরম্যাট ঠিক আগের মতোই ছিল, অংশগ্রহণকারী দলের সংখ্যাও ছিল ২৪টি। তবে আগের আসরগুলোতে একটা ম্যাচ জয়ের জন্য দুই পয়েন্ট করে দেওয়া হলেও এই আসর থেকে ম্যাচ জয়ের জন্য তিন পয়েন্ট করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
বারোটি শহরের বারোটি স্টেডিয়ামে ম্যাচগুলো অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৩৪ বিশ্বকাপে ইতালির আয়োজন স্বৈরশাসক মুসোলিনির হস্তক্ষেপে কলঙ্কিত হলেও এই আসরে সবদিক থেকেই দক্ষতার পরিচয় দেয় ইতালিয়ানরা। স্যালভেটর শিলাচির দুর্দান্ত পারফর্মেন্সে ভর করে মাঠের খেলাতেও ভালোই এগিয়ে যাচ্ছিলো ইতালি। কিন্তু সেমিফাইনালে ম্যারাডোনার আর্জেন্টিনার কাছে টাইব্রেকারে হেরে গেলে তৃতীয় হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয় তাদের। তবে অসাধারণ পারফর্ম করে সেই আসরের গোল্ডেন বুট ও গোল্ডেন বল দুটি পুরস্কারই জিতে নেন স্বাগতিক দলের স্ট্রাইকার স্যালভেটর শিলাচি।
১৯৯৪ বিশ্বকাপ: বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশ যখন আয়োজক
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে বৈশ্বিক রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের একচ্ছত্র দাপট থাকলেও ফুটবলে কখনোই যুক্তরাষ্ট্রের সেরকম দাপট ছিল না। তাছাড়া আমেরিকায় বেসবল, বাস্কেটবলের ভিড়ে ফুটবল অতটা জনপ্রিয়ও নয়। ফুটবলের জনপ্রিয়তা বাড়ানোর জন্যেই ১৯৯৪ বিশ্বকাপের আয়োজক হতে পুরোপুরি তোড়জোড় শুরু করে দেয় যুক্তরাষ্ট্র। তবে সেই আসরে আয়োজক হওয়ার জন্যে ব্রাজিল, মরক্কো ও চিলিও আগ্রহী ছিল। শেষপর্যন্ত চিলি নিজেদের প্রত্যাহার করে নিলে বাকি তিন দেশই অফিসিয়ালি বিড করে। সেখানে মরক্কো ও ব্রাজিলকে ভোটাভুটিতে হারিয়ে ১৯৯৪ বিশ্বকাপের আয়োজক নির্বাচিত হয় যুক্তরাষ্ট্র। আগের আসরের মতো এই আসরেও ২৪টি দল অংশ নেয়। নয়টি শহরের নয়টি স্টেডিয়ামে সেবার বিশ্বকাপের ম্যাচগুলো অনুষ্ঠিত হয়।
যুক্তরাষ্ট্রে ফুটবলের সেভাবে জনপ্রিয়তা না থাকলেও মাঠে দর্শক উপস্থিতির দিক থেকে আগের সব রেকর্ডকে ছাড়িয়ে যায় ১৯৯৪ বিশ্বকাপ। ম্যাচপ্রতি গড়ে ৬৯,০০০ দর্শক সেই বিশ্বকাপে উপস্থিত হয়েছিলো যা এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ! আয়োজনের দিক থেকে সব প্রত্যাশা ছাড়িয়ে গেলেও খেলার মাঠে তেমন সুবিধা করতে পারেনি আমেরিকানরা। ব্রাজিলের কাছে ১-০ গোলে হেরে রাউন্ড অফ সিক্সটিন থেকেই বিদায় নিতে হয় স্বাগতিকদের। আর রোজবৌল স্টেডিয়ামে ব্রাজিলের টেট্রাজয়ের মাধ্যমে বিশ্বকাপের ইতিহাসে অন্যতম সফল আসরের সমাপ্তি ঘটে।
১৯৯৮ বিশ্বকাপ: দ্বিতীয়বারে বাজিমাত ফ্রান্সের
১৯৩৮ সালের পর আবারো ১৯৯৮ সালে বিশ্বকাপ আয়োজন করে ফ্রান্স। সেই আসরের আয়োজক হতে প্রথমে পাঁচটি দেশ আগ্রহ দেখালেও শেষপর্যন্ত মরক্কো আর ফ্রান্স আয়োজক হওয়ার জন্যে অফিসিয়ালি বিড করে। ১৯৯৪ সালের মতো এবারো ভোটাভুটিতে হারে মরক্কো, দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বকাপের আয়োজক হয় ফ্রান্স। এই আসরে অংশগ্রহণকারী দলের সংখ্যা ২৪ থেকে বাড়িয়ে ৩২ এ উন্নীত করে ফিফা। দশটি শহরের দশটি স্টেডিয়ামে সেই বিশ্বকাপের ৬৪টি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। মাঠের খেলায় প্রথম আসরে চ্যাম্পিয়ন হতে না পারলেও এই আসরে ঠিকই সফল হয় ফরাসিরা। জিনেদিন জিদানের জোড়া গোলে ব্রাজিলকে ৩-০ গোলে হারিয়ে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ জিতে নেয় ফ্রান্স।
২০০২ বিশ্বকাপ: এশিয়ার মাটিতে বিশ্বকাপ!
আগের ১৬টি বিশ্বকাপের সবগুলো ইউরোপ কিংবা দুই আমেরিকায় অনুষ্ঠিত হলেও এর ব্যতিক্রম ঘটে ২০০২ সালে। একবিংশ শতাব্দীর প্রথম বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয় এশিয়ার দুই দেশ জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ায়। বিশ্বকাপের ইতিহাসে ২০০২ সালেই সর্বপ্রথম যৌথ আয়োজক দেখা যায়, আর এখন পর্যন্ত সেটাই একমাত্র নজির। প্রথমে অবশ্য দক্ষিণ কোরিয়া আর জাপান এককভাবে আয়োজক হওয়ার আবেদনই করেছিলো। তবে আয়োজক হওয়ার দৌড়ে মেক্সিকোকে হারাতে শেষপর্যন্ত যৌথ আয়োজক হতে রাজি হয় দুই দল। কিন্তু দুই দলের মধ্যকার প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও ভৌগলিক দূরত্বের কারণে সেবার বিশ্বকাপ আয়োজনে ফিফাকে ভালোই বেগ পেতে হয়েছিলো।
দক্ষিণ কোরিয়ার দশটি ও জাপানের দশটি- মোট বিশটি স্টেডিয়ামে সেই আসরের ৬৪টি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়েছিলো। মাঠের পারফর্মেন্সে স্বাগতিক দুই দেশই নিজেদের আগের রেকর্ড ছাড়িয়ে গিয়েছিলো। জাপান প্রথমবারের মতো রাউন্ড অফ সিক্সটিনে পৌঁছেছিলো। আর দক্ষিণ কোরিয়া তো তাদের স্বপ্নের সীমাকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিলো! এশিয়ার প্রথম দেশ হিসেবে বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে খেলে নতুন ইতিহাস গড়েছিলো দক্ষিণ কোরিয়া। যদিও দক্ষিণ কোরিয়ার ম্যাচগুলোতে রেফারির বেশ কিছু সিদ্ধান্তে বিতর্কের ঝড় উঠেছিলো। জাপানের ইয়োকোহামা স্টেডিয়ামে ব্রাজিলের রেকর্ড পঞ্চমবারের মতো বিশ্বকাপ জয়ের মাধ্যমে এশিয়ায় অনুষ্ঠিত প্রথম বিশ্বকাপের সমাপ্তি ঘটে।
২০০৬ বিশ্বকাপ: বিতর্কিতভাবে দ্বিতীয়বারের মতো আয়োজক জার্মানি
২০০৬ এর বিশ্বকাপ আয়োজক হওয়ার জন্য প্রথমে পাঁচটি দেশ আবেদন করলেও ব্রাজিল নাম প্রত্যাহার করে নিলে রেসে টিকে থাকে মরক্কো, ইংল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা ও জার্মানি। ২০০০ সালের ৬ জুলাই জুরিখে ২০০৬ বিশ্বকাপের আয়োজক ঠিক করার জন্য ফিফা কংগ্রেসে ভোটাভুটি অনুষ্ঠিত হয়। আগের আসরগুলোতে এক রাউন্ড ভোটের মাধ্যমে আয়োজক নির্বাচিত হলেও সেবার আয়োজক নির্বাচনে ফিফাকে তিন রাউন্ড ভোটের ব্যবস্থা করতে হয়। শেষ রাউন্ডে টিকে ছিলো জার্মানি ও দক্ষিণ আফ্রিকা। হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের পর মাত্র একভোটে জিতে ২০০৬ বিশ্বকাপের আয়োজক নির্বাচিত হয় জার্মানি। কিন্তু পরে দেখা যায় যে ফিফায় নিউজিল্যান্ডের প্রতিনিধি চার্লি ডেম্পসি ভোটই দেননি! অথচ ওশেনিয়া ফুটবল কনফেডারেশন ডেম্পসিকে দক্ষিণ আফ্রিকার পক্ষে ভোট দিতে বলেছিলো! পরে জানা যায়, জার্মানির কাছ থেকে ঘুষের প্রস্তাব পেয়েই ডেম্পসি এহেন কাজ করেছিলেন।
আয়োজক হওয়ার প্রক্রিয়ায় যতই বিতর্ক থাকুক, আয়োজনে সেবার কোনো ত্রুটি জার্মানি রাখেনি। জার্মানির বারোটি শহরের বারোটি স্টেডিয়ামে বিশ্বকাপের ম্যাচগুলো অনুষ্ঠিত হয়। তবে ১৯৭৪ সালের মতো এবার আর ঘরের মাঠে বিশ্বকাপ জিততে পারেনি জার্মানি, তৃতীয় হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয় তাদের। আর বার্লিনের ফাইনালে জিদানের ঢুঁস কান্ডের পর টাইব্রেকারে ফ্রান্সকে হারিয়ে ইতালির চতুর্থবারের মতো বিশ্বজয়ের মাধ্যমেই সেই আসরের সমাপ্তি ঘটে।
২০১০ বিশ্বকাপ: আফ্রিকার প্রথম বিশ্বকাপ
২০০৬ বিশ্বকাপের স্বাগতিক দেশ নির্বাচনে বিতর্কের জের ধরে ফিফা আয়োজক নির্বাচনে নতুন এক নিয়ম করে। এই নিয়ম অনুযায়ী বিশ্বকাপ আয়োজন প্রতিটি মহাদেশে চক্রাকারে ঘুরবে। সেই চক্র শুরু হওয়ার কথা ছিল আফ্রিকা মহাদেশে বিশ্বকাপ আয়োজনের মধ্য দিয়ে। আফ্রিকার তিন দেশ মরক্কো, তিউনিসিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকা আয়োজক হওয়ার জন্য অফিসিয়ালি বিড করে। এক রাউন্ডের ভোটে জিতে ২০১০ বিশ্বকাপের আয়োজক নির্বাচিত হয় দক্ষিণ আফ্রিকা। দক্ষিণ আফ্রিকার নয়টি শহরের দশটি স্টেডিয়ামে ম্যাচগুলো অনুষ্ঠিত হয়। আয়োজনের দিক থেকে অন্যতম সেরা আয়োজন করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলো দক্ষিণ আফ্রিকা। কিন্তু মাঠের পারফর্মেন্সে বড্ড বেশি বিবর্ণ ছিল দেশটি। প্রথম রাউন্ড থেকেই বিদায় নেয় স্বাগতিক দক্ষিণ আফ্রিকা। বিশ্বকাপের ইতিহাসে আর কোনো স্বাগতিক দল প্রথম রাউন্ড থেকে বিদায় নেয়নি। জোহানেসবার্গের সকার সিটি স্টেডিয়ামে স্পেনের প্রথম বিশ্বকাপ জয়ের মাধ্যমে আফ্রিকার প্রথম বিশ্বকাপের পর্দা নামে।
২০১৪ বিশ্বকাপ: মারাকানাজোর পর মিনেরাওজো
কন্টিনেন্টাল রোটেশন পলিসি অনুযায়ী ২০১৪ বিশ্বকাপের আয়োজক হওয়ার কথা ছিল দক্ষিণ আমেরিকার কোনো দেশের। ব্রাজিলের সাথে কলম্বিয়াও প্রথমে বিশ্বকাপের আয়োজক হওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ দেখালেও শেষপর্যন্ত কলম্বিয়া সরে যায়। ফলে ব্রাজিলই একমাত্র দেশ হিসেবে ২০১৪ বিশ্বকাপের আয়োজক হওয়ার জন্য অফিসিয়ালি বিড করে এবং ২০০৭ সালের ৩০ অক্টোবর ফিফা ২০১৪ বিশ্বকাপের আয়োজক হিসেবে ব্রাজিলের নাম ঘোষণা করে। প্রস্তুতিতে ধীরগতি থাকায় বিশ্বকাপ আয়োজনের পূর্বে বেশ সমালোচনার মুখে পড়তে হয় ব্রাজিলকে। তবে বিশ্বকাপ শুরুর আগে সব কাজ ঠিকই শেষ করে ব্রাজিল। বারো শহরের বারোটি ভেন্যুতে ২০১৪ বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয়।
আয়োজনের দিক থেকে সবকিছু ঠিকঠাকভাবে করলেও মাঠের পারফর্মেন্সে আবারো এক নতুন ট্র্যাজেডির জন্ম দেয় ব্রাজিল। ১৯৫০ বিশ্বকাপের মারাকানাজো ভোলার জন্য ব্রাজিল খুব বেশি চাচ্ছিলো ২০১৪ সালে ঘরের মাঠে অনুষ্ঠেয় বিশ্বকাপটি জিততে। কিন্তু বেলো হরিজান্তের এস্তাদিও মিনেরাও স্টেডিয়ামে সেমিফাইনালে জার্মানির কাছে ৭-১ গোলের বিশাল ব্যবধানে হেরে উল্টো নতুন আরেক ট্র্যাজেডির জন্ম দেয় ব্রাজিল! সেদিনের ম্যাচটি ইতিহাসের পাতায় মিনেরাওজো নামে ঠাঁই পেয়ে যায়। আয়োজক হিসেবে দুবারই এমন ট্র্যাজেডির জন্ম দেওয়ায় ব্রাজিলের জন্য বিশ্বকাপের আয়োজক হওয়াকেই অনেকে অপয়া বলে ঘোষণা করে দেয়। মারাকানায় ফাইনালে আর্জেন্টিনাকে ১-০ গোলে হারিয়ে জার্মানির চতুর্থ বিশ্বজয়ের মাধ্যমে ঘটনাবহুল ২০১৪ বিশ্বকাপের সমাপ্তি ঘটে।
তবে ২০১৮ বিশ্বকাপের আয়োজক নির্বাচনের সময়ে ফিফা কন্টিনেন্টাল রোটেশন পলিসি প্রত্যাহার করে নেয়। এখনকার নিয়ম অনুসারে যেকোনো দেশই বিশ্বকাপের আয়োজক হওয়ার জন্য আবেদন করতে পারবে। তবে শর্ত একটাই, দেশটি যে মহাদেশে অবস্থিত সেই মহাদেশ আগের দুই আসরের স্বাগতিক হতে পারবে না। এই নিয়মের কারণেই ২০১৮ বিশ্বকাপের আয়োজক হিসেবে আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের কেউ আবেদন করতে পারেনি। ২০১৮ বিশ্বকাপের আয়োজক হওয়ার জন্য রাশিয়া, ইংল্যান্ডের সাথে নেদারল্যান্ডস-বেলজিয়াম ও স্পেন-পর্তুগাল জয়েন্ট বিড করে। ২০১০ সালের ২ ডিসেম্বর ২ রাউন্ডের ভোটাভুটিতে জয়ী হয়ে ২০১৮ বিশ্বকাপের আয়োজক নির্বাচিত হয় রাশিয়া। একই দিনে চার রাউন্ডের ভোটাভুটি শেষে অস্ট্রেলিয়া, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রকে হারিয়ে ২০২২ বিশ্বকাপের আয়োজক নির্বাচিত হয় কাতার।
এপর্যন্ত অনুষ্ঠিত হওয়া বিশটি বিশ্বকাপের মধ্যে ছয়টি বিশ্বকাপে স্বাগতিক দল চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। পক্ষান্তরে মাত্র একবার স্বাগতিক দল গ্রুপপর্ব থেকে বাদ পড়েছে। পরিসংখ্যান থেকে একটা ব্যাপার নিশ্চিত, স্বাগতিক হওয়ার কারণে সেই দলের পারফর্মেন্স গ্রাফে কিছুটা হলেও উন্নতির ছোঁয়া লাগে। এখন দেখা যাক স্বাগতিক হওয়ার সুবিধা কাজে লাগিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে রাশিয়ার ফুটবলে যে খারাপ সময় যাচ্ছে সেটি তারা কাটিয়ে উঠতে পারে কিনা। তবে স্বাগতিকদের মাঠের পারফর্মেন্স যেমনই হউক, মাঠের বাইরে সবকিছু সুন্দরভাবে আয়োজন করে একটা সফল বিশ্বকাপ রাশিয়া উপহার দিবে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
ফিচার ইমেজ : wavuti