আজকালকার ক্রিকেটে ৩২১ আর তেমন বাঘ-ভাল্লুক কোনো রান নয়। ৩০০ তো হরহামেশাই হচ্ছে, এই বিশ্বকাপেই এর আগে হয়েছে আটবার। সাড়ে তিনশ রানের মাইলফলকের দেখাও তো পেয়েছে ভারত আর ইংল্যান্ড, ভয় পাওয়ার তাই কারণ ছিল না। তবুও খচখচানি ছিল, এই বিশ্বকাপে যে ৩০০ রান তাড়া করার উদাহরণ তৈরি করতে পারেনি কোনো দল।
কাউকে না কাউকে উদাহরণটা তৈরি করতেই হতো, বাংলাদেশের হাত ধরেই সে যাত্রা শুরু হলো। প্রতিপক্ষ উইন্ডিজ সাত উইকেটে পরাজিত হলো।
যেদিন বাংলাদেশ জেতে, শুরু থেকেই নাকি সেদিন বাতাসে জয়ের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। টন্টনে বোধহয় আজ তেমনই কোনো দিন ছিল। নইলে টস থেকে শুরু করে সবখানেই বাংলাদেশের নিরঙ্কুশ জয়ের আর ব্যাখ্যা কী!
অবশ্য টস জয়ের পরেও উইন্ডিজকে ব্যাটিংয়ে পাঠানো নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ ছিল। প্রতিপক্ষ যখন গেইল-রাসেলদের মতো দানবেরা, তখন তো রান পাহাড়ের নিচে চাপা পড়ার শঙ্কা ছিলই। উপরি হিসেবে টানা চতুর্থ ম্যাচে বাংলাদেশ নেমেছিল দলের গতিতারকা রুবেলকে ছাড়া।
তবে মাশরাফির নেয়া সিদ্ধান্তকে সঠিক প্রমাণ করতে সময় নেননি সাইফুদ্দিন, আঘাত হেনেছিলেন ম্যাচের চতুর্থ ওভারেই। ব্যক্তিগত ১৩তম বলেও রানের খাতা খুলতে ব্যর্থ হয়ে গেইল ফিরেছিলেন প্যাভিলিয়নে। কাকতালীয়ই বলতে হবে, বিশ্বকাপে এর আগে সর্বশেষ যেবার ‘ডাক’ মেরে আউট হয়েছিলেন তিনি, প্রতিপক্ষ ছিল বাংলাদেশ।
গেইল বিদায় নিয়েছিলেন দলীয় ৬ রানে। গেইলের বিদায়ের পরে আরও বেশি রক্ষণাত্মক হয়ে পড়া উইন্ডিজ পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে প্রথম পাওয়ারপ্লে কাজে লাগাতে। প্রথম দশ ওভারে রান তুলেছিল মোটে ৩২, যার ষোল রানই এসেছিল চারটি চারের মারে।
টন্টনের ছোট মাঠে উইন্ডিজের ব্যাটসম্যানদের থেকে আশা ছিল ছক্কাবৃষ্টির। অথচ ম্যাচের প্রথম ছক্কার মার দেখতে কি না অপেক্ষা করতে হয়েছিল একাদশ ওভার পর্যন্ত! এভিন লুইসের সেই ছক্কার পরই যেন কিছুটা গতি পায় উইন্ডিজের ইনিংস। অবশ্য এরপরও দলীয় শতরানের দেখা মেলে ২৩তম ওভারে।
সেখান থেকে ম্যাচ শেষে যে স্কোরবোর্ডে ৩২১ রান জমা হলো, তার মূল কারিগর শিমরান হেটমায়ার। আক্রমণাত্মক ব্যাটিংকেই জীবনের সমস্ত ধ্যানজ্ঞান বানিয়ে ফেলা এই ক্রিকেটার মাঠে নেমেছিলেন ৩৩তম ওভারে৷ ৪০তম ওভারে সাজঘরে ফেরার আগে খেলেছিলেন ২৬ বল, এর মাঝেই তুলে নিয়েছিলেন ক্যারিয়ারের ৩য় ফিফটি।
তাঁকে সঙ্গ দিতে শাই হোপ তো ছিলেনই। বাংলাদেশকে সামনে পেলেই মূর্তির মতো উইকেটে অবিচল হয়ে ওঠা এই বাজান ক্রিকেটার আরও একবার ভুগিয়েছেন বাংলাদেশের বোলারদের। নড়বড়ে নব্বইয়ের ঘরে মুস্তাফিজের শিকার হয়ে ফেরার আগে খেলে গিয়েছেন দর্শনীয় ৯৬ রানের ইনিংস।
দু’জনের গড়ে দেয়া ভিত্তির ওপরে দাঁড়িয়ে বোলারদের শাসিয়েছেন জেসন হোল্ডারও। সাকিবকে সীমানার বাইরে আছড়ে ফেলেছিলেন মোকাবেলা করা দ্বিতীয় বলেই। পরে আরও এক ছক্কা আর চারটি চারে রান করেছিলেন ১৫ বলে ৩৩। উইন্ডিজকে নিয়ে যাচ্ছিলেন আরও বড় সংগ্রহের দিকে।
তা যে হয়নি, এর কৃতিত্ব দিতে হবে বাংলাদেশের ডেথ ওভারের বোলিংকে, আরও নির্দিষ্ট করে বললে মুস্তাফিজুর রহমানকে। প্রথম ছয় ওভারে ৪৩ রান দেয়া মুস্তাফিজ ইনিংস শেষ করেছিলেন ৯-০-৫৩-৩ বোলিং ফিগার নিয়ে। এর চেয়েও বড় কথা, ভয়ংকর হয়ে ওঠার আগেই ফিরিয়েছিলেন আন্দ্রে রাসেলকে। শেষ ৩৬ বলে উইন্ডিজ তাই তুলতে পারেনি ৩৯ রানের বেশি, উইন্ডিজ থেমেছিল ৩২১ রানে।
তবুও এই বিশ্বকাপের ফলাফল আর বাংলাদেশের অতীত রেকর্ডের কথা মাথায় রেখে ৩২২ রানের লক্ষ্যমাত্রাকে অনতিক্রম্যই মনে হচ্ছিল। গত কয়েক বছরে বাকি দলগুলো যখন স্কোরবোর্ডে তিনশ রান তোলাকে ছেলেখেলা বানিয়ে ফেলেছে, বাংলাদেশ সে সময়ে ৩০০ রান তুলেছিল সবচেয়ে কমসংখ্যক বার। এমনকি শেষ চার বছরে দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করে তিনশ ডিঙাতে পারেনি একবারও। বিশ্বকাপের মঞ্চে তাই অতীতের সব রেকর্ড ভেঙেচুরে বাংলাদেশ এই রান তাড়া করে ফেলবে, এমন বিশ্বাসে বিশ্বাসী হওয়া একটু দূরতম কল্পনাই ছিলো।
কল্পনার ভূমিতে রঙ ছড়ানোর প্রাথমিক কাজটা করেছিলেন সৌম্য সরকার। তার অভিষেকের পর থেকে সৌম্যের উড়ন্ত সূচনা মানেই বাংলাদেশের জয়, উড়ন্ত সূচনা এনে দিয়েছিলেন আজও। সমান দুই চার আর ছক্কার মারে বাংলাদেশকে পঞ্চাশ পার করিয়েছিলেন নবম ওভারে, তামিমকে নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন ১১তম পঞ্চাশ পেরোনো জুটি।
সৌম্যের ব্যাটে ঝলক দেখে যেন নিজের ‘হারানো’ ফর্মও কিছুটা ফিরে পেয়েছিলেন তামিম ইকবাল। এবারের বিশ্বকাপে নিজের প্রথম তিন ম্যাচে রান না পেলেও ব্যাট ঝলসে উঠেছিল আজ, ক্যারিয়ারের ৪৭তম ফিফটির হাতছোঁয়া দূরত্বে দাঁড়িয়ে অবশ্য ফিরতে হয়েছিল সাজঘরে। তার আগে সাকিব আল হাসানের সঙ্গে গড়েছিলেন ৬৯ রানের জুটি, তামিম ফেরার খানিক বাদে ফিরেছিলেন ‘মিস্টার ডিপেন্ডেবল’ মুশফিকুর রহিমও। জয় তখনও ১৮৯ রান দূরত্বে দাঁড়িয়ে।
রুবেল এ ম্যাচে না ফিরলেও দলে বদল একটি এসেছিল। মিথুনের জায়গায় এসেছিলেন লিটন দাস। ক্যারিয়ারে বাকি একদিনের ম্যাচগুলোতে টপ অর্ডারেই ব্যাট করা লিটন দাস এদিন নেমেছিলেন পাঁচ নম্বরে। ‘এলাম, দেখলাম, জয় করলাম ‘-এর আদর্শ উদাহরণ হয়ে বিশ্বকাপে নিজের প্রথম ম্যাচেই লিটন পেয়েছেন অর্ধশতকের দেখা, আগের ২৮ ওয়ানডে ম্যাচে যার দেখা পেয়েছিলেন মাত্র দুইবার।
তার ৬৯ বলে চার ছক্কা আর আট চারের মারে সাজানো ইনিংসটি ছিল ৯৪ রানের। এর মাঝে ছিল শ্যানন গ্যাব্রিয়েলকে টানা তিন বলে ছক্কা হাঁকানোর কীর্তিও।
তবুও ম্যান অফ দ্য ম্যাচের পুরষ্কার বাগাতে পারেননি তিনি। বলা ভালো, সাকিব আল হাসান তা হতে দেননি। এমনিতেই হাবেভাবে যা বোঝাচ্ছেন, তাতে টের পাওয়া যাচ্ছে, বিশ্বকাপে এসেছেন কোনো মিশন নিয়ে। প্রতি ম্যাচে, প্রতি প্রতিপক্ষকে তা যেন বুঝিয়ে দিতে চাইছেন হাড়ে হাড়ে। শুরুর ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে হয়েছিলেন ম্যাচসেরা, পঞ্চাশ করেছিলেন নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে, বিশ্বকাপে নিজের প্রথম শতকের দেখা পেয়েছিলেন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে কার্ডিফে। মাঝে শ্রীলংকার বিপক্ষে ম্যাচটি ভেসে গিয়েছিল বৃষ্টিতে, কিন্তু ব্রিস্টলের সেই বৃষ্টি তার ফর্ম ভাসিয়ে নিতে পারলে তো! বোলিংয়ে নিয়েছিলেন দুই উইকেট, তবে ম্যাচটিকে নিজের করে নেবার রসদ জমিয়ে রেখেছিলেন ব্যাটিং ইনিংসের জন্যে। মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের সঙ্গী হয়ে দ্বিতীয় বাংলাদেশি হিসেবে তুলে নিয়েছেন বিশ্বকাপে ‘ব্যাক টু ব্যাক’ সেঞ্চুরির কীর্তি।
রান করার চেয়েও রান করার ধরনে দৃষ্টি কেড়েছেন সবার। আইসিসির বিবরণে দেয়া ‘আল্ট্রা-অ্যাগ্রেসিভ’ ব্যাটসম্যান বিশেষণের সার্থকতা প্রমাণ করে খেলেছেন স্বভাবসুলভ আক্রমণাত্মক ঢঙেই। চড়ে বসতে দেননি কোনো বোলারকেই, ওভারপ্রতি সাড়ে ছয় ছুঁইছুঁই রানের চাহিদাও তাই নাগালের মাঝেই ছিল সবসময়। নিজে তুলে নিয়েছেন সেঞ্চুরি, লিটন দাসের সঙ্গে গড়েছেন ১৮৯ রানের জুটি। বাংলাদেশের পক্ষে ৪র্থ উইকেট জুটিতে এর চেয়ে বেশি রান ওঠেনি একবারও, বিশ্বকাপ ইতিহাসেই ৪র্থ উইকেটে এই রানের ওপরে আছেন কেবল মাইকেল ক্লার্ক-ব্র্যাড হজ জুটি।
দু’জনের আক্রমণাত্মক ব্যাটিংয়ে উইন্ডিজের বোলাররা নেমে এসেছিলেন পাড়ার বোলারদের স্তরে। ছয়ের কম ইকোনমি রেট নিয়ে ম্যাচ শেষ করতে পারেননি কেউ। অবশ্য ৩২২ রানের লক্ষ্যমাত্রা যে ম্যাচে তাড়া করা হয় ৫১ বল বাকি থাকতে, সে ম্যাচে বোলারদের ইকোনমি রেট ছয়ের নিচে থাকার কথাও না।
৪২.৩ ওভারে এত রান তাড়া করার কথা জেনে অবাক ঠেকছে? এই বাংলাদেশ দল তো অবাক করতেই জানে!