ফোনটা বেজে উঠল।
আমি তখন বেঘোরে ঘুমাচ্ছিলাম, ফোনের শব্দে আমার ঘুম ভাঙল। আমার মা ফোন করেছেন। আমি ঘড়ির দিকে তাকালাম। রাত সাড়ে তিনটা।
রাত সাড়ে তিনটায় মায়ের ফোন আসাটা নিশ্চয়ই কোন সুসংবাদ বয়ে আনে না, ঠিক?
ঐ মুহূর্তটা, ঐ তারিখটা আমি কখনো ভুলবো না। ফোনের দিকে তাকিয়ে আমি বুঝে গিয়েছিলাম কী হতে চলেছে। কয়েক সপ্তাহ ধরে চারপাশে একটা ফিসফিসানি চলছিলো, একটা দুশ্চিন্তা ছিল সকলের মধ্যে। কিন্তু অনাগত সত্যিটা কেউ মেনে নিতে পারছিলেন না। ঐ সময়ে যখন ফোনে আমার মায়ের নামটা ভেসে উঠলো, আমি বুঝে গিয়েছিলাম।
ফোনের ওপারে আমার মা কাঁদছিলেন। তার মনে হচ্ছিলো কোন বিস্ফোরণে তার বাড়িটা কাঁপছে।
আমরা তখনই খবর দেখলাম। হ্যাঁ, ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে।
সময় যেন থমকে গেল। নিজেকে খুব অসহায় লাগছিল, একই সাথে অপরাধী।
এই সময়ে আমার কিয়েভে আমার মায়ের পাশে থাকার কথা। দুই দিন আগে তার জন্মদিন ছিল। আমাদের একসাথে তার বাড়িতে রাতের খাবার খাওয়ার কথা ছিল, যেখানে আমার বোন ও আমার কিছু বন্ধুদের উপস্থিত থাকার কথা। ১৯ থেকে ২৯ তারিখের মধ্যে আমার ফ্লাইটগুলোও বুকিং দেওয়া ছিল, কিন্তু ব্রিটেনে কিছু কাজের কারণে আমি আমার ফ্লাইটের তারিখ পরিবর্তন করে ২৬ তারিখে যাওয়ার মনস্থির করি।
আমি প্রচণ্ড ধাক্কা পেয়েছিলাম। আমার চারটি সন্তান। আমার নিজের কাছেই পুরো ব্যাপারটা ভীষণ গোলমেলে। আমার সবচেয়ে ছোট সন্তানের বয়স আট, তার কাছে আমি কী ব্যাখ্যা দেব?
আমি বলতে পারব না, সারাদিনে আমাকে ঠিক কতবার ফোনে চার্জ দিতে হয়েছে। আমি সারাক্ষণ বিভিন্ন মানুষকে ফোন করছিলাম। কখনো বন্ধুদের, কখনো পরিবারের বিভিন্ন সদস্যদের, কখনো পুরনো সহকর্মীদের, কখনো সতীর্থদের। জানতে চাইছিলাম, তারা নিরাপদে আছে কি না, তাদের পরিবারের কী অবস্থা, এরপরে কী ঘটবে, আর সাহায্যের জন্য আমি কী করতে পারি।
এই পরিস্থিতিতে ঘাবড়ানোটাই স্বাভাবিক, কারণ এই সময়ে নেওয়া যেকোনো সিদ্ধান্ত যে কারোর জীবন পাল্টে দিতে পারে।
আমার মনে পড়ে, একটা মুহূর্তে আমি রীতিমতো জমে গিয়েছিলাম। আমি আমার স্ত্রীকে বলেছিলাম,
“আমি জানি না আমার কী করা উচিত…”
এ সময়ে আমার মনে হলো, আমার পরিবারকে নিয়ে দেশ ছেড়ে ভলে যাওয়াটাই বোধ হয় সবচেয়ে ভালো, কিন্তু আমার মা এবং বোন উভয়েই আমাকে একই কথা বললেন, ফোনে মায়ের বলা কথাটা তো এখনো আমার কানে বাজে, “আমি দেশ ছেড়ে কোথাও যাচ্ছি না। এই দেশটাই আমার বাড়ি।”
ঐ রাতেই রাষ্ট্রপতি জেলেনস্কি জনগণের উদ্দেশ্যে পরিষ্কার বার্তা দিয়ে দিলেন। তিনি বললেন যে তিনি কিয়েভ ছাড়বেন না। পাশাপাশি আমাদের ভূমি রক্ষায় আমাদেরকেই এগিয়ে আসতে বললেন তিনি। এখানেই আমাদের ভবিষ্যৎ। তাই এটা ছিল আমাদের দেশের অস্তিত্বের প্রশ্ন।
অমন একটা মুহূর্তে, আপনার দৃষ্টিভঙ্গি, আপনার অগ্রাধিকার, আপনার পুরো পৃথিবীই পাল্টে যাবে।
সাফল্য আসলে কী? ফুটবল ম্যাচে জেতা? চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়? টাকা উপার্জন? ভালো ব্যবসা?
এর কোনোটাই নয়। সাফল্যের অপর নাম স্বাধীনতা, সাফল্যের অপর নাম বেঁচে থাকা।
পরের দিনগুলোতে বিভিন্ন কাহিনী আমাদের কানে আসতে শুরু করল।
শত শত মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে পালানোর বদলে সিদ্ধান্ত নিচ্ছিল থেকে যাওয়ার। বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা প্রবাসীরাও নিজেদের ভূমি রক্ষার জন্য ফিরে আসছিল, কোনো দ্বিধা ছাড়াই। ফলাফল নিয়ে ভেবে তারা সময় নষ্ট করছিল না, তারা শুধু জানত যে তাদের ফিরতে হবে।
আমি এমন কথাও শুনেছি, যে বিশ বছরের তরুণেরা রাস্তা অবরোধ করে রেখেছে, যেন শত্রুরা তাদের গ্রামে, তাদের বাড়িঘরে আক্রমণ করতে না পারে। এমন অনেক মানুষের কথা শুনেছি, যারা বিধ্বস্ত দালানে গিয়ে আহত প্রতিবেশীদের উদ্ধারে সাহায্য করত। এমন দম্পতির কথা শুনেছি, যারা দু’জনেই পেশায় ডাক্তার, এবং শহরে চলমান বোমা বিস্ফোরণের মধ্যেই হাসপাতালে ছুটেছে আহতদের সাহায্য করতে, এবং যাওয়ার সময়ে বন্ধুদের বলে গেছে,
“যদি আমাদের কিছু হয়, কথা দাও আমাদের সন্তানরা বেড়ে উঠবে তোমাদের অধীনে।”
ভাবা যায়!
বিধ্বস্ত শহরের অসহায় মানুষকে সাহায্য করার জন্য এই দম্পতিকে কয়েকদিন হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল। অবশেষে তারা তাদের সন্তানদের কাছে ফিরে এসেছিল, অবশ্যই দেশের প্রতি দায়িত্ব শেষ করে।
এমন অনেক গল্প আমার জানা। বীরদের গল্প, বীরত্বের গল্প। কষ্টের গল্প, বেদনার গল্প।
আমার একজন আন্টি তার বেজমেন্টে আটকে ছিলেন পুরো চার দিন। বোম্বিং চলার কারণে তিনি বেরোতে পারতেন না। পরে রাশিয়ানরা আধাবেলার জন্য বোম্বিং থামানোডর পরে তিনি পালিয়ে আমার মায়ের বাসায় চলে এসেছিলেন। আমার অনেক কাছের বন্ধু মারা গিয়েছিলেন এই হামলায়। আর এমন পরিস্থিতিতে, তাদের জন্য দুঃখ করার মতো অবকাশও ছিল না আমাদের।
আমার নিজের কাছে নিজেকে অপরাধী লাগছিল। আমি দেশে ফিরতে চাইছিলাম। নিজের চোখে পরিস্থিতি দেখতে চাইছিলাম, নিজের ভূমিকে রক্ষা করতে চাইছিলাম। চেয়েছিলাম সবাইকে সাহায্য করতে। আমি আমার মা’কে জানালাম, “আমি ফিরছি।”
কিন্তু তিনি বললেন, “আন্দ্রেই, তুমি এখানে এসে কী করবে? তুমি তো সৈনিক নও। তুমি যেখানে আছো, ওখানেই থাকো। মিডিয়ায় যাও, ওদের সত্যটা জানাও। যুদ্ধ শুধু বন্দুক আর বোমা দিয়েই হয় না, যুদ্ধ হয় তথ্য দিয়েও। তুমি তোমার পরিচয়, তোমার যোগাযোগ কাজে লাগাও। তহবিল জোগাড় করো। বৈদেশিক সাহায্য আনো।”
আমি মায়ের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলাম। পরের কিছুদিন আমি আমার সাধ্যের সবটুকু দিয়ে সাহায্যের চেষ্টা করলাম। শুধু আমি নই, পুরো পৃথিবীর মানুষই যেন এই কাজটাই করছিল। পুরো গণতান্ত্রিক বিশ্বের মধ্যে একতা সৃষ্টি হলো।
বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ আমাকে ফোন করতে লাগলো- ইতালি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, সব জায়গা থেকে। কেউ চাঁদা তুলে পাঠাতে চেয়েছিল, কেউ সাহায্য করতে চেয়েছিল, কেউ আবার শুধু পরিবার আর বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ করতে চেয়েছিল।
একে অপরকে ফোন করে আমরা এমনটাই বলতাম, “আমার বন্ধু গ্রামে থাকে, বা আমার চাচা শহরে থাকেন, বা আমার দাদা-দাদী তাদের অ্যাপার্টমেন্টে থাকেন, আপনি কি এর কাছাকাছি কাউকে চেনেন, যে একটু দেখে বলতে পারবে যে তারা সুস্থ আছেন কি না?”
অনেক মানুষ এভাবে সাহায্য চেয়েছিল, এবং উত্তরে কেউই ‘না’ শোনেননি।
২.
ইউক্রেনের জনগণ জানে স্বাধীনতার অর্থ, এই দেশটা আমাদেরই হাতে গড়া। আমাদের দেশের বয়স খুব বেশি নয়, কিন্তু আমাদের গল্পটা সকলের পরিচিত। আমাদের সংস্কৃতি, ভাষা, ইতিহাস অনেক পুরনো, কিন্তু আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি মাত্র ৩০ বছর আগে। এই কারণেই, আমাদের প্রজন্মের মানুষের কাছে ইউক্রেন সমবয়সী একজন। আর এই বন্ধনটা আমরা আঁকড়ে ধরে রাখতে চেয়েছি সবসময়ে।
আমার গল্পটাই ইউক্রেনের গল্প।
স্বাধীনতার আগেই আমি কিয়েভ শহরের প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। তখন আমি শিশু, প্রতি সপ্তাহান্তে ফুটবল খেলার জন্য শহরের এদিকে ছুটে বেড়াতাম। নয় বছর বয়স থেকে আমি খেলতে যাওয়ার জন্য বাস এবং মেট্রোতে চড়া শুরু করি। ফুটবল মাঠের খবর রাখতে রাখতে পুরো কিয়েভের মানচিত্র আমার মাথায় চলে আসে।
ইউক্রেনের আধুনিক ইতিহাসের প্রতিটা ঘটনার জন্য আলাদা আলাদা গল্প আছে আমার কাছে। চেরনোবিল বিস্ফোরণের সময়ে আমাদের উদ্ধার করে কিয়েভের বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। আমি আমার সাথে কয়েকটা ফুটবল নিয়ে এসেছিলাম। আমার মনে পড়ে, আমার বাবা একটা গাইগার কাউন্টার দিয়ে একটা ফুটবল পরীক্ষা করেছিলেন, এবং ঐ বলে স্বাভাবিকের তুলনায় পঞ্চাশ গুণ তেজস্ক্রিয়তা ছিল। পরে ওটাকে আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়।
যখন ১৯৯১ সালে আমাদের দেশ স্বাধীনতা অর্জন করলাম, আমি তখন ডায়নামো কিয়েভের একাডেমির হয়ে একটা এক মাসব্যাপী টুর্নামেন্ট খেলছি। জায়গাটা ছিল মস্কোর কাছে। আমি প্রতিদিন হোটেলে খবর দেখতাম। গর্বাচেভ, ইয়েলসিন, সবার খবর পেতাম আমি। আমরা যখন মস্কো থেকে ট্রেনে করে কিয়েভের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিলাম, তখনও আমরা সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ। কিন্তু যখন কিয়েভের স্টেশনে নামছি, তখন আর সোভিয়েত ইউনিয়নের অস্তিত্ব নেই, আমরা পা রাখছি একটা স্বাধীন সার্বভৌম দেশে! আমাদের ইউক্রেনে!
সব জায়গায়, সবার হাতে হাতে নীল হলুদ পতাকা উড়ছিলো। সবার মুখে হাসি লেগে ছিল।
আমার এই একই অনুভূতিটা হয়েছিল যেদিন আমি প্রথমবারের মতো ইউক্রেন জাতীয় দলের জার্সি পরেছিলাম। সেটা ছিল একটা বয়সভিত্তিক দলের ম্যাচ। লভিউতে অনুষ্ঠিত ঐ ম্যাচে ইউক্রেনের অনূর্ধ্ব-১৬ দলের হয়ে নেদারল্যান্ডের বিপক্ষে ২-২ গোলে ড্র করেছিলাম আমরা।
এখানে একটু বলে রাখি, ইউক্রেনের নাগরিকদের জীবনে ফুটবল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ইউক্রেনে ফুটবলই এক নম্বর খেলা। ডায়নামো কিয়েভের কিংবদন্তিতুল্য খেলোয়াড় ওলেগ ব্লখিন, ইগর বেলানোভের মতো ব্যালন ডি’অর জয়ীকে আদর্শ মেনে বড় হয়েছি আমি। কিন্তু তবুও, আমাদের প্রজন্মের কাছে ফুটবল শুধু একটা খেলা ছিল না। ফুটবল আমাদের মধ্যে সকল ভেদাভেদ ঘুচিয়ে দিত, এক পতাকার নিচে এনে দাঁড় করাতো সবাইকে।
যাই হোক, সেই রাতে লভিউয়ের পরিবেশ ছিল অকল্পনীয়। হাজার হাজার দর্শকে পূর্ণ স্টেডিয়ামটা রীতিমতো গমগম করছিল। একটা বয়সভিত্তিক ম্যাচ দেখতে এত মানুষের আগমন অপ্রত্যাশিত, কিন্তু মানুষ এসেছিল। এসেছিল ইউক্রেনের পতাকার জন্য একদল ছেলেকে ইউক্রেনের জার্সিতে খেলতে দেখার জন্য। ঐ রাতে মানুষ ইউক্রেন দলকে দেখতে এসেছিল, সোভিয়েত ইউনিয়ন নয়।
২০১২ সালে আমরা ইউরো আয়োজন করলাম। কিন্তু ওটা শুধুই আরেকটা টুর্নামেন্ট ছিল না, ঐটা ছিল একটা ‘দেখিয়ে দেওয়া’, জাতি হিসেবে আমরা কী করতে পারি। এই টুর্নামেন্টটা আয়োজনের জন্য আমাদের অনেক লম্বা পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। আমরা কঠোর পরিশ্রম করে স্টেডিয়াম তৈরি করেছি, ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে আগত দর্শকদের জন্য বিভিন্ন সেবার উন্নতি করেছি। যখনই আমাদেরকে ঐ টুর্নামেন্টের সহ-আয়োজক হিসেবে ঘোষণা করা হলো, আমি তখন থেকেই স্বপ্ন দেখেছি ঐ টুর্নামেন্টে খেলার। আমার বয়স প্রায় পঁয়ত্রিশ ছুঁয়েছিল, পিঠের ব্যথাটা খুব ভোগাচ্ছিল, তবুও ঐ ইউরোতে খেলার সুযোগটা হাতছাড়া করতে চাইনি।
একটা জাতি হিসেবে আমাদের জন্য ঐ সময়টা খুব সুন্দর ছিল।
ঐ ইউরোর ঠিক দশ বছর পরে, রাশিয়া যখন আমাদের দেশে আক্রমণ করলো, প্রথমে মনে হচ্ছিল আমরা বোধহয় আমাদের সব অর্জন হারিয়ে ফেললাম। আমাদের সব গল্পের এখানেই সমাপ্তি। কিন্তু আমরা জানতাম, আমরা এটাকে চলতে দিতে পারি না।
৩.
যুদ্ধের ছয় মাস কেটে গেছে।
আমাদের সামরিক বাহিনীর অবিশ্বাস্য দৃঢ়তা এবং গণতান্ত্রিক বিশ্বের প্রতিক্রিয়ার কারণে আমরা এখনো পৃথিবীর মানচিত্র হারিয়ে যাইনি। কিছু মানুষ ঘরে ফিরছে। ফুটবল মৌসুম পুনরায় শুরু হয়েছে। আমরাও স্বাভাবিক জীবনে ফেরার চেষ্টা করছি।
কিন্তু আমাদের লড়াই এখনো শেষ হয়নি।
২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া যখন আমাদের ওপর আক্রমণ করলো, আমরা চিন্তা করা বা শোক পালনের সময় পাইনি। এখন সেই দিনগুলোর দিকে তাকালে বুঝতে পারি, কী ভয়াবহ দিন পার করেছি আমরা।
কিন্তু এখনই সব ভুলে যাওয়া যাবে না।
এই ব্যাপারটা দুনিয়ার যেকোনো জায়গায় ঘটতে পারে, যেকোনো সময়ে। এটা শুধু ইউক্রেনের সংগ্রাম নয়, এই সংগ্রাম পুরো গণতান্ত্রিক বিশ্বের।
আপনি যখন এই লেখাটা পড়ছেন, আপনি হয়তো নিজেকে নিরাপদ ভাবছেন। হয়তো ভাবছেন, এসব যুদ্ধবিগ্রহ, আক্রমণ, হামলা থেকে অনেক দূরে রয়েছেন আপনি। কয়েক বছর আগে অনেক ইউক্রেনবাসীও এমনটাই ভাবত। কিন্তু পৃথিবী আর এমন নেই, বিশ্বাস করুন। এই ঘটনাটা যেকোনো সময়ে যেকোনো জায়গায় ঘটতে পারে, যদি আমরা শিক্ষা না নিই।
ঐ হামলার পর আমি দুইবার দেশে ফিরেছি। দু’বারই প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির ইউনাইটেড২৪ এবং গুড ফাউন্ডেশনের লরিয়াস স্পোর্টসের হয়ে কাজের জন্য। তাই আমি বাস্তবতাটা খুব ভালোভাবে দেখেছি। পোল্যান্ড থেকে ট্রেন ধরে কিয়েভে ফিরেছিলাম এপ্রিলে, প্রথমবারের মতো। প্রথম যে জিনিসটা আমাকে ধাক্কা দিয়েছিল, সেটা হলো ‘নৈঃশব্দ’। একটা অদ্ভুত নীরবতা।
আপনি যদি কখনো ট্রেনে করে ইউক্রেনে যেয়ে থাকেন, তাহলে ব্যাপারটা আপনার জানা। ট্রেনে প্রচুর কোলাহল থাকে। মালপত্র ওঠানো-নামানোর শব্দ, মানুষের উচ্চ কণ্ঠস্বর, শিশুদের দৌড়াদৌড়ি, হাসাহাসি। কিন্তু আমার এবারের অভিজ্ঞতা ছিল পুরোপুরি উল্টো। শান্ত পরিবেশ, যাত্রীশূন্য বগি, আবেগশূন্য চেহারা। বুঝতে পারছিলাম, আমরা প্রবেশ করতে যাচ্ছি এমন একটা অঞ্চলে, যেখানে যুদ্ধ চলছে।
প্ল্যাটফর্মে দেখলাম আরেক দৃশ্য। যুদ্ধফেরত সৈন্যরা দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছেন তাঁদের পরিবারের জন্য। মায়েরা, স্ত্রীরা, শিশুরা কাঁদছেন। অনেক দিন পরে বাড়ি ফিরছেন সৈনিকরা।
এরপর আমি একজন বন্ধুর সাথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কিয়েভের রাস্তায় হেঁটেছি। আমার শৈশবের স্মৃতিবিজড়িত জায়গাগুলো ঘুরে দেখেছি, দেখতে চেয়েছি সেগুলো আদৌ অবশিষ্ট আছে কিনা। আর চেয়েছি মানুষকে দেখতে, মানুষের অনুভূতিটা বুঝতে।
এই শহরটা আমার। এই শহরের প্রতিটি কোণকে আমি চিনেছি আমার শৈশবে, মেট্রোতে ঘুরতে ঘুরতে। শহরের প্রতিটি কোণে আমার গল্প আর স্মৃতি মিশে আছে। কিন্তু এই মুহূর্তে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বিপরীত। রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা অবিশ্বাস্য রকমের কম। দিনে ছয় সাতবার এয়ার রেইডের সাইরেন ছাড়া কোন শব্দের উৎস নেই। আর আপনি যখন প্রথমবার এই শব্দটা শুনবেন, শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে যাবে ভয়ের শীতল স্রোত।
অনেকগুলো চেকপয়েন্ট পেরিয়ে আমরা গাড়ি নিয়ে শহরের বাইরে গেলাম। গেলাম সেখানে, যেখানে আমি বেড়ে উঠেছি, স্কুলে গিয়েছি, যেসব মাঠে আমি খেলেছি। পরিচিত এসব জায়গাকে যখন রকেট আক্রমণে বিধ্বস্ত অবস্থায় দেখবেন, আগুনে পোড়া অবস্থায় দেখবেন দালানকোঠাকে, সেটা আপনার মধ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে বাধ্য।
কিয়েভের বাইরে অবস্থাটা আরো খারাপ।
আমি যখন দ্বিতীয়বার ইউক্রেনে গেলাম, আমি ইরপিনে গিয়েছিলাম। একসময়ের দৃষ্টিনন্দন শহর, নতুন নতুন দালানকোঠা… এখন আর সেসবের কিছুই অবশিষ্ট নেই। এখন সব অন্ধকার, বিপর্যস্ত, বিধ্বস্ত। এবং পুরো ব্যাপারটা ঘটছে বাস্তবে, চোখের সামনে, সিনেমার রূপালি পর্দায় নয়।
আমরা আরো পূর্বে গেলাম, নিপ্রোর দিকে। হাসপাতালের শিশুদের বিভাগে দেখলাম ছয়-সাত বছর বয়সী ছেলেমেয়েরা ভর্তি, প্রত্যেকেই আহত, ক্ষতবিক্ষত। বোমার আঘাতে কারো হাত-পা উড়ে গেছে, কারো পরিবারের সবাই মারা গেছে, অনেকের আর থাকার জায়গা নেই। আমি পরের ঘরে গেলাম, সেখানেও গল্পটা এমনই।
সতি বলতে, দ্বিতীয় ঘরের পর আমি আর নিতে পারছিলাম। এত দুঃখ, এত শোক, এত কষ্ট, এত আর্তনাদ আমি সইতে পারছিলাম না।
এটাই বাস্তবতা। এটাই যুদ্ধ।
কিন্তু কেন এই যুদ্ধ? আমি জানি না। আমি আমার বাচ্চাদেরও কোনো উত্তর দিতে পারি না।
মানুষ চেষ্টা করছে আবার ঘুরে দাঁড়ানোর, কিন্তু পরিস্থিতি তাদের পক্ষে নেই। শরণার্থী শিবিরের ছোট্ট জায়গায় অনেক বেশি মানুষ গাদাগাদি করে থাকছে। জীবনধারণের মৌলিক বিষয়গুলোর চাহিদা অনুযায়ী জোগান নেই সেখানে। সামনের শীতকালে কী পরিস্থিতি হবে, ভাবতেও পারছি না।
আমাদের তাই তহবিল সংগ্রহের কাজটা চালিয়ে যেতে হবে। উদ্বাস্তু মানুষের সাহায্যে এগিয়ে আসতে হবে। পাশাপাশি বহির্বিশ্বকে সত্যিটা জানাতে হবে।
আর এটাই এখন আমার মূল কাজ।
লরিয়াসের সাথে যুক্ত হয়ে আমি ওয়ারশের একটি শরণার্থী শিবিরেও গিয়েছি, চেষ্টা করেছি সেখানকার আশ্রিত বাড়িঘর ও পরিবার হারানো ইউক্রেনীয় শিশুদের একটু মানসিক সাহায্য দিয়ে যুদ্ধকালীন এই ট্রমা থেকে বের করে আনার। আমি একা নই, এক্ষেত্রে আমার দেখা হয়েছিল আরো কয়েকজন অ্যাথলেটের। টেনিস তারকা ইগা শোয়ান্টেকের সাথে দেখা হয়েছিল, যিনি তহবিল সংগ্রহের জন্য ক্রাকোতে একটা প্রদর্শনী ম্যাচের আয়োজন করেছিলেন। কাতার বিশ্বকাপে নিয়ে যাওয়ার জন্য পোল্যান্ডের অধিনায়ক রবার্ট লেভানডফস্কিকে একটি ইউক্রেনের পতাকার নীল-হলুদ রঙের বাহুবন্ধনী দিয়েছিলাম আমি।
যখনই আমি লরিয়াসের কোনো অনুষ্ঠানে যাই, অবচেতনেই আমার মনে পড়ে যায়, খেলাধুলার শক্তি আসলে কতটা। খেলাধুলা মানুষের ওপর তো বটেই, প্রভাব ফেলতে পারে যুদ্ধের নীতিনির্ধারণেও। হয়তো খেলাধুলার শক্তি দিয়েই পৃথিবীকে পাল্টে দেওয়া সম্ভব।
আমি এখনো আশাবাদীদের দলে। মিশমিশে আঁধারেও আমি আলোর রেখা খুঁজে নিতে চেষ্টা করি। আমি এখনো আমার দেশের একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছি, একেবারে পরিষ্কারভাবে।
এই যুদ্ধটা আমাদের পাল্টে দিয়েছে, কিন্তু আমাদের মূলমন্ত্রটা পাল্টায়নি।
এই দেশ আমাদের, এই মাটি আমাদের। আমাদের স্বাধীনতা, আমাদের ভবিষ্যৎ আমরা নিজেরাই অর্জন করে নেব। আমরা আবার গল্প লিখব। একতার গল্প, বেঁচে থাকার গল্প।
***
ইরপিন ভ্রমণের একটা ঘটনা দিয়ে শেষ করি। ইরপিনে সুন্দর ফুটবল স্টেডিয়াম ছিল, নতুন একাডেমি ছিল। বোমা হামলার পরে, পুরো শহরে মাত্র একটা ফুটবল মাঠই অক্ষত হিসেবে অবশিষ্ট থাকে। আমি শহরের মেয়রের সাথে তহবিল সংগ্রহ করে মাঠগুলো পুনর্নির্মাণের কথা বলছিলাম, কেননা এই মুহূর্তে ওগুলো একেবারেই ব্যবহারের অনুপযোগী।
কিন্তু ঐ সময়ে, ঐ অনুপযোগী মাঠেও, একদল দশ-বারো বছর বয়সী শিশু ফুটবল খেলছিলো।
ঐ শিশুরা যে পরিবেশে বড় হচ্ছে, যে পরিবেশে খেলছে, সেটা ওদের প্রাপ্য নয়। কিন্তু তবুও ওরা খেলছে।
আমার চোখে, এটাই প্রতিরোধ। এটাই ইউক্রেনের শক্তি।