টেস্ট অধিনায়ক হিসাবে বিরাট কোহলি কতটা সফল?

১.

২০১৪ সালের ডিসেম্বরে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টেস্ট সিরিজের মাঝপথে মহেন্দ্র সিং ধোনি টেস্ট ক্রিকেটকে বিদায় জানালে ভারতের টেস্ট অধিনায়ক হিসাবে দায়িত্ব পান বিরাট কোহলি। অধিনায়ক হিসাবে নিজের প্রথম তিন ইনিংসে তিনটি শতক হাঁকিয়ে নতুন অধ্যায়ের যাত্রা বেশ ভালোভাবেই শুরু করেন। অধিনায়কের দায়িত্ব পাওয়ার আগেও নিয়মিত রান করতেন কোহলি। দায়িত্ব পাওয়ার পর তার রানের ক্ষুধা আরও বেড়ে যায়। টেস্ট ক্রিকেটের পর সীমিত ওভারের ক্রিকেটেও ধোনি অধিনায়কত্ব ছেড়ে দিলে তিন ফরম্যাটেই ভারতের অধিনায়কের দায়িত্ব পান তিনি। 

ভারতের বিশ্বজয়ী অধিনায়ক ধোনির পরিবর্তে অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করে এখনও ভারতকে বৈশ্বিক কোনো টুর্নামেন্টে সাফল্য এনে দিতে না পারলেও দ্বিপাক্ষিক সিরিজগুলোতে অপরাজেয় দলে পরিণত করেছেন কোহলি। ইতঃমধ্যে টেস্ট ক্রিকেটে ভারতের সবচেয়ে সফল অধিনায়ক হিসাবে নিজের নাম লিখিয়েছেন তিনি। ওয়ানডে ক্রিকেটেও তার সফলতা উল্লেখযোগ্য। এখন পর্যন্ত ৮০ ম্যাচ নেতৃত্ব দিয়ে পরাজয়ের স্বাদ পেয়েছেন মাত্র ১৯ ম্যাচে।

অধিনায়কের দায়িত্ব পাওয়ার পর কোহলির রানের ক্ষুধা আরও বেড়ে যায় ; Image Source: Getty Images

অধিনায়কের দায়িত্ব পাওয়ার পর ব্যাট হাতেও তিনি আরও দায়িত্বশীল হয়ে উঠেন। দুর্দান্ত ধারাবাহিকতার সাথে রান করে চলেছেন প্রতি ম্যাচে। এখন পর্যন্ত ভারতকে ৪৮টি টেস্টে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। এই ৪৮ ম্যাচে ১২টি অর্ধশতক এবং ১৮টি শতকের সাহায্যে ৬১.১৯ ব্যাটিং গড়ে ৪,৬৫১ রান সংগ্রহ করেছেন তিনি। ওয়ানডে ক্রিকেটে তার ধারাবাহিকতা অকল্পনীয়। অধিনায়ক হিসাবে ৭৬ ইনিংস ব্যাট করে শতক হাঁকিয়েছেন ২১ ইনিংসে, অর্ধশতক ১৯ ইনিংসে। অধিনায়ক হিসাবে কমপক্ষে এক হাজার রান করেছেন, এমন ব্যাটসম্যানদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যাটিং গড় তার। তিনি ৪,৮০০ রান করেছেন ৮০.০০ ব্যাটিং গড়ে।

২.

ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সদ্যসমাপ্ত টেস্ট সিরিজের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে ইয়ন বিশপকে বিরাট কোহলি বলেছিলেন, ক্যাপ্টেন্সি শুধুমাত্র নামের আগে ‘C’ থাকা। কোহলি তার নামের পাশে অধিনায়ক শব্দটার দায়িত্ব ঠিকঠাকভাবেই পালন করে যাচ্ছেন। এখন পর্যন্ত ভারতকে ৪৮ টেস্টে নেতৃত্ব দিয়ে ২৮টি টেস্টে জয় এনে দিয়েছেন। তার শতকরা জয়ের হার ৫৮.৩৩%। এখন পর্যন্ত টেস্ট ক্রিকেটে ৫০ জন অধিনায়ক ত্রিশ কিংবা এর বেশি ম্যাচে অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেছেন। তাদের মধ্যে শতকরা জয়ের হারের দিক দিয়ে কোহলির উপরে আছেন শুধুমাত্র স্টিভ ওয়াহ এবং রিকি পন্টিং। দুইজনেই ছিলেন ‘অপরাজেয়’ অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক। ভারতীয় অধিনায়কদের মধ্যে বিরাট কোহলির পর তালিকায় রয়েছেন মহেন্দ্র সিং ধোনি। তিনি শতকরা জয়ের হারের দিক দিয়ে ৪৫ শতাংশ জয় নিয়ে ২০তম স্থানে অবস্থান করছেন। সৌরভ গাঙ্গুলী ৪২.৮৬% ম্যাচে জয় নিয়ে ২২তম স্থানে আছেন। 

ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সিরিজ জয়ের পর ট্রফি হাতে কোহলি ; Image Source: AFP 

ভারতের হয়ে এখন পর্যন্ত সাতজন অধিনায়ক ৩০ কিংবা এর অধিক ম্যাচে নেতৃত্ব দিয়েছেন। এর মধ্যে মনসুর আলি খান পতৌদি ছাড়া বাকি ছয় অধিনায়কের নেতৃত্বে ব্যাটিং শক্তিমত্তা প্রায় সমান সমান ছিল। সৌরভ গাঙ্গুলীর নেতৃত্বে ব্যাটসম্যানদের গড় ছিল ৩৮.৭৪ রান, সুনীল গাভাস্কারের অধীনে ৩৭.৯০, বিরাট কোহলির নেতৃত্বে এখন পর্যন্ত ৩৭.৮৪, মহেন্দ্র সিং ধোনির সময় ৩৭.০০, আজহারউদ্দীন এবং কপিল দেবের সময় ব্যাটিং গড় ছিল যথাক্রমে ৩৬.৫১ ও ৩৬.১৩। 

ব্যাটিং গড় প্রায় সমান হলেও বোলিং গড়ের দিক দিয়ে অন্যান্য ভারতীয় অধিনায়কের চেয়ে বেশ এগিয়ে আছেন বিরাট কোহলি। তার নেতৃত্বে বিশেষ করে পেসাররা অসাধারণ বোলিং করে যাচ্ছেন। এখন পর্যন্ত তার নেতৃত্বে ভারত ৪৮ টেস্টে গড়ে ২৬.৩৩ রান খরচ করেছেন। তার চেয়ে কম বোলিং গড় আছে শুধুমাত্র চারজন অধিনায়কের। ইংল্যান্ডের পিটার মে (২১.৯৪), মাইক বার্লি (২৪.৬৫), দক্ষিণ আফ্রিকা হ্যানসি ক্রনিয়ে (২৫.৮৪) এবং ভিভ রিচার্ডসের ওয়েস্ট ইন্ডিজের (২৫.৯৭)। টেস্ট ক্রিকেটে কমপক্ষে ৩০ টেস্টে নেতৃত্ব দিয়েছেন, এমন অধিনায়কদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বোলিং গড় বাংলাদেশের মুশফিকুর রহিমের সময়কালে (৪৫.৮৪)।

বোলিং ডিপার্টমেন্ট দক্ষতার সাথে পরিচালনা করছেন কোহলি ; Image Source: Getty Images

বিরাট কোহলি তার বোলিং ডিপার্টমেন্টকে ইয়ান চ্যাপেল, ক্লাইভ লয়েড, স্টিভ ওয়াহ এবং রিকি পন্টিংদের মতো অধিনায়কদের চেয়ে ভালোভাবে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এর কারণে তিনি ভারতের সবচেয়ে সফল টেস্ট অধিনায়ক হতে পেরেছেন। তার আগে টেস্ট ক্রিকেটে ভারতীয় অধিনায়কদের বোলিং গড় ছিল ৩২ থেকে ৩৬ রানের মধ্যে। সেখানে কোহলির অধীনে মাত্র ২৬.৩৩!

৩.

বর্তমানে সব দেশই নিজের সুবিধার্থে পিচ তৈরি করে। এতে করে ব্যাটসম্যানরা কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হয়। তাই কোহলির নেতৃত্বে ভারত কেমন করছে, সেটা বোঝার জন্য ব্যাটিং গড়ের চেয়ে বোলিং গড় কত কম, সেটা দেখে আসা যাক।

অধিনায়ক বিরাট কোহলির ভারতের ব্যাটিং গড় ৩৭.৮৪ এবং বোলিং গড় ২৬.৩৩। ব্যাটিং গড় এবং বোলিং গড়ের পার্থক্য ১১.৫১। তার চেয়ে বেশি ব্যাটিং গড় এবং বোলিং গড়ের মধ্যে পার্থক্য আছে শুধুমাত্র স্টিভ ওয়াহর। ওয়াহ’র নেতৃত্বে অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটিং গড় ছিল ৪৩.১১ এবং বোলিং গড় ২৭.৪৫, পার্থক্য ১৫.৬৬। 

ভারতের টেস্ট দল; Image Source: Getty Images

টেস্ট ক্রিকেটে ব্যাটিং ভালো হলে ম্যাচ পরাজয়ের হার কম থাকলেও জয়ের জন্য দরকার ভালো বোলিং লাইনআপ। প্রতিপক্ষের ২০ উইকেট শিকার করেই টেস্টে জয় আদায় করে নিতে হয়। বিরাট কোহলির নেতৃত্বে ভারত প্রথমবারের মতো সব কন্ডিশনে ভালো করার মতো বোলিং অ্যাটাক গড়ে তুলেছে। তিনি আলাদাভাবে প্রত্যেক বোলারকে ফিটনেসের উপর গুরুত্ব দিতে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন। ফিটনেসের ঘাটতি থাকলে টেস্ট ক্রিকেটে সফলতা পাওয়া যায় না, সেটা বুঝিয়েছেন।

কোহলির সময়ে চোখে পড়ার মতো পরিবর্তন হয়েছে ইশান্ত শর্মার। ইশান্ত যখন জাতীয় দলে আসেন, তখন কয়েক স্পেলে দুর্দান্ত বোলিং করলেও লম্বা সময় ধরে বল করতে পারতেন না। তার অধীনে কঠোর পরিশ্রম করে তিনি লম্বা স্পেলে বল করে দেশে এবং দেশের বাইরে সফলতা পাচ্ছেন। ধোনির নেতৃত্বে তার বোলিং গড় যেখানে ৩৬.৬৫ ছিল, সেখানে কোহলির নেতৃত্বে মাত্র ২৭.২১। গত কয়েক বছরে যা আরও কম। উচ্চতার কারণে ইশান্ত শর্মার প্রধান অস্ত্র ছিল বাউন্সার। হঠাৎ লাফিয়ে ওঠা বলে ব্যাটসম্যানদের পরাস্ত করতে তিনি পারদর্শী। বর্তমানে নিয়মিত বলে সুইংও পাচ্ছেন তিনি। বাঁহাতি ব্যাটসম্যানদের বিপক্ষে বেশ বিপদজনক বোলার ইশান্ত; বল পুরাতন হয়ে গেলে পেসাররা যখন সুবিধা করতে পারে না, তখনও অধিনায়ক কোহলি ইশান্তের উপর ভরসা রাখেন। 

বিরাট কোহলি ; Image Source: Getty Images

৪.

অধিনায়ক বিরাট কোহলির সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষা দিতে হয় একাদশ নির্বাচন করতে গিয়ে। দেশের মধ্যে রবীন্দ্র জাদেজা, অশ্বিনদের মতো স্পিনারদের সার্ভিস পেয়ে থাকেন, তেমনি দেশের বাইরে বুমরাহ-ইশান্ত-শামি’রা সার্ভিস দেন। ম্যাচ জয়ের জন্য তিনি সবসময়ই কঠিন সব সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। দেশের বাইরে যেমন অশ্বিনের মতো বোলারকে একাদশের বাইরে রাখেন, তেমনি দেশের মাটিতে ইশান্ত, উমেশ যাদবরা ফর্মে থাকলেও একাদশের বাইরে রাখতে হয় বেশি স্পিনার খেলানোর কারণে।

বিরাট কোহলি; Image Source: Getty Images

গত বছর অস্ট্রেলিয়া এবং ইংল্যান্ডের মাটিতে চার পেসার নিয়ে খেলেছিল ভারত, যার মধ্যে চারজনই এগারো কিংবা বড়জোর দশ নাম্বারের ব্যাটসম্যান। এতে করে ব্যাটিং লাইনআপ দুর্বল হলেও ভারত সফলতা পেয়েছিল। কারণ, তারা নিয়মিত প্রতিপক্ষের বিশ উইকেট তুলে নিতে সক্ষম হয়েছিল। ব্যাটসম্যানদের জন্য প্রতিকূল পরিবেশেও বিরাট পাঁচজন বোলার কিংবা চারজন স্পেশালিস্ট বোলার এবং একজন অলরাউন্ডারকে খেলান। 

বিরাট কোহলির নেতৃত্বে এখন পর্যন্ত আটজন বোলার ত্রিশ কিংবা ততোধিক উইকেট শিকার করেছেন, যাদের মধ্যে সাতজন বোলারের বোলিং গড় ৩০ এর কম। শুধুমাত্র উমেশ যাদবের বোলিং গড় ৩০ এর বেশি। তার বোলিং গড়ও আরও কম হতে পারতো, যদি বিরাট কোহলির অধীনে একমাত্র পেসার হিসাবে ম্যাচে দশ উইকেট শিকার করার পরের সিরিজেই দলের বাইরে না যেতেন। উমেশ যাদব ঘরের মাঠে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ম্যাচে দশ উইকেট শিকার করার পরের সিরিজেই দল থেকে বাদ পড়েছিলেন।

সতীর্থদের সাথে উদযাপন করছেন কোহলি ; Image Source: Getty Images

বিরাট কোহলি এশিয়ার প্রথম অধিনায়ক হিসাবে দক্ষিণ আফ্রিকা, ইংল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে টেস্ট জয়ের কীর্তি গড়েছেন। এখন পর্যন্ত টেস্ট দলকে অসাধারণভাবে নেতৃত্ব দিয়ে যাওয়া বিরাট কোহলির লক্ষ্য থাকবে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপে জয় পাওয়া। টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ জিততে হলে প্রতিটি ম্যাচকেই গুরুত্ব সহকারে নিতে হবে। কারণ প্রতি ম্যাচের জন্য রয়েছে আলাদাভাবে পয়েন্ট। তাই দেশের মাটিতে ম্যাচ জয়ের পাশাপাশি ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং নিউ জিল্যান্ড থেকেও পয়েন্ট নিয়ে আসতে হবে। বিরাট কোহলির নতুন রূপের টেস্ট দল কাজটা কতটুকু করতে পারে, সেটাই দেখার বিষয়।

This article is in Bangla language. It is about the Virat Kohli's test captaincy. For references, please check the hyperlinks inside the article.

Featured Image: Getty Images

Related Articles

Exit mobile version