ব্রাজিলের একজন বিখ্যাত ক্রীড়া সাংবাদিক ব্যারেটো তার চাকুরী জীবন শেষে বিদায়ী এক বক্তব্যে বলেছিলেন,
“তোমরা কি ভাবছো আমি কাঁদতে শুরু করবো এখন? বোকার দল। শেষ আমি কেঁদেছিলাম ১৯৮২ সালে ব্রাজিল-ইতালি ম্যাচের পর।”
ফ্রান্সিসকো মোরেস ব্রাজিলের সবচেয়ে আইকনিক ফ্যান। বহু প্রবন্ধ, রিপোর্ট হয়েছে তাকে নিয়ে। ২৫ বছর বয়স থেকে দেশে-বিদেশে হওয়া ফ্ল্যামেঙ্গো ও ব্রাজিলের সব ম্যাচ দেখেছেন তিনি। ২০১৪ সালের বিশ্বকাপে ব্রাজিলের স্কোয়াড দেখে বলেছিলেন,
“এই স্কোয়াডের একমাত্র কোয়ালিটি প্লেয়ার নেইমার, তবে সে ১৯৮২’র সেই ব্রাজিল দলে জায়গা পাবে না।”
আক্ষরিক অর্থে না নিলেও ভাবনার অবকাশ থেকে যায়, কেমন ছিল সেই দলটি? যদি বলা হয় বিশ্বকাপ জয়ী সেরা দল কোনটি, তবে ১৯৭০ এর ব্রাজিল আর ২০১০ এর স্পেন নিয়ে তর্ক হবে। কিন্তু যদি বলা হয়, বিশ্বকাপ ইতিহাসের সবচেয়ে সুন্দর খেলা উপহার দেওয়া দল কোনটি? প্রায় সকল বোদ্ধার মতেই তা হলো ব্রাজিলের ১৯৮২ সালের দলটি। অথচ সেই দলটি ফাইনালেই ওঠেনি! তবে কী ছিল সেই দলের মধ্যে যার কারণে ফাইনালে না উঠেও তারা ফুটবলে স্বপ্নের দল হয়ে গেল?
১৯৮২ সাল, তখনো ইন্টারনেটের বিপ্লব হয়নি ইউরোপে সেভাবে। ব্রাজিলিয়ান লিগ নিয়মিত অনেক দেশেই দেখা যেত না। ১৯৭০ সালের স্মৃতি তখনও তাজা। জার্মান লিজেন্ড ফ্রাঙ্ক বেকেনবাওয়ার যেমন বলেন, “ব্রাজিল মানে আমার কাছে আক্রমণের পর আক্রমণ, আর গোল”, অধিকাংশ মানুষের কাছে ব্রাজিল সেই সময় যেন একটা রহস্যই ছিল। অধিকাংশ ব্রাজিলিয়ান তারকাই ব্রাজিলিয়ান লিগে খেলতেন, তাই তাদের সাপ্তাহিকভাবে ইউরোপের মাঠে লিগগুলোতে দেখা যেত না। ব্রাজিল মাঠে নামত, গ্যালারিতে সাম্বা নাচ চলত, সেই তালে মাঠে দলও খেলত- এমনই একটা মিথ ছিল তখন। এদিকে ১৯৭০ এর পর দুটো বিশ্বকাপে ব্রাজিলের পারফর্মেন্স তেমন আহামরি কিছু ছিল না।
এরপর দলে আসেন কোচ টেলে সান্তানা। ফুটবল খেলায় কোচের ভূমিকা অসম্ভব বেশি। দল সুন্দর খেলা খেলবে, নাকি ফলাফলের জন্য যেভাবে খুশি সেভাবে খেলবে তা ঠিক করতে পারেন একমাত্র কোচই। টেলে সান্তানা ছিলেন হল্যান্ডের ক্রুয়েফ, রাইনাশ মিশেল বা হালের পেপ গারদিওলাদের মতো, মাঠে মানুষের ৯০ মিনিট যেন নষ্ট না হয় সেদিকে সদা সচেষ্ট থাকতেন তিনি। তার মূলনীতিই ছিল, আনন্দ নিয়ে খেলো আর আনন্দ দাও। ব্রাজিলিয়ান ফুটবলে স্কিলের কখনো অভাব হয়নি আর তিনি সবাইকে তাদের সমস্ত স্কিল দেখাবার অনুমতি দিতেন। হাতে পেলেন তর্কাতীতভাবে ব্রাজিল ইতিহাসের সেরা প্রতিভাগুচ্ছকে।
‘সাদা পেলে’ খ্যাত জিকো তখন ব্রাজিল ফুটবলের প্রতীক। জিকোর খ্যাতি সেই আমলে বিশ্বের সর্বত্র, ব্রাজিলে অনেকে তাকে পেলে-গারিঞ্চার চেয়েও ভালো ভাবতো। তার পায়ে বল গেলেই গ্যালারিতে চিৎকার শুরু হয়ে যেত। আরেক খেলোয়াড় জুনিয়র, ফুলব্যাক। ডিফেন্ডার হলেও উপরে আসতেন অহরহ। তার বেশভূষা ছিল রক-ব্যান্ডের তারকাদের মতো। অনেক আধুনিক তরুণের কাছেই জুনিয়রের ক্রেজ ছিল। সাথে ছিলেন এডার ও বিখ্যাত খেলোয়াড় ফ্যালকাও, সৃজনশীল মিডফিল্ডার। তবে সব ছাপিয়ে ভাস্বর ছিলেন একজন। চেইন স্মোকার, ডাক্তার, ব্রাজিলে সামরিক শাসকের বিরুদ্ধে আন্দোলনের এক মহীরুহ- সক্রেটিস (তাকে নিয়ে এই লেখায় তার পুরো জীবনী, আন্দোলন তুলে ধরা হয়েছে)। পুরো দলে কারো কোনো ধরাবাঁধা জায়গা নেই, নিজের মনের মতো আক্রমণ শানাও, খেলো, গোল করো আর জেতো! হয়তো এই নীতিই হয়ে দাঁড়িয়েছিল এই দলটির আক্ষেপের কারণ!
বিশ্বকাপের কিছুদিন আগে ইনজুরিতে পড়েন দলের মূল স্ট্রাইকার সেরেস। তার জায়গায় আনা হয় সাও পাওলোর বিখ্যাত স্ট্রাইকার সেরজিনহোকে। যতই গোল করুক, জিকো-সক্রেটিসদের স্কিলের কাছে সেরজিনহো ছিলেন নিতান্তই শিশু। তবে সেঁটে গেলেন দলে, তারপরেও একটু খুঁত থেকেই গেল। আরেক সমস্যা ছিলেন গোলকিপার পেরেস। অল্প চাপেই ভেঙে পড়ার নজির ছিল তার। ব্রাজিল দলের গোলকিপারের যেমন কোয়ালিটি থাকার কথা, তেমনটা ছিল না তার। তবে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি তাকে। অধিকাংশ সময় ব্রাজিল এত আক্রমণে থাকত যে, প্রতিপক্ষ খুব একটা আক্রমণের সুযোগই পেত না!
৬৮,০০০ দর্শকের সামনে সেভিয়ার সানচেজ পিজুয়ানে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে মাঠে নামে ব্রাজিল। গোলকিপার পেরেস প্রথমেই তার জাত চেনান সোজা আসা একটি সাদামাটা শটকে তার পায়ের ভেতর দিয়ে যেতে দিয়ে! দারুণ আশা জাগানো ব্রাজিলের শুরুই হলো করুণ এক গোল হজম করে। মিডফিল্ড মাস্টার সক্রেটিস বুঝে গেলেন, বল তার ডিফেন্সে বেশি যেতে দেওয়া যাবে না। এবার ব্রাজিল খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এলো। সোভিয়েত ইউনিয়নকে ২-১ এ হারিয়ে যাত্রা হলো শুরু। এরপর স্কটল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ডে উড়িয়ে দিয়ে পরের রাউন্ডে এলো ব্রাজিল। ততদিনে মানুষ যা আশা করেছিল সেরকমই খেলা উপহার দিলো ব্রাজিল। দল বেঁধে উপরে উঠে অ্যাটাক, টেলিপ্যাথিকাল বোঝাপড়া আর অনবদ্য সব স্কিল। সেবার বিশ্বকাপের ফরম্যাট ছিল আলাদা। গ্রুপ পর্ব পেরোনো দলগুলোকে নিয়ে পরবর্তী চারটি গ্রুপ করা হতো তিনটি করে দল নিয়ে। ব্রাজিল পড়ল ডেথ গ্রুপে- ইতালি, আর্জেন্টিনা আর ব্রাজিল।
ম্যারাডোনার আর্জেন্টিনার সাথে প্রথম খেলায় জিকোর দারুণ একটি ফ্রি কিকে এগিয়ে গেলো ব্রাজিল। আর্জেন্টিনা ম্যাচে ফেরার চেষ্টা করতে থাকলেও ম্যাচের রাশ ছিল ব্রাজিলের হাতেই। সুন্দর ফুটবলের পসরা সাজিয়ে আরেকটি গোল দিয়ে দেয় ব্রাজিল। হতাশায় পেয়ে বসে ম্যারাডোনাকে। ব্রাজিলের এক প্লেয়ারের তলপেটে লাথি মেরে লাল কার্ড পেয়ে মাঠ ছাড়েন তিনি। ব্রাজিল জিতে যায় ৩-১ গোলে। ততক্ষণে ধরেই নেয়া হয়েছে, চতুর্থবারের মতো বিশ্বকাপ জিততে যাচ্ছে ব্রাজিল। পরবর্তী ম্যাচ ইতালির সাথে।
গ্রুপ পর্বে কোন ম্যাচ না জিতে তিনটি ড্র করে দ্বিতীয় রাউন্ডে আসে ইতালি, কোনোভাবে আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে দেয় তারা। সামনে ব্রাজিলের সাথে খেলা। ইতালির দ্বিতীয় গোলরক্ষক পরে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন যে, তারা ভেবেই নিয়েছিলেন যে তারা হারতে যাচ্ছেন, কোচ তাদের বলেছিলেন প্ল্যানমাফিক খেলার চেষ্টা করতে, বাকিটা বিধাতার হাতে!
কিন্তু একজন হার মানেননি। স্ট্রাইকার পাওলো রসি। বিশ্বকাপের মাস কয়েক আগেও তিনি ছিলেন জেলে, কেউ ভাবতেও পারেননি বিশ্বকাপে খেলবেন রসি; বিশ্বকাপে ভঙ্গুর ইতালির একমাত্র জ্বলজ্বলে তারা ছিলেন তিনি। খেলার পাঁচ মিনিটেই ইতালিকে এগিয়ে দিলেন তিনি। এরপর ব্রাজিল খেলা ধরলো। ১২ মিনিটে গোল শোধ করেও দিলো। ২৫ মিনিটে আবারো ইতালিকে এগিয়ে দেন রসি। ২-১ এ পেছানো ব্রাজিল আরো আক্রমণ শানায়। সেই সেরজিনহো লজ্জাজনক একটি মিস করে বসেন, সেই সাথে আরো কিছু স্বভাববিরুদ্ধ মিস করে ব্রাজিল। তবে ৬৯ মিনিটে আবারো খেলায় ফিরে ব্রাজিল ফ্যালকাওয়ের গোলে। পুরো স্টেডিয়াম আবার গর্জে ওঠে।
ইতালির তখন হাল ছাড়ার অবস্থা। ব্রাজিল বল পায়ে আবারো দুর্দান্ত আক্রমণ শানাতে শুরু করে। স্রোতের বিপরীতে ইতালির দুর্বল একটি শট, যেটি একটি বাচ্চা ছেলেও সহজে ধরতে পারে, সেটি হেলা করে লাইনের ওপারে গিয়ে ধরলেন একজন। ইতালি পেল কর্নার। ভেসে আসা বলটি দুর্বলভাবে ক্লিয়ার করলো ব্রাজিল ডিফেন্স। কোচের কৌশলই কিনা কে জানে, ডি বক্সের ভেতরে না থেকে বাইরে ছিলেন ইতালির দুই বেস্ট শ্যুটার, দুজনের সামনেই বলে শ্যুট নেবার সমান সুযোগ। শ্যুটটি নিলেন পাওলো রসি, নিজের হ্যাটট্রিকও পূরণ করলেন আর রচনাও করলেন ইতিহাসের এক অপূর্ণতার। আর ফিরতে পারলো না ব্রাজিল। ফ্যালকাওদের কান্না সবাইকে ছুঁয়ে গেলো। বরাবরের মতোই খোঁড়াতে খোঁড়াতে আসা ইতালি জিতে নিল বিশ্বকাপ। পরদিন গার্ডিয়ান পত্রিকা এক বিখ্যাত কথা লিখেছিল,
“আজ থেকে আর কোনো দলই কেবল স্কিল দিয়ে বিশ্বকাপ জিততে পারবে না, চাই সিস্টেম!”
ঠিক তা-ই হয়ে আসছে এরপর থেকে। সেই হারটি পেয়ে বসে ব্রাজিলকে, খেলোয়াড়ি জীবনের শিখরে থাকা সক্রেটিসরা মিইয়ে যান, তাদের অনেকেরই আর সেই জৌলুশ আর থাকেনি।
কী ছিল সেই ব্রাজিলে? ২০১০ এর স্পেনের ব্যতিক্রমী দিক ছিল পাসিং, তবে তা অনেক ধীরগতির। ১৯৭৪ এর হল্যান্ডের মাহাত্ম্য ছিল দলীয়ভাবে আক্রমণ, ১৯৭০ এর ব্রাজিলের ছিল ফ্লেয়ার আর দারুণ শ্যুটিং। ১৯৮২ সালের এই দলটির ছিল এগুলোর সবই। যে ১৫টি গোল করেছিল ব্রাজিল, তার সবই ছিল একেকটি শিল্পকর্ম। অনেক ফুটবল বোদ্ধার মতেই, এই দলটিই ছিল বিশ্বকাপ ইতিহাসের সবচেয়ে সুন্দর ফুটবল উপহার দেওয়া দল। নিচের এই ভিডিওটিতে আছে সেবারের সব গোল আর পাওলো রসির শেষ গোলের শ্যুটটির স্লো-মোশনে ব্রাজিলের সেই সুন্দর ফুটবলগুলোর টুকরো চিত্র।
জুলাই ৫, গার্ডিয়ানের হেডলাইন এলো, “The day a certain naivety of football died.”
জুকা নামের এক বিখ্যাত সাংবাদিক লিখলেন,
“ফুটবলকে যদি গানের সাথে মেলানো হয় এই দলটা ছিল বিটলস। হয়তো আজকের পর থেকে সবাই জয়টাই আগে চাইবে, সৌন্দর্য না।”
আসলেই, এরপরে ব্রাজিল আরো দু’বার বিশ্বকাপ জিতলেও আজও আপামর ব্রাজিল তথা অনেক প্রবীণ ফুটবল ফ্যানের মনেই এই দলটি চির অম্লান। পাওলো রসির ৭৫ মিনিটের সেই শটটি তার দেশকে একটি বিশ্বকাপ এনে দিলেও বিশ্বকাপ ইতিহাসের সুন্দরতম দলটিকে বঞ্চিত করেছিল তাদের প্রাপ্য থেকে। বেদনাবিধুর সমাপ্তি বিচারে মারাকানা ট্র্যাজেডির থেকেও ‘৮২র বার্সেলোনার সারিয়ার ট্রাজেডি কোনো অংশে কম নয় ব্রাজিলের ফুটবল ইতিহাসে।