ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে তামিম ইকবালকে ‘ড্যাশিং ওপেনার’ হিসেবে ডাকা হতো। তবে সময়ের প্রয়োজনে সেই বুম বুম তামিমের খোলস ভেঙে এখন ভীষণ পরিণত তিনি। একপ্রান্ত আগলে রেখে দলের ইনিংস এগিয়ে নেওয়ার গুরুদায়িত্ব এখন তার ঘাড়েই। গত চার বছর ধরে সেই দায়িত্ব বেশ ভালোভাবে সামলে যাচ্ছেন এই বাঁহাতি ওপেনার। যদিও ইনিংস আগলে রাখতে গিয়ে স্ট্রাইক রেট কমে যাওয়ায় অনেকেই সুযোগ পেলেই তামিমকে সমালোচনার জোয়ারে ভাসিয়ে দিচ্ছেন। কিন্তু শেষ চার বছরে তামিমের ঈর্ষণীয় সাফল্য কিন্তু সমালোচকদের ভুল প্রমাণ করতে যথেষ্ট।
সদ্য শেষ হওয়া ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরেও দলের সেরা ব্যাটসম্যান ছিলেন তামিম ইকবাল। দুই সেঞ্চুরি ও এক ফিফটিতে ওয়ানডে সিরিজে সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার জিতেছিলেন। টি-টুয়েন্টিতেও এক ফিফটি করে দলের সিরিজ জয়ে বেশ বড় ভূমিকা রেখেছিলেন তিনি। নিজের খেলায় এমন আমূল পরিবর্তন, আসন্ন এশিয়া কাপ নিয়ে পরিকল্পনা কিংবা বাংলাদেশ দলের দুর্বলতা- এসব নিয়েই ক্রিকবাজে কথা বলেছেন এই বাঁহাতি ওপেনার।
উইন্ডিজ সফরের জন্যে রোজার ঈদ পরিবারের সাথে উদযাপন করতে পারেননি। এখন আবার এই ঈদেও একটু আগেই অনুশীলনে যোগ দিলেন। এই মুহূর্তে ঠিক কোন ব্যাপারটা নিয়ে আপনি অনুশীলনে কাজ করছেন?
আমার মনে হয়, আপনার যখন ফর্ম ভালো থাকবে তখনই বেশি কাজ করা উচিত, কারণ খারাপ সময়ে কাজ করার অনুপ্রেরণা খুঁজে পাওয়া কিছুটা কঠিন। সবসময় রান পাবো কিংবা সাফল্যের ধারায় থাকবো এই নিশ্চয়তা আমি দিতে পারবো না, কিন্তু নিজেকে শতভাগ প্রস্তুত রেখে আমার কাজটাকে আমি সহজ করতে পারি। ভালো প্রস্তুতি সত্ত্বেও যদি আমি ব্যর্থ হই, তখন অন্তত নিজের সেরাটা দিতে পারায় সন্তুষ্ট থাকতে পারবো। ভালো খেলতে হলে ভালো প্রস্তুতিটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, আর এ কারণেই আমি একটু বেশি কাজ করছি।
আসলে অনুশীলনের ধরনটা ঠিক করাটাও খুবই দরকারি। যেমন ধরুন, ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরের আগে আমরা একধরনের প্রস্তুতি নিয়েছিলাম, কিন্তু আসন্ন এশিয়া কাপের জন্য আমরা অন্যভাবে নিজেদের প্রস্তুত করছি। কোন ধরনের উইকেটে খেলা হচ্ছে এবং প্রতিপক্ষের শক্তিমত্তা ঠিক কেমন এগুলো বিবেচনা করে অনুশীলনের ধরনটা ঠিক করাটা জরুরি।
বর্তমান সময়ে অধিকাংশ ওপেনারের স্ট্রাইক রেট যেখানে ১০০ কিংবা তারচেয়েও বেশি, সেখানে আপনার স্ট্রাইক রেট ৮০ এর নিচে। বর্তমানে যে ধরনের ফ্ল্যাট পিচে খেলা হয় সেই বিবেচনায় এই কম স্ট্রাইক রেট কি ক্ষতিকর ভূমিকা পালন করছে না?
অধিকাংশ সময়েই আমরা মিরপুর স্টেডিয়ামে খেলি, এখানকার পিচে দ্রুত রান করাটা বেশিরভাগ সময়েই দুরূহ। বর্তমানে ২৬০-৭০ রান পৃথিবীর সিংহভাগ মাঠে সহজেই তাড়া করা যায়, কিন্তু মিরপুরের মাঠে এখনো এই সংগ্রহই জয়ের জন্য যথেষ্ট। তাছাড়া বর্তমানে দলের ইনিংসটাকে ধরে রেখে বড় ইনিংস খেলার দায়িত্বটা আমার। এ কারণেই ঝুঁকি কম নিয়ে ভালো স্ট্রাইক রেট কিভাবে রাখা যায় এ ব্যাপারটা নিয়ে আমি কাজ করছি। এটা রাতারাতি করে ফেলা সম্ভব নয়। আমি যদি ইনিংস ধরে রাখার সাথে স্ট্রাইক রেটটা ৮৬-৮৭ এর মধ্যে রাখি সেটাই দলের জন্য বেশ উপকারী হবে।
বর্তমানে বেশ কিছু খেলোয়াড় ৯০ এর উপর স্ট্রাইক রেট রেখে রান করছেন, যেমন- বিরাট কোহলি, যেটা সত্যিই অসাধারণ। আমি যদি আমার স্ট্রাইক রেট ৮০-৮৫ এর দিকে নিতে চাই, তবে আমাকে বেশ কিছু জায়গায় উন্নতি করতে হবে। আমি দলের জন্য এখন যে কাজ করছি সেটাতে কোনো বিঘ্ন না ঘটিয়েই আমাকে স্ট্রাইক রেট উন্নতির ব্যাপারটা দেখতে হবে। রানের ধারা অব্যাহত রেখেই স্ট্রাইক রেট বাড়াতে চাই। এখন আমি যে অবস্থায় আছি তার চেয়ে ১০-১৫ শতাংশ উন্নতি করলেই হয়তো সেই লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব হবে। আমি আগে যেভাবে ব্যাট করতাম তার সাথে এখনকার ব্যাটিং স্টাইলে বেশ পার্থক্য রয়েছে। দীর্ঘদিন খেলার কারণে আমি অনেক কিছুর সাথে মানিয়ে নিতে শিখেছি।
দলে আপনার ভূমিকাটা ঠিক কী সেটা অনুধাবন করাটা খুবই জরুরি। সময়ের সাথে সাথে দলে আমার ভূমিকাতেও পরিবর্তন এসেছে। এখন টেস্ট আর ওয়ানডেতে আমি প্রথম ২০ বল দেখে-শুনে খেলি। যখন আমি ২০-৩০ বল খেলে ফেলি তখন আমার বড় ইনিংস খেলার সম্ভাবনাও অনেক বেড়ে যায়। শেষ তিন-চার বছরে এই ব্যাপারটায় আমি অনেক জোর দিয়েছি।
সীমিত ওভারের ক্রিকেটে দলে আরেক ওপেনার কে হবেন সেটা এখনো টিম ম্যানেজমেন্ট ঠিক করতে পারেনি, অথচ বিশ্বকাপ শুরু হতে এক বছরেরও কম সময় বাকি আছে। আপনার মতে এই সমস্যার সমাধান কী?
যেকোনো জুটির ক্ষেত্রে একজন ইনিংস ধরে খেলার দায়িত্ব নেয় আর অপরজন কিছুটা আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে খেলে রানের গতি বাড়ানোর দায়িত্ব নেয়। যখন কোনো তরুণ খেলোয়াড় উদ্বোধনী জুটিতে আমার সঙ্গী হয় তখন তাকে আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে খেলতে বলাটা আসলে কিছুটা বেমানান। কারণ দলে নিজের জায়গা পাকা করার জন্যেই তখন তাকে ব্যস্ত থাকতে হয়। কিন্তু সঙ্গী হিসেবে যদি স্বভাবজাত আক্রমণাত্মক কেউ আসে তখন আর এ ধরনের সমস্যা হয় না। এরকম উদ্বোধনী জুটি তৈরি হলে দলও লাভবান হয়। আমি বিশেষভাবে কারো নাম বলতে পারবো না, তবে শেষ দুই-তিন বছর অধিকাংশ সময়েই সৌম্য আমার সাথে ইনিংস সূচনা করেছে। আক্রমণাত্মক ক্রিকেট খেলার ব্যাপারে সে বেশ পটু ছিল।
ইতিমধ্যে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের পাঁচটি মৌসুম মাঠে গড়িয়েছে, কিন্তু এই লিগ থেকে জাতীয় দলে সেভাবে খেলোয়াড় উঠে আসেনি। এর কারণ কী?
বিপিএলে যেসব বিদেশী খেলোয়াড়েরা খেলে থাকেন তারা অধিকাংশ সময়েই টপ অর্ডারে ব্যাট করেন। শেষের দিকে নেমে রানের গতি বাড়ানোর চাপটা খুব বেশি থাকে, সেই চাপ সামলে বড় ইনিংস খেলাটা তরুণদের জন্য বেশ কঠিন। তাছাড়া পাঁচজন বিদেশী খেলোয়াড় খেলানোর নিয়মটাও এক্ষেত্রে নেতিবাচক ভূমিকা রেখেছে।
এসব লিগে আপনি যখন কোনো বিদেশী বোলারের বিপক্ষে রান পাবেন সেটা আপনাকে মানসিকভাবে ভীষণ চাঙ্গা করে তুলবে। জাতীয় দলে খেলতে গিয়ে আপনি যখন সেই বোলারের মুখোমুখি হবেন তখন আপনার জন্যে কাজটাও সহজ হয়ে যাবে। এই কাজটা আইপিএল খুব ভালোভাবে করছে। ভারতের তরুণ খেলোয়াড়েরা আইপিএলে টপ অর্ডারে ব্যাট করার সুযোগ পায় আর সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে তারা শীর্ষস্থানীয় বিদেশী বোলারদের দেখে-শুনে খেলার সুযোগটা পাচ্ছে। আমাদের বিপিএলেও এরকমটা করতে হবে। তাহলেই এই লিগ থেকে অনেক খেলোয়াড় জাতীয় দলে উঠে আসবে।
এবারের এশিয়া কাপে আপনার নিজের দলের কেমন সম্ভাবনা দেখছেন?
এবারের এশিয়া কাপে পরের রাউন্ডে কোয়ালিফাই করার জন্য প্রতিটি দল দুটি করে ম্যাচ পাবে। এই দুই ম্যাচের মধ্যে এক ম্যাচে হারলেই আপনি বাদ পড়ে যেতে পারেন! এ কারণে আপাতত প্রথম দুই ম্যাচ নিয়েই আমরা ভাবছি। আমাদের এই বর্তমান দলটার সুপার ফোরে খেলার সামর্থ্য বেশ ভালোভাবেই আছে। আর সুপার ফোরে আসরের সব শক্তিশালী দলের বিপক্ষেই আপনাকে খেলতে হবে। তাই সেখানে ভালো করতে চাইলে নিজেদের সেরাটা দেওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই।
এবারের আসরে ভালো কিছু করার জোরালো সম্ভাবনা আমাদের এই দলটার রয়েছে। শেষ কয়েকটি এশিয়া কাপে আমরা বেশ ভালো খেলা উপহার দিয়েছিলাম। শেষ তিন আসরের মধ্যে দুবারই আমরা ফাইনালে খেলেছিলাম। উইন্ডিজে আমরা যে ধরনের ক্রিকেট খেলেছি সেই ধারা ধরে রাখলে আমরা এবার ভালো কিছুর আশা করতেই পারি। তাছাড়া এবারের এশিয়া কাপ ওয়ানডে ফরম্যাটের হবে, তিন ফরম্যাটের মধ্যে এই ফরম্যাটেই আমরা অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী। তবে সব কিছু নির্ভর করছে নির্দিষ্ট ম্যাচে আমরা ঠিক কেমন পারফর্ম করছি তার উপরেই।
সাম্প্রতিক সময়ে রিস্ট স্পিনারদের সামলাতে বাংলাদেশী ব্যাটসম্যানরা বেশ হিমশিম খেয়েছেন। এর কারণ কী? এশিয়া কাপেও তো রশীদ খানের মতো একজন লেগ স্পিনারের মুখোমুখি হতে হবে আপনাদের…
আপনি যখন ঠিকভাবে অনুশীলন করতে পারবেন না কিংবা যখন আপনি কোনো ব্যাপারে ঠিকভাবে জানবেন না তখন স্বাভাবিকভাবেই আপনাকে কঠিন সময় পার করতে হবে। দশ বছর আগে যখন আমাদের সব পেস বোলারদের গতি প্রতি ঘণ্টায় ১২৫ কিলোমিটার ছিল তখন স্বাভাবিকভাবেই প্রতি ঘণ্টায় ১৪৫ কিলোমিটার বেগে কেউ যখন বল করতো তখন আমরা খুব সমস্যায় পড়তাম। কিন্তু এখন আমাদের দলেও এরকম গতিসম্পন্ন বেশ কিছু বোলার রয়েছে। তাই এখন আমরা সেই সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পেরেছি।
রিস্ট স্পিনারদের বিপক্ষে আমাদের দুর্বলতার কারণও ঠিক এটাই। আমাদের দলে ওই মানের কোনো রিস্ট স্পিনার নেই। তাই অনুশীলনে আমরা ভালো মানের কোনো রিস্ট স্পিনারের মুখোমুখি হতে পারছি না। এ কারণে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে রিস্ট স্পিনারদের বিপক্ষে আমাদের খুব বেশি ভুগতে হচ্ছে। তবে আমার মনে হয় টি-টুয়েন্টির চেয়ে ওয়ানডেতে রশীদ খানকে মোকাবেলা করাটা অপেক্ষাকৃত সহজ হবে। কারণ এই ফরম্যাটে আপনি একজন বোলারকে দেখে-শুনে খেলার জন্য অপেক্ষাকৃত বেশি সময় পাবেন।
একই সময়ে একটা কথা আমাদের মনে রাখতে হবে, রশীদ খানের মতো বোলারের বিপক্ষে কিছু ঠিক না করে তেড়েফুঁড়ে খেলতে গেলে হিতে বিপরীতই হবে। সে ভালো বোলার বলে সে কোনো বাজে বল করবে না এমন কোনো কথা নেই। বিশ্বের সব সেরা বোলারই কোনো না কোনো সময়ে বাজে বল করে থাকে। আমাদেরকে সেই বাজে বলের সুবিধা কাজে লাগিয়ে বাউন্ডারি আদায় করতে হবে আর অবশ্যই স্ট্রাইক রোটেশনের দিকে নজর দিতে হবে। তাকে সবসময় মেরে খেলাটা কখনোই আদর্শ পরিকল্পনা হতে পারে না।
টি-টুয়েন্টিতে বাংলাদেশ ঠিক কিভাবে এগিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে? বছরের শুরুতে নিদাহাস ট্রফিতে বাংলাদেশি ব্র্যান্ড ক্রিকেট নিয়ে বেশ আলোচনা হয়েছিলো…
এই ফরম্যাটে আমাদের পারফর্মেন্স কখনোই আহামরি কিছু ছিল না। তবে এই ফরম্যাটের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের তাদের মাঠে হারিয়ে আমরা ঘুরে দাঁড়ানোর একটা ইঙ্গিত দিয়েছি। কিন্তু এই একটা সিরিজ জয়ই আমাদের ভালো দল হয়ে ওঠা প্রমাণের জন্য যথেষ্ট নয়। এই ফরম্যাটে আমাদের সামর্থ্য নিয়ে যে প্রশ্ন ছিল বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের বিপক্ষে এই জয় সেই প্রশ্নকে কিছুটা হলেও স্তিমিত করেছে। ক্রিস গেইল কিংবা আন্দ্রে রাসেলের মতো পাওয়ার হিটার না থাকলেও এই ফরম্যাটে আমরা ভালো কিছু করতে পারি- এই বিশ্বাসটা এখন দলের মাঝে এসেছে।
টি-টুয়েন্টি মানেই চার-ছক্কার খেলা- এটা ভুল ধারণা। স্ট্রাইক রোটেট করে একটা নির্দিষ্ট সময় পর বাউন্ডারি মেরেও আপনি ম্যাচ বের করে আনতে পারবেন। এ কারণেই আমি বলেছিলাম যে ইংল্যান্ড কিংবা উইন্ডিজের মতো ক্রিকেট খেলার পরিকল্পনা না করে এই বাংলাদেশি ব্র্যান্ডের ক্রিকেট নিয়ে এগিয়ে যাওয়াটাই আমাদের জন্য ভালো হবে, কারণ এটাই আমাদের দলের সাথে বেশি মানানসই।
ফিচার ইমেজ: Arysports