মে মাস, ২০১৮ সাল।
বিসিবির হাই পারফরম্যান্স (এইচপি) ক্যাম্পে ডাক পেয়েছেন ইয়াসির আলী চৌধুরী রাব্বি। ‘এ’ দলের দুটি সিরিজ সামনে। শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে হোম সিরিজ ও আয়ারল্যান্ড সফর। এইচপি ক্যাম্প থেকেই বেশিরভাগ ক্রিকেটার সুযোগ পাবেন ‘এ’ দলে। রোমাঞ্চ নিয়ে অপেক্ষায় চট্টগ্রামের এই তরুণ।
তারপর হুট করে ভোজবাজির মতো বদলে গেল সব। মারাত্মক সড়ক দুর্ঘটনার কবলে পড়ে ইয়াসির আলীর সব রোমাঞ্চ বিষাদে ঢাকা পড়ে। পাঁচ মাস ঘরে বসে চোটের সঙ্গে লড়তে হয়েছে এই তরুণকে। মনের মাঝে অনেক ভয়, শঙ্কা নিয়ে ক্রিকেটে ফিরেন ইয়াসির। জাতীয় ক্রিকেট লিগ (এনসিএল), বাংলাদেশ ক্রিকেট লিগ (বিসিএল) খেলেছেন তিনি। কিন্তু মনের জড়তা দূর হয়নি।
এর মাঝেই বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের (বিপিএল) ষষ্ঠ আসরের ড্রাফটে চিটাগং ভাইকিংস দল টেনে নেয় ইয়াসিরকে। কিছুটা হতাশা দূর হয়।
বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটে বিপিএল এখন সবচেয়ে আলোকিত মঞ্চ। ঘরোয়া ক্রিকেটের বাকি টুর্নামেন্টগুলোতে ধারাবাহিকভাবে পারফর্ম করা ক্রিকেটারও চান এই মঞ্চের আলোর রোশনাই ক্যারিয়ারে পড়ুক, নিজের প্রতিভা মেলে ধরতে চান বিপিএলের মঞ্চে। বিপিএলের প্রতিটি আসরেই কম-বেশি দেশীয় ক্রিকেটারের দেখা মিলেছে, যারা ঘরোয়া ক্রিকেটে পরীক্ষিত হলেও টাকার ঝনঝনানির এই টুর্নামেন্টে নিজেকে নতুন করে গোটা দেশের সামনে উপস্থাপন করেছেন। ২২ বছর বয়সী ইয়াসিরকে বলা যেতে পারে সেই সব ক্রিকেটারদের প্রতিনিধি।
ঘরোয়া ক্রিকেটে পরিচিত মুখ হলেও বিপিএলের ষষ্ঠ আসর চট্টলার এই মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যানের জন্য শাপেবর হয়েই এসেছে। এর আগে তিনটি আসর খেললেও এবার নিজের জাতটা চিনিয়েছেন ইয়াসির।
চিটাগং ভাইকিংসের হয়ে ১১ ম্যাচে তিনটি হাফ সেঞ্চুরিসহ ৩০৭ রান করেছেন তিনি। বিপিএলের সপ্তম সেরা রানসংগ্রাহক তিনি। তার ভয়ডরহীন ব্যাটিং নজর কেড়েছে সবার। প্রশংসিত হয়েছে, আলোড়ন তুলেছে দেশজুড়ে। আগামীর সম্ভাবনাময় ব্যাটসম্যানের তালিকায় নাম উঠে গেছে ইয়াসিরের।
শুরুতে দু’টি ম্যাচ সাইড বেঞ্চে বসে কাটিয়েছেন। মোহাম্মদ আশরাফুল ব্যর্থ হওয়ার পরই তৃতীয় ম্যাচে চিটাগংয়ের একাদশে ঠাঁই হয় তার। খুলনা টাইটান্সের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচেই ওয়ান ডাউনে নেমে ৩৪ বলে ৪১ রানের ঝকঝকে ইনিংস খেলেছেন। তারপর আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি এই তরুণকে, চিটাগংয়ের জার্সিতে টানা ১১টি ম্যাচ খেলেছেন। খুলনার বিপক্ষেই ফিরতি ম্যাচে হাফ সেঞ্চুরি করেছেন।
৫৪ রানের ওই ইনিংসের পর দুই ম্যাচে বড় রান পাননি। তারপর হোম ভেন্যু চট্টগ্রামে দল হারলেও ইয়াসিরের ব্যাট হেসেছে নিয়মিত। টানা দু’টি ম্যাচে হাফ সেঞ্চুরি করেছেন। রংপুর রাইডার্সের বিরুদ্ধে ৭৮, রাজশাহী কিংসের বিপক্ষে ৫৮ রান করেছেন সুঠাম দেহের অধিকারী এই তরুণ ব্যাটসম্যান।
এবার বিপিএলের মাধ্যমে স্বপ্নের পরিধিটা বড় হয়েছে ইয়াসিরের। মুশফিকুর রহিম, রবি ফ্রাইলিঙ্ক, ক্যামেরন ডেলপোর্টরা পিঠ চাপড়ে দেয়ায় ব্যাটসম্যান হিসেবে নিজের প্রতি বেড়েছে বিশ্বাস। অস্ট্রেলিয়ার সাবেক ক্রিকেটার, মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান ডেমিয়েন মার্টিনের ভক্ত ইয়াসির বাংলাদেশ জাতীয় দলে খেলার ইচ্ছা মনের ভেতর লালন করেই ক্রমাগত ছুটছেন লক্ষ্যের পানে। টেস্ট ক্রিকেটের প্রতি বাড়তি আগ্রহ থাকলেও মুমিনুল হকের দেয়া পরামর্শে শাণিত ইয়াসির চান তিন ফরম্যাটেই বাংলাদেশের হয়ে খেলতে। একান্ত আলাপে এই তরুণ ব্যাটসম্যান বলেছেন, বিপিএলের পারফরম্যান্স ও ক্যারিয়ারের নানা দিক নিয়ে।
বিপিএলে নিজের পারফরম্যান্সের মূল্যায়ন কীভাবে করবেন?
বিপিএল যতটুকু খেলেছি, আলহামদুলিল্লাহ ভালো খেলেছি। সবসময় ইচ্ছা থাকে ভালো খেলার। তবে এবার যতটা খেলেছি, আল্লাহ অনেক দিয়েছেন আমাকে। আমি বলবো, আমার জন্য বিপিএল ভালোই গিয়েছে।
এর আগেও বিপিএল খেলেছেন। আপনার কি মনে হয়, এবারের পারফরম্যান্সই আপনাকে দেশব্যাপী বেশি পরিচিতি এনে দিয়েছে?
হ্যাঁ, অবশ্যই। এটা আমার চতুর্থ বিপিএল ছিল। গত তিন বছরে আমি ম্যাচ খেলতে পারিনি ওইভাবে। ২০১৫ সালেই সাতটা ম্যাচ খেলেছিলাম। এরপর শেষ দুই আসরে কোনো ম্যাচ খেলা হয়নি আমার। দুইবারই দলের সঙ্গে থাকলেও যেহেতু ম্যাচ খেলা হয়নি, তাই সেভাবে পরিচিত হওয়ার সুযোগ ছিল না। এবার বিপিএলে অনেকগুলো ম্যাচ খেলার সুযোগ পেয়েছি। আল্লাহর রহমতে ভালোই হয়েছে। তাই আমাকে বড় পরিচিতি এই বিপিএলই এনে দিয়েছে বলতে পারেন।
মোট ৩০৭ রান, তিনটি হাফসেঞ্চুরি। ইনিংস বড় করতে না পারার আক্ষেপ আছে নিশ্চয়ই?
আমার কাছে মনে হয়েছে, আমি ৫৮, ৫৪ রানে যেসব আউট হয়েছি, আমার ওই ইনিংসগুলো আরও বড় করা উচিত ছিল। এ জায়গাটায় আমি বলবো, আমি আমার সুযোগগুলো কাজে লাগাতে পারিনি। আর যে ম্যাচগুলোতে রান করতে পারিনি, সেগুলোতে তো প্রথম দিকেই আউট হয়ে গেছি। ওই ম্যাচগুলো নিয়ে কথা বলে লাভ নেই, যেহেতু আগে আউট হয়ে গেছি। আমার মনে হয়, যে ম্যাচগুলো আমি ১৫-২০ এর বেশি করেছিলাম সেগুলোতে আরও লম্বা করা উচিত ছিল।
চিটাগং ভাইকিংস দলে ব্যাটিংয়ে এবার আপনার ভূমিকা কী ধরনের ছিল?
যেটা আমার প্রথম ম্যাচ ছিল, ওই ম্যাচের আগের দিন মুশফিক ভাই, নান্নু স্যার (মিনহাজুল আবেদীন নান্নু) আমাকে বলেছিলো যে, তুই খেলবি। তোর ন্যাচারাল ক্রিকেটই খেলবি। এর বেশি কিছু চেষ্টা করার দরকার নাই। তুই তোর মতো খেলে যাবি, বাকি যা হয় দেখা যাবে। ওনারা বলেছিলো এটা খেয়াল করতে, যেন আমার উইকেট আমি প্রতিপক্ষকে উপহার দিয়ে না আসি। আমার উইকেট যেন তাদের কষ্ট করে নিতে হয়।
ড্রেসিংরুমে মুশফিক, ফ্রাইলিঙ্ক, ডেলপোর্টের মতো অভিজ্ঞ ক্রিকেটার ছিল। তাদের কোনো মন্তব্য ছিল আপনার পারফরম্যান্সে?
তারা সবসময় আমাকে সমর্থন করে গেছে। আমি যখন ম্যাচ খেলছিলাম না, তখন থেকেই মুশফিক ভাই, নান্নু স্যার, ম্যানেজমেন্ট থেকে সবাই বলেছে, ‘তুমি যেকোনো সময় সুযোগ পাবা। তৈরি থেকো, যেন ভালো খেলতে পারো।’ ইতিবাচক থাকতে বলেছে। আমাদের যে বিদেশি ক্রিকেটারগুলো ছিল, রবি ফ্রাইলিঙ্ক-ডেলপোর্ট ওরাও বলতো। আমিও ওদের সাথে কথা বলতাম। বলেছিলাম, আমি গত দুই বছর দলে থাকলেও ম্যাচ খেলতে পারিনি বিপিএলে। কীভাবে খেলতে হয়, ব্যাটিংয়ে ভালো করার পরামর্শ নিয়েছি। ওরাও বলেছে, তুমি ভালো খেলো বলেই তোমাকে দলে নেয়া হয়েছে। তুমি তোমার ন্যাচারাল খেলাটাই খেলবা। আর বেশি কিছু ভাবার দরকার নাই। ব্যাটিংয়ে গেলে শুধু ব্যাটিংয়ে মনোযোগী থাকবা। আর কিছু চিন্তার দরকার নাই। ওদের সাথে কথা বলে আমার আত্মবিশ্বাস আরও বেড়েছে।
বিপিএলে পারফর্ম করার পর ব্যাটসম্যান হিসেবে নিশ্চয়ই আত্মবিশ্বাস বেড়েছে। ঠিক কী ধরণের উন্নতি এসেছে আপনার ব্যাটিংয়ে?
আসলে আমি যেভাবে খেলতাম, দেখা যেত যে, ২-১টা ডট বল হলেই আমি মারার জন্য তাড়াহুড়ো করতাম। আমাকে ফ্রাইলিঙ্ক, মুশফিক ভাই বলেছে যে, আমি যেই মানের ব্যাটসম্যান, ২-৩টা ডট বল খেললেও যেন বিচলিত না হই। তাদের মতে, আমার সামর্থ্য আছে এক ওভারে ১৪-১৫ রান নেয়ার। বলেছেন খারাপ বলের জন্য অপেক্ষা করতে। খারাপ বল আসলে এমনিই মারা যাবে।
গণমাধ্যমে বলেছেন, আপনি টেস্ট খেলতে চান। সাদা পোশাকের ক্রিকেট আপনাকে বেশি টানে। টেস্ট খেলার জন্য নিজে মানসিকভাবে কতটা প্রস্তুত হয়েছেন?
ক্রিকেটের মূল খেলাই কিন্তু টেস্ট ক্রিকেট। আমি ছোটবেলা থেকেই যখন ক্রিকেট দেখতাম, তখন থেকেই অস্ট্রেলিয়ার ডেমিয়েন মার্টিন আমার পছন্দের ব্যাটসম্যান এবং তামিম ভাই। তামিম ভাইকেও ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি। তখন থেকেই ইচ্ছা যে, টেস্ট ক্রিকেট খেলবো। আল্লাহর রহমতে আমি জাতীয় ক্রিকেট লিগ, বিপিএলে ভালো খেলছি। সেখান থেকেই আত্মবিশ্বাস আসে যে, আমি হয়তো টেস্ট খেলতে পারবো।
আর আমাকে সৌরভ ভাই (মুমিনুল হক) সবসময় বলতো, (উনি জাতীয় ক্রিকেট লিগে আমার অধিনায়ক) তুমি শুধু টেস্ট নিয়ে চিন্তা করবে না। তোমার যে টেকনিক, তা দিয়ে তুমি বাংলাদেশের জন্য তিন ফরম্যাটেই খেলতে পারবা। শুধু টেস্ট নয়, উনি বলেছেন তিন ফরম্যাটে খেলার প্রস্তুতি, মানসিকতা রাখতে হবে।
২০১৮ সালে সড়ক দুর্ঘটনার কারণে আপনি পাঁচ মাস ক্রিকেটের বাইরে ছিলেন। সেই অবস্থা কাটিয়ে ক্রিকেটে ফেরার চ্যালেঞ্জ কেমন ছিল?
আমি দুর্ঘটনার পর যতগুলো টুর্নামেন্ট খেললাম, সবগুলোই আমার জন্য চ্যালেঞ্জিং ছিল। ইনজুরি থেকে উঠেছি, পাঁচ মাস মাঠের বাইরে ছিলাম। জাতীয় ক্রিকেট লিগ আমার জন্য অনেক চ্যালেঞ্জিং ছিল। ইনজুরি থেকে ফিরে জাতীয় লিগ, বিসিএল যেহেতু লম্বা খেলা, চার দিনের ম্যাচ, অনেক সময় ফিল্ডিং করাও কঠিন হয়ে পড়েছিলো। ফিল্ডিং করতেও পারিনি অনেক সময়। জাতীয় লিগের সময় একটু ভয়ে ভয়ে ছিলাম। মনে কাজ করতো, আল্লাহ না করুক, আবার না ইনজুরিতে পড়ে যাই! ওইটা মাথায় ছিল। আল্লাহর রহমতে জাতীয় লিগ যখন খেলে ফেললাম, তারপর বিপিএলে যখন প্রথম দুইটা ম্যাচ খেলি, তখন ওই জিনিসটা মাথা থেকে কেটে গেছে। এখন আশা করি ভালোভাবে এগিয়ে যেতে পারবো।
জাতীয় দলে খেলার স্বপ্ন সব ক্রিকেটারেরই থাকে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলার জন্য কতটা আত্মবিশ্বাসী এখন?
ছোটবেলা থেকেই ইচ্ছা, জাতীয় দলে অনেক দিন খেলবো। দেশকে সার্ভিস দিবো। ওই ইচ্ছাটা প্রবল হয়ে গেল, আমার নিজের প্রতি নিজের বিশ্বাসটা আরও বেড়ে গেছে এবার বিপিএলের পর। আল্লাহর রহমতে আমি অবশ্যই পারবো, ইনশাল্লাহ।