ফুটবলের সবচেয়ে জনপ্রিয় আসর বিশ্বকাপ ফুটবলের শুরু হয়েছিলো ১৯৩০ সালে, লাতিন আমেরিকার উরুগুয়েতে। ঐতিহাসিক বিশ্বকাপে সর্বপ্রথম ম্যাচে মেক্সিকোকে ৪-১ গোলে হারায় ফ্রান্স দল। ফুটবলের ঐতিহাসিক ও স্মরণীয় এই ম্যাচটিতে ‘লে ব্লু’ বা ‘দ্য ব্লু’দের অধিনায়ক ছিলেন আলজেরিয়ান বংশোদ্ভূত অ্যালেক্সান্ডার ভিলাপ্লেন। ফ্রান্সে এক সময়ের তুমুল জনপ্রিয় এই খেলোয়াড়ের জন্য ভক্তরা যেমন পাগল ছিলো, তেমনি ফ্রান্স ফুটবল দলের অধিনায়কের আর্মব্যান্ড পরতে পেরে উচ্ছ্বসিত ভিলাপ্লেন বলেছিলেন, “জীবনের সবচেয়ে আনন্দের দিন”।
ফুটবলে আজকের দিনে আমরা নায়ক থেকে ভিলেন বলতে বুঝি গোল দিয়ে দলকে এগিয়ে নেওয়ার পর আবার পেনাল্টির সহজ সুযোগে গোল করতে না পারা। কিন্তু ভিলাপ্লেনের কর্মকাণ্ডের কাছে এই ব্যাপারটিও নিছক তুচ্ছ ও সস্তা হয়ে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে হিটলার ফ্রান্স আক্রমণ করার মাত্র ৬ সপ্তাহের মধ্যে ১৯৪০ সালে দখল করে নেয় দেশটি। নাৎসি বাহিনীর ফ্রান্স দখলের পর ফুটবলার ভিলাপ্লেন ফ্রান্স ফুটবল দলের অধিনায়কের আর্মব্যান্ড খুলে রেখে তুলে নেন হিটলারের সুৎসটাফেল বা এসএস বাহিনীর আর্মব্যান্ড। শুরু হয় ভিলাপ্লেনের জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়। যে অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটে ফ্রান্স মুক্ত হওয়ার পর ফায়ারিং স্কোয়াডে তার মৃত্যুদণ্ডের মধ্য দিয়ে, আখ্যানটি একজন ফুটবলার, জঘন্য বিশ্বাসঘাতক, নিষ্ঠুর নাৎসি সমর্থক ও হিংস্র মানুষের।
প্রথম অধ্যায়: ফুটবলার ভিলাপ্লেন
আফ্রিকার আলজেরিয়াতে ১৯০৫ সালে জন্ম অ্যালেক্স ভিলাপ্লেনের, যিনি ছিলেন ফ্রান্সে শ্রমিক শ্রেণীর আলজেরিয়ান অভিবাসী পরিবারের সন্তান। ভিলাপ্লেন ছিলেন ফ্রান্স দলের প্রথম উত্তর আফ্রিকান খেলোয়াড়। ১৯২১ সালে মাত্র ১৬ বছর বয়সে চাচার সাথে ফ্রান্সের দক্ষিণ উপকূলে চলে আসেন তিনি, এরপর সদ্য গঠিত ক্লাব এফসি সেতে’তে যোগ দেন।
প্রতিভা চিনতে ভুল করেননি ক্লাবটির স্কটিশ খেলোয়াড়-ম্যানেজার ভিক্টর গিবসন। ভিলাপ্লেনকে দ্রুতই মূল দলে জায়গা করে দেন গিবসন। ফ্রান্সে তখনো পেশাদার ফুটবল অনুমোদন পায়নি, কিন্তু ক্লাব মালিকেরা খেলোয়াড়দের বেতন দেওয়ার কোনো না কোনো উপায় বের করে ফেলতেন। এই ক্লাব থেকেই ভাগ্যের পরিবর্তন শুরু হয় ভিলাপ্লেনের, অর্থের মুখ দেখতে শুরু করেন তিনি। ফ্রেঞ্চ কাপের সেমিফাইনালে সেতে জায়গা করে নেয়, যেখানে ভিলাপ্লেনের বিশাল অবদান ছিলো। ১৯২৭ সালে এই আলজেরিয়ানকে দলে টেনে নেয় এফসি সেতে ক্লাবটির চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ফুটবল ক্লাব নিম, যেখানে আরও বেশি আয় করতেন তিনি।
ভিলাপ্লেনের দক্ষতা তাকে ধীরে ধীরে খ্যাতির শীর্ষে আরোহণের দুয়ার খুলে দেয়। মিডফিল্ডার হিসেবে ভিলাপ্লেন ছিলেন দারুণ পরিশ্রমী খেলোয়াড়, সেই সাথে ছিলো অসাধারণ ট্যাকলের ক্ষমতা ও গোলের সুযোগ তৈরি করে দেওয়ার দারুণ দক্ষতা। তৎকালীন ফ্রান্সে তাকে অন্যতম সেরা হেডার ও মাঝমাঠের একজন দক্ষ সেনানী বিবেচনা করা হতো।
নিমে যোগ দেওয়ার পূর্বেই অবশ্য প্রতিভার খাতিরে জাতীয় দলে জায়গা করে নেন ভিলাপ্লেন। ১৯২৬ সালে বেলজিয়ামের বিপক্ষে খেলাটি ছিলো তার প্রথম ম্যাচ। ১৯২৭ সালে ভিলাপ্লেন যখন ইনজুরিতে আক্রান্ত হন, তখন ফ্রান্স দলে তার অনুপস্থিতি প্রবলভাবে টের পাওয়া যায়। ভিলাপ্লেন বিহীন ফ্রান্স দল পর্তুগালের কাছে ৪-০, স্পেনের বিপক্ষে ৪-১ এবং চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৬-০ গোলে পরাজিত হয়। হাঙ্গেরির বিপক্ষে ফ্রান্সের ১৩-১ গোলের ব্যবধানের ম্যাচটিতেও ছিলেন না ভিলাপ্লেন।
নিম থেকে দেশজোড়া খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে ভিলাপ্লেনের, পেতে থাকেন সমর্থকদের অকুণ্ঠ সমর্থন ও ভালোবাসা। ইতিহাসের প্রথম বিশ্বকাপে ফ্রান্স অংশগ্রহণের কিছুকাল পূর্বে দলটির অধিনায়ক নির্বাচিত হন ভিলাপ্লেন, যার অধীনে বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম ম্যাচ জিতে স্মরণীয় করে রাখে ফ্রান্স। রেসিং ক্লাব প্যারিসের নতুন প্রেসিডেন্ট বার্নান্ড লেভি দায়িত্ব শুরু করেন উচ্চাকাঙ্ক্ষা নিয়ে, তার স্বপ্ন ছিলো ক্লাবটিকে দেশের সেরা দলে পরিণত করা এবং অবশ্যই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ফ্রেঞ্চ ক্লাব রেড স্টারের বিপক্ষে একটি শক্তিশালী দল হিসেবে আবির্ভূত হওয়া। লেভি তার স্বপ্ন পূরণের জন্য প্রাধান্য দিয়েছিলেন ভিলাপ্লেনকে রেসিং ক্লাব প্যারিসে যোগ দেওয়ানো। ১৯২৯ সালে রেসিং ক্লাব প্যারিসে যোগ দেন ভিলাপ্লেন। এই প্যারিস থেকেই উন্মোচিত হয় তার দুর্দমনীয় অর্থের লোভ, উচ্চাভিলাষী ও অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের কলুষিত অধ্যায়।
প্যারিসে সদ্য যোগ দেওয়া ক্লাবে দু’হাতে অর্থ কামানো শুরু করেন ভিলাপ্লেন। অর্থ ও খ্যাতির সাথে বদলে যায় ভিলাপ্লেনের জীবনযাপনের ধরণ। নিয়মিত ক্যাসিনো ও সরাইখানায় যেতে শুরু করলেন তিনি। সেই সাথে জড়িয়ে পড়েন ঘোড়া দৌড় প্রতিযোগিতায় জুয়াড়িদের সাথে এবং এখান থেকেই আন্ডারওয়ার্ল্ডের মাফিয়াদের সাথে তার ওঠাবসা শুরু হয়। তর্কাতীতভাবে ফুটবলের প্রথম ‘ব্যাড বয়’ বলা হয় ভিলাপ্লেনকে। উরুগুয়ে বিশ্বকাপের পর আর মাত্র একটি ম্যাচ খেলেছিলেন তিনি, প্রদর্শনী ম্যাচে স্বাগতিক ব্রাজিলকে ৩-২ গোলে পরাজিত করে ফ্রান্স। এরপর মাত্র ২৪ বছর বয়সে আচমকা জাতীয় দল থেকে অবসর নেন তিনি, ফ্রান্সের হয়ে খেলেছিলেন মাত্র ২৬টি ম্যাচ।
১৯৩২ সালে ফ্রান্সে পেশাদার ফুটবল চালু হলে ভিলাপ্লেন যোগ দেন ফুটবল ক্লাব অ্যান্টিবে। তখন ফ্রান্সে চ্যাম্পিয়নশিপ দু’ভাগে বিভক্ত ছিলো, দক্ষিণাঞ্চল ও উত্তরাঞ্চল। দুই বিভাগের চ্যাম্পিয়ন দল চ্যাম্পিয়নশিপ শিরোপার জন্য একে অপরের মুখোমুখি হতো পরবর্তীতে। দক্ষিণাঞ্চলের চ্যাম্পিয়ন অ্যান্টিব শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচে এফসি ফাইবস লিলে দলকে পরাজিত করে শিরোপা জিতে নেয়। কিন্তু পরবর্তীতে ম্যাচ ফিক্সিংয়ের অভিযোগে অ্যান্টিবের শিরোপা বাতিল করা হয়। একই অভিযোগে চাকরি হারান ক্লাবটির ম্যানেজার, যদিও বলা হয়ে থাকে কোচ পরিস্থিতির শিকার হয়েছিলেন এবং ম্যাচ ফিক্সিংয়ের মূল হোতা ছিলেন ভিলাপ্লেন ও তার সাবেক ক্লাব সেতের দুই সতীর্থ। তিনজনকেই ক্লাব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
এতকিছুর পরও ভিলাপ্লেনকে লুফে নেয় নিস। কিন্তু নিজেদের ভুল বুঝতে বেশি সময় লাগেনি ক্লাবটির। ঝামেলা ভিলাপ্লেনের পিছু ছাড়েনি, হয়তো তিনিই সবকিছু আরও লেজে-গোবরে করে ফেলেছিলেন তার উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপনের মাধ্যমে। নিসে থাকাকালীন সময়ে তিনি প্রায়ই প্রশিক্ষণে অংশ নিতেন না, ম্যাচে অংশগ্রহণ করতেন না এবং অধিনায়ক হওয়া সত্ত্বেও দলের মূল লক্ষ্যের সাথে তার তেমন একটা আত্মনিয়োগ ছিলো না।
লিগ থেকে নিস অবনমিত হয় এবং ক্লাবটি ভিলাপ্লেনকে ছাটাই করে। মদ-জুয়া, ক্যাসিনো ও ঘোড়ার দৌড়ের জুয়ারিদের সাথে তার সম্পর্ক যতটা নিবিড় হতে থাকে, ফুটবল থেকে তিনি ততটাই দূরে সরে এসেছিলেন সেই সময়। জোয়ারের উচ্ছ্বাসে যে ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন তিনি, তা ক্রমশই ভাটায় পরিণত হতে বেশি সময় লাগেনি। নিস থেকে বরখাস্ত হওয়ার পর সাবেক গুরুর বদান্যতায় অবশেষে ১৯৩৪ সালে দ্বিতীয় ডিভিশনের ক্লাব বোর্দোতে সুযোগ হয় তার, যেখানে কোচ হিসেবে ছিলেন গিবসন। এই ক্লাবেও তার অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন ও অপেশাদার আচরণ অব্যাহত ছিলো। ১৯৩৫ সালে ঘোড়ার দৌড়ে ফিক্সিং এর অভিযোগে জেলে হয় ভিলাপ্লেনের। ক্যারিয়ারের এই পর্যায়ে এসেও সুযোগ কাজে লাগাতে ব্যর্থ হন ভিলাপ্লেন। অবশেষে গিবসনও বাধ্য হন তাকে বরখাস্ত করতে। ফুটবল থেকে চিরতরে হারিয়ে যান অসাধারণ এক ফুটবলার।
দ্বিতীয় অধ্যায়: ফ্রেঞ্চ গেস্তাপো এবং কুখ্যাত নাৎসি সমর্থক ভিলাপ্লেন
১৯৪০ সালের জুনে প্যারিস হিটলারের দখলে চলে আসে, বদলে যায় গোটা শহরের পরিস্থিতি। চিরতরে সবকিছু হারিয়ে যেমন প্যারিসবাসী পথে বসতে শুরু করে, তেমনি যুদ্ধের এই সময়টা চোরাকারবারি ও অনেক সন্ত্রাসীদের জন্য সুবর্ণ সুযোগ হয়ে আসে। এমনই এক স্থানীয় সন্ত্রাসী ছিলেন হেনরি লাফোন্ট, বেলজিয়ান প্রতিরোধক বাহিনীর প্রধানকে হত্যা করে নাৎসি বাহিনীর সাথে শখ্যতা গড়ে তোলেন যিনি।
অরাজকতার সুযোগে জেল থেকে সাবেক সহযোগী ও অনেক অপরাধীদের ছাড়িয়ে নিয়ে নিজের কার্যসিদ্ধি করা শুরু করলেন তিনি। প্যারিসের একসময়ের বিখ্যাত পুলিশ অফিসার পিয়েরে বনি দুর্নীতির অভিযোগে সাজাপ্রাপ্ত ও বরখাস্ত হয়েছিলেন, লাফোন্টের ডান হাত হিসেবে উত্থান ঘটে তার। অন্যদিকে আন্ডারওয়ার্ল্ডের মাফিয়াদের সাথে যোগাযোগের দরুন স্বর্ণ চোরাচালানের কাজ করতেন তখন ভিলাপ্লেন। ঘটনাচক্রে এই তিনজন মিলে গড়ে তোলে একটি দল, যারা নাৎসিদের সার্বিক সহযোগিতা করতে লাগলো। ৯৩, রু লারিস্টনে গড়ে উঠলো দলটির সদর দপ্তর, যারা কুখ্যাত ফ্রেঞ্চ গেস্তাপো নামে।
ফ্রেঞ্চ গেস্তাপো এই দলটি এসএস বাহিনীর ইউনিফর্ম গায়ে চড়িয়ে নাৎসিদের হয়ে সকল অপকর্ম করে বেড়াতো। হিটলারের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা ছিলো না, দলটির একমাত্র উদ্দেশ্য ছিলো ধনী হওয়ার। ধনী হওয়ার জন্য তারা নাৎসি বাহিনীকে যতভাবে সম্ভব সহযোগিতা করার তা করতো এবং হিটলারের বাহিনীর চাহিদা পূরণ করে নিজেদের আখের গুছিয়ে নিতো। ইহুদি নিধন, ইহুদি খুঁজে বের করে বন্দি করা, ফ্রান্সের প্রতিরোধক বাহিনীর উপরে আক্রমণ এবং বন্দিদের ফ্রেঞ্চ গেস্তাপোর সদর দপ্তরে নির্যাতন- এহেন কোনো কাজ ছিলো না যা তারা করতে দ্বিধা করতো।
১৯৪৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে ফ্রান্সে উত্তর আফ্রিকানরা মিলে তখন গড়ে তুলেছিলো Brigade Nord Africain (BNA), যার একটি অংশের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন ভিলাপ্লেন। ফ্রেঞ্চ গেস্তাপোর ভিলাপ্লেনের এই ইউনিট তাদের নিষ্ঠুরতার জন্য খুব দ্রুত কুখ্যাত হয়ে উঠে। যে ভিলাপ্লেন একসময় গায়ে ফ্রান্সের জার্সি পরে প্রতিপক্ষ শিবিরে ত্রাস ছড়িয়ে বেড়াতো, সেই লোকটি তখন প্রতিপক্ষের উর্দি গায়ে দিয়ে স্বদেশী ঘায়েল করে বেড়াচ্ছিলো।
১১ই জুন, ১৯৪৪ সালে ভিলাপ্লেনের দলের হাতে ১১ জন যোদ্ধা ধরা পড়ে, যাদের বন্দি করে খাদের কিনারায় হাঁটিয়ে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে দলটি। হত্যার আদেশটি সরাসরি ভিলাপ্লেনেরই ছিলো এবং বলা হয় তিনিও গুলি চালিয়েছিলেন। একটি বাড়িতে ইহুদি খুঁজতে গিয়ে ভিলাপ্লেন ৫৯ বয়সী এক বৃদ্ধাকে নির্যাতন করেছিলেন। পার্শ্ববর্তী খামারে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে, রাইফেল দিয়ে তাকে আঘাত করে ভয়ংকর মানুষে পরিণত হওয়া ভিলাপ্লেন। বৃদ্ধাকে ভয় দেখাতে তার সামনে দুই খামারীকে অমানুষিক নির্যাতন করা হয়েছিলো। বন্দি করার পর অর্থের বিনিময়ে ছাড়ার প্রতিশ্রুতি দিতেন মনের গহীনে হিংস্রতা লালন করা এই খেলোয়াড়। প্রয়োজন অনুসারে বাড়িঘরে আগুন জ্বালিয়ে দিতো দলটি। রক্তাক্ত ও আহতদের শরীর থেকে হিংস্রতার সাথে মূল্যবান বস্তু ছিনিয়ে নিতো তারা। আর এই সবকিছুর মূলে ছিলো ভিলাপ্লেন; ঠাণ্ডা, নির্বিকার, কঠিন হৃদয়ের একজন, যার অনুপ্রেরণায় সবকিছু হচ্ছিলো।
একসময় তিনি বুঝতে পারেন এই যুদ্ধ আর জিততে পারবে না হিটলার এবং ঐ বছরেই মিত্র বাহিনী ও ফ্রান্সের যোদ্ধারা ক্রমেই যখন ফ্রান্স পুনরুদ্ধারের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছে, তখনই সুর পাল্টে ফেলেছিলো কুখ্যাত এই ফ্রেঞ্চ গেস্তাপো অফিসার। শহরবাসীদের তিনি উল্টো বোঝাতে শুরু করলেন, একজন ফ্রেঞ্চ কেন এসএস উর্দি পড়বে? তিনি শুধু কাজটি করেছেন যেন নাৎসি বাহিনীর হয়ে কাজ করার ছলনায় নিজের দেশবাসীকে সাহায্য করতে পারেন। অর্থের লোভে মত্ত হয়ে অমানুষে পরিণত হওয়া লোকটি অন্তিম সময়েও স্বদেশীদের বাঁচানোর মিথ্যা ছলনায় অর্থের দাবিও করতেন। কিন্তু ভিলাপ্লেনের কোনো কূটচাল কাজে আসেনি। দেশের সাথে চরম বিশ্বাসঘাতকতা করা ভিলাপ্লেনকে ও তার কর্মকাণ্ড এত দ্রুত কেউই ভুলে যায়নি।
পরিশিষ্ট
প্যারিস মুক্ত হওয়ার পর আটক করা হয় ভিলাপ্লেনকে, করা হয় বিচারের মুখোমুখি। বিচার চলাকালীন সময়ে মামলার প্রসিকিউটর জানিয়েছিলেন, “তারা লুঠতরাজ, ধর্ষণ, অপহরণ, হত্যা এবং জার্মানদের সাথে যোগ দিয়েছিলো, এমনকি তারা জার্মানদের চেয়েও বেশি হিংস্রতা নিয়ে ভয়ংকর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতো।” বিচারে দোষী প্রমাণিত হওয়ায় মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় তাকে। ১৯৪৪ সালে বড়দিনের ঠিক পরের দিন মগোজ দুর্গে ফায়ারিং স্কোয়াডে দাঁড় করানো হয় ভিলাপ্লেন, লাফোন্ট, বনি এবং আরও পাঁচজনকে।
বুলেটের আঘাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে মারা যায় ফ্রান্সের সবচেয়ে ঘৃণিত ভিলাপ্লেনসহ অন্যান্যরা, ভিলাপ্লেনকে সমাহিত করা হয় অজ্ঞাত এক স্থানে, যা আজও অজানা। এখানে অন্য সবার মতো একজন ছিলেন না ভিলাপ্লেন। একজন প্রথিতযশা ফুটবলার থেকে কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধীতে পরিণত হওয়ার পিছনে ঠিক কী মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব কাজ করেছিলো তা হয়তো কখনোই জানা যাবে না, কিন্তু ফুটবল ও ফ্রান্সের ইতিহাসে ভিলাপ্লেন সময়ের সবচেয়ে নির্মম পরিহাস।
ফিচার ইমেজ- theversed.com