আলফিও বাসিলে: আর্জেন্টিনার শেষ সোনালী যুগের কোচ

‘আর্জেন্টিনা’ শব্দটি যদি কোনো ফুটবল ভক্ত দেখেন, অথবা শোনেন, কিংবা পড়েন, তাহলে সবার আগে কোন নামটি মনে পড়বে? নিঃসন্দেহে লিওনেল মেসি অথবা ডিয়েগো ম্যারাডোনার নাম। অথবা, তার চোখের সামনে ভেসে উঠতে পারে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার স্মরণীয় কোনো দ্বৈরথ।

বর্তমানে আর্জেন্টাইন ফুটবলের পোস্টার-বয় মেসি। অন্যদিকে, আর্জেন্টিনার সবচেয়ে বড় তারকার নাম ম্যারাডোনা। একজন তার পায়ের জাদুবলে দু’বার বিশ্বকাপ জিতেছেন, অন্যজন তার ফুটবল প্রতিভা দিয়ে সারা বিশ্বকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছেন।

বর্তমান আর অতীতের হিসেবে আর্জেন্টিনা ফুটবল দলের সবচেয়ে বড় দুই তারকার নাম মেসি এবং ম্যারাডোনা। মেসি কিংবা ম্যারাডোনার মতো ফুটবলারকে কোচিং করানো বিশ্বের যেকোনো ফুটবল কোচের কাছে গৌরবের বিষয়। অথচ আলফিও বাসিলে এদের দু’জনকেই কোচিং করিয়েছেন। এমন গর্বের বিষয় আর ক’জন ফুটবল কোচের আছে!

বাসিলে ছিলেন আর্জেন্টিনার সর্বশেষ স্বর্ণযুগের কোচ। তার হাত ধরেই আর্জেন্টিনা আজ থেকে ২৬ বছর আগে শিরোপা জিতেছিল। এরপর আর ট্রফি ছুঁয়ে দেখা হয়নি আর্জেন্টাইন ফুটবল দলের৷ অনেক তারকা এসেছেন, অনেকে বিদায় নিয়েছেন৷ আর্জেন্টিনার ট্রফি কেস আগের মতোই রয়ে গেছে।

লিওনেল মেসিও সেই অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে পারেননি। মেসি অবশ্য দলকে ১৯৯০ সালের পর বিশ্বকাপ ফাইনালে তুলতে পেরেছিলেন। কিন্তু ফাইনালে হারতে হয়েছে সেই নব্বইয়ের ঘাতক জার্মানির কাছেই। ফলাফল, তথৈবচ।

আর্জেন্টিনার শিরোপা খরা ঘোচাতে এখন পর্যন্ত ব্যর্থ লিওনেল মেসি; Image Credit: Martin Rose/Getty Images

ইতালি বিশ্বকাপে কার্লোস বিলার্দোর আর্জেন্টিনা ফাইনালে জার্মানির কাছে ১-০ গোলে পরাজিত হয়, যার পেছনে অনেকটা দায়ী ছিল বিলার্দোর ভুল ট্যাকটিকস। যেকোনো মূল্যে ম্যাচ জিততে গিয়ে ফাইনালে দুইটি লাল কার্ড দেখে বসে আর্জেন্টিনা। আক্রমণাত্মক ফুটবল খেলতে গিয়ে ৮৫ মিনিটে ডিফেন্ডারদের ভুলে পেনাল্টি পায় জার্মানি। সেখান থেকেই গোল করেন আন্দ্রেস ব্রেহমে।

রোমের ফাইনালে দুই লাল কার্ডসহ আর্জেন্টিনা মোট তিনটি কার্ড দেখে, যা ছিল সে আসরের সর্বোচ্চ। পাশাপাশি ২২টি হলুদ কার্ড নিয়েও বিলার্দোর আর্জেন্টিনা সবার উপরে ছিল। রোমে হৃদয় ভাঙার পর আর্জেন্টাইন ফুটবল ফেডারেশন এএফএ নতুন একজন কোচের সন্ধানে নামে। তারা এমন একজন কোচকে খুঁজছিলেন, যিনি দলকে নতুন করে সাজাতে পারবেন, এবং ম্যারাডোনার অনুপস্থিতি মানিয়ে নিতে পারবেন। মূলত রোমে হারার পর ফুটবলকে বিদায় বলতে চেয়েছিলেন ম্যারাডোনা। তার জন্যই এমন পরিকল্পনা ছিল এএফএ’র। 

এএফএ কোচ হিসেবে বেছে নেয় আলফিও বাসিলেকে। বাসিলে তখন রেসিং ক্লাবে কোচের দায়িত্বে ছিলেন। তার অধীনে রেসিং ক্লাব ১৯৮৮ সালে সুপারকোপা লিবার্তাদোরেস জয় করে। বাসিলের ফুটবল কৌশল দক্ষিণ আমেরিকান ফুটবল ভক্তদের নজর কেড়েছিল অনেক আগেই। তার ট্যাকটিকসের সাথে আর্জেন্টিনার প্রথম বিশ্বকাপজয়ী কোচ সিজার লুইস মেনোত্তির ট্যাকটিকসের বেশ মিল ছিল। ফেডারেশনের কর্তাব্যক্তিরাও তাদের পুরনো ফুটবল কৌশলে ফিরতে মরিয়া ছিলেন। আর এ কাজের জন্য বাসিলেই ছিলেন সবচেয়ে উপযুক্ত।

আর্জেন্টিনার সর্বশেষ শিরোপাজয়ী কোচ আলফিও বাসিলে; Image Source: Mundo Albiceleste

কোচ হিসেবে বাসিলের প্রথম কাজ ছিল ১৯৯১ সালে চিলিতে অনুষ্ঠিত কোপা আমেরিকার প্রস্তুতি হিসেবে দল গোছানো। কোচ হিসেবে তিনি ঘরোয়া লিগে ভালো করা তরুণ ফুটবলারদের বেছে নেন। তার লক্ষ্য ছিল আর্জেন্টিনা দলে নতুন মুখ নিয়ে আসা, এবং বিলার্দো-ম্যারাডোনা যুগকে দূরে সরিয়ে দেওয়া, যাতে করে তিনি দলে নতুন চিন্তাধারা প্রবেশ করাতে পারেন এবং একটি ভালো শুরু এনে দিতে পারেন। তার এই কাজ আরো সহজ হয়ে যায় ম্যারাডোনার নিষেধাজ্ঞায়। ডোপ টেস্টে ধরা পড়ে ১৫ মাসের জন্য মাঠের বাইরে চলে যান তিনি।

বাসিলের নিয়োগ দলের খারাপ সময়ে হলেও আর্জেন্টিনার ঘরোয়া লিগে তখন প্রতিভার অভাব ছিল না। এদের মধ্যে ছিলেন গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতা, ডিয়েগো সিমিওনে, লিওনার্দো আস্ত্রাদা, ডিয়েগো লাতোরে, দারিও ফ্রাঙ্কো, লিওনার্দো রদ্রিগেজ এবং আন্তোনিও মোহামেদ। দলে ভারসাম্য রাখার জন্য অভিজ্ঞদেরও দলে টানেন বাসিলে। তিনি অধিনায়কের আর্মব্যান্ড পড়িয়ে দেন ‘৮৬ বিশ্বকাপজয়ী ডিফেন্ডার অস্কার রাগেরির হাতে। গোলরক্ষক হিসেবে সার্জিও গোয়কোচিয়াই ছিলেন প্রথম পছন্দ। অন্যদিকে, গতি আর বৈচিত্র্যময়তার জন্য ক্লদিও ক্যানিজিয়া ছিলেন বাসিলের মূল্যবান সম্পদ।

হাঙ্গেরির বিপক্ষে ২-০ গোলের জয় দিয়ে আর্জেন্টিনার কোচ হিসেবে বাসিলে তার যাত্রা শুরু করেন। কিন্তু এরপর বেশ কয়েকটি প্রীতি ম্যাচে তার দল ড্র করলে তাকে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়। এ কারণে তিনি তার শিষ্যদের মানসিক শক্তি বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দেন। পরবর্তীতে আর্জেন্টিনা বেশ কয়েকটি প্রায় হেরে যাওয়া ম্যাচকে ড্রতে রূপ দেন। এর মধ্যে ওয়েম্বলিতে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে একটি ম্যাচ ছিল। সেই ম্যাচে ২-০ গোলে পিছিয়ে থেকেও ২-২ গোলের ড্র নিয়ে মাঠ ছাড়ে আলবিসেলেস্তেরা।

নিজের গড়া দলকে নিয়ে বাসিলে বেশ আত্মবিশ্বাসী ছিলেন৷ ১৯৯১ সালের কোপা আমেরিকার গ্রুপপর্বে ভেনেজুয়েলাকে ৩-০ গোলে এবং প্যারাগুয়েকে ৪-১ গোলে বিধ্বস্ত করে কোচের আস্থার প্রতিদান দেন বাতিস্তুতারা। গ্রুপপর্বে আর্জেন্টিনার একমাত্র বাধা ছিল স্বাগতিক চিলি। তাদের বিপক্ষেও ১-০ গোলে জয় পায় আর্জেন্টিনা৷ এরপর পেরুকে ৩-২ গোলে হারিয়ে গ্রুপসেরা হিসেবেই ফাইনাল রাউন্ডে জায়গা করে নেয় তারা।

১৯৯১ সালের কোপা আমেরিকার একটি ম্যাচ; Image Credit: ALEJANDRO PAGNI

কোপা আমেরিকার বর্তমান ফরম্যাটের চেয়ে আগের ফরম্যাটে বেশ ভিন্নতা ছিল। তখন দুই গ্রুপ থেকে সেরা দুইটি করে দল নিয়ে ফাইনাল রাউন্ড অনুষ্ঠিত হতো। সেখানে পয়েন্ট ব্যবধানে যারা এগিয়ে থাকতো, তাদেরকে চ্যাম্পিয়ন হিসেবে ঘোষণা করা হতো। ‘৯১ সালের কোপা আমেরিকায় ফাইনাল রাউন্ডে জায়গা করে নেয় আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, চিলি ও কলম্বিয়া।

আর্জেন্টিনার প্রথম ম্যাচ ছিল চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্রাজিলের বিপক্ষে। চিলির এস্তাদিও ন্যাসিওনাল স্টেডিয়ামে হাইভোল্টেজ ম্যাচ দেখার জন্য ভিড় জমান ফুটবল ভক্তরা। দর্শকদের প্রত্যাশা পূরণ করে ৩-২ ব্যবধান জয় তুলে নেয় আর্জেন্টিনা৷ জোড়া গোল করেন ফ্রাঙ্কো, অপর গোলটি করেন বাতিস্তুতা। চিলি ও কলম্বিয়ার বিপক্ষে জয় তুলে নিয়ে আর্জেন্টিনার বিপক্ষে হার সামাল দেয় ব্রাজিল। অপরদিকে, আর্জেন্টিনা তাদের পরবর্তী ম্যাচে চিলির বিপক্ষে ড্র করে। ফলে গোল ব্যবধানে ব্রাজিল বেশ এগিয়ে থাকায় কলম্বিয়ার বিপক্ষে জয়ের বিকল্প ছিল না আর্জেন্টিনার।

বাসিলে জয়ের জন্য আঁটঘাট বেঁধে পরিকল্পনা সাজাতে শুরু করেন৷ টুর্নামেন্টের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে দল যাতে ভেঙে না পড়ে, সে জন্য শিষ্যদের মানসিকভাবে শক্তি যোগান দেন। একই সাথে কলম্বিয়াকে চেপে ধরার জন্য অ্যাটাকিং ফর্মেশনে দল সাজান। বাসিলের শিষ্যরা ম্যাচের ২০ মিনিটের মাথায় দুই গোল করে ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। আর্জেন্টিনাকে দুর্দান্ত এক শুরু এনে দেন সিমিওনে এবং বাতিস্তুতা। খেলার ৭০ মিনিটে কলম্বিয়া এক গোল পরিশোধ করলেও শিরোপা শেষ পর্যন্ত আর্জেন্টিনার হাতেই ওঠে৷ কলম্বিয়াকে ২-১ গোলে হারিয়ে ১৩তম কোপা আমেরিকা শিরোপা জয় করে আলবিসেলেস্তেরা। আর্জেন্টিনার হয়ে বাসিলে স্বপ্নের এক যাত্রা শুরু করেন৷

১৯৯৩ সালে কোপা আমেরিকার শিরোপা জয়ের পর আর্জেন্টাইন ফুটবল দল; Image Source: Telemundo

 বাসিলের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল সাফল্যের পথকে দীর্ঘ করা। সেই সাথে ট্রফি কেসে নতুন নতুন শিরোপার আগমন ঘটানো। ১৯৯২ সালে বাসিলে এবং আর্জেন্টিনা জাতীয় ফুটবল দল আগের বছরের মোমেন্টাম ধরে রেখেছিল। সে বছর তারা দুইটি আন্তর্জাতিক প্রীতি টুর্নামেন্টের শিরোপা জয় করে। প্রথম ট্রফি ছিল জাপানে অনুষ্ঠিত কিরিন কাপ, অপরটি কোপা লিপটন। একই বছর আর্জেন্টিনার ফুটবল ইতিহাসে অন্যতম ভার্সেটাইল মিডফিল্ডার ফার্নান্ডো রেডন্ডোর উত্থান ঘটে৷ তিনি তার দুর্দান্ত প্লে-মেকিং দক্ষতা দিয়ে বাসিলের একাদশে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সদস্যে পরিণত হন।

আগের বছর কোপা আমেরিকা জেতায় ১৯৯২ সালে কিং ফাহাদ কাপে খেলার সুযোগ পায় আর্জেন্টিনা। এই টুর্নামেন্টের বর্তমান নাম কনফেডারেশন্স কাপ৷

সৌদি আরবে অনুষ্ঠিত এই টুর্নামেন্টের প্রথম ম্যাচে আইভরি কোস্টকে ৪-০ গোলে হারায় আর্জেন্টিনা। জোড়া গোল করেন বাতিস্তুতা৷ অপর দুই গোল করেন রিকার্ডো আল্টামিরানো ও আলবার্টো আকোস্টা। ফাইনালে বাসিলের দলের প্রতিপক্ষ ছিল স্বাগতিক সৌদি আরব, যারা আগের ম্যাচে যুক্তরাষ্ট্রকে হারিয়ে ফাইনালে জায়গা করে নিয়েছিল। ফাইনালে কিং ফাহাদ স্টেডিয়ামে দর্শকের ঢল নামে। কিন্তু স্বাগতিক দর্শকদের কাঁদিয়ে ৩-১ গোলের জয় তুলে নেয় আর্জেন্টিনা৷ টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হন রেডন্ডো। 

টানা দুই বছর অপরাজিত থাকার পর আর্জেন্টাইন ফুটবল ভক্তরা তৃতীয়বারের মতো বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। তারা ধরেই নিয়েছিল, এবার খুব সহজে বিশ্বকাপ জয় করতে পারবে তাদের ছেলেরা। কিন্তু বিশ্বকাপের মূলপর্বের আগে বাছাইপর্ব পার তো হতে হবে! বাছাইপর্বে আর্জেন্টিনার গ্রুপসঙ্গী হিসেবে ছিল কলম্বিয়া, প্যারাগুয়ে ও পেরু। কাগজে-কলমে আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ টিকিট নিশ্চিত ছিল। তাদের বড় পরীক্ষায় ফেলার মতো সামর্থ্য গ্রুপসঙ্গীদের থাকলেও জয়ের পাল্লা বাসিলের শিষ্যদের দিকেই ভারী ছিল৷

বিশ্বকাপ বাছাইপর্ব পার হওয়ার পাশাপাশি আর্জেন্টিনার আরো একটি মিশন ছিল। ১৯৯৩ সালের কোপা আমেরিকায় শিরোপা ধরে রাখা। ১৯৯৩ সালের শুরুর দিকে ম্যারাডোনা জাতীয় দলে ফেরার ঘোষণা দেন, যদিও তখন ম্যারাডোনার ফিটনেস ও পারফরম্যান্স নিয়ে অনেকে সন্দিহান ছিলেন। পাশাপাশি বাসিলের অধীনে তার খেলার অভিজ্ঞতাও ছিল না। কোপার প্রস্তুতি হিসেবে আর্জেন্টিনার ফুটবল ফেডারেশন বেশ কয়েকটি প্রীতি ম্যাচের আয়োজন করে। এর মধ্যে এল মনুমেন্টাল স্টেডিয়ামে ব্রাজিলের বিপক্ষে ম্যাচটি ছিল ম্যারাডোনার ‘কামব্যাক’ ম্যাচ৷ সে ম্যাচে ব্রাজিলের বিপক্ষে ড্র করে, যদিও তাদের এই ড্র’কে দর্শকরা ইতিবাচক হিসেবেই নিয়েছিলেন।

আলফিও বাসিলের সাথে ডিয়েগো ম্যারাডোনা; Image Credit: Bocajrs

১৯৯৩ সালে কোপার আসর বসেছিল ইকুয়েডরের মাটিতে। আর্জেন্টিনার গ্রুপে ছিল কলম্বিয়া, মেক্সিকো ও বলিভিয়া। টুর্নামেন্টের সবচেয়ে ফেবারিট দল হিসেবে ইকুয়েডরে গেলেও বাসিলের জন্য ভিন্ন এক বাস্তবতা অপেক্ষা করছিল৷ গ্রুপপর্বে তাদের একমাত্র জয় ছিল দুর্বল বলিভিয়ার বিপক্ষে। পরের দুই ম্যাচে ড্র করে কোয়ার্টারে জায়গা পায় আর্জেন্টিনা।

কোয়ার্টারে আর্জেন্টিনার প্রতিপক্ষ ছিল ব্রাজিল। টুর্নামেন্টে তখন সেলেকাওরাই ফেবারিট৷ ম্যাচের ৩৯ মিনিটে ব্রাজিল এগিয়ে যায়৷ প্রথমার্ধের বাকি সময়ে গোল পরিশোধ করতে না পারায় দ্বিতীয়ার্ধে কৌশল পরিবর্তন করেন বাসিলে, মাঠে নামান রদ্রিগেজকে। ৬৯ মিনিটে তার হেড থেকে করা গোলে সমতায় ফেরে আলবিসেলেস্তেরা। নির্ধারিত সময় ১-১ গোলে শেষ হওয়ার পর ম্যাচ গড়ায় টাইব্রেকারে। সেখানে ভাগ্যের জোরে জয় পায় আর্জেন্টিনা।

 সেমিফাইনালে আর্জেন্টিনার প্রতিপক্ষ ছিল কলম্বিয়া। কিন্তু এই ম্যাচের দৃশ্যপট ছিল হুবুহু ব্রাজিল ম্যাচের কপি। নির্ধারিত সময়ে সমতা থাকার পর এই ম্যাচও পেনাল্টির মাধ্যমে নিষ্পত্তি হয়। প্রথম পাঁচ শটে দুই দল সমান ৫টি করে গোল করে। কিন্তু সাডেন ডেথে আর্জেন্টিনাকে জয় এনে দেন গোয়কোচিয়া। ফাইনালে আর্জেন্টিনার প্রতিপক্ষ ছিল আমন্ত্রিত হিসেবে খেলা মেক্সিকো। ফাইনালে বাসিলের শিষ্যরা ঘুরে দাঁড়ায়। তবে প্রথমার্ধে গোল করতে না পারলেও ৬৩ মিনিটে বাতিস্তুতার গোলে আর্জেন্টিনা লিড পায়। কিন্তু সেটা চার মিনিটের বেশি স্থায়ীত্ব পায়নি, ৬৭ মিনিটে গোল পরিশোধ করেন বেঞ্জামিন গালিন্দো।

৭৩ মিনিট পর্যন্ত ১-১ গোলে সমতা থাকার কারণে অনেকেই ভেবেছিলেন, এ ম্যাচও হয়তো টাইব্রেকারে গড়াবে। কিন্তু তাদের সেই আশঙ্কাকে ভুল প্রমাণ করে ৭৪ মিনিটে বাতিস্তুতা নিজের দ্বিতীয় গোল করে দলের জয় নিশ্চিত করেন। বাসিলে আরো একবার সাফল্যের পালক যুক্ত করে দেশের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন৷ তিনি আর্জেন্টিনাকে তখনকার সময়ে সেরা দল হিসেবে ভাবতে বাধ্য করেন৷ 

১৯৯১ সালে কোপা আমেরিকা জয়ের পর; Image Credit: Soccer International, Volume 4, Issue 4, September 1993

কিন্তু কোপা আমেরিকায় আর্জেন্টিনা শিরোপা জিতলেও ড্র’গুলো ফুটবল কর্তাদের চোখ এড়ায়নি৷ এ কারণে তারা বিশ্বকাপ বাছাইয়ে দলের পারফরম্যান্স নিয়ে শঙ্কিত ছিলেন। কিন্তু সেই দুশ্চিন্তাকে পাশ কাটিয়ে পেরু ও প্যারাগুয়ের বিপক্ষে জয় দিয়ে বাছাইপর্ব শুরু করে আর্জেন্টিনা। কিন্তু এরপরই শুরু হয় হারের বৃত্ত। কলম্বিয়ার ঘরের মাঠে ২-১ গোলে পরাজিত হয়ে প্রথমবারের মতো আর্জেন্টিনার কোচ হিসেবে হারের স্বাদ গ্রহণ করেন বাসিলে৷

তবে অ্যাওয়ে ম্যাচগুলো শেষ হওয়ায় ঘরের মাঠে ভালো কিছুর প্রত্যাশা করছিলেন আর্জেন্টিনার ফুটবল ভক্তরা। পেরুকে ২-১ গোলে হারিয়ে সেই প্রত্যাশা কিছুটা পূরণ করে বাসিলের দল। কিন্তু এর পরের ম্যাচে প্যারাগুয়ের সাথে ড্র করে বসে। ঘরের মাঠের পরের ম্যাচের প্রতিপক্ষ ছিল কলম্বিয়া। পুরো বাছাইপর্বে কলম্বিয়ার পারফরম্যান্স ছিল অনবদ্য, যা অজানা ছিল না আর্জেন্টিনার।

এল মনুমেন্টাল স্টেডিয়ামে প্রথমার্ধে এক গোলের লিড নেয় কলম্বিয়া। দ্বিতীয়ার্ধে আর্জেন্টিনাকে ঘরের মাঠে বিধ্বস্ত করে আরো চার গোল করে বড় ব্যবধানের জয় পায়। স্বাগতিক দর্শকরা কলম্বিয়াকে দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানায়। এদের মধ্যে ম্যারাডোনাও ছিলেন। তিনি সেদিন গ্যালারিতে বসে দলের এই হার দেখেন। এই হারে আর্জেন্টিনার বাছাইপর্ব থেকে বাদ পড়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। শেষ পর্যন্ত পেরু ও প্যারাগুয়ের ম্যাচটি ড্র হলে প্লে-অফ খেলার সুযোগ পায় আর্জেন্টিনা। প্লে-অফে তাদের প্রতিপক্ষ ছিল অস্ট্রেলিয়া। শেষ পর্যন্ত প্লে-অফ থেকে বিশ্বকাপে জায়গা পায় তারা।

১৯৯৩ সালে কোপা আমেরিকার ফাইনালে মেক্সিকোর বিপক্ষে নিজের প্রথম গোল করার পর গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতা; Image Credit: Agence France-Presse/Getty Images

 ‘৯৪ বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে গ্রিসের বিপক্ষে মাঠে নামে আর্জেন্টিনা। ম্যাচ শুরুর আগেই অনেকে আর্জেন্টিনার হার দেখেছিলেন৷ কিন্তু বাতিস্তুতার হ্যাটট্রিকে সবার ধারণা পাল্টে যায়৷ ৪-০ গোলের বড় এক জয় দিয়ে বিশ্বকাপে শুভ সূচনা করে বাসিলের শিষ্যরা৷ পরের ম্যাচে তাদের প্রতিপক্ষ ছিল আফ্রিকান ‘সুপার ঈগলস’ নাইজেরিয়া। আগের ম্যাচে তারা বুলগেরিয়ার বিপক্ষে ৩-০ গোলে জয় পেয়েছিল। আর্জেন্টিনার বিপক্ষেও লিড পায় ‘সুপার ঈগল’রা, কিন্তু আর্জেন্টিনার খেলোয়াড়রা ঘুরে দাঁড়াতে সময় নেয়নি। বাতিস্তুতা এবং ক্যানিজিয়ার গোলে ২-১ ব্যবধানে জয় পায় আলবিসেলেস্তেরা। 

প্রথম দুই ম্যাচ থেকে ছয় পয়েন্ট নেওয়ায় অনেকে আবারও বলা শুরু করেছিল, আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ জিতবে। ম্যারাডোনার পারফরম্যান্সও দুর্দান্ত ছিল। যার ফলে ভক্তরা স্বপ্ন দেখা শুরু করে৷ কিন্তু এক খবরে সব কিছু এলোমেলো হয়ে যায়৷ নাইজেরিয়ার বিপক্ষে ম্যাচশেষে ম্যারাডোনার ডোপ টেস্ট করা হয়, আবারও তিনি ডোপ টেস্টে ধরা পড়েন। ফলে তাকে বিশ্বকাপ থেকে বহিস্কার করে দেশে পাঠানো হয়। একদিকে ম্যারাডোনার বিদায়, অন্যদিকে ক্যানিজিয়ার ইনজুরিতে বাসিলের সব পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়ে যায়৷ দলে তখন প্রধান ভরসা তরুণ তুর্কি ওর্তেগা।

‘৯৪ বিশ্বকাপে নাইজেরিয়ার বিপক্ষে জয়ের পর দিয়েগো ম্যারাডোনাকে ডোপ টেস্টের জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে; Image Credit: Joe Cavaretta/Associated Press

কিন্তু ওর্তেগা দলের বিপর্যয় সামাল দিতে ব্যর্থ হন। পরের ম্যাচে বুলগেরিয়ার বিপক্ষে হেরে গ্রুপে তৃতীয় হয়। এরপর গ্রুপপর্বে সেরা চারটি তৃতীয় দলের একটি হিসেবে দ্বিতীয় রাউন্ডে জায়গা পায় তার। শেষ ১৬’তে আর্জেন্টিনার প্রতিপক্ষ ছিল রোমানিয়া। কিন্তু এই ম্যাচে ভঙ্গুর আর্জেন্টিনার আর রক্ষা হয়নি। রোমানিয়ার সাথে ৩-২ গোলে হেরে তারা বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নেয়৷ আর্জেন্টিনার কোচের বাসিলে অধ্যায়ের প্রথম সমাপ্তি ঘটে।

অনেকেই বলে থাকেন, ম্যারাডোনার অনুপস্থিতি আর্জেন্টিনার ব্যর্থতার কারণ ছিল। কিন্তু সত্যিকার অর্থে, ম্যারাডোনার বিকল্প তখন থাকলেও ক্যানিজিয়া’র ইনজুরি আর্জেন্টিনা দলকে বেশি ভুগিয়েছিল। বিশ্বকাপ ব্যর্থতার পর বাসিলে জাতীয় দল ছেড়ে ক্লাব ফুটবলে ফিরে যান। অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ, রেসিং ক্লাব, বোকা জুনিয়র্সের মতো ক্লাবে কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন৷ কিন্তু তার দক্ষতা ও প্রাজ্ঞতা তাকে আবারও আর্জেন্টিনার জাতীয় দলের ডাগ-আউটে ফিরিয়ে আনে।

মেসিকে দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন আলফিও বাসিলে; Image Source: Mundo Albiceleste

 ২০০৬ বিশ্বকাপে ব্যর্থতার পর হোসে পেকারম্যানের জায়গায় বাসিলেকে নিয়োগ দেয় এএফএ৷ কিন্তু বাসিলের দ্বিতীয় অধ্যায় মোটেই সুখকর ছিল না। তার অধীনে ২০০৭ সালে আর্জেন্টিনা কোপা আমেরিকা জিততে ব্যর্থ হয়৷ ফাইনালে আর্জেন্টিনা হেরে যায় চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্রাজিলের কাছে। এরপর ২০১০ বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে দল ধারাবাহিকভাবে খারাপ করার কারণে তাকে কোচের পদ থেকে সরে যেতে হয়৷ ২০০৬ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত তিনি দ্বিতীয় মেয়াদে আর্জেন্টিনার কোচের দায়িত্ব পালন করেন৷ এই সময়ে মেসির উত্থানের শুরু দেখেন। যদিও মেসি সেই পেকারম্যানের সময় থেকেই দলে ছিলেন। বাসিলের কাছেও মেসি পছন্দের ছিলেন।

বাসিলে তার দ্বিতীয় মেয়াদে সফল হতে না পারলেও ফুটবল ইতিহাসে এক অনন্য কীর্তি গড়ে গেছেন। বিশ্বের একমাত্র কোচ হিসেবে তিনি মেসি ও ম্যারাডোনাকে কোচিং করিয়েছেন। তার দলকে সুসংগঠিত করার দারুণ ক্ষমতা ছিল। এ কারণেই সর্বশেষ বাসিলের অধীনে আর্জেন্টিনা বড় কোনো শিরোপা জিতেছে৷ ফলে, যতদিন না আর্জেন্টিনা আবার বড় শিরোপা জিততে পারবে, ততদিন বাসিলে আর্জেন্টিনার সর্বশেষ সোনালী যুগের সফল কোচ হিসেবে পরিগণিত হবেন। 

This article is in Bangla language. It is about Argentine last trophy winner coach Alfio Basile.  He is the only man to coach Maradona and Messi, and Argentina's glorious early-90s of Batistuta, Simeone and Redondo. Necessary references have been hyperlinked.

Featured Image Source:  AFP

Related Articles

Exit mobile version