গত দুই দশক পুরনো কোনো ক্রিকেটপ্রেমীকে যদি জিজ্ঞাসা করেন সেরা অ্যাশেজ সিরিজ কোনটি, সিংহভাগ ভোটই যাবে ২০০৫ অ্যাশেজের ঘরে। ঐতিহাসিক সেই সিরিজ বিখ্যাত হয়ে আছে এজবাস্টনের দ্বিতীয় টেস্টের জন্য। অস্ট্রেলিয়াকে দুই রানে হারিয়ে ইতিহাসের সেরা টেস্টটা জিতেছিল ইংল্যান্ড। সেই ম্যাচের রোমাঞ্চ এখনো ছুঁয়ে যায় ক্রিকেটপ্রেমীদের। প্রতি সেশনের রঙবদলের পরতে পরতে কত রোমাঞ্চ, কত উত্তেজনা, কত নাটকীয়তা মিশে ছিল!
স্টিভ হার্মিসনের বাউন্সারে মাইকেল ক্যাসপ্রোভিচের ডাক করতে গিয়েও না করার পর জেরাইন্ট জোন্সের দারুণ এক ক্যাচ। ব্রেট লি’র মাথা নুইয়ে বসে পড়া। আগুনে বোলিং করা অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফের তার দিকে ছুটে যাওয়া, হ্যান্ডশেক। সাবেক ইংলিশ ক্রিকেটার জ্যাক রাসেল সেই মুহূর্তটা ফুটিয়ে তুলেছেন তার তুলির আঁচড়ে। দারুণ এক আইকনিক মুহূর্ত কি না!
আপনার ভাবনায় হয়তো উঁকি দিয়ে যাবে গত অ্যাশেজের হেডিংলি টেস্টের কথাও, যেখানে একা হাতে ম্যাচ জিতিয়েছিলেন বেন স্টোকস। তবুও যদি আমাদের ছায়াসঙ্গী গুগলকে একই প্রশ্ন করেন, ০.৬৮ সেকেন্ডে গুগল আপনাকে জানাবে ২০০৫ সালের অ্যাশেজ আছে জনপ্রিয়তার শীর্ষে। এজবাস্টন টেস্টের গল্প না হয় অন্য কোনোদিনের জন্য তোলা রইল। চলুন ঘুরে আসি সেই সিরিজের পঞ্চম ও শেষ টেস্ট থেকে, যার জন্য এত লম্বা একটা ভূমিকা টানা।
ওভালের অবিনশ্বর মূর্তি
ইংলিশ সামার, ওভারকাস্ট কন্ডিশন। আকাশের মুখটাও তখন গোমড়া হয়ে উঠেছে, অভিমানী প্রেমিকার মতো। ওভালের ময়দানে চলছে অ্যাশেজ সিরিজের শেষ টেস্টের শেষদিনের খেলা। পুরো গ্যালারি গমগম করছে দর্শকে। ছয় রানের লিড নিয়ে দ্বিতীয় ইনিংস শুরু করা ইংল্যান্ডের নেই তিন উইকেট, স্কোরবোর্ডে রান মাত্র ৬৭। এমন সময় মঞ্চে আগমন তার। ছয় ফুট চার ইঞ্চি উচ্চতার ডানহাতি ব্যাটসম্যান; প্রথাগত ব্যাটিং স্টান্স নয় তার, হাই ব্যাকলিফটে ব্যাটিং করেন। দুই পায়ের মাঝে এমনই ফাঁক যে অনায়াসে একটা হাতি চলে যাবে! দারুণ স্টাইলিশ চুল, মাঝখানে আবার ব্লন্ড কালার করা। নাম — কেভিন পিটারসেন।
গ্লেন ম্যাকগ্রার হ্যাটট্রিক বলের সামনে পড়লেন তিনি। ম্যাকগ্রার বাউন্সার গিয়ে লাগল সোজা কাঁধে। কোনোরকমে ব্যাট-গ্লাভস সরিয়ে নিলেন বলের লাইন থেকে। কয়েক ওভার পরের ঘটনা। পিটারসেন তখন ব্যাট করেছেন ১৫ রানে। ব্রেট লি’র ফুল লেন্থ বলে ড্রাইভ করলেন, আউটসাইড এজ হয়ে বল যাচ্ছে ফার্স্ট স্লিপের শেন ওয়ার্নের দিকে। মিস করলেন ওয়ার্ন, জীবন পেলেন কেপি।
মোটে চার টেস্টের অভিজ্ঞতা, অভিষেকটাও হয়েছে অ্যাশেজের মঞ্চেই। ম্যাচের পাগলা ঘোড়ার লাগাম টানাটাও হচ্ছিল না তার। সাথে কেউ সঙ্গও দিতে পারছিলেন না তাকে। ওভালের আকাশ ঢেকে ফেলা মেঘে বোধহয় পরাজয়ের রক্তচক্ষু দেখছিল ইংল্যান্ড। শেষদিন অস্ট্রেলিয়া লাঞ্চ ব্রেকে গিয়েছিল ১৩৩ রানে পিছিয়ে থেকে। লাঞ্চ থেকে ফিরে আর পাঁচটা উইকেট নিলেই কেল্লাফতে। এক সেশনে সেই রান তাড়া করার ঝুঁকিটা বোধহয় নিত রিকি পন্টিংয়ের অস্ট্রেলিয়া।
অজিদের সেই পরিকল্পনা এর আগেই ধুলিস্মাৎ পিটারসেনের ব্যাটে। অজিদের একের পর এক পাঞ্চে নকআউট হয়ে যেতে শুরু করেছিল ইংল্যান্ড। কাউন্টার পাঞ্চ করলেন পিটারসেন। ম্যাকগ্রাকে পুল করে শুরু; ব্রেট লি’র ১৪৫ কিমি বেগে ধেয়ে আসা বাউন্সারকে হুক করে আছড়ে ফেললেন ডিপ ফাইন লেগের ওপারে; লি’কেই ব্যাটের ফুল ফেসড একটা স্ট্রেইট ড্রাইভ — দেখার মতো ব্যাপার বটে। শেন ওয়ার্নের লেগস্পিন টার্ন করার আগেই সুইপ করে পাঠিয়েছেন গ্যালারিতে; শন টেইটের করা গতিময় লেন্থ ডেলিভারি, কভার ড্রাইভ করে সেঞ্চুরি। ক্যারিয়ারের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি, অ্যাশেজের মতো বড় মঞ্চে… তাও যখন দল ধুঁকছিল। নিজের জোনে যা এসেছে, সবই মারার চেষ্টা করেছেন, সফলও হয়েছেন। ওভালে বইয়ে দিয়েছেন ঝড়। ১৫ চার, সাত ছক্কায় ১৫৮ রানের বিখ্যাত এক ম্যাচ-বাঁচানো (তথা অ্যাশেজ-বাঁচানো) ইনিংস। দলকে এনে দিয়েছেন বড় লিড।
সেই টেস্টের আগে ২-১ ব্যবধানে এগিয়ে ছিল ইংল্যান্ড। থেমেছেন ম্যাকগ্রার দারুণ এক আউটসুইঙ্গারে লাইন মিস করে বোল্ড হয়ে। উইকেটের চারপাশে শট খেলেছেন। ম্যাকগ্রা-লি-ওয়ার্ন, ডাকাবুকো তিন বোলারকেই পিটিয়েছেন হরদম। টিম ম্যানেজমেন্ট হয়তো আশা করছিল কোনোরকম দাত কামড়ে পড়ে থেকে টেস্ট ড্র করা। পিটারসেন বেছে নিলেন অন্য উপায়। অধিনায়ক মাইকেল ভন তাকে বলেছিলেন, নিজের স্বাভাবিক খেলাটা খেলতে।
পিটারসেন খেলেছেন ‘অস্বাভাবিক’ এক ইনিংস। হোমারের লেখা গ্রিক মহাকাব্য ‘দ্য ইলিয়াড’-এ যেমনটা দেখা যায়। ট্রোজান যুদ্ধে ঐশ্বরিক শক্তি দিয়ে দেবতারা নিজেদের পছন্দের যোদ্ধাকে সাহায্য করতেন, যাতে তারা অমর-অবিনশ্বর হয়ে যুদ্ধ করতে পারে। ওভালে সেদিন অমন এক অবিনশ্বর অবতারেই হাজির হয়েছিলেন কেপি। অমন পরিস্থিতিতে তার একেকটা শট দেখে মনে হচ্ছিল, মানবসন্তানদের শক্তির সীমারেখা তিনি ছাড়িয়ে গেছেন। কোনো স্বাভাবিক নিয়মে তখন ব্যাট চলছিল না।
সেই অমর যোদ্ধার সামনে নত হয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার সব বড় বড় নাম। যখন আউট হয়ে মাঠ ছাড়েন ওয়ার্ন এগিয়ে গিয়ে তার পিঠ চাপড়ে দিয়েছেন। সেদিন পিটারসেনের সঙ্গে স্বীকৃত শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে ছিলেন পল কলিংউড। একদিকে পিটারসেন ঝড় তুলেছেন ঠিকই, কিন্তু অন্য প্রান্তে কলিংউড ছিলেন শান্ত-ধীর-স্থির। ক্রিজে ছিলেন ৭২ মিনিট, বল খেলেছেন ৫১টি, রান করেছেন দশ।
আমাদের কল্পনা যেখানে সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়ায় আটকে যায়, ক্রিকেট সেখান থেকে নতুন আল্পনা আঁকে। সেই আল্পনার আঁকিবুঁকির প্রতিটা বাঁকে বাঁকে থাকে গা শিউরে ওঠা রোমাঞ্চ, আর অবিশ্বাস্য কিছু বাঁকবদল। কেপির সেদিনের ইনিংসটাও ছিল অমন। আমাদের কল্পনার সীমারেখা ছাড়িয়ে যাওয়া। খুইয়ে বসা ম্যাচটাতেই দলকে এনে দিয়েছেন ড্র করার রসদ। কেপি সেদিন ওভালের মাঠ ছেড়েছেন অমর এক যোদ্ধা হয়ে; দর্শকদের হাততালি, অভিবাদন আর স্ট্যান্ডিং ওভেশনে। ওভালের অবিনশ্বর এক মূর্তি, ইম্মোর্টাল অ্যাট ওভাল।
জেন্টল অফস্পিনার যখন ব্যাটিংস্তম্ভ
জন্ম ১৯৮০ সালের ২৭ জুন, দক্ষিণ আফ্রিকার নাটাল প্রদেশের পিটারমারিৎজবার্গ এলাকায়। বাবা দক্ষিণ আফ্রিকান, মা ইংলিশ। ক্রিকেটের শুরু কলেজ জীবনে, আনুষ্ঠানিকভাবে ক্রিকেটের সাথে পথচলা শুরু তখনই। কোয়াজুলু নাটাল একাদশের ‘বি’ টিমের হয়ে ইস্টার্ন্সের বিপক্ষে তিনদিনের সেই ম্যাচে এক উইকেট নিয়েছিলেন। রান করেছিলেন অপরাজিত ৩।
পিটারসেনকে আমরা ব্যাটসম্যান হিসেবেই চিনি, যিনি মাঝে মাঝে অফস্পিনটাও করতেন। তবে তার ক্রিকেট জীবন শুরু হয়েছিল অফস্পিনার হিসেবেই। ব্যাটিং পজিশন ছিল লোয়ার অর্ডারে। সেই প্লেয়িং রোল দিয়েই নজর কেড়েছিলেন সবার, বিশেষ করে ইংলিশ অধিনায়ক নাসের হুসাইনের।
১৯৯৯ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে যায় ইংল্যান্ড। সেই সফরে তিনদিনের এক প্রস্তুতি ম্যাচে পিটারসেনের কোয়াজুলু নাটাল মুখোমুখি হয় ইংল্যান্ডের। চারদিনের সেই ম্যাচের প্রথম ইনিংসে দারুণ কিছু শটে ৫৭ বলে ৬১ রানে অপরাজিত থাকেন পিটারসেন। সেদিন নয় নম্বরে ব্যাট করেন তিনি। বল হাতেও ছিলেন উজ্জ্বল। তার বলেই আউট হয়েছিলেন নাসের হুসাইন, মাইকেল আথারটন, মাইকেল ভনের মতো ব্যাটসম্যানরা। ব্যাটে-বলে এমন পারফরম্যান্সের পর নাসের হুসাইন নিজে থেকেই পিটারসেনের সঙ্গে কথা বলেন। পরামর্শ দেন ইংল্যান্ডের কোনো কাউন্টির সাথে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার।
নাটালে আরো দুই মৌসুম খেলে পিটারসেন পাড়ি জমান ইংল্যান্ডে। দক্ষিণ আফ্রিকার কোটা প্রথার কারণেই এই প্রস্থান। নিয়ম ছিল একাদশে কমপক্ষে চারজন কৃষাঙ্গ ক্রিকেটার থাকতে হবে। যার কারণে নাটালের ‘এ’ টিম থেকে বাদও পড়েছিলেন পিটারসেন। তার দাবি ছিল, মেধা দিয়েই বিচার হোক, কোনো কোটা দিয়ে নয়। তাই ক্লাবের সাথে বিচ্ছেদ। ইংল্যান্ডের ক্যানক ক্রিকেট ক্লাব হয় তার নতুন ঠিকানা। মা ব্রিটিশ হওয়ায় সেখানকার নাগরিকত্ব পাওয়া নিয়ে ঝামেলা হয়নি। প্রথমবারের মতো পরিবার ছেড়ে বিদেশ বিভূঁইয়ে থাকা। থাকতেন একটা রুম নিয়ে, যেটার ঠিক ওপরেই একটা স্কোয়াশ কোর্ট। খেলার পাশাপাশি কাজ করতেন একটা বারেও।
সেবার দক্ষিণ আফ্রিকা ছেড়ে ইংল্যান্ডে পাড়ি না জমালে পিটারসেনকে হয়তো আমরা প্রোটিয়া ক্রিকেটার হিসেবেই চিনতাম। নাটালের কোথা প্রথার ওপর বিরক্ত হয়েই এই সিদ্ধান্ত নেন তিনি। সেই দলের অনেক সতীর্থও তাকে পরামর্শ দেন ইংল্যান্ডে চলে যেতে। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এসেছিল দক্ষিণ আফ্রিকান ক্রিকেটের তৎকালীন প্রধান আলী ব্যাখারের সঙ্গে পিটারসেনের বাবার আলাপচারিতার পর। উত্তপ্ত সেই সভার পর পিটারসেনের বাবা তাকে বলেন,
‘তুমি যাচ্ছো, এই কোটা প্রথা কখনোই শেষ হবে না।’
সময়টা ২০০০ সাল। ক্যানকের হয়ে তখন পুরোদমে খেলে যাচ্ছেন কেপি। তখন তিনি যোগাযোগ করেন নটিংহ্যামশায়ারের তৎকালীন কোচ ক্লাইভ রাইসের সাথে। সাবেক এই দক্ষিণ আফ্রিকান ক্রিকেটার কেপিকে প্রথম দেখেছিলেন ১৯৯৭ সালে, এক স্কুল ক্রিকেট টুর্নামেন্টে। তখনই তাকে নটিংহ্যামের হয়ে খেলার প্রস্তাব দেন। সেবার মানা করলেও নিজে থেকেই খেলার আগ্রহ দেখান পিটারসেন।
নটিংহ্যামের হয়ে অভিষেক ম্যাচেই হাঁকান সেঞ্চুরি। প্রথম মৌসুমে বাজিমাৎ, ৫৭.৯৬ গড়ে করেন ১,২৭৫ রান। স্বপ্নের মতো সময় কাটছিল। ক্রিকেটের বাইবেল-খ্যাত ‘উইজডেন অ্যালামনাক’ লিখেছিল,
‘প্রথম মৌসুমের এই ফর্ম ধরে রাখতে পারলে পিটারসেনের নাম ইংল্যান্ডের ভবিষ্যৎ টেস্ট স্কোয়াডে দেখা যাবে।’
পরের বছরও তার ব্যাটে একই ধারাবাহিকতা বজায় থাকলো। ব্যাট হয়ে ওঠলো রান ফোয়ারা। ২০০৩ সালে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ১,৬৪৬ ও সীমিত ওভারের ক্রিকেটে পিটারসেন করেন ৭৪৬। এমন আগুনে পারফর্ম্যান্সের পর ডাক পান ইসিবি ন্যাশনাল অ্যাকাডেমির হয়ে ভারত সফরের দলে। ভারতের মাটিতেও দাপট দেখালেন পিটারসেন। প্রথম শ্রেণির ম্যাচগুলোতে ১০৪.৬০ গড়ে ৫২৩ রান। ভারত ‘এ’ দলের বিপক্ষে একমাত্র ওয়ানডেতেও ১৩১ রানের মারকাটারি ইনিংস।
থ্রি লায়ন্স ইন লেফট ট্রাইসেপ
দক্ষিণ আফ্রিকার কোটা প্রথা নিয়ে যারপরনাই বিরক্ত পিটারসেন। তার ভাষ্যমতে, যদি সেখানেই ক্রিকেট চালিয়ে যেতেন, তাহলে ক্রিকেটটাই কখনো খেলা হতো না আর,
‘সিস্টেমের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে যেতাম আমি, ক্রিকেট থেকে ছিটকে গিয়ে হয়তো অন্য কিছু করতাম।’
ভাগ্যিস ইংল্যান্ডে চলে গিয়েছিলেন। তা না হলে আধুনিক ক্রিকেট হয়তো এমন দারুণ এক ব্যাটসম্যানের দেখা পেতই না। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সেই দারুণ স্টাইলিশ ব্যাটসম্যানের শুরুটা হয়েছিল ২০০৪ সালে। এর আগে কাউন্টিতে টানা চারটা মৌসুম খেলেছেন চুটিয়ে, ব্যাটে ছুটেছে রানের বন্যা। ইংল্যান্ড দলও তার দিকে নজর রেখেছিল। সে বছর পাঁচ ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজ খেলতে ইংল্যান্ড যাবে জিম্বাবুয়ে সফরে। জিম্বাবুয়ের সকল ক্ষমতা তখন রবার্ট মুগাবের হাতে।
জিম্বাবুয়ের তখনকার রাজনৈতিক অবস্থা ও নিরাপত্তা ইস্যু বিবেচনা করে স্কোয়াড থেকে নাম প্রত্যাহার করে নেন স্টিভ হার্মিসন ও অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফ। অফস্পিন ও লোয়ার অর্ডারে ব্যাট হাতে কার্যকারিতার বিবেচনায় ফ্লিনটফের জায়গায় ডাক পান পিটারসেন। সিরিজের চার ম্যাচে তিন ইনিংসে ব্যাট করার সুযোগ পান তিনি। নিজের দ্বিতীয় ম্যাচেই দেখা পান হাফ সেঞ্চুরির।
নিজের সেরাটা জমিয়ে রেখেছিলেন পরের সিরিজের জন্য। ২০০৫ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে যায় ইংল্যান্ড। সেবারও ফ্লিনটফের ইনজুরিতে দলে ডাক পান পিটারসেন, খেলেছিলেন বৈরি এক আবহাওয়ায়। গ্যালারি থেকে ভেসে আসছিল ‘ট্রেইটর’ নামক দুয়ো। পুরো সিরিজজুড়েই সেটা চলেছে। পিটারসেন অবশ্য আগে থেকেই আন্দাজ করতে পেরেছিলেন, এমন কিছু হবে। সেই দুয়োধ্বনিই যেন পিটারসেনকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করলো। সাত ম্যাচ সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচেই দেখা পান অভিষেক ওয়ানডে সেঞ্চুরির। ৯৬ বলে ছয়টি চার ও দুই ছক্কায় ১০৮ রানে অপরাজিত থাকেন তিনি। সেই ম্যাচটা হয় টাই।
ওদিকে দর্শকদের তীর্যক বাক্যবাণ যেভাবে বেড়েছে, তেমনি পাল্লা দিয়ে কথা বলেছে পিটারসেনের ব্যাট। সিরিজের বাকি পাঁচ ম্যাচে সেঞ্চুরি করেছেন আরো দুটি, হাঁফ সেঞ্চুরি একটি। সিরিজ শেষে সাত ম্যাচে পিটারসেনের নামের পাশে ৪৫৪ রান, গড়টাও আকাশছোয়া, ১০৫.৫৮! যদিও ইংল্যান্ড হেরেছিল ওয়ানডে সিরিজটা।
১৩৬ ওয়ানডেতে ৪০.৩৭ গড়ে রান করেছেন ৪৪৪০। আছে নয় সেঞ্চুরি, ২৫টি হাঁফ সেঞ্চুরি। তার ক্যালিবারের এক ব্যাটসম্যানের জন্য একটু সাদামাটাই বলা চলে। তবে টেস্টে তার রেকর্ডস ঈর্ষা জাগানিয়া। ১০৪ ম্যাচে প্রায় ৪৮ গড়ে ৮১৮১ রান। টেস্টে ইংল্যান্ডের পঞ্চম সর্বোচ্চ রানের মালিক। ২৩ সেঞ্চুরির সাথে আছে ৩৫ হাফ সেঞ্চুরি। রেকর্ডবুকে তার নামের পাশে জ্বলজ্বল করছে তিনটা ডাবল সেঞ্চুরিও। আছে দারুণ কিছু ইনিংসও। লিডসে উইন্ডিজের বিপক্ষে ২২৭, লর্ডসে ভারতের বিপক্ষে ২০২*। ২০১১ অ্যাশেজে অ্যাডিলেডে ২২৭। সেবার অ্যাশেজ ফিরেছিল ইংল্যান্ডে। ঘরের মাঠে জেতা ২০১৩ অ্যাশেজেও ছিলেন
আলাদা করে বলতে হবে ২০১০ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের কথা। ছয় ম্যাচে ৬২ গড়ে তার ব্যাট থেকে এসেছিল ২৪৮ রান, যা টুর্নামেন্টের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। হয়েছিলেন টুর্নামেন্ট সেরা। ফাইনালে খেলেছিলেন ৩১ বলে ৪৭ রানের ইনিংস। এর আগে ২০০৭ বিশ্বকাপেও ছিলেন ছন্দে। নয় ম্যাচে দুই সেঞ্চুরি, তিন হাফ সেঞ্চুরিতে ৪৪৪ রান করে হয়েছিলেন সেই টুর্নামেন্টে ইংল্যান্ডের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক।
জন্মসূত্রে দক্ষিণ আফ্রিকান হলেও মনেপ্রাণে ইংলিশই ছিলেন পিটারসেন। ইংলিশ ক্রিকেটকে ধারণ করতেন বুকে। সেটা চোখে দেখা না গেলেও তার বাম বাহুতে আঁকা থ্রি লায়ন্সের ট্যাটুটা ঠিকই দেখা যেত। সেই ট্যাটুর মাহাত্ম্য ফুটে উঠেছে বারবার, তার খেলা একেকটা দারুণ ইনিংসে, অপ্রথাগত ব্যাটিং স্টান্সে দাঁড়িয়ে মারা একেকটা শটে।
অধিনায়ক পিটারসেন
এবার তার অধিনায়কত্বের কথা বলা যাক। ২০০৮ সালে ঘরের মাঠে ঘরের মাঠে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টেস্ট সিরিজ হারে ইংল্যান্ড। তখন অধিনায়ক মাইকেল ভন। একদিকে দলের ভরাডুবি, অন্যদিকে নিজের ব্যাটেও রান নেই। হতাশা থেকে পদত্যাগ করে বসেন তিনি। ওদিকে ওয়ানডে অধিনায়ক পল কলিংউডও দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছেন। ইসিবির ভরসা তাই পিটারসেন। ভরসার প্রতিদানও দিলেন হাতেনাতে। প্রোটিয়াদের ছয় উইকেট হারিয়ে শুরু, ব্যাট হাতে সেঞ্চুরি; রূপকথা। টেস্টের সঙ্গে ওয়ানডে অধিনায়কত্বও জুটলো কাঁধে। সেখানেও পিটারসেনের বাজিমাৎ। দক্ষিণ আফ্রিকাকে ৪-০ ব্যবধানে হারায় পিটারসেনের ইংল্যান্ড।
সেই বছর নভেম্বরে ভারত সফরে যায় ইংল্যান্ড। সাত ম্যাচের প্রথম পাঁচটাতেই হেরে যায় পিটারসেনের দল। পঞ্চম ওয়ানডেটা হয়েছিল কটকে। একইদিনে মুম্বাইয়ে সন্ত্রাসী হামলা হয়েছিল, যেটা ‘২৬/১১’ বলে পরিচিত। সেই সন্ত্রাসী হামলার পর সিরিজের বাকি দুই ম্যাচ বাতিল হয়ে যায়। নিরাপত্তার খাতিরে ইংল্যান্ড দলকে সরিয়ে নেয়া হয় সংযুক্ত আরব আমিরাতে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে টেস্ট সিরিজ খেলতে ভারত ফেরেন পিটারসেনরা। দুই ম্যাচ সিরিজের প্রথম টেস্টেই ছয় উইকেটের হার, রান পাননি পিটারসেনও। অবশ্য ড্র হওয়া দ্বিতীয় টেস্টে সেঞ্চুরি পান স্টাইলিশ এই ব্যাটসম্যান।
মাঠে দারুণ এক ব্যাটসম্যান কিংবা নেতা হলেও ড্রেসিংরুমে সবার নেতা হতে পারেননি তিনি। তরুণ ক্রিকেটাররা তাকে পছন্দ করলেও সিনিয়ররা তার অনেক কিছুই মেনে নিতে পারেননি। সাথে যুক্ত হয়েছিল ইংল্যান্ডের তৎকালীন কোচ ছিলেন পিটার মুরসের সাথে তার বিবাদ। তার সাথে একেবারেই বনিবনা হয়নি পিটারসেনের। টিম ম্যানেজম্যান্টের কাছে বেশ ক’বার জানান, মুরসের সাথে কাজ করা যাচ্ছে না। তবুও সিদ্ধান্ত পক্ষে আসেনি তার। কোচ-অধিনায়কের সেই বিবাদ মোটামুটি শোরগোল ফেলে দিয়েছিল ইংলিশ ক্রিকেটে। সেই শোরগোলে নীরবতা নামিয়ে আনেন পিটারসেন নিজেই। ২০০৯ সালের ৮ই জানুয়ারি পদত্যাগ করেন তিনি।
সুইচ হিট এবং অন্যান্য
২০১১ ওয়ানডে বিশ্বকাপে পেপসির বিজ্ঞাপনের কথা মনে আছে? পেপসির ফিচার করা সেই বিজ্ঞাপনে ছিল ধোনির হেলিকপ্টার শট, দিলশানের দিলস্কুপ, সাকিবের সুপার স্কুপ, শেবাগের আপার কাট, আর পিটারসেনের ‘পাল্টি হিট’। পাল্টি হিটের ক্রিকেটীয় নাম সুইচ হিট। সুইচ হিট খেলতে হলে ডানহাতি কিংবা বাঁহাতি ব্যাটসম্যানের নিজের ব্যাটিং স্টান্স-স্টাইল পুরোপুরি বদলে ফেলতে হয়। সেই কাজটাই প্রথমবার অনায়াসে করেছিলেন পিটারসেন।
২০০৮ সালে ন্যাটওয়েস্ট সিরিজে স্কট স্টাইরিসকে টানা দুটো ছয় মেরেছিলেন পিটারসেন সুইচ হিট করে। ডানহাতি থেকে পুরোপুরি বাঁহাতি ব্যাটসম্যান হয়ে গেছিলেন তখন। এর ফলাফল আসে তৎক্ষণাৎই। দাবি উঠে এমন শটকে নিষিদ্ধ করার, পরে অবশ্য এমসিসি সেই শটকে অনুমোদন দেয়।
পিটারসেনের ক্যারিয়ার ছিল উত্থান-পতনে ভরপুর। ছিল এমন একটা রোলার কোস্টার রাইড, যেটাকে কখনোই বোরিং মনে হয়নি। ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই দুর্দান্ত কোনো ইনিংস কিংবা মাঠের বাইরের কোনো সমালোচিত কাণ্ড; হেডলাইন হয়েছেন বরাবর তিনিই। ফিরে দেখা যাক সেই ঘটনাগুলোই।
নটিংহ্যামে বিদায়ঘন্টা
২০০৩ সাল। বিবর্ণ পারফরম্যান্সে নটিংহ্যাম সেবার নেমে গেল দ্বিতীয় বিভাগে। ওদিকে পিটারসেন রাস্তা খুঁজছেন জাতীয় দলের ঢোকার। নির্বাচকদের নজর কাড়তে হলে খেলতে হবে ভালো কোনো দলে। কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দিলেন তিনি আর থাকতে চান না দলে। চুক্তির মেয়াদ রয়েছে আরো এক বছর। ভালোভাবে নেননি নটিংহ্যামের অধিনায়ক জেসন গালিয়ান। রেগেমেগে ট্রেন্টব্রিজের বারান্দা থেকে পিটারসেনের কিটব্যাগ ফেলে দেন তিনি। তিক্ততা আরো বেড়ে যায়। চুক্তির মেয়াদ শেষ করে পিটারসেন যোগ দেন সেবার হ্যাম্পশায়ারে।
কথার লড়াই, বাউন্ডারি পেরিয়ে
২০০৬ সালে ‘ক্রসিং দ্য বাউন্ডারি’ নামে প্রকাশিত হয় পিটারসেনের আত্মজীবনীমূলক বই। সেই বইয়ে তিনি ধুয়ে দিয়েছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার কোটাপ্রথাকে। অভিযোগের তীর গেছিল আফ্রিকান অধিনায়ক গ্রায়েম স্মিথের দিকেও। ২০০৫ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরী গিয়ে দর্শকদের কাছ থেকে কটুকথা তো পিটারসেন শুনেছেনই। বাদ যাননি প্রতিপক্ষের ক্রিকেটারদের কাছ থেকেও।
স্মিথের স্লেজিং টেকনিককে ধুয়ে দিয়ে তাকে ‘মাপেট’ বলেছিলেন পিটারসেন। এর উত্তরে স্মিথ সরাসরিই বলেছিলেন,
‘আমি আমার দেশকে ভালোবাসি। এজন্যই আমি পিটারসেনকে একটুও পছন্দ করি না।’
মজার ব্যাপার হচ্ছে, ২০১৩ সালে পিটারসেন-স্মিথ খেলেছেন একই দলের হয়ে। সেবার ইংলিশ কাউন্টি সারের অধিনায়ক ছিলেন স্মিথ।
টুইটারে শোরগোল
২০১০ সালে ইংল্যান্ড সফরে যায় পাকিস্তান। সেই হোম সিরিজের ওয়ানডে দল থেকে বাদ পড়েন পিটারসেন। বেশ ধাক্কা দিয়েছিল তাকে সেই ঘটনা। শোরগোল ফেলে দিলেন টুইটারে। সেই টুইটে তিনি তুলে আনেন ২০১০ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের অনবদ্য পারফরম্যান্সের কথা। অভিযোগের তীর ছোঁড়েন ইংল্যান্ডের নির্বাচকদের দিকে। সেই টুইট পরে মুছে দিলেও যা হওয়ার তা হয়েই গেছিল। আবারও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে ইংলিশ ক্রিকেট। ইংলিশ ক্রিকেটের হর্তাকর্তাদের সঙ্গে তার বিবাদটাও ফুটে উঠেছিল সেবার ভালোভাবে, যার জন্য গুনতে হয়েছিল জরিমানাও।
এর দুই বছর পর আবারও টুইটারে আলোচনার বিষয় হন পিটারসেন। ২০১২ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজ খেলছিল উইন্ডিজ। সেই ম্যাচে স্কাই স্পোর্টসের ধারাভাষ্যকার হিসেবে ছিলেন নিক নাইট। এক পর্যায়ে সাবেক এই ইংলিশ ক্রিকেটার বলেন,
‘পিটারসেনকে ছাড়া ইংল্যান্ডের ওয়ানডে দল আরো ভালো।’
ব্যস, পিটারসেনকে আর পায় কে! ক্ষোভ উগড়াতে বেছে নিলেন টুইটারকে। সেখানে একহাত নেন নাইটকে, যার কারণে বড় অংকের জরিমানাও গুনেছেন তিনি।
অবসরনামা
ইংল্যান্ডের সেরা ব্যাটসম্যানদের মধ্যে একজন পিটারসেন। সেই ক্যারিশম্যাটিক ব্যাটসম্যানই তার ওয়ানডে ক্যারিয়ারের ইতি টেনেছেন একটু অন্য ঢংয়ে। ওয়ানডেতে রান পাচ্ছিলেন না তিনি। কথা উঠছিল তাকে ঘিরে। তবে পাকিস্তানের বিপক্ষে টানা দুই সেঞ্চুরি করে ঠিকই ফিরে আসেন নিজের স্টাইলে। বাগড়া দিল ক্রিকেটের ঠাঁসা শিডিউল।
সেবার আইপিএলে দিল্লি ডেয়ারডেভিলসের হয়ে পুরো মৌসুম খেলার কথা তার, যেটা খেলতে গেলে আসন্ন সামারে পিটারসেনকে পাবে না ইংল্যান্ড। টিম ম্যানেজমেন্ট তাকে ছাড়বে না, পিটারসেনও নাছোড়বান্দা। অবসর নিয়ে ফেললেন ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি থেকে। কেবল টেস্টটাই চালিয়ে যাবেন। যদিও সেই ঘোষণার মাস দুয়েক পরই, অবসর ভেঙে ফেরার কথা জানান তিনি। অবশ্য অবসর ভেঙে ফেরার পর মোট নয়টি ওয়ানডে খেলেছেন পিটারসেন।
ক্ষুদেবার্তায় সর্বনাশ!
২০১২ সালে ইংল্যান্ড সফরে যায় দক্ষিণ আফ্রিকা। তিন ম্যাচের টেস্ট সিরিজের প্রথমটি জিতে প্রোটিয়ারা, দ্বিতীয়টি ড্র হয়। সেই ড্র হওয়া টেস্টে ১৪৯ রানের দারুণ এক ইনিংস খেলেন পিটারসেন, জেতেন ম্যাচসেরার পুরস্কারও। সিরিজ নির্ধারণী তৃতীয় ও শেষ টেস্ট ছিল লর্ডসে। লর্ডসেই টেস্ট ক্যারিয়ারের ইতি টানতে চলেছেন তৎকালীন অধিনায়ক অ্যান্ড্রু স্ট্রাউস, সেটা আবার তার ক্যারিয়ারের শততম টেস্টও। বিশেষ এক অনুভূতি তার জন্য।
তার সেই আনন্দ অনুভূতিতে ছেঁদ পড়লো কোচ অ্যান্ডি ফ্লাওয়ারের ফোনকলে। ফ্লাওয়ার তাকে জানান, দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেটারদের কাছে মেসেজ পাঠিয়েছেন পিটারসেন, যেখানে নিজের কয়েকজন টিমমেট, কোচ এবং স্ট্রাউসের সমালোচনা করেছেন তিনি। এমনকি ক্যারিয়ারের শেষ টেস্ট খেলতে যাওয়া স্ট্রাউসকে কীভাবে আউট করতে হবে, সে উপায়ও বাতলে দিয়েছেন তাদের। সেই খবর মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগেনি। সেই মেসেজগুলোর ছবি প্রিন্ট করে পরদিন হেডলাইন করেছিল পত্রিকাগুলো।
স্ট্রাউস নিজের ক্যারিয়ারের ইতি নিয়ে ভাববেন কী, পিটারসেনের এহেন কাণ্ডই হয়ে উঠলো তার মাথাব্যথার কারণ, যার পুরোটাই তিনি তুলে ধরেছেন তার আত্মজীবনী ‘ড্রাইভিং অ্যাম্বিশন’-এ। লর্ডস টেস্টের দল থেকে বাদ পড়েন পিটারসেন। তার এমন কাণ্ডকে সরাসরি বিশ্বাসঘাতকতা বলেছেন স্ট্রাউস।
লর্ডস টেস্টের দল থেকে বাদ পড়ার পর পিটারসেন নিজেই স্বীকার করে নেন মেসেজ পাঠানোর কথা। সেই ম্যাচের পর স্ট্রাউসের বাড়ি গিয়ে তার কাছে ক্ষমা চান পিটারসেন। ক্ষমা মঞ্জুর করেন স্ট্রাউস। কেন এই কাজ করেছিলেন পিটারসেন? তার উত্তর ছিল, উত্তেজনার বশে।
অ্যাশেজের ছাইচাপা আগুনে দগ্ধ
২০১৩ সালের ফিরতি অ্যাশেজ। অস্ট্রেলিয়ায় ভরাডুবি হলো ইংল্যান্ডের। ৫-০ তে হোয়াইটওয়াশ। মিচেল জনসন সেবার আগুন ঝরিয়েছিলেন বল হাতে; পাঁচ ম্যাচে নিয়েছিলেন ৩৭ উইকেট, তার থেকেও আগুনে ছিল তার আগ্রাসনটা। ভরাডুবির ভয়ংকর সেই অ্যাশেজে ইংল্যান্ডের সর্বোচ্চ স্কোরার ছিলেন পিটারসেন, পাঁচ ম্যাচে ২৯৪ রান।
তবে মাঠের পারফরম্যান্স ছাপিয়ে পিটারসেন আলোচনায় ছিলেন কোচের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে। অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার-পিটারসেন একে অন্যের সাথে থাকতেই পারছিলেন না। ইসিবির কাছে ফ্লাওয়ারের সোজাসাপ্টা প্রস্তাব, হয় কেপিকে বের করো, নয়তো আমাকে। ইসিবি ভরসার হাত ফ্লাওয়ারের কাঁধে রাখলেও পদত্যাগ করেন তিনি। পিটারসেনের জন্যও জাতীয় দলের দরজা বন্ধ হয়ে যায় তখনই। সিডনিতে অনুষ্ঠিত সেই অ্যাশেজের শেষ টেস্টেই শেষবারের মতো সাদা পোশাকে দেখা গেছিল পিটারসেনকে।
ঠোঁটকাটা, ইগো কিংবা আত্মবিশ্বাস
মাঠ কিংবা মাঠের বাইরে সবসময়ই প্রাধান্য দিয়েছেন নিজের মতামতকে, ছিল প্রচণ্ড অহংবোধ নিজেকে নিয়ে। তার চেয়ে বেশি ছিল আত্মবিশ্বাস। আত্মঅহমিকা কিংবা নিজের প্রতি বিশ্বাসে আঘাত লাগতে দেননি কখনো, যার কারণে আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারটাও খুব বেশি বড় হয়নি। সেই ইগো কিংবা আত্মঅহমিকার একটা ছোট্ট গল্প বলা যাক।
ফ্রেন্ডস প্রভিডেন্ট কাপের ২০০৭ আসরের ফাইনাল হচ্ছে লর্ডসে। প্রথমে ব্যাট করে ৩২৫ রানের বিশাল সংগ্রহ ডারহামের। ব্যাট করতে নেমে প্রথম দুই বলেই নেই দুই উইকেট। ওটিস গিবসনের হ্যাটট্রিক বলের সামনে পড়লেন পিটারসেন।
বল হাতে তৈরি গিবসন। থার্ড স্লিপেও ফিল্ডার সেট করলো ডারহাম। কী হতে যাচ্ছে? লেন্থ বল, নাকি লাইনে পিচ করা কোনো স্ট্রেইট ডেলিভারি। গিবসনের হাত থেকে ছুটে গেল অফ স্টাম্পের বেশ বাইরে পিচ করা একটা বাউন্সার। উচ্চতা ভালো হওয়ায় পুল-হুকে বরাবরই ভালো পিটারসেন। গিবসনও সেই জায়গাতেই চ্যালেঞ্জ করলেন, ‘মেরে দেখাও।’
পিটারসেন ছাড়লেন না বাউন্সারটা। টেনে এনে পুল করলেন। হ্যাটট্রিকের সম্ভাবনা মাথায় রেখেও। বাউন্ডারি না হলেও ইগোর যুদ্ধে সমানে সমানে লড়েছেন। বাকি অনেক ক্রিকেটারদের সঙ্গে এখানেই পার্থক্য তার।
পিটারসেন কি ম্যাচ উইনার? দুঃসময়ে তিনি এমন অনেক ইনিংসই খেলেছেন, যাতে ভর করে ম্যাচ জিতেছে ইংল্যান্ড। ২০০৯-১৩ এই টাইমস্প্যানকে তৎকালীন ইংল্যান্ডের সেরা সময় বলা যায়। প্রথম বৈশ্বিক শিরোপা, দু’টো অ্যাশেজ জেতা, টেস্ট র্যাংকিংয়ের শীর্ষে ওঠা। এর সবক’টাতেই সরাসরি অবদান ছিল পিটারসেনের। পিটারসেনের সঙ্গে সবচেয়ে ভালো সম্পর্ক ছিল মাইকেল ভনের। পিটারসেনের সক্ষমতা, হিটিং অ্যাবিলিটি নিয়ে খুব ভালো ধারণা ছিল তার। সে কারণেই ভরসার হাতটাও তার কাঁধে রেখেছিলেন সাবেক এই ইংলিশ অধিনায়ক। বলা চলে, পিটারসেনের পূর্ণ ব্যবহার তিনিই করতে পেরেছেন।
ইগো, অহমিকা, ঠোঁটকাটা স্বভাব, পাগলাটে কাজকর্ম। সব মিলিয়ে বিতর্ক, সমালোচনা যেন পিছু ছাড়ত না পিটারসেনের। তবে মাঠের ক্রিকেটে কখনো আপস করেননি কিছুর সাথেই, ঢেলে দিতেন নিজের পুরোটাই। বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্য দর্শকরা তাকে হয়তো পছন্দ করতেন না; কিন্তু যখন মিড উইকেট দিয়ে জোরেশোরে একটা পুল করতেন, কিংবা ফুটওয়ার্কের মুন্সিয়ানায় ইনসাইড আউট শটে এক্সট্রা কভার দিয়ে উড়িয়ে মারতেন, তখন চোখ ফেরানোর উপায় থাকতো না।
সেই পিটারসেন ব্যাট-প্যাড তুলে রেখেছেন ২০১৮ সালে। জাতীয় দলে ব্রাত্য হয়েছেন সেই কবেই। এরপর দাপিয়ে বেড়িয়েছেন ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটে। আইপিএল, পিএসএল, সিপিএল, বিগ ব্যাশ; সবখানেই দেখা গেছে তাকে। বর্ণাঢ্য সেই ক্যারিয়ার থেমেছে পিএসএলের মঞ্চে।
আফসোসের দীর্ঘশ্বাস আর রোলার কোস্টার রাইড
পিটারসেনের ক্যারিয়ারে ফিরে তাকালে সহজেই বলা যায়্, পাগলামি-খামখেয়ালি না করলে আরো অনেক কিছু অর্জন করতে পারতেন তিনি। এত বিতর্ক, এত সমালোচনা, তবুও রেকর্ডবুক কিংবা ইংল্যান্ডের বিশাল ক্রিকেট ইতিহাসে তিনি স্বমহিমায় উজ্জ্বল। ওয়ালি হ্যামন্ড, টেড ডেক্সটার, পিটার মে’র চেয়ে বেশি টেস্ট খেলেছেন। টেস্ট ক্যারিয়ার শেষ করেছেন জিওফ্রে বয়কট-ডেভিড গাওয়ারের চেয়ে বেশি গড় নিয়ে। সেঞ্চুরিতে পেছনে ফেলেছেন গ্রাহাম গুচ, লেন হাটন, কেন বেরিংটনের মতো ক্রিকেটারদের। এটা কোনো তুলনা নয়, কেবল দেখানোর চেষ্টা এতটুকুই – নয় বছরের ক্যারিয়ারে এত অর্জন যার, যদি আরেকটু নিজেকে সামলে রাখতেন, তাহলে বোধহয় ক্রিকেট বিধাতা আরো দারুণ কিছু তুলে দিতেন তার পাতে।
পিটারসেন শেষ অবধি হেরেছেন সেই ইগো আর দ্বন্দ্বের খেলাতেই। তবে এর আগ পর্যন্ত যে রোলার কস্টার রাইডে তিনি চড়েছেন, সেটা নিঃসন্দেহে সবার জন্যই উপভোগ্য ছিল। আপেক্ষিক উত্তরের একটা প্রশ্ন থেকেই যায়। যদি বিতর্ক না থাকতো, যদি সমালোচিত না হতেন, তিনি আদৌ কেভিন পিটারসেন হয়ে উঠতে পারতেন কি না। কারণ, স্যার ইয়ান বোথামের পর এমন চরিত্র ইংলিশ ক্রিকেটে তিনিই ছিলেন। বোথাম যদি হয়ে থাকেন এলভিস প্রিসলির ক্ল্যাসিক মিউজিক, তবে পিটারসেন হবেন হালের মাথা দোলানো রক।
ইংলিশ ক্রিকেটের এক অদ্বিতীয় চরিত্র তিনি। যে চরিত্র আসল চিত্রনাট্য ছাপিয়ে, বেশি ফুটে উঠেছে বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে। প্রতিভার ঝলকানি মঞ্চ আলো করে রেখেছিল সবসময়ই। কিন্তু আচমকা ধেয়ে আসা কিছু মেঘে ঢাকা পড়েছে সেই আলো। ছিলেন আধুনিক ইংল্যান্ডের ক্রিকেটাকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র, যিনি জ্বলজ্বল করতেন নিজের আলোয়। সেই আলোয় উদ্ভাসিত হতো চারপাশ।
প্রায়ই দেখা দিতেন ধ্রুবতারা হয়ে। সেই আদিম ধ্রুবতারা, যা দেখে যুগের পর যুগ পথ খুঁজে নিয়েছে দিকহারা কোনো নাবিক, পথভোলা বেদুইনের দল। ইংল্যান্ডের জন্যও তাই ছিলেন তিনি। পরিসংখ্যানের অতল সমুদ্রে ডুব দিলেও সংখ্যাগুলো এসে তার পক্ষে সাক্ষ্য দেবে।
সময়ের সাথে আদিম শিলালিপিও ক্ষয়ে যায়, যাকে একসময় মনে হতো অক্ষয়। নক্ষত্রের নিজস্ব আলো আছে, তবুও নক্ষত্রের পতন হয়। কেভিন পিটারসেনও তেমন এক শিলালিপি, তেমনই এক নক্ষত্র। ইংলিশ ক্রিকেটের অবিনশ্বর এক মূর্তি, অদ্বিতীয় এক চরিত্র। তবুও কী নিদারুণ পতন! আফসোসের দীর্ঘশ্বাস আরো দীর্ঘ হয়। আরো ক’টা দিন থেকে গেলে, ইংল্যান্ডের ক্রিকেটাকাশে ধেয়ে আসা শুক্লপক্ষের রাতগুলো হয়তো আলোকিত হতো তারই রোশনাইয়ে।