ক্রিকেটের প্রাচীনতম সংস্করণ টেস্ট ক্রিকেট। পরবর্তীতে একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট শেষে দর্শক মাতাতে তৈরি হয় ক্রিকেটের ক্ষুদ্রতম সংস্করণ টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের তিন ফরম্যাটেই দেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করা একজন ক্রিকেটারের আজীবন স্বপ্ন থাকে। তিন ফরম্যাটেই সফল হওয়া- সেটা তো একজন ক্রিকেটারের সৌভাগ্যের বিষয়। ক্রিকেটে দলগত সাফল্য তখনই আসে যখন বোলিং, ব্যাটিং, ফিল্ডিং তিন বিভাগেই ক্রিকেটাররা নিজেদের সেরাটাই দেন। তবে এতে বোলারদের ব্যর্থতা অনেক সময় চাপে ফেলে দেয় ব্যাটসম্যানদের।
একজন বোলারের স্বপ্নই থাকে দেশের হয়ে হ্যাটট্রিক কিংবা ৫ বা ততোধিক উইকেট নেওয়ার। তবে ক্রিকেটের ক্ষুদ্রতম সংস্করণ টি-টুয়েন্টি ক্রিকেটে মাত্র ৪ ওভার বল করে ৫ উইকেট ঝুলিতে পোরা কিছুটা কষ্টসাধ্য। এই কষ্টসাধ্য ব্যাপারটি করে দেখিয়েছেন বেশ কয়েকজন বোলার। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের তিন ফরম্যাটেই ৫ উইকেট নিয়েছেন এমন বোলার এ পর্যন্ত ৫ জন আছেন; যে তালিকায় সর্বশেষ নাম উঠেছে ভারতীয় পেসার ভুবনেশ্বর কুমারের। অবশ্য এশিয়ান দর্শকরা এটি নিয়ে গর্ব করতেই পারেন, তালিকার ৫ জন বোলারের ৪ জনই এশিয়ান। চলুন জেনে নেওয়া যাক তাদের সম্পর্কে।
১. উমর গুল (পাকিস্তান)
পাকিস্তানকে বলা হয় ফাস্ট বোলারদের পূণ্যভূমি। ওয়াসিম আকরাম, ওয়াকার ইউনুস, আকিব জাবেদ, শোয়েব আক্তারের মতো পেসাররা জন্ম নিয়েছে পাকিস্তানে। তাদের মতো এতটা জনপ্রিয় না হতে পারলে ক্যারিয়ারে বেশ সফল ছিলেন উমর গুলও। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের তিন ফরম্যাটেই পাঁচ উইকেট পাওয়া প্রথম বোলার উমর গুল। ২০০৩ সালে বাংলাদেশের বিপক্ষে হয় তার টেস্ট অভিষেক। সে বছরই জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে খেলেন ক্যারিয়ারের প্রথম একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ। ২০০৪ সালে পাকিস্তানের কর্নেল গাদ্দাফী স্টেডিয়ামে ভারতের বিপক্ষে তুলে নেন টেস্ট ক্যারিয়ারের প্রথম ৫ উইকেট।
আন্তর্জাতিক টেস্ট ক্রিকেটে ৫ উইকেট নিয়েছেন ৪ বার। একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ৫ উইকেট শিকার করেছেন ২ বার, যার প্রথমটি আসে ২০০৩ সালে বাংলাদেশ এর বিপক্ষে। ২০০৯ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে নিউজিল্যান্ড এর বিপক্ষে মাত্র ৬ রান দিয়ে তুলে নেন ৫ উইকেট। ২০১৩ সালে সেঞ্চুরিয়নে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারে ২য় বারের মতো শিকার করেন ৫ উইকেট।
জাতীয় দলের জার্সি গায়ে টেস্টে খেলেছেন ৪৭টি ম্যাচ, উইকেট নিয়ছেন ১৬৩টি। পাকিস্তানের জার্সি গায়ে একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে তাকে শেষবারের মত তাকে দেখা গিয়েছিল ২০১৩ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে। পরে ঘরোয়া টি-টোয়েন্টিতে ভাল করার সুবাদে টি-টোয়েন্টি দলে ফিরলেও টেস্ট কিংবা একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আর ফেরা হয়নি। ১৩০টি একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে তার উইকেট সংখ্যা ১৭৯টি। আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে ৬০ ম্যাচে তার শিকার ৮৫টি উইকেট।
২. টিম সাউদি (নিউজিল্যান্ড)
পুরো নাম টিমোথি গ্র্যান্ট সাউদি, নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট দলের বর্তমান সহ-অধিনায়ক। মালয়েশিয়ায় অনুষ্ঠিত ২০০৮ সালের অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপে তিনি ছিলেন সেই টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়। সে বছরই ডাক পান নিউজিল্যান্ড এর জাতীয় দলে। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে হয় টেস্ট অভিষেক। অভিষেকেই তুলে নেন পাঁচ উইকেট। টেস্ট ক্রিকেটে ৫ উইকেট শিকার করেছেন এ পর্যন্ত ৬ বার, একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ২ বার। ২০১০ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে নেন টি-টুয়েন্টি ক্রিকেট ক্যারিয়ারের প্রথম পাঁচ উইকেট। ২০১৫ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ড এর বিপক্ষে করেন নিজের ক্যারিয়ার সেরা বোলিং। ৩৩ রান দিয়ে তুলে নেন ৭ উইকেট। ১২৩ রানে ইংল্যান্ড গুটিয়ে গেলে ৮ উইকেটের সহজ জয় পায় নিউজিল্যান্ড।
৩. অজন্তা মেন্ডিস (শ্রীলঙ্কা)
এ তালিকার ৩য় সদস্য শ্রীলঙ্কান স্পিন বোলার অজন্তা মেন্ডিস। তাকে বলা হয় ক্রিকেটের রহস্যময়ী স্পিনার। তার বলের জাদু বোঝাটা ব্যাটসম্যানদের জন্য বেশ কঠিন ছিল। অবশ্য ক্রিকেটকে পুরোপুরি ক্যারিয়ার হিসেবে নিতে পারেননি মেন্ডিস। কাজ করছেন শ্রীলঙ্কান সেনাবাহিনীর লেফটেনেন্ট হিসেবে। ২০০৮ সালে ভারতের বিপক্ষে তার টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক হয়। অভিষেক টেস্টে নিয়েছিলেন ৮ উইকেট। সেই বছরই ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে হয় একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক। একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রথম ৫ উইকেট লাভ করেন ২০০৮ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিপক্ষে। আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে একমাত্র বোলার হিসেবে দুবার শিকার করেছেন ৬ উইকেট, যার প্রথমটি আসে ২০১১ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে
পরের বছর জিম্বাবুয়ের সাথে মাত্র ৮ রান দিয়ে নিয়েছিলেন ৬ উইকেট। ২০১২ সালের ২৬ অক্টোবর লাভ করেন শ্রীলঙ্কার সর্বোচ্চ পুরস্কার “শ্রীলঙ্কান অর্ডার অব বান্টু”। শেষবারের মতো জাতীয় দলের জার্সি গায়ে খেলেছেন ২০১৫ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে।
৪. লাসিথ মালিঙ্গা (শ্রীলঙ্কা)
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ৫ উইকেট পাওয়া কিংবা যেকোনো ফরম্যাটে হ্যাটট্রিক করা একজন বোলারের কাছে অনেক বড় একটা অর্জন। তবে তার কাছে হ্যাটট্রিক যেন এক অতি সাধারণ একটি বিষয়। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তার হ্যাটট্রিকের সংখ্যা মোট ৪টি। ডেথ ওভারের অন্যতম এক সফল বোলার তিনি। তার নামানুসারে অনেকেই তার বোলিং অ্যাকশনকে স্লিংগাও বলে থাকে। ২০০৪ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে তার টেস্ট অভিষেক হয়। টেস্ট ক্রিকেটে প্রথমবারের মতো ৫ উইকেটে নিয়েছিলেন ২০০৫ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে।
ঘন ঘন ইনজুরিতে পড়ার ফলে টেস্ট ক্রিকেট চালিয়ে নিয়ে যাওয়া তার জন্যে অনেকটা কঠিনই ছিল। বলা যায়, একপ্রকার বাধ্য হয়েই টেস্ট ক্রিকেট থেকে বিদায় নেন ২০১০ সালে। একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এ পর্যন্ত ৫ উইকেট নিয়েছেন মোট ৭ বার। ২০১২ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৩১ রান দিয়ে তুলে নেন ৫ উইকেট। তার ক্যারিয়ারে ৪ হ্যাটট্রিকের মধ্যে ২টিই ছিল বিশ্বকাপে, যার প্রথমটি ছিল ২০০৭ বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে, ২য়টি ২০১১ সালে কেনিয়ার বিপক্ষে। একমাত্র খেলোয়াড় হিসেবে নিয়েছেন টানা ৪ বলে ৪টি উইকেট। গত বছর বাংলাদেশের বিরুদ্ধে করেছেন ক্যারিয়ারের ৪র্থ হ্যাটট্রিক।
৫. ভুবনেশ্বর কুমার (ভারত)
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের তিন ফরম্যাটেই ৫ উইকেট নেওয়া বোলারদের তালিকার নতুন সদস্য ভারতীয় ফাস্ট বোলার ভুবনেশ্বর কুমার। ২০১৪ সালে ট্রেন্ট ব্রিজ ক্রিকেট গ্রাউন্ডে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তুলে নিয়েছিলেন টেস্ট ক্যারিয়ারের প্রথম ৫ উইকেট। গত বছর শ্রীলঙ্কা সফরে লাভ করেন একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ক্যারিয়ারের প্রথম ৫ উইকেট। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে তিন ম্যাচ টি-টুয়েন্টি সিরিজের প্রথম ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকাকে ২০৪ রানের টার্গেট দেয় ভারত। জবাবে ভুবনেশ্বর কুমারের বোলিং তোপে নির্ধারিত ২০ ওভারে ৯ উইকেটে ১৭৫ রান করে দক্ষিণ আফ্রিকা। ভারত জয় পায় ২৮ রানের।
২৪ রান দিয়ে ভুবনেশ্বর কুমার তুলে নেন আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারের প্রথম ৫ উইকেট। জায়গা করে নেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের তিন ফরম্যাটেই ৫ উইকেট নেওয়া বোলারদের এলিট ক্লাবে।
ফিচার ইমেজ: googlycricket.net