বাংলাদেশের জন্য কেঁদেছিলেন, কাঁদিয়েছিলেন কোচ এডি বারলো

চলতি ঘটনা দিয়েই শুরু করা যাক। গ্যারি কারস্টেনকে বাংলাদেশ দলের  কোচ হিসেবে চাইলো বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড ( বিসিবি)। দক্ষিণ আফ্রিকান এই লোকটি ভারতকে বিশ্বকাপ জিতিয়েছিলেন। ইতিহাসের অন্যতম সফল কোচও বলা যায় তাকে। ভারতের পাশাপাশি নিজের দেশ দক্ষিণ আফ্রিকার কোচও হয়েছেন। কিন্তু বাংলাদেশে তিনি এলেন না। চেয়েছিলেন ৫০ হাজার ডলার মাসিক বেতন। কেটেছেটে তা ৪৫ হাজার ডলারে নামিয়ে এনেছিলেন। যেখানে এই দলের সাবেক কোচ চান্দিকা হাতুরুসিংহের বেতন ছিল ১৮ হাজার ডলার কিংবা ২২ লাখ টাকার মতো। শুধু বেতনই নয়, কারস্টেন সঙ্গে জুড়ে দিয়েছিলেন আরেক শর্ত, মাশরাফি বিন মুর্তজা-সাকিব আল হাসানদের সঙ্গে তিনি কেবলমাত্র সিরিজের সময়ে কাজ করবেন। বাকিটা সময় তিনি থাকবেন নিজের ব্যক্তিগত সব ‘আলাদা’ প্রজেক্টে।

কারস্টেনকে ভিলেন করা হচ্ছে না। হালের ক্রিকেটে অর্থের ঝনঝনানি তথা কম সময়ে বেশি টাকা উপার্জনের যে পথ ফ্র্যঞ্চাইজিভিত্তিক লিগগুলো করে দিচ্ছে কোচ-ক্রিকেটারদের, সেখানে জাতীয় দলের কোচ পেতে বাংলাদেশ হিমশিম খাবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এমন দিনেই মনে পড়ে কারস্টেনের মতোই প্রোটিয়া কোচ এডি বারলোর কথা, যার হাতে বাংলাদেশ খেলেছিল অভিষেক টেস্ট ম্যাচ, যার মন্ত্রণায় বদলে গিয়েছিল দেশের ঘরোয়া ক্রিকেটের দর্শন। ক্রিকেটারদের মনে যিনি প্রথম ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন ‘আক্রমণ’ আর ‘সংকল্প’। সেই এডি বারলো বাংলাদেশকে ভালবেসেছিলেন। বলা যায়, একটু বেশিই ভালবেসেছিলেন। তাই তো যাবার বেলায় নিজের চোখের পানি আটকে রাখতে পারেননি। যদিও এই পুঁজিবাদী সমাজে এই মুহূর্তে এডি বারলো বিদায় নিলে তার চোখের পানিকে কেন্দ্র করেই পাঠককে খবরটি ‘খাওয়াতে’  উঠেপড়ে লাগতো গণমাধ্যম। তাতে ক্ষতি হতো, তার ভালোবাসা প্রকাশে বাধা পড়তো। তার যাওয়ার পর আজ ১৭ বছর পরও তাকে নিয়ে লেখার জন্য ভাবতে হতো না। লেখার বিষয় হয়ে উঠতেন না তিনি।

বাংলাদেশ ও এডি বারলো

গর্ডন গ্রিনিজকে বাংলাদেশি নাগরিকত্ব দেওয়া হয়েছিল। সেটা তার আনিত সাফল্যের কারণেই। তার অধীনেই আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে প্রথম সাফল্যগুলো পেতে থাকে বাংলাদেশ। দেশের প্রথম বিশ্বকাপ দলটি তিনি গড়েছিলেন। কিন্তু বোর্ডকে নিজের মতামত দিতে গিয়েই বিপাকে পড়লেন। ১৯৯৯ সালে যখন টেস্ট স্ট্যাটাস পেতে মরিয়া বিসিবি, তখন সবধরনের আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ভালোভাবেই চালিয়ে যাচ্ছিল তারা। শোনা যায়, এই সময়েই গ্রিনিজ নাকি বিসিবিকে টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার ব্যাপারে তাড়াহুড়ো না করতে পরামর্শ দিয়েছিলেন। তাতেই কাল হয়েছিল। তিন বছরের চুক্তিটা যেদিন শেষ হবে, তার ঠিক একদিন আগে বরখাস্ত করা হলো তাকে। তার চেয়েও বড় কথা, ম্যাচ চলাকালীন সময়ে বরখাস্ত হয়েছিলেন গ্রিনিজ। তার অধীনে থাকা ক্রিকেটাররা এখনও সেই ঘটনাকে ‘লজ্জার’ বলে অভিহিত করেন।

এডি বারলোর পূর্বসূরি কোচ গর্ডন গ্রিনিজ; Source: Sportskeeda.com

গ্রিনিজের পর যখন কোচশূন্য বাংলাদেশ, তখনই আগমন এডি বারলোর। দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেট বোর্ডের ওই সময়ের সভাপতি আলী বাখারের পরামর্শে এডি বারলোকে নিয়ে এসেছিল বিসিবি। বারলো গর্ডন গ্রিনিজের মতো মহাতারকা ছিলেন না বটে, কিন্তু গ্রিনিজের মতো করেই আপন করে নিয়েছিলেন বাংলাদেশকে। দ্বিমত থাকতে পারে যে, দুজনের মধ্যে কে সবচেয়ে বাংলাদেশকে ভালোবেসেছিলেন।

মূলত, এডি বারলোকে বোর্ড অব ডিরেক্টর হিসেবে আনা হয়েছিল বাংলাদেশে। তার কাজ শুধু ক্রিকেটারদের নিয়েই নয়, দেশের ক্রিকেটীয় অবকাঠামো নিয়ে কাজ করা। সেভাবেই এগিয়েছিলেন। তার অধীনে মাত্র টেস্ট ক্রিকেটে পা রাখা একটি দল বদলে গিয়েছিল মানসিকভাবে, বদলে গিয়েছিল ক্রিকেটীয় জ্ঞানে, মননশীলতায়, আক্রমণে।

বাংলাদেশে এযাবতকালে অনেক কোচ এসেছেন-গিয়েছেন। কিন্তু এডি বারলো একমাত্র কোচ যিনি কিনা বাংলাদেশের জাতীয় দলের আগে হাত দিয়েছিলেন ঘরোয়া ক্রিকেটে। তার দেওয়া সূত্রে  বাংলাদেশ জাতীয় লিগ ১৯৯৯ সাল থেকে শুরু হয়। মূলত টেস্টের কথা মাথায় রেখেই এই লিগ চালু করেন তিনি, যা এখনও বহাল তবিয়তে প্রতি বছর নিয়ম করে মাঠে গড়াচ্ছে।

প্রথম টেস্টের সেই ঐতিহাসিক মুহূর্ত; Source: Daily Ittefaq

১৯৯৯ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের সঙ্গে থাকতে পেরেছিলেন তিনি। যদিও এখনও সমর্থক-ক্রিকেটার-সংগঠকদের অন্তরে আগের মতোই আছেন বারলো। ২০০০ সালে যখন টেস্ট স্ট্যাটাস পেল বাংলাদেশ দল, ঠিক তখনই স্ট্রোকের করাল থাবায় পড়লেন সাবেক এই প্রোটিয়া ওপেনার। মস্তিস্কে রক্তক্ষরণ হয়ে স্বাভাবিক হাঁটাচলা থেমে গেল। ব্যাস, বারলোর চলে যাওয়ার দিনগুলোও ঘনিয়ে আসতে থাকলো। যদিও থেমে থাকেননি তিনি। ওই অবস্থাতেই কাজ করে গেছেন। ২০০০ সালে অসুস্থতা নিয়েই বাংলাদেশ দলকে নিয়ে কেনিয়ায় গেলেন ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিল (আইসিসি) নক আউট টুর্নামেন্টে। সস্ত্রীক বাংলাদেশে এসেছিলেন, পরে সঙ্গী হয়েছিল একটি হুইলচেয়ার। ২০০০ সালের ১০ নভেম্বর যখন অভিষেক টেস্ট খেলবে বাংলাদেশ, তখন হুইলচেয়ারে বসেই পরম রণপরিকল্পনা এঁটেছিলেন।

‘ফার্স্ট ইম্প্রেশন ইজ দ্য বেস্ট ইমপ্রেশন’- প্রবাদকে মাথায় রেখেই যেন অভিষেক টেস্টে কিছু একটা করে দেখানোর প্রত্যয় ছিল তার মধ্যে। হয়তো মাথায় রেখেছিলেন, এত কষ্টে পাওয়া টেস্ট স্ট্যাটাসের প্রথম মিশনটা যদি ভালো করা যায় তাহলে হয়তো বিশ্বে বাংলাদেশ ক্রিকেটে নাম মনে রাখার মতোই হবে।

বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে ২০০০ সালের ১০ নভেম্বর ভারতের বিপক্ষে টস থেকে শুরু করে সবটা দেখলেন বারলো, এখানেও সঙ্গী হুইলচেয়ার আর স্ত্রী। যদিও বাংলাদেশ হেরেছিল, কিন্তু প্রথম টেস্টেই মনে রাখার মতো অনেক কিছু করে দেখিয়েছিল বাংলাদেশ।

ওই সময়ে বাংলাদেশ দলের ক্রিকেটাররা এখনও শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করেন বারলোকে। প্রায় প্রত্যেকেই তাদের ক্যারিয়ারে বারলোর অবদান স্বীকার করেছেন। সাবেক অধিনায়ক হাবিবুল বাশার সুমন বারলো প্রসঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন,

আমি যা কিছু অর্জন করেছি ওই মানুষটার (বারলো) বদৌলতে। যখন জাতীয় দলে আমার অবস্থান অনিশ্চিত, তখন থেকেই বারলো আমাকে মানসিকভাবে সমর্থন দিয়ে গেছেন। প্রথম টেস্টের আগে তার ওই কথাগুলো এখনও মনে পড়ে। তিনি নির্বাচকদের বলেছিলেন, ‘সুমিকে (সুমনকে সুমি নামে ডাকতেন বারলো) অভিষেক টেস্ট দলে থাকতে হবে।

সাবেক অধিনায়ক হাবিবুল বাশার সুমন; Source: Sportskeeda.com

সাবেক অধিনায়ক ও বাংলাদেশের অভিষেক টেস্টে সেঞ্চুরিয়ান (১৪৫) আমিনুল ইসলাম বুলবুল শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেছেন বারলোকে। অভিষেক টেস্টে তার ইতিহাস গড়া ইনিংসেও জড়িয়ে ছিলেন বারলো। সে প্রসঙ্গে বুলবুল বলেছেন,

আমি ভালো করার জন্য মাটি কামড়ে পড়েছিলাম। শ্রীনাথ, আগারকার, সুনীল জোশিদের মতো বোলারের কারণে ভারত ওই ম্যাচে খাতাকলমে আগেই এগিয়ে ছিল। আমি নিজেকে অনেক সময় দিচ্ছিলাম কন্ডিশনের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে। সেশনের পর সেশন আমি খারাপ বলের জন্য অপেক্ষা করেছি, পরিকল্পনা করেছি। ৯০ রানের ইনিংস খেলার পর নার্ভাস হয়ে গিয়েছিলাম। শুধু মাথার মধ্যে দুটো নাম ঘুরছিল। একটি জাভেদ মিয়াঁদাদ, অন্যটি প্রভিন অমরে। দুজনেই দেশের অভিষেক টেস্টে সেঞ্চুরি করেছেন। এই ব্যাপারগুলো মাথায় রেখে নিজেকে উৎসাহ দেওয়ার চেষ্টা করছিলাম। শেষপর্যন্ত আমি সেঞ্চুরি পার করি। আল্লাহকে ধন্যবাদ দিয়ে যখন ড্রেসিংরুমের দিকে তাকাই, দেখি প্যারালাইজড বারলো আমার ইনিংসের প্রতি সম্মান জানাতে হুইলচেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করছেন। পরে স্ত্রীর সহায়তায় দাঁড়ালেন। এটা এখনও মূল্যবান মুহূর্ত আমার জন্য।

শেষপর্যন্ত মনের সঙ্গে পেরে ওঠেননি বারলো। শারীরিক অবস্থা তাকে পেরে উঠতে দেয়নি। ২০০১ সালের প্রথমদিকেই বিদায় নিতে হয়েছে তাকে। বিদায়ের দিন বিসিবির কার্যালয়ের করিডোর থেকে কাঁদতে কাঁদতে বের হয়েছিলেন বারলো। কাঁদিয়েছিলেন সবাইকে। স্ত্রীর সাহায্যে কোনোরকমে হেঁটে বের হয়েছিলেন। খালি পড়েছিল হুইলচেয়ারটা।

ক্রিকেটার ও ব্যক্তি জীবনে এডি বারলো

এডি বারলো দক্ষিণ আফ্রিকায় তার সময়ের সেরা অলরাউন্ডারদের একজন। ১৯৬৯ সালে বর্ণবাদের কারণে তার দেশ আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে নিষিদ্ধ না হলে হয়তো বিশ্বব্যাপী কিংবদন্তি হিসেবেই পরিচিতি পেতেন তিনি। যদিও নিজের দেশে এখনও তিনি কিংবদন্তি। ডানহাতি ওপেনিং ব্যাটিংয়ের সঙ্গে ডানহাতি পেস বোলিংটাও দারুণ হতো তার হাতে। দক্ষিণ আফ্রিকা আন্তর্জাতিকভাবে নিষিদ্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত দেশের হয়ে ৩০টি টেস্ট ম্যাচ খেলেছিলেন বারলো। সেখানে বল হাতে নিয়েছিলেন ৪০ উইকেট। ব্যাট হাতে মোট রান ২,৫১৬। সর্বোচ্চ ২০১ রানের ইনিংস খেলেছেন। হাফ সেঞ্চুরি ১৫টি, সেঞ্চুরি ৬টি।

মজার ব্যাপার হলো, তার প্রিয় প্রতিপক্ষ ছিল অস্ট্রেলিয়া। টেস্ট ক্যারিয়ারের ৬টি সেঞ্চুরির ৫টিই করেছিলেন অজিদের বিপক্ষে। প্রথম শ্রেণীতে ২৮৩ ম্যাচে ১৮,২১২ রানের সঙ্গে বারলোর ৪৩টি সেঞ্চুরি ও ৮৬টি হাফ সেঞ্চুরি রয়েছে। উইকেট নিয়েছেন ৫৭১টি। লিস্ট ‘এ’ ম্যাচ খেলেছেন ৯৯টি। ব্যাটে রান ২,৯৮৩, সেঞ্চুরি ৩টি, হাফ সেঞ্চুরি ২২টি। উইকেট তুলেছেন ১৬১টি।

ক্রিকেটার এডি বারলো; Source: Sportskeeda.com

ক্রিকেটে আসাটা সহজ ছিল না তার জন্য। ট্রান্সভিলায় থাকাকালীন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিকেট দলের হয়ে একদিন নেটে ব্যাটিং অনুশীলন করছিলেন বারলো। দলের কোচ পিটার ওয়াকার তাকে জিজ্ঞেস করলেন, “বারলো তুমি কি আর কোনো খেলা খেল?” বারলো উত্তর দিয়েছিলেন, “আমি অনেক রাগবি খেলি।” তখন কোচ তাকে বলেছিলেন, “তাহলে তোমার উচিত রাগবির দিকেই মনোযোগী হওয়া।

ওই সময়ে ক্রিকেটের পাশাপাশি জিওগ্রাফি নিয়ে পড়ছিলেন বারলো। মূলত তার পরিকল্পনা ছিল শিক্ষক হওয়া। কিন্তু কোচের এমন বিষবাক্য তার ক্যারিয়ারের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। জোরেশোরেই ব্যাট-বল নিয়ে পড়লেন। ১৯৬০-৬৮ সাল পর্যন্ত ট্রান্সভিলার হয়ে খেললেন। এরপর ১৯৬১ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা জাতীয় দলের হয়ে ডাক পেলেন।

এডি বারলো, দক্ষিণ আফ্রিকার ড্রেসিংরুমে; Source: Sportskeeda.com

দেশ ক্রিকেটে নিষিদ্ধ হওয়ার পর ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত ক্রিকেট খেলেছেন। এরপর ক্রিকেট ছেড়ে শূকরের খামার গড়লেন। তারপর ওয়াইনের খামার। একই সঙ্গে ক্রিকেট কোচিংয়ের যঙ্গে জড়িয়ে গেলেন। তারপর তো ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশের কোচ হয়ে আসা। বারলো যে অসুস্থতায় বাংলাদেশ ছেড়েছিলেন, সেই অসুস্থতা তাকে ২০০৫ সালে ৬৫ বছর বয়সে দুনিয়ার ওপারে নিয়ে যায়।

শুধু বিশ্ব ক্রিকেট নয়, বাংলাদেশ ক্রিকেট যেন তার অভাবটা আরও বেশি টের পায়। এখনও মনে করা হয়, কোচ ও টিম ডিরেক্ট বারলোকে হারানো বাংলাদেশের জন্য অনেক বড় একটা ক্ষতি। বারলো যদি থাকতেন তাহলে হয়তো বাংলাদেশের ক্রিকেটে আরও অনেক উন্নতি হতো । ঘরোয়া ক্রিকেটের অবস্থা এই মুহূর্তে এমন বেহাল দশা হতো না।

ফিচার ইমেজ- Daily Prothom Alo

Related Articles

Exit mobile version