১.
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর দ্বিতীয় অ্যাশেজ সিরিজ। তখন অ্যাশেজে অস্ট্রেলিয়ার আধিপত্য চলছিল। ১৯২০-২১ মৌসুমে নিজেদের মাটিতে ৫-০ ব্যবধানে অ্যাশেজ পুনরুদ্ধার করার পর ১৯২১ মৌসুমে ইংল্যান্ডের মাটিতে অ্যাশেজ জিতেছিল ৩-০ ব্যবধানে। সে সময় অস্ট্রেলিয়ার বোলারদের সামনে কোণঠাসা হয়ে ছিলেন ইংল্যান্ডের ব্যাটসম্যানরা। ব্যতিক্রম ছিলেন শুধুমাত্র ফ্রাঙ্ক উলি। ইংল্যান্ডের বাঁহাতি এই কিংবদন্তি ব্যাটসম্যান ১৯২০ এবং ১৯২১ সালের অ্যাশেজে মোট ১৮ ইনিংস ব্যাট করে ছয়টি অর্ধশতকের সাহায্যে ৩৪.৮৯ ব্যাটিং গড়ে ৬২৮ রান সংগ্রহ করেছিলেন।
১৯২১ সালের ১১ জুন। লর্ডসে অ্যাশেজের দ্বিতীয় টেস্টে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টসে জিতে প্রথমে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ইংল্যান্ড। ব্যাট করার ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এমনটা বলার উপক্রম নেই। কারণ সে সময় অবস্থা এমন ছিল যে, ইংল্যান্ড আগে ব্যাট করুক কিংবা পরে, কোনো পরিস্থিতিতেই বাড়তি সুবিধা আদায় করে নিতে পারতো না। তাই টসে জিতে প্রথমে ব্যাট করাতে খুব বেশি পার্থক্য গড়ে দিত না। প্রথমে ব্যাট করতে নামা ইংল্যান্ডের হয়ে ফ্রাঙ্ক উলি একপ্রান্ত আগলে রাখলেও আরেক প্রান্তে নিয়মিত বিরতিতে উইকেট হারাতে থাকে তারা। শেষ পর্যন্ত ইংল্যান্ড ১৮৭ রান সংগ্রহ করে, যার মধ্যে উলি একাই করেন ৯৫ রান। সম্পূর্ণ ইনিংসে দলের মোট রানের ৫০% রান সংগ্রহের ঘটনা আছে ১৭৩ টি, এর মধ্যে একটি উলির।
প্রথম ইনিংসে ৯৫ রান সংগ্রহের পর দ্বিতীয় ইনিংসেও রান পেয়েছিলেন উলি। দ্বিতীয়বারও শতক হাঁকাতে ব্যর্থ হলেও খেলেছিলেন ৯৩ রানের অসাধারণ ইনিংস। তার দু’টি অসাধারণ ইনিংসের কল্যাণে অস্ট্রেলিয়াকে চতুর্থ ইনিংসে ১২৯ লক্ষ্য ছুঁড়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল ইংল্যান্ড, যা আট উইকেট হাতে রেখেই টপকে যায় অস্ট্রেলিয়া।
২.
ফ্রাঙ্ক এডওয়ার্ড উলি। ১৮৮৭ সালের ২৭ মে কেন্টের টনব্রিজে জন্মগ্রহণ করেন। ক্রিকেটের প্রতি আগ্রহ শৈশব থেকেই। কেন্টের অ্যাঞ্জেল গ্রাউন্ড তার বাসস্থান থেকে মাত্র ১০০ গজ দূরে। সেখানে তার আনাগোনা ছিল নিয়মিত। যখনই সময় পেতেন, তখনই ছুটে যেতেন অ্যাঞ্জেলে। মাত্র দশ বছর থেকেই নিয়মিত অনুশীলন করতেন তিনি। এরপর সেখানে বেশ কয়েক বছর খেলার পর ১৯০৫ সালে কেন্টের দ্বিতীয় একাদশে খেলার সুযোগ পান। পরের বছরেই কেন্টের মূল দলের হয়ে কাউন্টি ক্রিকেট খেলেন উলি।
ইংল্যান্ডের হয়ে ১৯০৯ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে ফ্রাঙ্ক উলি’র। মাঝখানে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাধা পড়লেও তার ক্যারিয়ার থমকে যায়নি। ১৯৩৪ সাল পর্যন্ত আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ইংল্যান্ডের হয়ে ৬৪ ম্যাচ খেলেন। ৬৪টি টেস্টে পাঁচটি শতক এবং ২৩টি অর্ধশতকের সাহায্যে ৩৬.০৭ বোলিং গড়ে ৩,২৮৩ রান সংগ্রহ করেছিলেন। বাঁহাতি এই ব্যাটসম্যান বল হাতেও বেশ সফল ছিলেন। লেফট-আর্ম এবং স্লো লেফট-আর্ম অর্থোডক্স, দুই স্টাইলেই বল করতেন তিনি। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ইনিংসে চারবার পাঁচ উইকেট এবং একবার ম্যাচে দশ উইকেট শিকার করে ৩৩.৯১ বোলিং গড়ে ৮৩ উইকেট শিকার করেছিলেন তিনি।
৩.
ফ্রাঙ্ক উলি তার ক্যারিয়ারের বেশিরভাগ ম্যাচ খেলেছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকা এবং অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ২৬ ম্যাচ এবং অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৩২ ম্যাচ খেলেছিলেন তিনি। এই দুই দেশে তার আসা-যাওয়াও নিয়মিত হতো। তিনি ১৯০৯ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে যান, সেখানে লোকাল এক দলের বিপক্ষে খেলেন। ঐ দলে ক্রিকেটারের সংখ্যা ছিল ২২জন, ২২ জনের সবাই ফিল্ডিংও করেছিল।
ফ্রাঙ্ক উলি প্রথম অস্ট্রেলিয়া সফরে যান ১৯১১ সালে। অ্যাশেজের ঐ আসরে অস্ট্রেলিয়াকে ৪-১ ব্যাবধানে পরাজিত করেছিল ইংল্যান্ড। ঐ সফরে বেশ ভালো সময় কাটিয়েছিলেন উলি। তাসমানিয়ার বিপক্ষে অপরাজিত ৩০৫ রানের ইনিংস খেলেছিলেন। সফরে মোট ৭৮১ রান করেছিলেন ৫৫.৭৮ ব্যাটিং গড়ে, এবং ১৭ উইকেট শিকার করেছিলেন ২৯.৫৮ বোলিং গড়ে।
একজন ক্রিকেটারের সেরা সময় শুরু হয় ২৫ বছর বয়সের পর থেকে। ১৯১৪ সালে যখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়, তখন উলির বয়স ছিল ২৭ বছর। সে সময় তার ক্যারিয়ার থেকে মূল্যবান চার বছর হারিয়ে গিয়েছিল। ১৯১৯ সালে যুদ্ধশেষে তার ক্যারিয়ার যেখানে শেষ হয়েছিল, সেখান থেকেই শুরু হয়। মাঝখানের সময় তিনি বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করেছিলেন। এই সুখী বন্ধনের স্থায়িত্ব ছিল প্রায় ৫০ বছর।
৪.
ফ্রাঙ্ক উলি তার সময়কার অন্যতম সেরা আক্রমণাত্মক ব্যাটসম্যান ছিলেন। দ্রুত রান তোলার ক্ষেত্রে তার সময়কার অন্যান্য ব্যাটসম্যানদের চেয়ে বেশ এগিয়ে ছিলেন তিনি। ডন ব্র্যাডম্যান যেখানে তার ক্যারিয়ারে মাত্র ছয়টি ছয় হাঁকিয়েছিলেন, সেখানে তার থেকে দুই দশক আগে খেলা শুরু করা উলি হাঁকিয়েছেন ১৫টি ছয়।
১৯২৩ সালে ফ্রাঙ্ক উলি তার কাউন্টি ক্লাব কেন্টের হয়ে সর্বোচ্চ ২৭০ রানের ইনিংস খেলেছিলেন। শক্তিশালী মিডলসেক্সের বিপক্ষে ২৭০ রান করতে তিনি মাত্র ২৬০ মিনিট ক্রিজে ছিলেন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও তার এমন আক্রমণাত্মক ব্যাটিংয়ের দেখা মিলেছিল। ১৯২৪ সালে সিডনিতে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ১৩৯ বলে ১২৩ রান সংগ্রহ করেছিলেন। দুর্দান্ত এই ইনিংস খেলার পথে আর্থার মেইলির বলে তিনি বলকে মাঠ ছাড়া করেন। পরে বল খুঁজে পেতে দশ মিনিট সময় লাগে। তার বিরতিহীন আক্রমণাত্মক ব্যাটিং দেখে আর্থার বলেছিলেন,
‘আমি অন্তত দশ মিনিটের জন্য স্কোরিং-রেট স্লো করতে পেরেছিলাম।’
তার দীর্ঘ ক্যারিয়ারে এমন আক্রমণাত্মক ইনিংস খেলার ঘটনা বহু আছে। ১৯৩১ সালে ৪৪ বছর বয়সী উলি ইয়র্কশায়ারের শক্তিশালী বোলিং আক্রমণের বিপক্ষে মাত্র ২০০ মিনিট ব্যাট করে ১৮৮ রান তুলেছিলেন।
সাল ১৯৩৪, উলির বয়স ৪৭। এই বয়সে অন্যান্য ক্রিকেটাররা বিদায়ের প্রহর গোনেন। কিন্তু তিনি এই বয়সে কেন্টের হয়ে স্মরণীয় এক মৌসুম কাটান, দশটি শতক হাঁকিয়েছিলেন তিনি। প্রতিটি শতকের জন্য গড়ে ১০৭ মিনিট ব্যাট করেছিলেন তিনি। এর মধ্যে সবচেয়ে দ্রুততম শতক হাঁকিয়েছিলেন মাত্র ৬৩ মিনিটে।
৫.
ফ্রাঙ্ক উলি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে শতক হাঁকিয়েছিলেন পাঁচটি। সর্বশেষ শতক হাঁকিয়েছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ম্যানচেস্টারে। ১৯২৯ সালের ২৭ জুলাই দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে চতুর্থ টেস্টে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সর্বোচ্চ ১৫৪ রানের ইনিংস খেলেছিলেন। ক্যারিয়ারসেরা ইনিংসটি যখন খেলেন, তখন তার বয়স ছিল ৪২ বৎসর ৬১ দিন। টেস্ট ক্রিকেটে তার চেয়ে বেশি বয়সে শতক হাঁকানোর রেকর্ড আছে আর মাত্র চারজনের।
তিনি ১৯০৬ সাল থেকে ১৯৩২ সাল পর্যন্ত প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলেছিলেন। এই সময়ে তিনি ৯৭৮ ম্যাচ খেলে ১৪৫টি শতক এবং ২৯৫টি অর্ধশতকের সাহায্যে ৪০.৭৭ ব্যাটিং গড়ে ৫৮,৯৫৯ রান সংগ্রহ করেছিলেন। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে শতকের দিক থেকে তার চেয়ে বেশি শতক হাঁকানো ক্রিকেটারের সংখ্যা ছয়জন। তবে অর্ধশতক হাঁকানোর দিক থেকে তিনি সবার উপরে আছেন। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি রান তোলার দিক থেকে উলির অবস্থান দ্বিতীয়। তার উপরে আছেন শুধুমাত্র স্যার জ্যাক হবস। তিনি ৫০.৭০ ব্যাটিং গড়ে ৬১,৭৬০ রান সংগ্রহ করেছিলেন।
ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি বল হাতেও প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে দুর্দান্ত নৈপুণ্য প্রদর্শন করেছিলেন ফ্রাঙ্ক উলি। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি উইকেটশিকারি বোলারদের তালিকায় তার অবস্থান ২৮তম। দুই সহস্রাধিক উইকেট নেওয়া ৩৩ জন বোলারের মধ্যে তিনি একজন। তিনি ইনিংসে ১৩২ বার পাঁচ উইকেট এবং ম্যাচে ২৮ বার দশ উইকেট শিকার করে ১৯.৮৭ বোলিং গড়ে ২,০৬৬ উইকেট শিকার করেছিলেন। তার ঝুলিতে রান এবং উইকেটের পাশাপাশি ক্যাচের সংখ্যাও সহস্রাধিক। ফিল্ডার হিসাবে তার চেয়ে বেশি ক্যাচ তালুবন্দি করতে পারেননি আর কোনো ফিল্ডার। তিনিই একমাত্র ফিল্ডার হিসাবে সহস্রাধিক ক্যাচ লুফে নিয়েছিলেন, প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে তার ক্যাচের সংখ্যা ১,০১৮টি।
প্রকৃত অলরাউন্ডার বলতে যা বুঝানো হয়, ফ্রাঙ্ক উলি ঠিক তাই ছিলেন। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে সর্বোচ্চ রানসংগ্রাহকদের তালিকায় ছিলেন দ্বিতীয়, একমাত্র ফিল্ডার হিসাবে সহস্রাধিক ক্যাচ এবং বল হাতে দুই হাজারের বেশি উইকেটই জানান দেয়, প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অলরাউন্ডার হিসাবে সর্বকালের সেরাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন তিনি।