মুস্তাফিজুর রহমান। বাংলাদেশের ক্রিকেটের এক উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় নাম। বাংলাদেশের মানুষের ভালবাসার এক অপর নাম। যার জাদুকরী বলের মূর্ছনায় কেঁপে ওঠে কোটি হৃদয়। তার এক একেকটি বল যেনো ভ্যান গগের এক একটি অপূর্ব শিল্প কর্ম। আর মুস্তাফিজ নিজে হলেন ক্রিকেট মাঠের সেই ভ্যান গগ।
মুস্তাফিজুর রহমানের জন্ম সাতক্ষীরায়। ১৯৯৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর। সাতক্ষীরা থেকে ৪৫ কি.মি. দক্ষিণে তেঁতুলিয়া গ্রামে মুস্তাফিজের বাড়ি। চার ভাই আর দুই বোনের মাঝে সবার ছোট তিনি। আর দশটা পরিবারের মত মধ্যবিত্ত এক পরিবারেই মুস্তাফিজের জন্ম। জন্মের পরপরই বাবা-মা ঠিক করে ফেললেন তার ছেলেকে হয় ডাক্তার না হয় ইঞ্জিনিয়ার বানাবেন। পরিবারের সম্মান উঁচুতে তুলবেন মুস্তাফিজ। শেষ পর্যন্ত পরিবারের সম্মান শুধু উঁচুতে নয় রাজসিংহাসনে তুলেছেন মুস্তাফিজ। কিন্তু ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হয়ে নয়, এক প্রতিকূল পরিবেশের মধ্য দিয়ে। আজ আমরা সেই গল্পই শুনবো।
ছোটবেলা থেকেই ক্রিকেটের প্রতি চরম আকর্ষণ মুস্তাফিজের। সারাদিন বই-খাতার বদলে ব্যাট-বল নিয়ে পড়ে থাকতেন। বাবা-মার বিষয়টি একদমই পছন্দ ছিল না। জোর করে তাকে বারবার পড়তে বসাতেন। মুস্তাফিজের সবচেয়ে আপন ছিলেন তার সেজো ভাই মোখলেছুর রহমান। মোখলেছুর রহমান এবং তাদের মেজো ভাই জাকির হোসেন তখন টেনিস বল দিয়ে ক্রিকেট খেলতেন। মুস্তাফিজের বয়স যখন ১০-১২ বছর হল তখন সেও তাদের সঙ্গী হল। বিস্ময়ের কথা মুস্তাফিজের তখন বল করার দিকে কোন আগ্রহ ছিল না! ব্যাট করার প্রতিই তার যত আগ্রহ!
গ্রামের তেঁতুলিয়া মাঠে একদিন খেলা চলছিল। মুস্তাফিজরা তিন ভাইই খেলছিলেন। বিপক্ষ দলের সেরা ব্যাটসম্যান তখন ক্রিজে। একের পর এক বাউন্ডারি। কিছুতেই তাকে আউট করা যাচ্ছে না। মুস্তাফিজের ভাই মোখলেছুর রহমান মুস্তাফিজের হাতে তুলে দিলেন বল। বল করলেন মুস্তাফিজ! এবং আউট! জীবনের প্রথম বলেই উইকেট নিয়ে জানান দিলেন পাড়াগাঁয়ের ক্রিকেট নয়, বিশ্ব ক্রিকেটকে নাড়িয়ে দিতে এসেছেন তিনি। তার বোলের জাদুতে বিমোহিত করতে এসেছেন তিনি। এই উইকেটটিই মুস্তাফিজের জীবনের টার্নিং পয়েন্ট হয়ে গেল। বোলিং এর দিকে ঝুঁকে পড়লেন তিনি।
বরেহা মলনি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি করানো হল মুস্তাফিজকে। বাড়ি থেকে এল ক্রিকেট খেলাত প্রতি চরম নিষেধাজ্ঞা। কিন্তু রক্তে যার ক্রিকেট তাকে আটকিয়ে রাখে সাধ্য কার? তাই বাড়ি থেকে পালিয়ে বার বার ছুঁটে যেতেন খেলার মাঠে। এরই মাঝে চলে এল অনূর্ধ্ব-১৪ এর বাছাই পর্ব। সেজো ভাইয়ের সহযোগীতায় অংশ নিলেন মুস্তাফিজ। উত্তীর্ণ হয়ে গেলেন। শুরু হল সাতক্ষীরায় ক্রিকেট একাডেমির অধীনে প্রশিক্ষণ।
সেজো ভাই মোখলেছুর রহমান প্রতিদিন ভোরে উঠতেন মুস্তাফিজের জন্য। তারপর গ্রাম থেকে ৪৫ কি.মি. দূরে মোটরসাইকেলে করে সাতক্ষীরা নিয়ে আসতেন প্রশিক্ষণের জন্য। আজ আমরা মহেন্দ্র সিং ধনীর জীবনী নিয়ে বানানো সিনেমা দেখে বাহবা দেই। মুস্তাফিজের জীবন কি কম প্রতিকূলতায় ভরপুর ছিল? তার জীবন কি কম নাটকিয়তাই পূর্ণ?
অনূর্ধ্ব-১৪ এর পরে অনূর্ধ্ব-১৬ তে সাতক্ষীরার হয়ে প্রথম মাঠে নামেন মুস্তাফিজ। হীরে চিনতে কতক্ষণ লাগে? ডাক পেয়ে গেলেন খুলনার বিভাগীয় দলে। ২০১২ সালে শেরে বাংলা স্টেডিয়ামে ফাস্ট বোলিং ক্যাম্পে ট্রায়াল দিতে আসেন মুস্তাফিজ। কোচের নজরে পড়ে যান তিনি। মুগ্ধ কোচ এরপর তার হাতে পাওয়া হীরার টুকরোকে ঘষা মাজার কাজ শুরু করলেন।
চোখের পলকেই অনূর্ধ্ব-১৯ জাতীয় দলে সুযোগ পেয়ে গেলেন মুস্তাফিজ। স্বপ্ন পূরণের হতছানি তার সামনে। ২০১৪ সালে অনূর্ধ-১৯ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের হয়ে খেললেন এই বিস্ময়বালক। ৬ ম্যাচ খেলে ৯ উইকেট তুলে নিলেন। জানান দিলেন তার আগমনী বার্তার। টুর্নামেন্টের অন্যতম সেরা বোলার ছিলেন তিনি।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে বাংলাদেশ এ দলে জায়গা পেয়ে গেলেন। সবাই চমকে গেল। প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটও খেলা শুরু করলেন। ঘরোয়া ক্রিকেট শুরুর ৬ মাসের মাথায় এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট খেলা শুরুর এত কম সময়ে কেউ কি কখনও বাংলাদেশ দলে ডাক পেয়েছে? খুঁজে দেখার মত বিষয়। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে একমাত্র টি-টুয়েন্টি ম্যাচে ডাক পেলেন। মাত্র চার ওভারেই শহীদ আফ্রিদি আর মোহাম্মদ হাফিজের মত বাঘা বাঘা ক্রিকেটারদের আউট করে দিলেন মুস্তাফিজ। বাংলাদেশ প্রথমবারের মত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে টি-টুয়েন্টি ম্যাচ জিতে নেয়। তাও ৭ উইকেটের বিশাল ব্যবধানে।
কেটে গেল আরো দুমাস। পৃথিবীবাসি তখনও মুস্তাফিজকে চিনতে পারেনি ঠিকমত। মাত্র ৪ ওভারে আর কতটাই চেনানো যায় নিজেকে? ভারতের বিপক্ষে ওয়ান ডে দলে ডাক পেলেন মুস্তাফিজ। ওয়ানডে অভিষেকেই ৫ উইকেট তুলে নিলেন। হয়ে গেলেন ম্যাচ সেরা। জিতল বাংলাদেশ। পরের ম্যাচেও মাত্র ৪৩ রানের বিনিময়ে নিলেন ৬ উইকেট। হয়ে গেলেন ইতিহাসের অংশ। করলেন বিশ্বরেকর্ড। জানিয়ে দিলেন বিশ্বকে ক্রিকেটের সব রেকর্ড তার পায়ের সামনেই লুটোপুটি খেতে যাচ্ছে। এর আগে কেউ অভিষেকের দুই ম্যাচে দুইবার ৫ উইকেটসহ ১১ উইকেট তুলে নিতে পারেন নি। এ ম্যাচেও ম্যাচসেরা হয়ে বিশ্বের ৪র্থ বোলার হিসেবে এ কীর্তি গড়লেন তিনি। বাংলাদেশ এ ম্যাচও জিতে ভারতকে সিরিজ হারাল প্রথমবারের মতো। তিনিই পৃথিবীর ইতিহাসের একমাত্র খেলোয়াড় যিনি একই সাথে ওয়ানডে এবং টেস্ট দুই ক্ষেত্রেই অভিষেকেই ম্যান অব দ্যা ম্যাচ হয়েছেন।
আইসিসি বছর শেষে তাকে ওয়ানডে বর্ষসেরা দলের সদ্য হিসেবে ঘোষণা করল। প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে এ সম্মান পেলেন মুস্তাফিজ। এরই মাঝে ওয়ান ডে তে তিনবার আর টি টুয়েন্টিতে ১ বার মোট ৪ বার ৫ উইকেট স্বীকার করেছেন মুস্তাফিজ। এছাড়াও আই পি এল আর ন্যাটওয়েস্ট টি-টুয়েন্টি ব্লাস্টও কাঁপিয়ে এসেছেন তিনি।
তিনিই আমাদের মুস্তাফিজ! আমাদের গর্ব। আমাদের কাটারবয়! আমাদের রয়েল বেঙ্গল টাইগার!