মেসি-মন্ত্রে মায়ামি-মহাকাব্য

১.

ক্রীড়ালেখকদের কাছে ‘রূপকথা’ শব্দটা বেশ প্রিয়। অন্তত চোখে সয়ে আসা কোনো ঘটনার চেয়ে ব্যতিক্রম কিছু দেখলে, অথবা সাধারণ নিয়মের ব্যত্যয় ঘটলে তারা ‘রূপকথা’ শব্দটা ব্যবহার করেই থাকেন। ফুটবল-ব্যক্তিত্বদের মধ্যে হয়তো লিওনেল মেসির ক্ষেত্রেই সবচেয়ে বেশিবার ব্যবহৃত হয়েছে শব্দটা। অবশ্য গত দুই দশক ধরে মেসি মাঠে যা করছেন, তাতে রূপকথাগুলোও চোখ সয়ে যাওয়ারই কথা!

ইন্টার মায়ামির ক্ষেত্রে ব্যাপারটা অবশ্য ভিন্ন। লিওনেল মেসির চোখধাঁধানো নৈপুণ্য এতদিন টেলিভিশনের সামনে বসেই উপভোগ করেছেন মায়ামির সমর্থক-খেলোয়াড়েরা, এখন দেখছেন চোখের সামনে, মাঠেই। বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের দোলাচলে, চোখ কচলে তারা দেখছেন জাদুকরের একের পর এক মনোমুগ্ধকর জাদু। মোহাবিষ্ট দর্শকদের সামনে টুপি থেকে কখনো খরগোশ বের করছেন জাদুকর, কখনো বেরিয়ে আসছে আস্ত একটা ক্যাঙ্গারু!

মেসির জাদু চলছেই, চলছে সেই চিরচেনা উদযাপন; Image Source: Getty Images

পয়েন্ট তালিকা অনুসারে মেজর লিগ সকারের সবচেয়ে বাজে দল এই ইন্টার মায়ামি, নিতান্ত অবনমনের কোনো ব্যাপার নেই বলে সেই শঙ্কাটা নেই। তবে লিগের বাইশ ম্যাচ শেষে তাদের চেয়ে বেশিবার পরাজয়ের মুখ দেখেনি আর কোনো দল, গোলসংখ্যাও ম্যাচপ্রতি মাত্র একটা করে। সেই দলটাই যখন লিগস কাপ খেলতে গেল, কে ভেবেছিল টুর্নামেন্টের শেষ দৃশ্যে শিরোপা উঠবে এই দলের অধিনায়কের হাতে! অথবা ইউএস ওপেন কাপের সেমিফাইনালে, মেজর লিগ সকারের সেরা দল সিনসিনাটির বিপক্ষে যখন নির্ধারিত সময়ের পর যোগ করা সময়ের সপ্তম মিনিটেও দলটি পিছিয়ে আছে ২-১ ব্যবধানে, কে ভেবেছিল, সেই দলটিই শেষ পর্যন্ত যাবে ফাইনালে!

লিগস কাপ বা ইউএস ওপেন কাপ, প্রতিযোগিতার নাম ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু প্রায় প্রতিটা ক্ষেত্রেই ম্যাচের নায়কের নাম অভিন্ন।

নামটা আপনি জানেন।

২.

গত মাসে যখন মায়ামির জার্সিতে প্রথমবারের মতো মাঠে নামছেন লিওনেল মেসি, তাকেই তখন দেখা হচ্ছিল একটা ভাঙাচোরা দলের সম্ভাব্য ত্রাণকর্তা হিসেবে। আর্জেন্টিনা, বার্সেলোনা, প্যারিস সেইন্ট-জার্মেইনকে বারবার বিপদের শঙ্কা থেকে টেনে তুলেছেন মেসি, ইন্টার মায়ামিতেও সেটা দেখার প্রত্যাশা ছিল সবার। কিন্তু মূল প্রশ্নটা ছিল, দলকে টেনে তুলতে ঠিক কত সময় নেবেন তিনি!

উত্তরটা পাওয়া গেল দ্রুতই। খুব বেশি না, মেসির সময় লাগলো মাত্র চল্লিশ মিনিট। মেক্সিকান ক্লাব ক্রুজ আজুলের বিপক্ষে ১-০ ব্যবধানে এগিয়ে থাকা ইন্টার মায়ামি তাদের অগ্রগামিতা হারিয়েছিল দ্বিতীয়ার্ধে মেসি নামার পরপরই। সমতার পথে এগোতে থাকা ম্যাচের শেষ চালটা চাললেন লিওনেল মেসি নিজেই, ৯৪তম মিনিটে বক্সের সামান্য বাইরে থেকে নেওয়া তাঁর ফ্রি-কিক জড়িয়ে গেল জালে। অভিষেকেই বাজিমাত!

অভিষেকেই মেসির বাজিমাত; Image Source: Getty Images

এবার একটু ফাস্ট ফরোয়ার্ড করা যাক, ঠিক আটাশ দিন তেইশ ঘণ্টা আটাশ মিনিট পরে। লিগস কাপের ফাইনালের প্রথমার্ধে বক্সের বাইরে থেকে অসাধারণ শটে গোল করলেন মেসি, টুর্নামেন্টে এবং ইন্টার মায়ামির জার্সিতে দশমবারের মতো। পরে টাইব্রেকারে ফাইনাল জিতে নিজেদের পাঁচ বছরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো শিরোপার স্বাদ পেলো ইন্টার মায়ামি।

একই গল্পের পুনরাবৃত্তি করেছেন ন্যাশভিল কোচ,

“ম্যাচে এমন কিছু মুহূর্ত আসে, যখন লিওনেল মেসিকে থামানো খুব কঠিন হয়ে পড়ে। উনি যেটা করতে চান, সেটা তিনি করেই ছাড়েন, ঐ সময়ে তাকে আটকে রাখা প্রায় অসম্ভব।”

-গ্যারি স্মিথ, কোচ, ন্যাশভিল

লিগস কাপের ফাইনালের প্রথম ২২ মিনিট ৫৭ সেকেন্ড চমৎকারভাবে মেসিকে আটকে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন ন্যাশভিলের খেলোয়াড়রা। বিপজ্জনক জায়গায় মেসির পায়ে বল পৌঁছাতে দিচ্ছিলেন না তারা, রক্ষণের দারুণ সমন্বয়ে মেসিকে যেন কিছুটা নিষ্প্রভই দেখাচ্ছিল। মেসিকে আটকে রেখে বরং মায়ামির অন্য খেলোয়াড়দের আক্রমণে ওঠার সুযোগ করে দিচ্ছিল ন্যাশভিল, মেসিও তাই বলের খোঁজে কখনো রাইট উইং, কখনো লেফট উইংয়ে ঘুরছিলেন, আবার নেমে আসছিলেন মাঝমাঠেও।

ফাইনালে অবিশ্বাস্য এক গোল করেন লিওনেল মেসি; Image Source: Getty Images

তবে যেই মুহূর্তে বলের স্পর্শ পেলেন তিনি, তার সময় লাগলো মাত্র তিন সেকেন্ড, আর চারটা স্পর্শ। প্রথম স্পর্শে বলের নিয়ন্ত্রণ নিলেন, দ্বিতীয় স্পর্শে ছিটকে ফেললেন ন্যাশভিলের রক্ষণভাগের খেলোয়াড় ওয়াকার জিমারম্যানকে, তৃতীয় স্পর্শে বলের নিয়ন্ত্রণ রাখলেন নিজের কাছে, আর চতুর্থ শটে, বুম! বক্সের বাইরে থেকে নেওয়া মেসির নিখুঁত শটটা প্রতিপক্ষ গোলরক্ষককে পরাস্ত করে লুটোপুটি খেলো জালে।

এই দুটো গোলের মাঝে মেসি করেছেন আরো আটটি গোল। আটলান্টা ইউনাইটেড আর অরল্যান্ডো সিটির বিপক্ষে জোড়া গোল করে দলকে এগিয়ে নিয়েছিলেন, ডালাসের বিপক্ষে প্রথম গোলে দলকে এগিয়ে নিয়ে দ্বিতীয় গলে ফিরিয়েছেন সমতায়, শার্লটের কফিনে পুঁতেছেন শেষ পেরেক। অরল্যান্ডো সিটি আর শার্লটের বিপক্ষে আবার পেনাল্টি পেয়েও নিজে নেননি, গোলখরায় ভুগতে থাকা সতীর্থ স্ট্রাইকার জোসেফ মার্তিনেজকে দিয়েছেন গোল করার সুযোগ। তাতে আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছিলেন মার্তিনেজ, সেমিফাইনালে ফিলাডেলফিয়ার বিপক্ষে দলকে এগিয়ে দিয়েছিলেন চমৎকার গোলে, একই কাজ করেছিলেন ইউএস ওপেন কাপের সেমিফাইনালে সিনসিনাটির বিপক্ষেও।

মেসি শুধু একাই খেলছেন না, যেন সাথে খেলাচ্ছেন পুরো ইন্টার মায়ামি দলকেই!

৩.

২০০৭ সালে যখন মেজর লিগ সকারে নাম লেখাচ্ছেন ডেভিড বেকহ্যাম, তখনই তার চুক্তিপত্রে ছিল ২৫ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে লিগে নতুন ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রয়ের সুযোগ। সেই সুযোগটা যখন বেকহাম গ্রহণ করছেন, ততদিনে সাত বছর কেটে গেছে। এর চার বছর পরে, ২০১৮ সালে, তিনি এবং আমেরিকান ব্যবসায়ী হোর্হে মাস মিলে ঘোষণা দিলেন, ইন্টার মায়ামি নামের সেই নতুন দলটার আবির্ভাব ঘটতে চলেছে আমেরিকার ফুটবলে। তবে দল হিসেবে আবির্ভাব ঘটলেও, মাঠে নামতে নামতে আরো দুটো বছর কেটে গেল। ২০২০ সালে যখন প্রথমবারের মতো মেজর লিগ সকারের ইস্টার্ন কনফারেন্সে খেলতে নামলো ইন্টার মায়ামি, তখন বিশ্বজুড়ে চলছে কোভিড-১৯ নামক মহামারী। বলে রাখা ভালো, মেজর লিগ সকারের ২৯টা দল এই প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় দুটো ভাগে ভাগ হয়ে। ইস্টার্ন কনফারেন্সের অধীনে রয়েছে ১৫টি দল, বাকি ১৪টি দল খেলে ওয়েস্টার্ন কনফারেন্সে।

এই মহামারী, এবং পরের বছরের একটা নিয়মভঙ্গের অভিযোগ, সব মিলিয়ে শুরুটা ঠিক মনের মতো হয়নি ইন্টার মায়ামির জন্য। তাই ক্লাব প্রতিষ্ঠার পাঁচ বছরের মাথায় যখন প্রথমবারের মতো ট্রফির ছোঁয়া পেল দলটি, সেটিও নিজেদের সাথেই এমএলএসে খেলতে শুরু করা দলটির বিপক্ষে, ব্যাপারটাকে খানিকটা ‘পোয়েটিক জাস্টিস’ বলেই মনে হতে বাধ্য।

Image Source: Getty Images

“আশা করছি, এই ট্রফিটা হবে আমাদের অনেক ট্রফির মধ্যে প্রথমটা। একটা অসাধারণ রাত… আর এই রাতটাই আমাদের প্রজেক্টের প্রথম দৃশ্যমান সাফল্য।”

-হোর্সে মাস, সহপ্রতিষ্ঠাতা, ইন্টার মায়ামি

মাঠের খেলায় মায়ামির অবস্থা খুব ভালো ছিল না কখনোই। আগেই যেমনটা বলা হয়েছে, ট্রফির ছোঁয়া তো দূরের কথা, মেজর লিগ সকারের সম্মিলিত পয়েন্ট টেবিলের সেরা দশেও কখনো ঢুকতে পারেনি দলটি। লিওনেল মেসির আগমন তাই ঠিক কতটা পাল্টে দিয়েছে দলটিকে, সেটা আর না বললেও চলছে! প্রথম ট্রফিজয়ের পালা তো সাঙ্গ হয়েছেই, এখন দলটা স্বপ্ন দেখছে শুধুই ওপরের দিকে যাওয়ার। আর শুধু ইন্টার মায়ামি ফুটবল দলই নয়, মেসি পাল্টে দিতে শুরু করেছেন পুরো মেজর লিগ সকারকেই। কে জানে, হয়তো আমেরিকার ফুটবলের গতিপথটাই পাল্টে দেবেন মেসি!

৪.

ঘড়ির কাঁটায় তখন ৮৫ মিনিট।

এফসি ডালাসের বিপক্ষে ৪-৩ ব্যবধানে পিছিয়ে রয়েছে ইন্টার মায়ামি। বক্সের ঠিক বাইরে ফ্রি-কিক নেওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন লিওনেল মেসি। রেফারি বাঁশিতে ফুঁ দিলেন, মেসির বাঁ পায়ের শটটা সামনের মানবদেয়ালের মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গিয়ে পরাস্ত করলো গোলরক্ষকে। গোল!

সতীর্থরা ছুটলেন মেসির দিকে। মেসি কিন্তু কর্নার পতাকার দিকে ছুটলেন না, সেই পরিচিত উদ্বাহু দৌড়ের উদযাপনও নেই। মেসি দ্রুত ছুটছেন নিজেদের অর্ধে, হাত নেড়ে সবাইকে ডাকলেন দ্রুত নিজেদের অর্ধে ফেরার জন্য। আরো একটা গোল তো করতে হবে অন্তত, সময় যে বেশি বাকি নেই!

গোল করেই কাজ শেষ হয়নি মেসির, দলকে যে জেতাতেও হবে! Image Source: Getty Images

“মেসির জয়ের ক্ষুধাটা এখনো আগের মতোই আছে।”

-জেরার্দো মার্তিনো, কোচ, ইন্টার মায়ামি

এর আগে বার্সেলোনাতে মেসিকে কোচিং করিয়েছেন মার্তিনো, অভিজ্ঞতা আছে আর্জেন্টিনার জাতীয় দলের দায়িত্ব নেওয়ারও। মেসিকে বেশ ভালোই চেনেন এই আর্জেন্টাইন, আর চেনেন বলেই বলতে পারছেন, মাঠের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এখনো ফুরিয়ে যাননি মেসি।

Image Source: Getty Images

অবশ্য ফুরিয়ে যাওয়ার কথাও নয়।

লিওনেল মেসির মতো মহাতারকারা নিজেদের কাজটা খুব ভালো বোঝেন। জানেন, ঠিক কোন মুহূর্তে, কীভাবে ম্যাচটাকে ঘুরিয়ে দেওয়া যায়, নিশ্চিত পরাজয়ের ম্যাচকেও টেনে আনা যায় নিজেদের দিকে। দলের প্রয়োজনে মেসি তাই কখনো নিচ্ছেন গোলস্কোরারের ভূমিকা, আবার কখনো তিনিই প্লে-মেকার হয়ে খেলাটাকে পরিচালনা করছেন, বল বানিয়ে দিচ্ছেন ফরোয়ার্ডদের উদ্দেশ্যে। অরল্যান্ডো সিটির বিপক্ষে আবার দেখা গেল অন্য মেসিকে, যে মেসি ট্যাকল করছেন প্রতিপক্ষকে। ফিলাডেলফিয়ার বিপক্ষে দ্বিতীয়ার্ধে যখন প্রতিপক্ষের আঘাতে দলের তরুণ খেলোয়াড় নোয়াহ অ্যালেন মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছেন, অধিনায়ক মেসি সামনে গিয়ে এর প্রতিবাদ করছেন, চোখে চোখ রেখে কথা বলছেন আঘাতকারী হোসে মার্তিনেজের সাথে। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, ম্যাচের পরে টানেলেও মার্তিনেজের সাথে কথা কাটাকাটি হয়েছে মেসির।

ইন্টার মায়ামির এই দলটাকে যেন একেবারে নিজের করে নিয়েছেন লিওনেল মেসি!

আরো একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। মেসিকে দর্শকদের সামনে প্রথমবারের মতো উপস্থাপন করার অনুষ্ঠানের টিকেট পাচ্ছিলেন না তারই সতীর্থ লিওনার্দো কাম্পানা। দলের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হওয়ার পরপরই ব্যাপারটা জানতে পেরে মেসি নিজেই তাকে টিকেটের ব্যবস্থা করে দেন। শুধু তাই নয়, ইন্টার মায়ামির প্রত্যেক খেলোয়াড়কে কালো-গোলাপি বর্ণের বিশেষ হেডফোনও উপহার দিয়েছিলেন মেসি। সতীর্থরাও তাই স্বাভাবিকভাবেই মুগ্ধ।

Image Source: Miami Total Futbol

“ব্যাপারটা এমন হতে পারতো যে, মেসি এলেন, এবং তিনি নিজের কাজটা তার মতো করে গেলেন। কিন্তু না, মেসি আসার পরই দারুণভাবে নিজেকে মানিয়ে নিলেন দলের সাথে। সিনিয়রদের সাথে মিশলেন, জুনিয়রদের সাথে মিশলেন, যেন তিনি শুধুই আরেকজন সাধারণ খেলোয়াড়। হ্যাঁ, খেলোয়াড় হিসেবে তাঁর প্রতি আমার অসীম শ্রদ্ধা আগেও ছিল, কিন্তু তার সাথে খেলার পর থেকে আমি মানুষ হিসেবেও তাকে অসম্ভব সম্মান করি। উনি মানুষ হিসেবে অসাধারণ, অবিশ্বাস্য।”

-ডিআন্দ্রে ইয়েডলিন, সাবেক অধিনায়ক, ইন্টার মায়ামি

মেসির আগমনের আগ পর্যন্ত ইন্টার মায়ামির অধিনায়কের বাহুবন্ধনীটা ছিল এই ইয়েডলিনের কাছেই, মহাতারকার আগমনে তাকেই বাহুবন্ধনীটা পরিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। সেই বাহুবন্ধনীটা ফিরিয়েও দিলেন মহাতারকা, ট্রফি জয়ের পরে নিজের বাহুবন্ধনী খুলে পরিয়ে দিলেন ইয়েডলিনকে। এরপর দু’জনে মিলে উঁচিয়ে ধরলেন দলের ইতিহাসের প্রথম শিরোপা।

মেসি নয়, বাহুবন্ধনী শোভা পাচ্ছে ইয়েডলিনের হাতে; Image Source: Apple TV

ফুটবলার হিসেবে ইয়েডলিন যথেষ্ট অভিজ্ঞ, চর্মগোলকের সাথে বহুদিন ধরেই তার জানাশোনা, তবুও মেসি-বুসকেটস-আলবাদের সতীর্থ হিসেবে পাওয়াটা তার কাছে স্বপ্নের মতোই। ১৮ বছর বয়সী বেনহামিন ক্রিমাস্কি অবশ্য এই ত্রয়ীর সাথে খেলাটা চাপ হিসেবে নিতে চান না, তিনি জপছেন উপভোগের মন্ত্রটাই।

“পাগলাটে ত্রিশটা দিন কাটালাম। কীভাবে যে ত্রিশটা দিন কেটে গেল, কী কী যে ঘটলো, এখনো ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। তবে সত্যি বলতে, আমি ভীষণ উপভোগ করেছি এই ত্রিশটা দিন। আশা করি, আমাদের এই অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকবে।”

-বেনহামিন ক্রিমাস্কি, ফুটবলার, ইন্টার মায়ামি

পাগলাটেই তো।

লিগস কাপটা একাই জেতালেন, ইউএস ওপেনের ফাইনালেও তুললেন দলকে। সেটিও মেজর লিগ সকারের সেরা দল সিনসিনাটির বিপক্ষে, নিজের প্লে-মেকার সত্ত্বাকে পুরোপুরি প্রদর্শন করে। আগের ম্যাচগুলোর মতো প্রতিপক্ষের বক্সের আশেপাশে জায়গা পাচ্ছিলেন না মেসি, তাই বাধ্য হয়েই নিচে নেমে আসছিলেন বারবার। এর মধ্যেই বার দুয়েক কাঁটা কম্পাসে মাপা ক্রস ফেললেন দীর্ঘদেহী ফরোয়ার্ড লিওনার্দো কাম্পানার মাথায়, তাতেই কাজ হয়ে গেল। লিগস কাপের ফাইনালের মতো এখানেও বাকি কাজটা সারলেন গোলরক্ষক ড্রেক ক্যালেন্ডার, টাইব্রেকারে প্রতিপক্ষের শট ঠেকিয়ে বীরত্বের ভাগটাও বুঝে নিলেন।

সব মিলিয়ে, মাঠের মেসি এখন চনমনে, মাঠের বাইরে নির্ভার। ৮ ম্যাচে ১০ গোল পেয়ে গেছেন, সাথে পেছেন ৩টা অ্যাসিস্টও। মাঠের বাইরেও পাচ্ছেন অকুণ্ঠ সম্মান আর ভালোবাসা। আমেরিকা-জীবনের শুরুটা যে এতটা ভালো হবে, মেসি হয়তো নিজেও সেটা ভাবেননি। আর মেসির এই চনমনে রূপের রহস্যটা ফাঁস করেছেন তার এক সময়ের আর্জেন্টাইন সতীর্থ নাহুয়েল গুজমান, যদিও সেটা আন্দাজ করাটা যেকোন ফুটবলপ্রেমীর জন্যই সহজ।

“বিশ্বকাপ জয়ের পর মেসির ওপর আর কোন চাপ নেই এখন। রীতিমতো হাওয়ায় ভেসে চলছে ও এখন।”

-নাহুয়েল গুজমান, সাবেক গোলরক্ষক, আর্জেন্টিনা
লিগস কাপের সর্বোচ্চ গোলদাতা লিওনেল মেসি, সেরা খেলোয়াড়ও; Image Source: Getty Images

কিন্তু যাকে নিয়ে এত কথা, সেই লিওনেল মেসি নিজে কী বলছেন? লিগস কাপের ফাইনালের আগে সংবাদ সম্মেলনে কথা বলেছিলেন মেসি, বলেছিলেন বার্সেলোনা-পিএসজি-মায়ামি জীবন নিয়ে।

“প্রথম থেকেই যেমনটা বলে আসছি, আমি এই শহরে এসেছি নিজের ইচ্ছায়। এই সিদ্ধান্তটা আমারই, আমি অনেক ভেবেচিন্তেই এখানে এসেছি। প্যারিসে যাওয়াটা যেমন শেষ মুহূর্তের সিদ্ধান্ত ছিল, এটা তেমন কিছু না। আমি বার্সেলোনা ছাড়তে চাইনি কখনোই, প্যারিসে যাওয়ার সিদ্ধান্তটাও আমার ইচ্ছায় ছিল না। বার্সেলোনায় পুরোটা জীবন কাটানোর পরে প্যারিসে যেয়ে আমাকে নতুন করে মানিয়ে নিতে হয়েছে। ব্যাপারটা খুব একটা সহজ ছিল না, মাঠে এবং মাঠের বাইরে। তবে এই মুহূর্তে যেটা ঘটছে, সেটা প্যারিসের ঘটনার সম্পূর্ণ বিপরীত।”

-লিওনেল মেসি।

মেসি কথা বলেছিলেন তার নিত্যনতুন উদযাপনের ব্যাপারে।

“আমার তিন ছেলে এখনো ছুটিতে, ওদের স্কুল এখনো শুরু হয়নি। তাই প্রতি রাতে আমরা একসাথে মার্ভেলের সুপারহিরো মুভি দেখি। ওরাই আমাকে বুদ্ধি দিয়েছিল, যেন ম্যাচে গোল করতে পারলে আমি মার্ভেলের সুপারহিরোদের মতো উদযাপন করি। সেখান থেকেই এই উদযাপনের শুরু। তবে এই উদযাপনটা আমি শুধু হোম ম্যাচেই করি, কেননা তখন আমার ছেলেরা মাঠে থাকে, আমার কাছাকাছি। ওদেরকে গ্যালারিতে দেখতে পেলেই কেবল আমি এই উদযাপন করি।”

-লিওনেল মেসি
পর্দার সুপারহিরোদের মতোই উদযাপন চলছে মেসির; Image Source: Apple TV

বোঝাই যাচ্ছে, বিশ্বকাপ জয়ের পর ফুরফুরে মেসি এখন পুরোমাত্রায় উপভোগ করছেন জীবনকে। আর চাপহীন মেসি যে কতটা ভয়ঙ্কর, সেটাই এখন অবাক চোখে অবলোকন করছে ফুটবলবিশ্ব, হয়তো প্রথমবারের মতোই। ফ্রি-কিকে এই মেসি অপ্রতিরোধ্য, পেনাল্টিতে তিনি ঠাণ্ডা মাথার খুনি। গোল করার ক্ষেত্রে তিনি বিধ্বংসী, প্লেমেকিংয়ে সেই তিনিই অর্কেস্ট্রোর পরিচালক। মাঠে আর মাঠের মেসিই নেতা, সতীর্থ আর সমর্থকদের শেষ ভরসার জায়গা। এই মেসি দুর্দান্ত, এই মেসি দুর্বার। জাদুটা তার পায়ে অনুমেয়, জাদুর ধরনটা অননুমেয়। অসম্ভবও এখানে সহজসাধ্য, রূপকথা লেখা হয় আঙুলের তুড়িতে।

রূপকথার এই রাজপুত্রের খোঁজেই তো এতদিন ছিল ইন্টার মায়ামি!

[সকল তথ্য ও পরিসংখ্যান ২৬ আগস্ট ২০২৩ পর্যন্ত]

This article is in Bangla language. It is inspired from an English article published in the Athletic, based on the changes Lionel Messi brought to Inter Miami, one of the teams of Major League Soccer. Necessary images are inserted inside the article.

Necessary Source: The Athletic
Featured Image: Getty Images

Related Articles

Exit mobile version