বছর পাঁচেক আগের কথা। বাংলাদেশের ক্রিকেটের ইতিহাসে অন্যতম সাহসী ও গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন মাশরাফি বিন মুর্তজা। ভারতের বিপক্ষে ২০১৫ সালের ওয়ানডে সিরিজ শুরুর আগের দিন তিনি উইকেটটা একটু দেখেই ড্রেসিংরুমে ছুটলেন।
মাশরাফির চোখ তখন চকচক করছে। উইকেটের ফাটল আর ঘাসের হালকা আবরণ তাকে ভাবিয়ে তুলেছিল। সতীর্থদের সাথে কথা বললেন; জানালেন, তিনি চার পেসার খেলাতে চান। অর্থ হলো, মাশরাফি অভিষেক করাতে চান মুস্তাফিজুর রহমানের।
মাশরাফি বলেন,
‘আমি কোচ (চান্দিকা) হাতুরুসিংহেকে বললাম, মুস্তাফিজের কাটারগুলো অন্যরকম আর খুব ভালো প্রভাব ফেলতে পারবে। ভারত বিপদে পড়তে পারে। সাকিব (আল হাসান) ও তামিম (ইকবাল) আমার সিদ্ধান্ত পছন্দ করলো।’
মাশরাফি হীরা চিনতে ভুল করেননি। কীভাবে নেটে মুস্তাফিজ বাংলাদেশের শীর্ষ ব্যাটসম্যানদের ভোগাচ্ছিলেন, সেটা তার নজর এড়ায়নি। ততদিনে পাকিস্তানের বিপক্ষে মুস্তাফিজের টি-টোয়েন্টি অভিষেক হয়ে গেছে। সেই স্মৃতি সবার মনেই তাজা ছিল।
তবে, কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল আরাফাত সানির ব্যাপারে। পাকিস্তানকে ৩-০ ব্যবধানে ওয়ানডেতে হোয়াইটওয়াশ করার সিরিজটা তিনি খেলেছেন। পারফরম্যান্সও ছিল ভাল।
মাশরাফি বলেন,
‘আমি তাকে (হাতুরুসিংহে) বললাম, আরাফাত সানি পাকিস্তানের বিপক্ষে ভাল করেছে। সে ভারতের বিপক্ষে ভাল করলে হয়তো ৪৫ রান দিয়ে দুই উইকেট পাবে। আর মুস্তাফিজ যদি খুব খারাপও করে, তাহলে হয়তো ৬০ রান হজম করবে। এই ১৫ রান কি খুব বেশি কিছু হবে?’
হাতুরুসিংহে মেনে নিলেন। সেই সপ্তাহে বাংলাদেশ ক্রিকেটে নতুন ইতিহাস রচনা হল। মুস্তাফিজের ১৩ উইকেটের সুবাদে প্রথমবারের মতো ভারতের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজ জিতল বাংলাদেশ।
পরের সিরিজটা ছিল দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে, দেশের মাটিতে। সেই সিরিজেও যথারীতি ‘হিট’ ছিলেন মুস্তাফিজ। সে বছর আইসিসির বর্ষসেরা ওয়ানডে দলে ছিল বাঁহাতি এই পেসারের নাম। পরের বছর এশিয়া কাপ টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশকে ম্যাচ জেতান, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে গিয়ে এক ম্যাচে নেন পাঁচ উইকেট।
ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে (আইপিএল) ‘হটকেক’-এ পরিণত হন তিনি। সানরাইজার্স হায়দরাবাদ তাকে দুই লাখ ডলার দিয়ে কিনে নেয়। সেবার আইপিএলে প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়ন হয় হায়দরাবাদ। মুস্তাফিজের ভূমিকা তাতে স্মরণ না করলেই নয়, সেরা উদীয়মান তারকার পুরস্কার জিতে নেন তিনি। পুরো টুর্নামেন্টজুড়ে আলোচনায় ছিল তার ধারালো অফ-কাটার আর নিখুঁত ইয়র্কার। স্লোয়ার ডেলিভারিগুলো ছিল স্পিনারদের মতো। স্পিনারদের মতোই ছুঁড়তেন, শুধু গতি স্পিনারদের চেয়ে একটু বেশি ছিল। ওই ১২টা মাস বিশ্বজুড়ে ব্যাটসম্যানদের রীতিমতো ধাঁধাঁয় ফেলে দিয়েছিলেন তিনি। গণমাধ্যমের চোখে তিনি ছিলেন ‘কাটার মাস্টার’।
মুস্তাফিজকে মূলত মাটিতে নামিয়ে আনে এক বেরসিক ইনজুরি। ২০১৬ সালে ইংল্যান্ডে গিয়েছিলেন টি-টোয়েন্টি ব্লাস্ট খেলতে। সেখানে কাঁধের ইনজুরিতে পড়েন, মাঠ থেকে দূরে থাকেন পাক্কা আট মাস। বাংলাদেশের ক্রিকেট সার্কিটে গুঞ্জন ছিল, মাত্রাতিরিক্ত ক্রিকেট খেলাটাই মুস্তাফিজের ইনজুরির কারণ।
ইনজুরিতে পরার আগে সাদা বলের ক্রিকেট তিনি খেলেছিলেন ২২টি। তাতে ১৩.০৮ গড়ে পান ৪৮ উইকেট। ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে তিনি ফিরে প্রথম ৩২টি উইকেট নিতেই গড়টা দ্বিগুন হয়ে যায়।
মুস্তাফিজ যখন জাতীয় দলে আসেন, তখন পেস বোলিং কোচ ছিলেন জিম্বাবুয়ের হিথ স্ট্রিক। তিনি বলেন,
‘ওর কাঁধের ইনজুরিটা বড় একটা ভূমিকা রেখেছে। আগে যে বড় বড় কাটারগুলো ও করতে পারতো, সেটা এই ইনজুরির কারণে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। এটা ওর অন্যতম বড় অস্ত্র। শুরুতে এর জন্যই ও বিরাট সাফল্য পাচ্ছিল। আর এখন বোলারের রহস্য নিয়ে রীতিমতো তদন্ত করা হয়। ব্যাটসম্যানরাও ওর বোলিং নিযে অনেক কাজ করেছে। বোঝাপড়াটাও তাই আগের চেয়ে ভালো।’
আইপিএলেও চিত্রটা একই রকম ছিল। প্রথম মৌসুমে ১৭ উইকেট পান ২৪.৭৬ গড় আর ৬.৯০ ইকোনমি রেটে। অথচ, ২০১৮ সালে মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের হয়ে পান কেবল সাত উইকেট, গড় ৩২.৮৫। ইকোনমি ওভার প্রতি প্রায় ১.৫ বেড়ে যায়।
এটুকু পরিসংখ্যানেই স্পষ্ট যে, কোনো একটা গণ্ডগোল আছে। যারা মুস্তাফিজের খুব কাছের লোক, তারা স্বীকার করেন মুস্তাফিজ এখন স্লোয়ার ডেলিভারি নিয়ে খুব ‘স্ট্রাগল’ করছেন। তবে তিনি ফুরিয়ে গেছেন, সেটা বলার উপায় নেই। কারণ, ২০১৯ সালের বিশ্বকাপেও তিনি তেমন চার বোলারের একজন, যারা বিশ কিংবা তার বেশি সংখ্যক উইকেট পেয়েছেন।
তবে এটা ঠিক যে, মুস্তাফিজের ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট ক্যারিয়ারটা থমকে গেছে। ইনজুরি লুকিয়ে খেলতে গেছেন – এমন অভিযোগ স্বয়ং বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডই (বিসিবি) করেছে। তিনি টেস্ট ক্রিকেটে কখনোই নিজেকে খুব একটা নিজেকে মেলে ধরতে পারেননি। সম্প্রতি তিনি এটাও জানিয়েছেন যে, তিনি বেশি মনোযোগ দিতে চান সাদা বলের ক্রিকেটেই। কোচরাও তাকে এখন টেস্টে নেওয়ার পক্ষপাতি নন। ঢাকায় বসে এক সংবাদ সম্মেলনে কোচ রাসেল ডমিঙ্গো তেমনটাই বলেছিলেন,
‘আমার মনে হয় না, এখনো ও টেস্টের জন্য প্রস্তুত। কিছু টেকনিক্যাল দিকে ওর উন্নতি দরকার।’
ক’দিন আগেই টেস্ট অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন মুমিনুল হক। নতুন অধিনায়ক আর কোচ ডমিঙ্গো – দু’জনেই টেস্টের জন্য এখন আবু জায়েদ রাহী ও এবাদত হোসেনকে চাইছেন। আর টি-টোয়েন্টিতে দল নতুন ও ভালো কোনো কম্বিনেশন খুঁজছে।
এই সময়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও এসেছে বিস্তর পরিবর্তন। মুস্তাফিজের কাছাকাছি সমযে ক্যারিয়ার শুরু করে দক্ষিণ আফ্রিকার কাগিসো রাবাদা কিংবা ভারতের জাসপ্রিত বুমরাহ এখন ‘সুপারস্টার’। অন্যদিকে, মুস্তাফিজের সময় ফুরিয়ে আসছে। প্রশ্নও উঠছে, তাহলে কি মুস্তাফিজ ফুরিয়ে আসছেন? তার শুরুর সেই আগুন কি আর কখনো ফিরবে না?
নবনিযুক্ত পেস বোলিং কোচ ওটিস গিবসন অবশ্য হাল ছাড়তে নারাজ। তিনি বলেন,
‘আমি মনে করি, এখনো সে বাংলাদেশ দলের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। বিশ্বের যেকোনো দলই তার মতো যোগ্যতাসম্পন্ন একজন বাঁহাতি ফাস্ট বোলারকে দলে রাখতে চাইবে। তার যোগ্যতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। এখন কেবল তাকে নিজের মানটা আরো বাড়িয়ে নিতে হবে।’
তাহলে মুস্তাফিজকে ঠিক কী করতে হবে? গিবসন বললেন মুস্তাফিজকে কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করতে,
“Can you build enough pressure first and attack later? Do you have wicket-taking options with the new ball, in the middle of the game, and maybe when the ball is reversing? Those are the things that Fizz has to work out.”
ঘরোয়া ক্রিকেটের শীর্ষ কোচ মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন মনে করেন, টি-টোয়েন্টি ফ্র্যাঞ্চাইজি দুনিয়ায় নিজের হারানো আসনটা ফিরে পেতে পারেন মুস্তাফিজ। তবে, এর জন্য নিজের মধ্যে বৈচিত্র্য বাড়াতে হবে। তিনি বলেন,
‘ওর মধ্যে ডেডিকেশন আছে। এটা সত্যি যে, ইনজুরি একটা বড় ব্যাঘাত ঘটিয়েছে ওর উন্নতিতে। আর একটা ব্যাপার মানুষকে বোঝানো যায় না যে, একজন খেলোয়াড়ের উন্নতির ধারা সবসময় ধারাবাহিক হয় না। সব সময় এটা এগোবে, এমন ভাবাও ঠিক না। এমন কিছু সময় আসে, যখন খেলোয়াড়রা একটা জায়গায় স্থির হয়ে থাকেন।’
সালাহউদ্দিন মনে করেন, মুস্তাফিজ এখন তার ক্যারিয়ারের সেই জায়গাটাতেই আটকে আছেন। তিনি বলেন,
‘এই পর্যায়টা এমন যখন একজন খেলোয়াড়ের উন্নতি করার মানসিকতাটা পাল্টানো উচিৎ নয়। আসলে এটা নিজেকে আরেক ধাপ ওপরে নিয়ে যাওয়ার আগের স্তর। খেলোয়াড়দের উন্নতির পথটা কখনো মসৃন হয় না। প্রতিটা ধাপে এমন কিছু সময় আসে, যখন তাদের থেমে যেতে হয়। তখন তারা আরেকটা ধাপে ওঠার চেষ্টা করেন। এটা অটোমেটিক প্রোসেস।’
বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে (বিপিএল) নিয়মিত কোচিং করানো সালাহউদ্দিন বিষয়টা উদাহরণ দিয়ে ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন,
‘ধরেন, কোনো একজন ব্যাটসম্যান শুধু ড্রাইভ আর পুল শট খেলতে পারে। এই শটগুলো দিয়েই সে রান করে। একদিন হলো কি, ব্যাটসম্যান একেবারেই আটকে গেলেন। কারণ, তার হাতে আর কোনো বিকল্প রাস্তা নেই। কারণ তিনি জানেন না, কীভাবে স্কয়ার কাট কিংবা ফ্লিক করতে হয়। তখন তিনি এসব নিয়ে কাজ করেন। ক্রিকেটে এভাবেই অগ্রগতি হয়। এখানে একটা একটা করে শিখতে হয়। মুস্তাফিজের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার হয়েছে। ও এখন একটা জায়গায় আটকে আছে। আমি আশাবাদী যে ও ফিরে আসবে। কারণ, সেই ক্ষুধাটা ওর মধ্যে দেখতে পাই। আমি জানি না, ও নিজের বোলিংয়ে নতুন কোন বৈচিত্র্য আনতে চলেছে, কিন্তু এটা বুঝি যে ওর ভেতরে কিছু একটা চলছে। তাই, এটা বলা যায় না যে ও আর কখনোই আইপিএল খেলতে পারবে না।’
পাঁচ বছর আগে মুস্তাফিজের ওপর ভরসা রেখেছিলেন মাশরাফি। এখন মাশরাফি আর অধিনায়ক নন। তবে সেই প্রতিদানটা বাকি আছে, মুস্তাফিজ আছেন। আর এর জন্য যা করার করতে হবে ‘ফিজ’কেই!