মার্কাস ট্রেসকোথিক, জোনাথন ট্রট, অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফ, মন্টি পানেসার, সারাহ টেইলরের পর বেন স্টোকস — মানসিক ক্লান্তিজনিত কারণে ক্রিকেট থেকে বিরতি নেয়া ইংল্যান্ডের ক্রিকেটারদের তালিকাটা দীর্ঘতর হচ্ছে। শুধু ইংল্যান্ড নয়, মানসিক অবসাদের কারণে অস্ট্রেলিয়ার গ্লেন ম্যাক্সওয়েল, নিক ম্যাডিনসন, উইল পুকোভস্কিও ক্রিকেটের বাইরে থেকেছেন। ক্রিকেটে খেলোয়াড়ি নৈপুণ্য, মানসিক শক্তি নিয়ে বিস্তর গবেষণা ও আলাপ-আলোচনা হলেও মানসিক সুস্থতা নিয়ে খুব একটা কথা হয় না।
সারা বছর ঘরোয়া ও আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলার পাশাপাশি এই করোনাকালে ক্রিকেটারদের নিত্যসঙ্গী হয়েছে আরও একটা বিষয় — জৈব সুরক্ষা বলয়, ইংরেজিতে যাকে বলা হয় ‘বায়ো-সিকিউর বাবল’।
এই জৈব সুরক্ষা বলয়ে খেলোয়াড়দের থাকতে হয় বাইরের জগৎ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে। প্রতিটা সিরিজের আগে, সফরের আগে নির্দিষ্ট দেশের নিয়ম অনুযায়ী থাকতে হয় বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টিনে। নিয়মিত কোভিড-১৯ পরীক্ষা তো আছেই। কোয়ারেন্টিনের সময় একা একা একটা রুমে নিজেকে বন্দি করে রাখা কতটা কষ্টের তা আইপিএল শুরু হবার আগে জানিয়েছিলেন সাকিব আল হাসান:
“ঘরবন্দি থেকে একবার প্রচণ্ড রকম অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলাম। তারপর একটু রিকভারি শুরু হয়েছে। খুব বাজে রকমের ডিপ্রেশন ছিল, আমার আগে কখনও এরকম হয়নি। পরশুদিন একটা পর্যায়ে আমার মনে হয়েছে… লোকে যে আত্মহত্যা করে ডিপ্রেশনে, কেন করে, সেটা বুঝতে পেরেছি আমি। এতটাই বাজে অবস্থা হয়েছিল।”
কিংবা বেন স্টোকসের কথাই ধরা যাক। ২০১৯ সালে স্টোকস ইংল্যান্ড দলের সাথে গিয়েছিলেন ক্যারিবিয়ান সফরে। সেখান থেকে দীর্ঘ বিশ্বকাপ শেষে পাঁচ ম্যাচ সিরিজের অ্যাশেজ। এরপর গেলেন দক্ষিণ আফ্রিকা ও নিউ জিল্যান্ড সফরে, যা চললো গত বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত।
করোনাভাইরাস-পরবর্তী সময়ে স্টোকসকে এক বাবল থেকে অন্য বাবলে দৌঁড়াতে হয়েছে। জৈব সুরক্ষা বলয়ে থেকে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও পাকিস্তান সিরিজ শেষ করবার পরই ছুটেছেন মাতৃভূমি নিউজিল্যান্ডে, শয্যাশায়ী বাবার পাশে থাকতে। গত বছর ডিসেম্বরে বাবার মৃত্যুর পর ক্রিকেটে ফেরত এসে দক্ষিণ আফ্রিকায় খেলেন টি-টোয়েন্টি সিরিজ। এরপর এ বছরের ফেব্রুয়ারি-মার্চে ভারতে দু’মাসের লম্বা সফরের পর আইপিএল।
করোনাভাইরাসের আঘাতে আইপিএল স্থগিত হয়ে যাবার আগে দীর্ঘদিন বাবলে থাকার ক্লান্তিজনিত কারণে দেশে ফিরে যান ইংল্যান্ডের আরেক ক্রিকেটার লিয়াম লিভিংস্টোন।
জৈব সুরক্ষা বলয়ে করোনাভাইরাসের আকস্মিক আঘাতের কারণে সম্প্রতি পাকিস্তানের বিপক্ষে সম্পূর্ণ নতুন ওয়ানডে দল নামাতে হয় ইংল্যান্ডকে, যার নেতৃত্বে ছিলেন স্টোকস। ডারহামের হয়ে এর আগে খেলেছেন টি-টোয়েন্টি ব্লাস্টে। দ্য হান্ড্রেডেও নর্দার্ন সুপারচার্জার্সের হয়ে খেলছিলেন স্টোকস। অর্থাৎ, প্রায় দশ মাস স্টোকস ছিলেন বাইরের জগতের থেকে বিচ্ছিন্ন পরিবেশ তথা বায়ো-বাবলে। তার উপর বাবার মৃত্যু। কুমার সাঙ্গাকারা বলছিলেন,
“It must have been very very tough for Stokes”.
দীর্ঘদিন বাবলে থাকার পর মানসিক ক্লান্তি ভর করায় এর আগে ছুটি নিয়েছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার কুইন্টন ডি ককও। ভবিষ্যতে যে তালিকাটা আরও দীর্ঘ হবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
ভারতের সাবেক মেন্টাল কন্ডিশনিং কোচ প্যাডি আপটন এ বছরের শুরুতে বলেছিলেন,
“দীর্ঘদিন বায়ো-বাবলে থাকার কারণে খেলোয়াড়দের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। কিছু কিছু সমস্যা হয়তো প্রতিরোধ করা যাবে, কিন্তু আমার মনে হয় না আমরা এই বিষয়ে যথেষ্ট কাজ করছি। হয়তো খেলোয়াড়দের কারো খারাপ কিছু হয়ে যাবার পর আমাদের টনক নড়বে।”
অভিজ্ঞ এই কোচের পর্যবেক্ষণ বলছে, বায়ো-বাবলে থাকাকালীন মানসিক সমস্যায় বেশি ভোগেন তুলনামূলক বয়ঃজ্যেষ্ঠ ও বহির্মুখী ক্রিকেটাররা। পরিবার, স্ত্রী-সন্তান থেকে দীর্ঘদিন দূরে থাকাটা সহজ কাজ নয়।
ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেটাররা মানসিক সুস্থতার বিষয়টাকে অগ্রাধিকার দিলেও উপমহাদেশে বিষয়টা এখনো একটা ট্যাবু। স্টোকস বিরতি নেবার পর এক টুইটে ভারতের উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান শ্রীবৎস গোস্বামী একটা টুইট করেন যার সারমর্ম এরকম — এখানে কেউ ‘লোকে কী বলবে’ এই ভয়ে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কথা বলে না৷ কেউ বলতে পারে না যে সে অবসাদগ্রস্ত, পাছে কেউ তাকে দুর্বল মানসিকতার লোক ভেবে না বসে। আর জনতার ‘ট্রলিং’ তো আছেই।
বছরতিনেক আগে দীর্ঘদিন খেলার মধ্যে থাকার কারণে ৬ মাসের বিরতি নিয়েছিলেন সাকিব আল হাসান। সে সময় অধিকাংশ মন্তব্যই ছিলো নেতিবাচক। ‘সাকিব টেস্ট খেলতে চান না’-জাতীয় অভিযোগও ওঠা শুরু হয় সে সময়ই, যাতে অংশ নিয়েছিল ক্রিকেট বোর্ডও। অথচ সাকিব যে মানসিক অবসাদে ভুগছিলেন, এমন সম্ভাবনার কথা বলার মানুষ খুব বেশি ছিল না। সমর্থন তো পানই-নি, উপরন্তু জুটেছে নিন্দা।
মানসিক স্বাস্থ্য ও মানসিক দৃঢ়তা যে আলাদা দুটো বিষয়, তা বুঝতে ভুল করেন অনেকেই।
“আমি মনে করি যে, ভারতীয়দের সহ্যশক্তি বিদেশিদের তুলনায় একটু বেশি। আমি ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, ওয়েস্টে ইন্ডিজের বহু ক্রিকেটারদের সঙ্গে খেলছি। ওরা মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে হতাশা প্রকাশ করত।”
কথাটা বলেছিলেন বিসিসিআই সভাপতি ও সাবেক ভারতীয় অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলী। সৌরভ ভুলটা করেছেন এখানেই, মানসিক সহ্যশক্তি ও মানসিক স্বাস্থ্যকে গুলিয়ে ফেলেছেন।
মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে অনেকদিন ধরেই সরব ভারতের অধিনায়ক বিরাট কোহলি। নিজেও একসময় প্রচণ্ড অবসাদে ভুগেছেন বলে জানেন যে, এই সময়টায় সাহায্য কতটা জরুরি। পথ বাতলে দিয়েছেন কোহলি নিজেই:
“দলের সঙ্গে এমন কাউকে দরকার যাকে মানসিক সমস্যার কথাটা খুলে বলা যাবে। এক্ষেত্রে পেশাদার কারও সাহায্য অবশ্যই প্রয়োজন।”
কোহলি মনে করেন, মানসিক সুস্থতার জন্য খেলা থেকে সাময়িক বিরতি নেয়াকে স্বাভাবিকীকরণ করতে হবে।
তবে জৈব সুরক্ষা বলয়ে থাকার ব্যাপারটি এড়াতে পারবেন না ক্রিকেটাররা। প্যাডি আপটনের পরামর্শ হলো, খেলোয়াড়দের থেকে নিতে হবে ফিডব্যাক।
“আমি এখনো শুনিনি আইসিসি ক্রিকেটারদের থেকে বায়ো-বাবলের ব্যাপারে ফিডব্যাক নিয়েছে৷ তাদের উচিত ক্রিকেটারদের সাথে কথা বলে এমন একটা উপায় খুঁজে বের করা, যাতে তাদের মানসিক ক্লান্তি কমিয়ে আনা যায়।”
এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া (সিএ)। আগামী গ্রীষ্মে জৈব-সুরক্ষা বলয়ে ক্রিকেটারদের মানসিক সুস্থতা নিশ্চিতকরণে আঁটঘাট বেঁধেই নেমেছে তারা। পুরুষদের দলের সাথে সার্বক্ষণিক উপস্থিতি থাকবে মনোবিদ মাইকেল লয়েডের, মেয়েদের মানসিক স্বাস্থ্য দেখভাল করবেন মনোবিদ পিটার ক্লার্ক। জৈব সুরক্ষা বলয়ে মনোবিদ নিয়োগ দেয়াও তাই কার্যকরী সিদ্ধান্ত হতে পারে।
ক্রিকেট যতখানি শারীরিক খেলা, ঠিক ততখানিই মানসিক। একজন ক্রিকেটার চোটে পড়লে তার শারীরিকভাবে সেরে ওঠা যতটা জরুরি, মানসিকভাবে সেরে ওঠাও ঠিক ততখানিই জরুরি। একটা উদাহরণের সাহায্যে বিষয়টি ব্যাখ্যা করা যাক।
স্টুয়ার্ট ব্রড গত দশকের প্রথম ভাগ অবধি একজন বেশ ভালো লোয়ার-অর্ডার ব্যাটসম্যান ছিলেন, নামের পাশে টেস্ট সেঞ্চুরি যার প্রমাণ। ২০১৪ এর আগস্টে বরুণ অ্যারনের বাউন্সারের আঘাতে নাকের হাড় ভেঙে যায় ব্রডের। এরপর থেকে বাউন্সারের ব্যাপারে স্বাভাবিকভাবেই ভয় কাজ করত তার মধ্যে, যাকে বলা হয় পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার বা পিটিএসডি। মনোবিদের সাহায্যে অনেকটা সেরে উঠলেও ব্রডের ব্যাটিংটা আর কখনোই আগের অবস্থায় ফেরত যায়নি। এই চোটের আগে ব্রডের ব্যাটিং গড় ছিল প্রায় ২৪ (২৩.৯৬), চোটের পর যা আশঙ্কাজনকভাবে কমে হয়ে যায় ১৩.১৯।
অর্থাৎ, ক্রিকেটারদের শারীরিক পুনর্বাসনের পাশাপাশি মানসিক পুনর্বাসনও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ৷ এর ব্যত্যয় ঘটলে প্রভাব পড়তে পারে মাঠের পারফরম্যান্সেও। ক্রিকেটারদের নিজেদের এগিয়ে আসতে হবে, সরব হতে হবে মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপারে।
সর্বোপরি, ক্রিকেট বোর্ডগুলোকে খেলোয়াড়দের প্রতি সহানুভূতিশীল হতে হবে। ইসিবি যেমন স্টোকসের সিদ্ধান্তে তার পাশে থেকেছে, সেভাবে অন্য বোর্ডগুলোকেও খেলোয়াড়দের সিদ্ধান্তকে সম্মান জানাতে হবে। বিশেষ করে কোভিড-১৯ এর এই কঠিন সময়ে মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি আলাদা করে নজর দেয়া খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে।