প্রথম টি-টোয়েন্টির পর সাকিব আল হাসান হঠাৎ গায়েব। গায়েব মানে একেবারে অদৃশ্য। অনুশীলনে তাকে পাওয়া যাচ্ছে না, এমনি এমনি দলের সঙ্গে ড্রেসিংরুমেও তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। তাহলে সাকিব কোথায়? সাকিব অসুস্থ। আবহাওয়ার চাপ তার বুকে চেপে বসেছে। যে কারণে বুকে-নাকে ঠাণ্ডা-সর্দি-জ্বর, মাথাব্যথা, আর তীব্র পেটের ব্যথা; সব রোগ একসাথে। অবস্থাটা এতটাই সঙ্গীন যে সাকিব দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টির আগে আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনেই এলেন না। ম্যাচ পূর্ব সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো অধিনায়ককে ছাড়া। সাকিব খেলবেন তো? সেই সংশয় ছিল ম্যাচের আগের রাত; ম্যাচের দিন সকালেও।
কিন্তু সাকিব মাঠে নামলেন। অসুস্থতা নিয়েই মাঠে নামলেন। শুধু নামলেন না, জিতলেন সবকিছু; গড়লেন নতুন রেকর্ড। সাকিব হলেন ম্যাচসেরা, মিরপুরের কুয়াশাচ্ছন্ন পরিবেশে ক্যারিবিয়ানদের বিপক্ষে ব্যাটে আর বলে আবিস্কার করলেন নতুন কোনো টর্নেডো।
ব্যাট হাতে মাত্র ২৬ বলে খেললেন অপরাজিত ৪২ রানের ঝড়ো ইনিংস, সঙ্গে বল হাতে ৫ উইকেট। সব মিলিয়েই ম্যাচ সেরা সাকিব। বলে রাখা ভালো, আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে এটাই সাকিবের প্রথম ৫ উইকেট পাওয়া। এর মধ্যে দিয়ে তিন ফরম্যাটেই এক ম্যাচে ৫ উইকেট নেওয়ার গৌরব অর্জন করলেন প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে। বিশ্বজুড়ে তার অবস্থান ৮ নম্বরে।
১.
ম্যাচ শেষে সাকিব যখন সংবাদ সম্মেলনে এলেন, তখন প্রস্তুতি চলছিলো। এর মাঝেই দলের মিডিয়া ম্যানেজার রাবিদ ইমামের সঙ্গে তার কথা চলছে। এক ফাঁকে বলে উঠলেন, “ভাই আমি তো কিছুই খাইতে পারি না, কিছুই না, স্যালাইনও না।“
রাবিদ ইমাম একপর্যায়ে সবাইকে জানালেন, সাকিব নাকি আগের দিন থেকে প্রায় পুরোটা সময় অভুক্ত ছিলেন। সেই সাকিবকে দেখে বোঝার উপায় নেই তার অধীনে কিছুক্ষণ আগে বিশ্বের এক নম্বর টি-টোয়েন্টি দলকে ৩৬ রানে পরাজিত করেছে আর দল।
ম্যাচের আগে তাত্ত্বিকভাবে বাংলাদেশ সফরকারীদের চেয়ে পিছিয়ে ছিল। আগের ম্যাচে হারের কারণে বাড়তি প্রত্যাশার চাপ ছিল সাকিব-মুশফিকদের উপর। পাশাপাশি দলটা ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং ফরম্যাটটা টি-টোয়েন্টি; সেটাও মাত্থায় ছিল বাংলাদেশ টিম ম্যানেজমেন্টের। সবশেষে শীতের শিশির, যা দুই দলের মধ্যে ব্যবধান গড়ে দিতে পারতো।
সবকিছুকে জয় করেছে বাংলাদেশ। আগে ব্যাট করতে নেমে ৪ উইকেটে ২১১ রানের বিশাল দলীয় ইনিংস খেলতে গিয়ে ওপেনার লিটন কুমার দাস ৩৪ বলে ৬০ রানের বিশাল এক ইনিংস খেলে দলের ব্যাটিং লাইনআপে দারুণ এক আত্মবিশ্বাস ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। বাকি ওভারগুলোতে তাই সাকিবরা কেবল ক্যারিবিয়ান বোলারদের উপর ঝড় উঠিয়েছেন। সাকিবের ব্যাটে অপরাজিত ৪২, সৌম্য ৩২ আর মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ অপরাজিত ৪৩।
১২০ বলের ইনিংসে ২১২ রানের লক্ষ্য ছেলেখেলা নয়। কিন্তু আবারও, প্রতিপক্ষ সেই ওয়েস্ট ইন্ডিজ বলে দুশ্চিন্তার কপালে ভাঁজ পড়েছেই বাংলাদেশের। তাই বল হাতে শুরু থেকেই চেপে ধরার চেষ্টা। ফলাফল, ১৭৫ রানে গুটিয়ে দেওয়া ক্যারিবিয়ানদের।
আর এই লড়াইয়ে প্রায় সবটুকু আলো নিজের দিকে কেড়ে নিয়েছিলেন সাকিব। বিশ্বসেরা অলরাউন্ডারের মানদণ্ডের পারদ যে অনেক উপরে, তা-ও বুঝিয়েছেন প্রথম উইকেট নিতে গিয়েই। সাকিব যখন নিকোলাস পুরানকে তামিম ইকবালের তালুবন্দী করালেন, তার ঠিক আগের বলে একই ডেলিভারিতে সাকিবকে ছক্কা হাঁকিয়েছেন পুরান। সাকিব প্রমাণ করেছেন নিজেদের মোমেন্টামকে।
নিজেদের জন্য বিপদজনক হয়ে ওঠার আগেই ফিরিয়েছেন হেটমায়ারকে। ড্যারেন ব্রাভো, কার্লোস ব্রেথওয়েট আর ফাবিয়ান অ্যালেনকে উইকেটে ঠিকমতো দাঁড়াতেই দেননি। সব মিলিয়ে নিজের কোটার ৪ ওভার বল করে খরচ করেছেন মাত্র ২০ রান। সঙ্গে একটি রেকর্ড, একটি জয়।
২.
বন্ধু তামিম ইকবাল অনেক আগেই দেশের হয়ে তিন ফরম্যাটে সেঞ্চুরির কীর্তিটা নিজের নামে লিখে নিয়েছিলেন। সাকিবের সামনে প্রথম হওয়ার সুযোগ ছিল কেবল বোলিংয়ে। সেটাও হয়ে গেল এবার। প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে ৫ উইকেট তুলে নিলেন। এই তালিকায় সাকিবের আগে নাম লিখিয়েছেন আরও সাতজন। তারা হলেন ভারতের কুলদীপ যাদব ও ভুবেনেশ্বর কুমার, দক্ষিণ আফ্রিকার ইমরান তাহির, পাকিস্তানের উমর গুল, শ্রীলঙ্কার অজন্তা মেন্ডিস ও লাসিথ মালিঙ্গা এবং নিউজিল্যান্ডের টিম সাউদি।
দেশের জার্সিতে সাকিব টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে এর আগে এক ম্যাচে সর্বোচ্চ ৪ উইকেট নিয়েছেন। সেটাও তিনবার। ওয়ানডেতে পাঁচ উইকেট নিয়েছেন একবার। কিন্তু সাদা পোশাকের টেস্টে এই কীর্তির সংখ্যা ১৮ বার!
একে তো অসুস্থতা, তার উপর উইকেটের অবস্থা আর প্রত্যাশার চাপ। সবকিছু মিলিয়ে হয়তো পুরো ব্যাপারটি একেবারে সহজ ছিল না সাকিবের জন্য। তারপরও, কোনো ‘প্রথম’ মানেই স্পেশাল। সাকিব তাই সংবাদ সম্মেলনে বললেন,
ডিউয়ের মধ্যে বোলিং করাটা অবশ্যই ডিফিকাল্ট। তারপরও বলবো খুবই ভালো লেগেছে, প্রথমবার কোনো কিছু হলে ভালো লাগেই। তিন ফরম্যাটের এক ফরম্যাটে ছিলো না, এখন হয়ে গেল। কোনকিছুতে চ্যালেঞ্জ থাকলে চ্যালেঞ্জটা নিতে ভালো লাগে। চেষ্টা থাকে দলের জন্য কন্ট্রিবিউট করার। যদি হয় ভালো, না হলে অনেক সময় দেখতে খারাপ লাগে। তবে সবসময় চেষ্টা থাকে।
এহেন রেকর্ডের পরও সাকিব আসলে ম্যাচে নিজের ব্যাটিংকেই এগিয়ে রাখছেন। সংবাদ সম্মেলনে এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন,
উইকেট পাওয়া একটু ভাগ্যের বাপার। আরেকটা জিনিস যেটা আছে আমার কাজটা করতে হবে, আর ভাগ্য সাথে থাকাটা জরুরি। তো দুইটাই আজকে ছিল। আমার কাছে যেটা মনে হয়, ব্যাটিংটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছিলো ঐ সময়। কারণ যেটা বললাম, ঐ সময় আমাদের দুইজনের একজনের উইকেট পড়ে যেত, আর পরের ব্যাটসম্যান যদি আউট হয়ে যেত তাড়াতাড়ি, তাহলে এরকম রান আমাদের হতো না। একটা সময় যখন পর পর দুই উইকেট পড়ে গেল, তখন আমি চিন্তা করেছি যে আমাদের আবার ব্যাটিংয়ে ধস নামবে কি না।
তো ঐ সময় আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। রিয়াদ ভাইয়ের অনেক ক্রেডিট ঐ টাইমে এসে প্রেশারটা ওদের দিকে শিফট করে দিয়েছে, যেটা আমাদের কাজটা অনেক সহজ করে দিয়েছে। রিয়াদ ভাই যেহেতু অনেক শট খেলছিল, তাই আমাদের জন্য ইনিংস বিল্ড আপ করাটা ইজি ছিল। আমার বেশি কাজ ছিল রোটেট করা, আর ওরকম বল এলে বাউন্ডারি মারা। আমার কাছে মনে হয়, রিয়াদ ভাইয়ের ব্যাটিং অনেক স্পেশাল ছিল। অবশ্যই লিটন ও সৌম্যর ইনিংসও খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। সবাই কন্ট্রিবিউট করেছে, এগুলো দলের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
আগের ম্যাচে পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা কেন ভালো করতে পারেনি, সেই প্রশ্নের জবাবটা ব্যাটসম্যানদের থেকেই নিতে বলেছিলেন সাকিব। বক্তব্যটা অনেকের কাছেই চোখে লেগেছে। জয়ের ম্যাচে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলতেই জানিয়ে দিলেন, ব্যাপারটি স্রেফ মজা ছিল। পাশাপাশি সংবাদমাধ্যমকে খানিকটা খোঁচা দিতেও ভুল করেননি।
সাকিব বলেছেন,
ব্যাটসম্যানদের দোষ দিয়ে আসিনি। উনাকে বলেছি, এটা কোনো নেগেটিভ ইস্যু না। ফান করে বলেছি। পুরা উত্তরটা তো আপনারা লিখবেন না, বা বলবেন না। জাস্ট ঐ নেগেটিভ নিউজটা আসে আর কী। কারণ আমার নেগেটিভ নিউজ মানুষ বেশ ভালো খায়। আমিও পছন্দ করি। কারণ আমি মনে করি এটা আমাকে ভাল করার জন্য অ্যাটলিস্ট একটু হলেও প্রেরণা যোগায়!
আইপিএলে সাকিব নিজের জায়গাটা ধরে রাখতে পেরেছেন। সানরাইজার্স হায়দ্রাবাদেই খেলবেন তিনি। তার আগে প্রস্তুতিটা ভালোই সেরে নেওয়া হচ্ছে। সাকিব এগোতে থাকুক নিন্দুকের মুখে ছাই ঢেলে, সাকিব এগোতে থাকুক সেরা হয়ে, বাংলাদেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন হয়েই।