১.
যেকোনো সেক্টরেই সফল হবার জন্য ধারাবাহিকতা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি ফ্যাক্টর, খেলাধুলাতেও এটা প্রযোজ্য। তবে একইসাথে খেলাধুলাতে ‘ল অফ অ্যাভারেজ’ বলে একটি কথা প্রচলিত রয়েছে। ক্রিকেটে একজন ব্যাটসম্যান প্রতিদিনই রান পাবেন না, কিংবা একজন বোলার প্রতিদিনই উইকেট পাবেন না। কিংবা ফুটবলে একজন স্ট্রাইকার প্রতি ম্যাচে গোল করতে পারবেন না, অথবা একজন গোলকিপারও প্রতি ম্যাচে গোল সেভ করতে পারবেন না। মাঝে মাঝে তারা ব্যর্থও হবেন। কিন্তু অনেক সময়েই দেখা যায়, অধারাবাহিকভাবে কম রান করা অনেক ব্যাটসম্যানকেও ধারাবাহিকভাবে বেশি রান করা ব্যাটসম্যানের চেয়ে বেশি মূল্যায়ন করা হয়। অথবা, বেশি গোল করা একজন স্ট্রাইকারের চেয়ে কম গোল করা একজন স্ট্রাইকারকে গুরুত্ব বেশি দেওয়া হয়।
এর কারণগুলো কী? আজকের পর্বে ক্রিকেটের আলোকেই বিষয়টি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা যাক। পরের পর্বে আলোচনা হবে ফুটবল নিয়ে।
২.
১৯৯৬ বিশ্বকাপ দিয়ে শুরু করা যাক। সেই বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকার ওপেনার গ্যারি কারস্টেন ৬ ম্যাচে ৭৮.২০ গড়ে করেছেন ৩৯১ রান, আর ব্রায়ান লারা ৬ ম্যাচে রান ৫৩.৮০ গড়ে করেছেন ২৬৯ রান। এখন প্রতিটি ম্যাচে তাদের স্কোরগুলো একটু লক্ষ্য করা যাক।
বলুন তো, সেই টুর্নামেন্টের প্রেক্ষাপটে গ্যারি কারস্টেন আর ব্রায়ান লারার মাঝে কে বেশি সফল? দুই খেলোয়াড়ের মাঝে কে বেশি ধারাবাহিক? পরিসংখ্যান অনুযায়ী, নিঃসন্দেহে কারস্টেন। কিন্তু কে বেশি সফল, কিংবা কার অবদানটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল দলের জন্য?
দুজনের গড়, রান সংখ্যা কিংবা ধারাবাহিকতা দেখলে নিঃসন্দেহে বলে দেওয়া যায়, কারস্টেনই এগিয়ে। কিন্তু বাস্তবে কি তা-ই? পরিসংখ্যান সবসময় সত্য কথা বলে না, সত্যটা খুঁজে বের করার জন্য একটু বিশ্লেষণ করতে হয়। সেটাই একটু করা যাক।
‘৯৬ বিশ্বকাপ ক্রিকেটে ওয়েস্ট ইন্ডিজের শুরুটা হয়েছিল খুব বাজেভাবে। প্রথম ম্যাচে জিম্বাবুয়ের সাথে জিতলেও ভারত আর কেনিয়ার সাথে ম্যাচ হেরে যায় উইন্ডিজ। ম্যাচ হারাটাও খুব বড় বিষয় নয়, কিন্তু ব্যাটিং বিপর্যয়ে পড়ে দুই ম্যাচে রান করে মাত্র ১৭২ আর ৯৩। সেই সময় বিশ্বের সেরা ব্যাটসম্যান ব্রায়ান লারা (তখন তিনিই ১ নম্বরে ছিলেন) দুই ম্যাচে করেন মাত্র ২ আর ৮ রান। নিরাপত্তাজনিত কারণে শ্রীলঙ্কায় যেতে না চাওয়ায় সেই ম্যাচে পয়েন্ট হারায় উইন্ডিজ। গ্রুপপর্বের অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে শেষ ম্যাচটা তাই হয়ে যায় বাঁচা-মরার লড়াই। সেই ম্যাচে ব্রায়ান লারা ৬০ রান করেন। কিন্তু সবকিছু ছাড়িয়ে যায় দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ম্যাচটিতে।
দক্ষিণ আফ্রিকা দল হিসেবে সেই টুর্নামেন্টে অসাধারণ খেলছিল। শুধু অপরাজিতভাবেই গ্রুপ থেকে উঠে আসেনি, বরং প্রতিপক্ষকে সামান্যতম সুযোগও দেয়নি তারা। স্বাগতিক শক্তিশালী পাকিস্তানকে বিপক্ষে একপ্রকার হেসেখেলেই হারিয়েছে। কোয়ার্টার ফাইনালে উইন্ডিজের বিপক্ষে দক্ষিণ আফ্রিকা তাই ছিল নিরঙ্কুশ ফেভারিট। সেই ম্যাচে লারা করেন ৯৪ বলে ১১১ রান। এই রান করার পথে সিমকক্সের এক ওভারে ৫টি বাউন্ডারি মারেন। লারার দ্যুতিতে চোখ ধাঁধিয়ে যায় আফ্রিকানদের। সেই ম্যাচ জেতার পর সেমিতে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষেও জয়ের পথেই ছিল তারা। ২০৮ রানের টার্গেটের সেই ম্যাচে লারা করেন ৪৫ রান। কিন্তু সেখানে আরেক ‘গ্রেট’ শেন ওয়ার্ন ম্যাচ বাঁচিয়ে নিয়ে যান।
এখানে এই দুজনের মাঝে কে ধারাবাহিক, আর কে সফল? সফলতার জন্য ধারাবাহিকতা অত্যাবশ্যক নয় বটে, তবে কেউ যদি সফলতার সাথে সাথেও ধারাবাহিক হতে পারে, তাহলে তাকে বাড়তি কৃতিত্ব দিতেই হবে। কিন্তু সারা জায়গায় ধারাবাহিক থেকে মূল জায়গায় ব্যর্থ হলে সমস্যা।
৩.
১৯৯৬ বিশ্বকাপেরই আরেকটি ঘটনা বলা যাক। সেই বিশ্বকাপে শেন ওয়ার্ন আর অনিল কুম্বলের মাঝে কে ধারাবাহিক আর কে সফল?
সেমিতে উইন্ডিজের বিপক্ষে ম্যাচের আগপর্যন্ত বলা যায় ওয়ার্ন নিষ্প্রভই ছিলেন। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ৪ উইকেট বাদ দিলে বাকি চার ম্যাচে ৪ ম্যাচে ৩৩.৭৫ গড়ে ৪ উইকেট বিশ্বমানের একজন স্পিনারের জন্য বড় আসরে ব্যর্থতারই পরিচায়ক। কিন্তু নিজেকে ফিরে পাবার জন্য সম্ভবত অস্ট্রেলিয়ার জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনের দিনটিই বেছে নিয়েছিলেন।
সেমিফাইনালে সেই ম্যাচে শুরু থেকেই আগুন ছড়াচ্ছিলেন অ্যামব্রোস আর বিশপ। ০ রানে ১ম, ৭ রানে ২য়, ৮ রানে ৩য় আর একপর্যায়ে ১৫ রানেই ৪ উইকেট পড়ে যায় অস্ট্রেলিয়ার। শেষপর্যন্ত খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ২০৭ রান করতে পারে অস্ট্রেলিয়া। ষষ্ঠ ওভারে ব্রাউনকে ফ্লিপারে আউট করে প্রথম ব্রেক-থ্রু দেন ওয়ার্ন। গিবসন, জিমি অ্যাডামস আর বিশপকে আউট করে ম্যান অব দ্য ম্যাচ হন ওয়ার্ন। হেরে গেলে ফাইনালে উঠতে পারবে না, এমন ম্যাচে কম পুঁজি নিয়ে এমন অসাধারণ পারফর্মেন্স। তবে ফাইনালে শ্রীলঙ্কার কাছে বেদম মার খান। ধারণা করা হয়, ডে-নাইট ম্যাচে কুয়াশার কারণে বল গ্রিপ করতে সমস্যা হওয়ায় তার বোলিং খারাপ হয়েছিলো। শুধুমাত্র এই কারণেই অস্ট্রেলিয়ার কোচকে সেই টুর্নামেন্টের পর বহিস্কার করা হয়, কারণ আগে লক্ষ্য করলে হয়তো প্রতিকূল পরিস্থিতির জন্য প্র্যাকটিস সেরে নেওয়া যেত। তবে শ্রীলঙ্কা সেদিন যেমন মারকুটে ফর্মে আর দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল, তাতে কোনো পরিকল্পনাই তাদের দমাতে পারতো বলে মনে হয় না। সেটা অবশ্য ভিন্ন প্রসঙ্গ।
এখন পুরো টুর্নামেন্টে কুম্বলের ৭ ম্যাচে ১৮.৭৩ গড়ে ১৫ উইকেট, আর ওয়ার্নের ৭ ম্যাচে ২১.৯১ গড়ে ১২ উইকেটের মাঝে কোন পারফরম্যান্সকে ধারাবাহিক আর কোনটিকে সফল বলবেন?
৪.
১৯৯৬ এর কথা তোলা থাকুক, সেখানে তো ওয়ার্ন ফাইনাল হেরেছিলেন। ১৯৯৯ বিশ্বকাপ একটু দেখা যাক। সেই বিশ্বকাপে পাকিস্তান আর নিউজিল্যান্ডের সাথে পরপর দুই ম্যাচ হেরে প্রায় বাতিলের পর্যায়ে চলে গিয়েছিলো অস্ট্রেলিয়া। উইন্ডিজের সাথে ‘মাস্ট উইন’ ম্যাচে পান ১১ রানে ৩ উইকেট, মূল কাজটা অবশ্য ম্যাকগ্রা করেছিলেন (৫/১৪)। এরপরের ম্যাচগুলোতে আবার ব্যর্থ। ইন্ডিয়ার সাথে ৬ ওভারে ৪৯ রান দিয়ে কোনো উইকেট পাননি, আর জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ৫৫ রানে ১ উইকেট। সুপার সিক্সের শেষ ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ম্যাচে স্টিভ ওয়াহ বললেন, সেই ম্যাচের ট্রাম্পকার্ড ওয়ার্ন। কিন্তু ওয়ার্ন ৩৩ রানে ২ উইকেট পেলেও ম্যাচটা বাঁচালেন স্টিভই। তবে ওয়ার্ন সম্ভবত তার সেরাটা জমিয়ে রেখেছিলেন মূল সময়ের জন্য।
পোলক আর ডোনাল্ডের তোপে পড়ে সেমিতে আবারও অস্ট্রেলিয়া ২১৩ রানে অলআউট। সেই বিশ্বকাপের আফ্রিকার মতো দলের জন্য এটা মামুলি টার্গেটই বলা চলে। ১২ ওভারে কোনো উইকেট না হারিয়ে ৪৮ রান করে পথেই ছিল আফ্রিকা। কিন্তু এবারেও ব্রেক-থ্রু দিলেন ওয়ার্ন। দারুণ খেলতে থাকা গিবসকে ( ৩৬ বলে ৩০ রান) বোল্ড করলেন বড় টার্নে। পরের ওভারে ফিরিয়ে দিলেন ক্রিস্টেনকে। ক্রনিয়েকেও ফেরত পাঠালেন দুই বল পরই। ৪৮ রানে ০ উইকেট থেকে ৫৩ রানে ৩ উইকেট, তিনটিই ওয়ার্নের। এরপর আবার ফিরে আসলেন যখন, পোলক আর ক্যালিস আরেকটি বড় জুটি গড়ে ফেলেছিলেন। ক্যালিসকে ফিরিয়ে সেই জুটি ভাঙলেন। ম্যাচে পেলেন ৪ উইকেট, মাত্র ২৯ রানের বিনিময়ে। ফাইনালে এবার আর কোনো ভুল নয়। পাকিস্তানের বিপক্ষে পেলেন ৪ উইকেট। প্রথম ৭ ম্যাচে ১০ উইকেটের ব্যর্থতা ঢেকে গেল শেষ ৩ ম্যাচের ১০ উইকেটে। ফলাফল, সেমিফাইনাল আর ফাইনালে ম্যান অব দ্য ম্যাচ!
পুরো টুর্নামেন্টের ধারাবাহিকভাবে ভালো খেলা অ্যালটের (৯ ম্যাচে ১৬.২৫ গড়ে ২০ উইকেট) চেয়ে তুলনামূলক অধারাবাহিক ওয়ার্নকে (১০ ম্যাচে ১৮.০৫ গড়ে ২০ উইকেট) কি সফল বলা যাবে না?
৫.
ধারাবাহিকতা একজন খেলোয়াড়ের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে যেহেতু একজন খেলোয়াড় কোনো না কোনো দিন ব্যর্থ হবেনই, তাই যে খেলোয়াড় দলের সবচেয়ে প্রয়োজনের দিন নিজের সেরাটা দেন, তাকে একটু আলাদাভাবে মূল্যায়ন করাটাই স্বাভাবিক।
কেবল খেলোয়াড়ের ব্যক্তিগত পারফরমেন্স নয়, একটি দল পর্যন্ত অধারাবাহিক হয়েও সফল হতে পারে।
১৯৯২ বিশ্বকাপের সবচেয়ে ধারাবাহিক দল কোনটি? নিউ জিল্যান্ড; গ্রুপপর্বে মাত্র একটি ম্যাচে হারে তারা। আর সবচেয়ে অধারাবাহিক দল কোনটি? পাকিস্তান; অনেকটা ভাগ্যের জোরেই সেমিতে উঠেছে। ‘ভাগ্য’ বলা হলো এই কারণে যে, ইংল্যান্ডের সাথে গ্রুপপর্বের ম্যাচে ৭৪ রানে অলআউট হয়ে গিয়েছিল পাকিস্তান। বৃষ্টির জন্য সেই ম্যাচ পন্ড হয়ে যাওয়ায় ১ পয়েন্ট পায় পাকিস্তান। কিন্তু সেমিতে অসাধারণ এক ম্যাচ ইনজামাম-উল হকের কৃতিত্বে জিতে পরে ফাইনালেও জিতে যায় পাকিস্তান। পুরো টুর্নামেন্টে ৯ ম্যাচ খেলে নিউজিল্যান্ড জেতে ৭ ম্যাচ, হারে ২টি ম্যাচে; সফলতার হার ৭৭.৭৭%। ১০ ম্যাচ খেলে পাকিস্তান জেতে ৬ ম্যাচ, হেরে যায় ৩ ম্যাচে আর পরিত্যক্ত হয় ১টি ম্যাচ; সফলতার হার ৬০% । বিশ্বকাপ শেষে বিবেচ্য কোনটি- কোন দল বেশি ধারাবাহিক, নাকি কোন দল বেশি সফল?
১৯৯৬ বিশ্বকাপই লক্ষ্য করুন। ওয়েস্ট ইন্ডিজ গ্রুপের ৫ ম্যাচে জয় পায় মাত্র দুটিতে। কেনিয়ার বিপক্ষে ম্যাচেও হেরে যায়। অন্যদিকে অপর গ্রুপের সাউথ আফ্রিকা ৫ ম্যাচের ৫টিতেই জিতে কোয়ার্টারে আসে, অথচ মুখোমুখি হওয়ার পর খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে আসা সেই উইন্ডিজের সাথে হেরে যায়!
তবে একইসাথে ধারাবাহিক এবং সফল দলের দেখাও ইতিহাসে পাওয়া যায়। ২০০৭ বিশ্বকাপের অস্ট্রেলিয়া এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ। সেই বিশ্বকাপের প্রতিটি ম্যাচ জিতে টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয় অস্ট্রেলিয়া।
কাজেই দেখা যাচ্ছে, একজন খেলোয়াড় কিংবা দলের জন্য ধারাবাহিকতার চাইতেও বেশি জরুরি হচ্ছে প্রয়োজন মতো ভালো খেলা। কেউ যদি প্রয়োজনের দিন সেরাটা দেবার পাশাপাশি প্রতিটি ম্যাচেই ধারাবাহিক থাকতে পারে, তাহলে সে বাড়তি কৃতিত্বের দাবিদার। তবে খুব ধারাবাহিক খেলে প্রয়োজনের দিন হোঁচট খাওয়ার চাইতে অপ্রয়োজনের দিন ব্যর্থ হলেও প্রয়োজনের দিন নিজের সেরাটা দিতে পারাই উত্তম।
‘সময়ের এক ফোঁড়, কিংবা অসময়ের দশ ফোঁড়’ – প্রবাদটার প্রচলন তো আর শুধু শুধু হয়নি!