শুরুতে ব্যাপারটাকে ভালো বলেই মনে হয়। বাংলাদেশের সিনিয়র ক্রিকেটাররা সবাই পারফর্ম করছেন। বাংলাদেশ ইদানিংকালে ম্যাচ জিতলে সিনিয়রদের ওপর ভর করেই জিতছে। এটা দেশের ক্রিকেটের জন্য ভালো সংবাদ। কিন্তু এই সংবাদের পেছনেই লুকানো আছে একটা আতঙ্কের কথা- বাংলাদেশের তরুণরা সেভাবে প্রভাব রাখতে পারছে না আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে। এই সংকটটা বেশি দেখা যাচ্ছে তরুণ ব্যাটসম্যানদের ক্ষেত্রে।
শুধুমাত্র ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরটাকে বিবেচনায় নেওয়া যাক। এই সফরে বাংলাদেশের মোট রানের ৭১ শতাংশই এসেছে তামিম ইকবাল, সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহিম ও মাহমুদউল্লাহর ব্যাট থেকে। তামিম করেছেন দুটি সেঞ্চুরি। এ সফরে বাংলাদেশের পক্ষে আসা ১০টি ফিফটির ৮টিই করেছেন এই চার সিনিয়র ব্যাটসম্যান। বিপরীতে বাংলাদেশের সেরা ৮ তরুণ ব্যাটসম্যান তিন ফরম্যাট মিলিয়ে ২৯টি ইনিংস খেলে করতে পেরেছেন মাত্র ৩৬৯ রান।
এই সফরে তিন ফরম্যাট মিলিয়ে সুযোগ পাওয়া তরুণরা হলেন- লিটন দাস, এনামুল হক বিজয়, সৌম্য সরকার, সাব্বির রহমান রুম্মন, মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত, মুমিনুল হক, আরিফুল হক ও নুরুল হাসান সোহান। এই আটজন মিলিয়ে পুরো সফরে ফিফটি করেছেন মাত্র দুটি; যার একটা শেষ ম্যাচে এসেছে লিটনের ব্যাট থেকে।
বাংলাদেশের তিনজন সেরা ঘরোয়া ক্রিকেটের কোচ মোহাম্মদ সালাউদ্দিন, খালেদ মাসুদ এবং নাজমুল আবেদীন ফাহিম এই ব্যাটসম্যানদের সাথে শুরু থেকে থেকেই ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন এবং তাদের লক্ষ্য করছেন। এই তিন কোচ মনে করছেন এই তরুণদের মানসিক ও টেকনিক্যাল ঘাটতি, পরিকল্পনার অভাব, রানের জন্য ক্ষুধার অভাব এবং জীবনযাপন পদ্ধতির ভুল তাদেরকে এই দুরাবস্থায় ঠেলে দিয়েছে। তিনজনই একমত যে, শুধুমাত্র প্রতিভা আর সম্ভাবনা দিয়ে এই খেলোয়াড়দের পক্ষে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে খুব বেশিদূর যাওয়া সম্ভব না।
পুরো ক্যারিবিয় সফরে সবচেয়ে বেশি সুযোগ পেয়েছেন লিটন। টপ অর্ডারে ব্যাটিং করেছেন এবং এই আট জনের মধ্যে সর্বোচ্চ ১৫৮ রান করেছেন। শেষ টি-টোয়েন্টিতে ৬১ রানের ঝড়ো ইনিংসকে বাদ দিলে আরও অন্তত তিনটি ম্যাচে ভালো শুরু পেয়েছেন। কিন্তু শেষ অবধি সেটা কাজে লাগাতে পারেননি। অন্তত দুটি ম্যাচে শরীর থেকে দূরের বল খেলতে গিয়ে আউট হয়েছেন।
বিসিবির গেম ডেভেলপমেন্ট জাতীয় ম্যানেজার, বিকেএসপির সাবেক প্রধান কোচ এবং বিসিবির বর্তমান নারী ক্রিকেট উইংয়ের দায়িত্বে থাকা নাজমুল আবেদীন ফাহিম বলছিলেন, লিটনের টেকনিক ও স্কিলের ঘাটতি নেই। কিন্তু তাকে সর্বোচ্চ স্তরে ভালো করতে গেলে আরো বড় পরিসরে চিন্তাভাবনা করতে হবে,
লিটন প্রমাণ করেছে, ওর এই স্তরে খেলার যোগ্যতা আছে। কিন্তু ও নিজের ভুলে আউট হচ্ছে। সে অন্যদের মতো অস্বচ্ছন্দ নয়। কিন্তু লিটনকে নিজের ভেতর থেকে আরো বড় করে ভাবতে হবে। আমি ওর চিন্তার প্রক্রিয়াটা জানি না। কিন্তু আপনি যখন বড় করে ভাবতে পারবেন না, আপনি সেরকম খেলতেও পারবেন না; নিজের জন্য বা দলের জন্য।
প্রস্তুতি ম্যাচে ৭০ রান করার পরও লিটনকে ওয়ানডেতে বিবেচনা করা হয়নি। তার বদলে অধিনায়ক মাশরাফি বরং আস্থা রেখেছিলেন এনামুল হক বিজয়ের ওপর। যিনি তিন ওয়ানডেতে মাত্র ৩৩ রান করতে পেরেছিলেন।
বিপিএলজয়ী কোচ সালাউদ্দিনের অধীনে ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলে থাকেন বিজয়। সালাউদ্দিন বলছেন, বিজয় এখনও একটা সঠিক পরিকল্পনা করতে পারছেন না কোনো ইনিংসের জন্য। সালাউদ্দিন বলছিলেন,
আমি ওকে তিনটি ইনিংসেই ব্যাট করতে দেখলাম। তার তিনটি ভিন্ন ভিন্ন পরিকল্পনা ছিল। কোনো একটা নির্দিষ্ট স্টাইল বা ধরন ছিল না। একটি ম্যাচে সে সবকিছু পেটাতে চাচ্ছিল, আরেকটি ম্যাচে সে সবকিছু ডিফেন্স করতে চাচ্ছিল। অন্যদিকে লিটন দেখুন, নিজের একটা স্টাইলে শক্ত হয়ে আছে। সে আউট হোক আর নাই হোক, বলের ওপর চড়াও হচ্ছে।
এই অলআউট অ্যাটাক বা পুরোপুরি ডিফেন্সটা তখনই আসে, যখন আপনি সিঙ্গেল বের করতে পারবেন না। সেটা সে ইচ্ছে করে করুক বা তার সিঙ্গেল বের করতে পারার ক্ষমতার অভাব হোক। যদিও টিম ম্যানেজমেন্টের একটা চাহিদা থাকে। তাই বলে কেউ প্রতিটা বলে চড়াও হতে পারে না। এনামুলের এখন একটা নির্দিষ্ট পরিকল্পনায় স্থির হওয়া দরকার।
এনামুল ওয়ানডেতে যে সুযোগটা পেয়েছেন, সৌম্যও টি-টোয়েন্টিতে সেই সুযোগ পেয়েছেন। ফেব্রুয়ারি থেকে ওয়ানডে ও টেস্ট দলে জায়গা হারালেও টি-টোয়েন্টিতে ধারাবাহিকভাবে সুযোগ পাচ্ছেন।
সৌম্যর ওপর এই আস্থা রাখায় তিনটি টি-টোয়েন্টিতেই বাংলাদেশের টপ অর্ডার বিপাকে পড়েছে। প্রথম ম্যাচে তিনি ‘গোল্ডেন ডাক’ পেয়েছেন। পরে লডারহিলে পেস ও বাউন্সে রীতিমতো সংগ্রাম করে পার করেছেন। অথচ পেস ও বাউন্স ভালো খেলার যোগ্যতার জন্যই সাকিবরা তাকে দলে রাখতে চেয়েছিলেন। তিন ম্যাচে তিনি করেছেন মাত্র ১৯ রান। গত ১১ ইনিংসে সৌম্যর ব্যাটিং গড় ৭.৯১! এর পাশাপাশি শ্রীলঙ্কা-এ দলের বিপক্ষে দেশের মাটিতে ৬ ইনিংসেও কোনো ফিফটি করতে পারেননি এই বাহাতি ওপেনার।
সালাউদ্দিন মনে করেন, সৌম্যর কিছু টেকনিক্যাল ঘাটতি আছে, যেগুলো নিয়ে অনেক আগেই কাজ করা উচিত ছিল। সেইসাথে তার মানসিক সমস্যা এই জটিলতা আরও বাড়াচ্ছে।
সৌম্যর কিছু টেকনিক্যাল সমস্যা আছে, যেগুলো অনেক আগে কাজ করে ঠিক করা উচিত ছিল। অফস্পিনে তার বেশ সমস্যা হয়। সোজা মারতেও সমস্যা হয়। সে সবকিছু মিড অন আর মিড উইকেটের ওপর দিয়ে মারার চেষ্টা করে। সে ভালো মারকুটে ব্যাটসম্যান।
সৌম্য যখন একটা ফিফটি করে, তখন সবাই বলে সৌম্য ফর্মে ফিরে এসেছে। কিন্তু আমি মনে করি, সৌম্য তখনই ফর্মে ফিরবে, যখন সে তার শক্তির জায়গায় খেলবে। সে ইদানিং রক্ষণাত্মক হয়ে গেছে। ওর আগ্রাসী মনোভাব এখন আর নেই। আর ধারণা ওর মানসিকতার পরিবর্তনই টেকনিক্যাল সমস্যার কারণ।
সাব্বির আরেকজন তরুণ খেলোয়াড়, যিনি রান খুজে পাচ্ছেন না। তবে তার সমস্যা কেবল আর ক্রিকেটে সীমাবদ্ধ নেই। তিন ওয়ানডে ইনিংসে সাব্বির করেছেন ২৭ রান। এটা ঠিক যে, তার ব্যাটিংয়ের সবগুলো সুযোগ এসেছে শেষ ৫ ওভারে।
সাব্বিরকে শুরু থেকে দেখছেন বাংলাদেশের সাবেক অধিনায়ক ও ঘরোয়া ক্রিকেটের কোচ খালেদ মাসুদ পাইলট। তিনি বলছিলেন, এই তরুণ ক্রিকেটারদের মনোসংযোগেই সমস্যা আছে।
সাকিব ছাড়া এখনকার সিনিয়র ক্রিকেটারদের কেউই শুরুতেই খুব ভালো করেনি। কিন্তু মুশফিকুর রহিম, মাহমুদউল্লাহ ও তামিম গত চার পাঁচ বছরে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। ওরা সবাই নিজেদের পারফরম্যান্সে খুব মনোযোগী ছিল।
এদেরকে আলাদাভাবে নজরে রাখা ও অণুপ্রাণিত করা দরকার এখন। ফাহিম ভাইয়ের মতো কারো উচিত এদের সাথে একক সেশনে বসা। ওদের ওপর এটা বিনিয়োগ করা দরকার। ওদের দেখা দরকার তামিম, মুশফিক, মাশরাফি কেমনভাবে খেলাটাকে আকড়ে ধরে আছে। আপনি এই সিনিয়রদের জিম বা নেট থেকে টেনে বের করতে পারবেন না। কিন্তু জুনিয়রদের ক্ষেত্রে সেটা বলতে পারছি না।
পাইলট একইসাথে এই তরুণ ক্রিকেটারদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের আসক্তি নিয়ে সমালোচনা করলেন। তিনি বলেন-
আপনাকে কেন প্রতি মুহুর্তে ফেসবুক অনুসরণ করতে হবে? আমি একজন খেলোয়াড়কে দেখেছি অনেক বেশি পোস্ট করে এবং লাইকের জন্য ছোটাছুটি করে। ফেসবুকে লাইক না খুজে আপনার পারফরম্যান্স দিয়ে লাইক খুজুন।
আবার নাজমুল আবেদীন ফাহিম বিশ্বাস করেন, এই খেলোয়াড়দের কাউকে কাউকে ‘এ’ দলের মতো কোথাও নেতৃত্বে দিলে তাদের পারফরম্যান্স বেরিয়ে আসতে পারে। কারণ, এমনও হতে পারে এরা ছায়ায় ঢাকা পড়ে থাকতে থাকতে ক্লান্ত হয়ে গেছেন।
মোসাদ্দেক অবশ্য তরুণ ক্রিকেটারদের মধ্যে অনেক বেশি প্রতিশ্রুতি ছড়াতে পেরেছিলেন। তৃতীয় ওয়ানডেতে ৫ বলে ১১ রানের একটা ইনিংস খেলেছেন। তিনি আরেকটু ওপরে ব্যাটিং আশা করতে পারেন। কিন্তু ছয় মাস চোখের ইনজুরির কারণে বাইরে থাকায় তিনি অনেক কিছু মিস করেছেন। এখন ফিরে নিজের জায়গাটা খুঁজে পাচ্ছেন না।
মুমিনুল হক যদিও টেস্টে গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের সবচেয়ে ধারবাহিক ব্যাটসম্যান। কিন্তু এই সফরে তিনিও ভালো করতে পারেননি। আরিফুল বা নুরুল হাসান সোহানও তেমন কিছু করতে পারেনি। যদিও সোহান ৬৪ রানের একটা ইনিংস খেলেছিলেন প্রথম টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে।
একেক জনের ক্ষেত্রে কারণটা হয়তো একেক রকম। একেক জনের ক্ষেত্রে অজুহাতটা হয়তো একেক রকম। কিন্তু ফলাফলটা সবার ক্ষেত্রে একইরকম, তরুণদের ব্যাট থেকে রান আসছে না। এটা হয়তো এখনই খুব বিপদের কথা নয়। কিন্তু দিন শেষে এটা বাংলাদেশের ভবিষ্যতের জন্য বিশাল একটা অশনি সংকেত হয়ে উঠতে পারে। একদিন সাকিব, তামিম, মুশফিক, মাহমুদুল্লাহরা থাকবে না, তখন দলের পরিণতি কী হবে?
ফিচার ইমেজ- AFP