দ্বিতীয় মেয়াদে জিদানের চ্যালেঞ্জ

২০১৮-১৯ মৌসুমের শুরুতেই বেশ বড় দু’টো ধাক্কা খায় রিয়াল মাদ্রিদ। গত ৯ বছর ধরে সান্তিয়াগো বার্নাব্যুকে গোলবন্যায় ভাসানো ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো বিদায় নেন, সাথে বিদায় নেন হ্যাটট্রিক চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতানো কোচ জিনেদিন জিদান। এই ধাক্কা সামাল দিতে তাড়াহুড়োয় প্রেসিডেন্ট ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ কোচ হিসেবে নিয়োগ দেন হুলেন লোপেতেগিকে, মাদ্রিদের কোচ হওয়ার সুবাদে অবশ্য ঠিক বিশ্বকাপের আগমুহুর্তে স্পেনের কোচের চাকরিটা খোয়াতে হয় তাকে। লোপেতেগিকে এনে অবশ্য লাভ হয়নি, দু’জনের রেখে যাওয়া শূন্যতার গহ্বরের এক কোণাও পূরণ হয়নি। লোপেতেগির একের পর এক ব্যর্থতায় মাদ্রিদিস্তারা ধৈর্য্য হারিয়ে ফেলছিলেন, তার কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেন লুইস সুয়ারেজ, তার হ্যাটট্রিকে ক্ল্যাসিকোতে ৫-১ ব্যবধানে হারে রিয়াল মাদ্রিদ, বেজে যায় লোপেতেগির বিদায়ঘন্টা। লোপেতেগির পর দলের দায়িত্ব দেওয়া হয় এতদিন ‘বি’ টিমের দায়িত্ব পালন করা সান্তিয়াগো সোলারির হাতে। সোলারি শুরুতে উন্নতির ছাপ দেখালেও টানা ২ ক্লাসিকোতে পরাজয়ে তার পায়ের নিচের মাটিও সরে যাচ্ছিল। তাকে বিদায় করে দেওয়ার কাজটি করে আয়াক্স, বার্নাব্যুতে এসে মাদ্রিদকে ৪-১ গোলে হারিয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগের দ্বিতীয় পর্ব থেকেই বিদায় করে দেয় আমস্টারডামের তরুণেরা, সোলারির সময়ও রিয়ালের চ্যাম্পিয়নস লিগের মতই শেষ।

লোপেতেগির ভাগ্য বরণ করে নিতে হয়েছে সোলারিকেও; Image Source : Sportco.io 

সমর্থক ও ক্লাবের চাপ সামাল দিতে তাই পেরেজ আবার দ্বারস্থ হন জিনেদিন জিদানের, যেন ক্লাবকে খাদের কিনারা থেকে তুলে আনতে পারেন তিনি। জিদান এখন পর্যন্ত তেমন কিছু করতে পারেননি, বরং এই সিজনটি শেষ পর্যন্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে রিয়াল মাদ্রিদ ইতিহাসের সবচেয়ে বাজে মৌসুমগুলোর একটি। আসছে নতুন মৌসুম, নতুন মৌসুমে জিদানের সামনে তাই অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ। তিনি পারবেন কি পারবেন না, সে আলোচনা পরে করা যাবে। আগে দেখা যাক, জিদানের চ্যালেঞ্জগুলো কী।

শক্তিশালী দল গঠন

এই মৌসুমে রিয়াল মাদ্রিদের অন্যতম সমস্যা ছিল তাদের বেশিরভাগ খেলোয়াড়দের বাজে ফর্ম। মার্সেলো, টনি ক্রুস, ২০১৮ সালের বিশ্বসেরা খেলোয়াড় লুকা মদ্রিচ, কিংবা অধিনায়ক সার্জিও রামোস, কেউই তাদের সেরা ফর্মের ধারেকাছেও ছিলেন না। এর ফলে যা হয়েছে, দল হিসেবে ভুগেছে মাদ্রিদ। ব্যতিক্রম একমাত্র ছিলেন করিম বেনজেমা, এই ফ্রেঞ্চ ফরোয়ার্ড পুরো মৌসুমজুড়েই ছিলেন দুর্দান্ত ফর্মে। রিয়াল মাদ্রিদের বাজে অবস্থা বোঝানোর জন্য এটুকু বলাই যথেষ্ট, সিজনের মাঝখানে এসে তাদের সেরা উইঙ্গার ছিলেন ১৮ বছর বয়সী ভিনিসিয়াস জুনিয়র। স্কোয়াডের এই দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠার জন্য জিনেদিন জিদানকে অবশ্যই বেশ কিছু খেলোয়াড়কে দলে ভেড়াতে হবে।

দল পুনর্গঠনে রিয়ালের প্রয়োজন হ্যাজার্ডের মত তারকাকে; Image Source : Bleacher Report

ইতঃমধ্যেই মাদ্রিদ ৫০ মিলিয়ন ইউরোর চুক্তিতে পোর্তোর ডিফেন্ডার এডার মিলিতাওকে দলে ভিড়িয়েছে, দলবদলের গুজব অনুযায়ী খুব শীঘ্রই মাদ্রিদের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করবেন চেলসির বেলজিয়ান উইঙ্গার ইডেন হ্যাজার্ড ও ফ্রাঙ্কফুর্টের সার্বিয়ান স্ট্রাইকার লুকা ইয়োভিচ। হ্যাজার্ডের জন্য মাদ্রিদকে গুনতে হবে একশ’ মিলিয়নেরও বেশি ইউরো, ইয়োভিচের জন্য পরিমাণটা ৬০ মিলিয়ন। তবে এতেই মাদ্রিদের সমস্যার সমাধান হবে না, তাদের প্রয়োজন বুড়িয়ে যাওয়া লুকা মদ্রিচের বিকল্প, সাথে প্রয়োজন একজন রাইট উইঙ্গার। কিলিয়ান এমবাপ্পের কথা বেশ জোরেসোরে শোনা গেলেও উয়েফার ফিন্যানশিয়াল ফেয়ারপ্লে পলিসি (এফএফপি) মেনে তাকে দলে ভেড়ানো বেশ ঝামেলার ব্যাপার হবে ‘অল হোয়াইট’দের জন্য। লুকা মদ্রিচের বিকল্প হিসেবে বাতাসে ভাসছে স্পার্সের ডেনিশ মিডফিল্ডার ক্রিস্টিয়ান এরিকসেনের নাম, তবে তার দামটাও চড়া। এছাড়া মার্সেলোর বাজে ফর্ম চিন্তা করে ভাবা হচ্ছে সিটির ফ্রেঞ্চ লেফটব্যাক বেঞ্জামিন মেন্ডির কথাও, তবে তাকে কিনতে গেলেও দাম পড়বে প্রায় ৬০ মিলিয়ন। চলে যাচ্ছেন কেইলর নাভাস, লাগবে থিবো কোর্তোয়ার ব্যাকআপও। সব মিলিয়ে এই ট্রান্সফার উইন্ডোতে মাদ্রিদকে শক্তিশালী দল গঠন করতে হলে খরচ করতে হবে বিপুল পরিমাণ অর্থ, এবং সাথে খেয়াল রাখতে হবে এফএফপির বিষয়টিও।

রোনালদোর অভাব পূরণ

একজন রোনালদোর মূল্য এই মৌসুমে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে রিয়াল মাদ্রিদ; Image Source : Eurosport

একজন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো কতখানি গুরুত্বপূর্ণ – তা বোধ করি ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ এই মৌসুমের পর বুঝতে পেরেছেন। রোনালদোর চুক্তি পেরেজ নবায়ন করেননি, তাকে মাদ্রিদ ছেড়ে চলে যেতে দিয়েছেন তুরিনে। এরপর এই মৌসুমে দল ভুগেছে গোলখরায়, করিম বেনজেমা একা পোষাতে পারেননি। পারবেন কী করে, তিনি তো আর রোনালদো নন!

রোনালদো ২০১৭-১৮ মৌসুমে গোল করেছিলেন সর্বমোট ৪৪টি, লিগে ২৬ আর চ্যাম্পিয়নস লিগে ১৫টি। তার আগের মৌসুমে লিগে ২৫, চ্যাম্পিয়নস লিগে ১২টি আর সবমিলিয়ে করেছিলেন ৪২টি গোল। তার আগের মৌসুমে করেছিলেন সব মিলিয়ে ৫১ গোল, লিগে ৩৫ ও চ্যাম্পিয়নস লিগে ১৬টি। এই ৩ মৌসুমে একটি লিগ জিতেছিল মাদ্রিদের সাদা দল, অবিশ্বাস্যভাবে উঁচিয়ে ধরেছিলো টানা ৩টি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপা।

আর এই মৌসুমে? ধুঁকে ধুঁকে তিন নম্বরে থেকে লিগ শেষ করেছে তারা, চ্যাম্পিয়নস লিগের দ্বিতীয় রাউন্ডে বাদ পড়েছে ঘরের মাঠ সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে আয়াক্সের কাছে চার গোল খেয়ে। অথচ এই মৌসুমে রিয়াল মাদ্রিদ লিগে গোল করেছে সর্বসাকুল্যে ৬৩টি! শেষ কবে রিয়াল মাদ্রিদ এত কম গোল করেছে, তা খুঁজতে ঘাটতে হবে বহু বছরের ইতিহাস। জিনেদিন জিদানের জন্য তাই রোনালদোর একজন বিকল্প খুঁজে বের করা অত্যন্ত জরুরী; ইডেন হ্যাজার্ড, কিলিয়ান এমবাপ্পে কিংবা নেইমার, যার ভেতরেই হোক না কেন!

হার না মানা মানসিকতার পুনর্জন্ম

রিয়াল মাদ্রিদের এই মৌসুমের প্রতীকী ছবি এটিই; Image Source : Yahoo! Sports

এই মৌসুমের আগের তিন মৌসুমে অন্য দলগুলো থেকে রিয়াল মাদ্রিদকে আলাদা করে দিয়েছিল তাদের মানসিকতা। পরিস্থিতি যতটা প্রতিকূলই হোক না কেন, মাদ্রিদের মনোবল থাকতো অটুট। এজন্যই এই সময়কালে বহু ম্যাচ পেছন থেকে এসে জিতেছে তারা, চ্যাম্পিয়নস লিগে ধাক্কা খেয়েছে বহুবার, তবু মচকায়নি। অথচ এই মৌসুমের মাদ্রিদ যেন সেই দলের এক অভিশপ্ত ছায়ামাত্র, যাদের মানসিকতা কাঁচের মত ভঙ্গুর, সামান্য আঘাতেই যারা হাল ছেড়ে দেয়। এই মৌসুমের প্রথম ক্লাসিকোতে দুই গোল খাওয়ার পর দারুণ খেলছিল মাদ্রিদ, গোল শোধও করে ফেলেছিলো একটি। কিন্তু লুইস সুয়ারেজ তৃতীয় গোল করা মাত্রই যেন হতাশায় নুয়ে পড়ল পুরো দল, দেখাতে পারলো না আর কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা, আরও ২ গোল খেয়ে ন্যু ক্যাম্প থেকে ফিরলো ৫-১ হারের লজ্জা নিয়ে।

একজন অসাধারণ অনুপ্রেরণাদায়ী ম্যানেজার হিসেবে সুখ্যাতি অর্জন করেছেন জিনেদিন জিদান। কিন্তু এবার তার কাজটা আরও বেশি কঠিন। মাটি থেকে কোন কিছু গড়ে তোলার চেয়ে ভেঙে যাওয়া কিছু জোড়া লাগানো ঢের কঠিন, আর এই কঠিন কাজটাই জিদানকে এবার করতে হবে। এটাই এবার তার জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

অপ্রয়োজনীয় খেলোয়াড় ছাটাই

রিয়াল মাদ্রিদের এবারের মৌসুমের দলে আরেকটি বড় সমস্যা ছিল দলে থাকা অসংখ্য ‘ডেড উড’; যারা স্কোয়াডে ছিল বটে, কিন্তু তাদের নামের প্রতি বিন্দুমাত্র সুবিচার করতে পারেননি। নাম বলতে গেলে সবার আগে বলতে হবে গ্যারেথ বেলের নাম, এরপরই আসবেন মার্কো অ্যাসেন্সিও, মারিয়ানো ডিয়াজ, মার্সেলো, সার্জিও রামোস, ক্যাসেমিরো। এদের মধ্যে সবাইকে বিদায় না করলেও কিছু খেলোয়াড়কে বিদায় করা জিদানের জন্য অবশ্য প্রয়োজনীয়।

গ্যারেথ বেল বর্তমান রিয়াল মাদ্রিদ দলের জন্য স্রেফ একজন শ্বেতহস্তী; Image Source : Fox Sports Asia 

গ্যারেথ বেল বর্তমানে রিয়াল মাদ্রিদের জন্য একজন ‘শ্বেতহস্তী’ ব্যতীত আর কিছুই নন। তাকে বছরে বেতন দিতে হয় প্রায় ১৭ মিলিয়ন ইউরো, যার তুলনায় তার পারফরম্যান্স প্রায় শূন্যের কোঠায়। রোনালদোর ‘হাস্যকর’ বদলি হিসেবে আনা মারিয়ানো ডিয়াজও তেমন আহামরি কোনো ভূমিকা পালন করেননি, তেমনি বুড়িয়ে গেছেন লুকা মদ্রিচ। এছাড়া কোপ পড়তে পারে রাফায়েল ভারানে কিংবা ড্যানি কার্ভাহালের উপরও, দু’জনই এই মৌসুমে ছিলেন নিজেদের ছায়া হয়ে। সহজ কথায়, জিদানকে ঢেলে সাজাতে হবে দল। তবেই হয়তো ফিরবে পুরনো মাদ্রিদ।

জিনেদিন জিদানের এবারের কাজটা আরও কঠিন, দায়িত্ব অনেক বেশি। পারবেন কি না, সেটা সময়ই বলে দেবে। তবে মাদ্রিদিস্তারা তাদের ভালোবাসার জিজুর উপর আস্থা রাখতেই পারেন। কেননা জিদান মানেই জাদু, জিদান মানেই অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলা। ধ্বংসস্তুপ থেকে দলকে আবার গড়ে তোলার জন্য জিদানের চেয়ে বেশি ভরসা মাদ্রিদিস্তারা করতেন না কারও ওপরেই। তিনিই দায়িত্বে, বাকিটা তাই সময়ের খেরোখাতায় হিসাবের জন্য তোলা থাক! 

Zinedine Zidane has been appointed as the Real Madrid manager again. In his second stint, Zidane faces a whole array of new challenges. This article talks about those challenges. 

 

Feature Image : Business Insider

Related Articles

Exit mobile version