বিজ্ঞান, বুদ্ধিমত্তা আর সাথে একটু শিল্পের ছোঁয়া, সব এক করলে পাওয়া যায় দাবা! ক্ষুরধার মস্তিষ্কের এই খেলার সর্বোচ্চ অর্জন হলো বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়া। ক্লাসিক্যাল দাবায় ১৪ তম বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ভ্লাদিমির ক্রামনিক ২০০৫ সালের এক সাক্ষাৎকারে স্মরণ করেছিলেন তার পূর্ববর্তী সকল বিশ্ববিজেতাকে। সেই উইলহেল্ম স্টেইনিজ থেকে শুরু করে সেসময়ের সদ্য সাবেক হওয়া বিশ্বচ্যাম্পিয়ন গ্যারি ক্যাসপারভ পর্যন্ত সবার কথাই আলোচিত হয়েছে। রুশ চেস ম্যাগাজিন e3e5-এ প্রকাশিত সেই সাক্ষাৎকারের আজকে তৃতীয় পর্ব। উপস্থাপক হিসেবে ছিলেন ইন্টারন্যাশনাল মাস্টার ভ্লাদিমির বারস্কি। প্রথম এবং দ্বিতীয় পর্বে আমরা প্রথম সাতজন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন সম্পর্কে আলোচনা করেছি, আজ থাকছেন পরবর্তী তিনজন।
ক্রামনিক: আমি তালকে সেভাবে চিনিনা বলতে গেলে, তবে তার সাথে কিছু ম্যাচ খেলার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। ১৯৯০ সালে মস্কোতে একটি শক্তিশালী টুর্নামেন্ট হয়, তালও সেখানে খেলেন। তাকে খুবই অসুস্থ আর দুর্বল দেখাচ্ছিল। মেইন টুর্নামেন্টে আমাদের ম্যাচ পড়েনি, তবে ফাঁকা দিনগুলোতে আয়োজকগণ র্যাপিড আর ব্লিটজের ব্যবস্থা করেছিল। সেখানে কিছু ম্যাচ খেলেছি মনে পড়ে।
মিখাইল দ্য এলিয়েন
বারস্কি: খেলার ফলাফল কেমন ছিল?
ক্রামনিক: ব্লিটজে ড্র হয়েছিল, র্যাপিডে একটা ম্যাচ আমি জিতেও গেছিলাম। তাল একের পর পিস স্যাক্রিফাইস করে যাচ্ছিলেন বেশি চিন্তাভাবনা না করে। আসলে তিনি বিশ্রাম করছিলেন আর মজার জন্য খেলছিলেন, তাই ঐ ম্যাচগুলোর ফলাফল তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু না। কিন্তু যখন মনোযোগ দিচ্ছিলেন, তখন বেশ শক্ত হাতে খেলছিলেন এতটুকু মনে আছে। ব্লিটজে আমরা উভয়েই ভালো করেছিলাম, পুরো টুর্নামেন্টে যৌথভাবে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করি দুজনে। আমার বয়স তখন মাত্র ১৫, দাবাড়ুদের মধ্যে ছিলেন দশজন গ্র্যান্ডমাস্টার, একজন ইন্টারন্যাশনাল মাস্টার আর আমি তৎকালীন ফিদে মাস্টার।
খেলার এক পর্যায়ের কথা আমার স্পষ্ট মনে আছে। বেশ জটিল এবং বলতে গেলে সমান-সমান পরিস্থিতিতে হঠাৎ আমি দেখতে পেলাম তালের কাছে একটা দারুণ দান আছে যেটা দিলে আমার পজিশন আশাহীন হয়ে পড়বে। এবং হলোও ঠিক তা-ই, তাল সেটা খুঁজে পেলেন। তখন সময় শেষের দিকে চলে এসেছিল, আমরা বলতে গেলে বোর্ড থেকে হাতই তুলছিলাম না। শেষে পার্পেচুয়াল চেকের মাধ্যমে গেমটা ড্র হয়। এটা সুস্পষ্ট হয়ে গেল যে, জীবনের শেষদিকে চলে এলেও মিখাইল নেখমেভিচ দ্য এইটথ তখনও তালই ছিলেন। সেসময়ের ঐ চালটা এমনকি ক্লাসিক্যাল দাবাতেও খুব সামান্য দাবাড়ুই খুঁজে পেত। তার শান তখনও বজায় ছিল, হোক না সেটা ক্ষীয়মাণ তাল।
তাল একজন তারকা ছিলেন, ছিলেন এক প্রকৃত দাবা-প্রতিভা। যতদূর আমি বুঝতে পেরেছিলাম, তার জীবনে কোনো উচ্চাশা বা উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল না। তিনি খেলাটাকে শুধুই উপভোগ করে গেছেন। এই দৃষ্টিভঙ্গি অপেশাদার ঠেকতে পারে কিন্তু তার ট্যালেন্ট এতটাই মায়ার ইন্দ্রজাল সৃষ্টিকারী ছিল যে, তার অ্যামেচার অ্যাপ্রোচেই তিনি বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়ে যান।
ছোটতে আমি তালের খেলা সম্পর্কে সেভাবে জানতে পারিনি, কারণ আগেই বলেছি আমাদের শহরে বই-পুস্তক সেরকম সহজলভ্য ছিল না। কিন্তু বড় হয়ে আমি যখন তার খেলাগুলো দেখা শুরু করি, তখন বুঝতে পারি তিনি কোন পর্যায়ের দাবাড়ু ছিলেন। তিনি প্রকৃতপক্ষেই এক শক্তিশালী পজিশনাল দাবাড়ু ছিলেন, যদিও অনেকেই তাকে শুধুই ট্যাক্টিশিয়ান বলে অবমূল্যায়ন করতে চায়। অবশ্যই তার ট্যাকটিক সংক্রান্ত দক্ষতাও অগাধ ছিল, তবে অন্যান্য গুণাবলীতেও তার পূর্ণাঙ্গতা ছিল। সত্তর-আশির দশকে তার আরেক দফা উত্থান ঘটে।
বারস্কি: তালের ব্যাপারে এ কথা চাউর আছে যে, কারপভের সাথে কাজ করাই তার দ্বিতীয় উত্থানের কারণ … আপনার কী মনে হয়?
ক্রামনিক: আমার ঠিক তেমন মনে হয় না। মানে কারপভের সাথে কোলাবরেশনের দ্বারা তার উন্নতি হয়েছিল বটে, তবে এটাই একমাত্র কারণ নয়। তাল সেসময় দাবা ছাড়া বাকি দুনিয়ার থেকে প্রায় আলাদা থেকেছেন, যা তালসুলভ নয় মোটেই। তাল দাবার বোর্ডে বেশ খেটেছেন সেসময়টায়। তবে তাল এমনিতেই বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী, আপনি এটা অস্বীকার করতে পারেন না। তাল তার খেলার স্টাইলের সাথে যদি কোনোভাবে বতভিনিকীয় স্টাইলের কম্বিনেশন ঘটাতে পারতেন, তবে তাকে হারানো অসম্ভব হয়ে যেত। তাকে কেউ হারাতে পারত না।
বারস্কি: তবে হয়তো এমনটা সম্ভব নয়, একজনের পক্ষে এই দুই ধাঁচ একসাথে ব্যবহার করা অসম্ভব।
ক্রামনিক: হ্যাঁ, আসলেই এমন পরস্পরবিরোধী দুটো সত্ত্বা একত্রে কেউ বয়ে বেরাতে পারবে না। এখানে একটা কথা বলা খুব দরকার, সেটা হলো কোনো দাবাড়ুই কিন্তু দুর্বলতাহীন নন। সবারই কিছু না কিছু দুর্বলতা থাকে, আর এগুলোর উদ্ভবও ঘটে তাদের শক্তিমত্তার জায়গা থেকেই। আর এ কারণেই একজনের পক্ষে তাল আর বতভিনিকের খেলার ধরন একসাথে ধারণ করা সম্ভব না। বলতে গেলে তাদের খেলার ধাঁচ মিউচুয়ালি এক্সক্লুসিভ। একটির সাথে আরেকটির সংযোগ নেই মোটেই।
তালের খেলার ধাঁচ ছিল শক্তিশালী, দাবা বোর্ডে কিছু ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি করে সেই থেকে আক্রমণ। তার ছিল চমৎকার সৃজনক্ষমতা। আর এ থেকেই তার দুর্বলতারও সৃষ্টি। এমন একজন খেলোয়াড়ের পক্ষে দীর্ঘদিন দাবার রাজমুকুট ধরে রাখা সম্ভব নয়। তিনি ছিলেন এক জ্বলজ্বলে দ্যুতি, যার দ্রুতই উদয় ঘটেছে এবং দ্রুতই পতনও ঘটেছে। উপমা দিয়ে বলতে গেলে, তারাটি এত উজ্জল হয়ে জ্বলেছিল যে, সেটি দীর্ঘসময় নিজেকে জ্বালিয়ে রাখতে পারেনি, একবারে পুড়ে গেছে।
তালের ব্যাপারে কিছু বলা কঠিন, কারণ তিনি ছিলেন খুবই প্রতিভাবান, তাকে শুধুই ন্যাচারাল ফেনমেনন বলাই মানায়। আমি এ ব্যাপারে নিশ্চিত যে, যদি তিনি দাবায় না আসতেন তবে অন্য যেদিকে ফোকাস করতেন, সেখানেই সেরা হতেন। যদি তিনি বিজ্ঞানী হতেন, তবে সম্ভবত নোবেল পুরস্কার পেতেন। তার বৈশিষ্ট্য ছিল জাগতিক গুণাবলীর বাইরে। যারা তাকে ব্যক্তিগতভাব চিনতেন, তাদের অনেকেই বলেছেন, তার মধ্যে হোমো-স্যাপিয়েন্স এর কোনো বৈশিষ্ট্যই ছিল না। তিনি ছিলেন এলিয়েন। তার দাবা নিয়ে আলোচনা করা হলো ঈশ্বর কেমন দেখতে, সেটা নিয়ে আলোচনা করার মতো।
বারস্কি: পরবর্তী বিশ্বচ্যাম্পিয়ন বোধ হয় জাগতিক ছিলেন …
তিগ্রান দ্য ব্যালান্সড
ক্রামনিক: হ্যাঁ, সাথে তিগ্রান পেত্রসিয়ান মানুষ হিসেবেও খুব অমায়িক লোক ছিলেন। তার লেগ্যাসি ঘাঁটলে দেখা যাবে তিনি খুব গুটিয়ে নেয়া স্বভাবের লোক ছিলেন। আমি তার সব সেরা খেলাগুলো দেখে শেষ করলেও তার সম্পর্কে খুব কমই জানতে পেরেছি। খেলোয়াড় হিসেবে তিনি দেখিয়ে গেছেন যেকোনো পজিশন থেকেই ডিফেন্ড করা সম্ভব। তাকে আমি বলি ফার্স্ট ডিফেন্ডার উইথ ক্যাপিটাল ডি। অনেক ডিফেন্সিভ রসদের সাথে দাবাজগৎ পরিচিত হয়েছে তার হাত ধরেই। তিনি ছিলেন রহস্যময়। ব্রিলিয়ান্ট স্ট্র্যাটেজিস্ট হিসেবে খ্যাত ছিলেন। সাথে পজিশনাল স্ট্রেংথ আর ট্যাকটিক্সেও তার দখল ছিল। তবে তিনি মোটেই অ্যাটাকার ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন ডিফেন্স মাস্টার। পজিশনাল স্কিলে দক্ষতা থাকলেও তার অমোঘ অস্ত্র ছিল ডিফেন্স। তিনি বিপদকে অনেক দূর থেকে আঁচ করতে পারতেন। আর দাবাড়ু হিসেবেও তিনি ছিলেন স্বতঃস্ফূর্ত!
বারস্কি: তিগ্রানের উত্থানটা বোধ হয় ধীরে ধীরে হয়েছিল, ত্রিশের পরে নিজের সর্বোচ্চ ফর্মে যেতে পেরেছিলেন।
ক্রামনিক: তিগ্রান ছিলেন খুব স্মুদ একজন, বেশ শান্ত, ব্যালান্সড আর ঠাণ্ডা মাথার। স্নায়ুতন্ত্র ভালো কাজ করত তার, খুব সমন্বিত আর অবিচ্ছেদ্যভাবে। এভাবেই পেত্রসিয়ান উন্নতি করেছিলেন নিজের, কোনো তাড়াহুড়ো ছাড়া, সিস্টেম্যাটিকভাবে আর কোনো ব্রেকডাউন না ঘটিয়ে।
বরিস দ্য লার্জ স্কেল
ক্রামনিক: বরিস স্পাস্কির ব্যাপারে আমি একমত যে, তিনিই প্রথম ট্রু মডার্ন ইউনিভার্সাল চ্যাম্পিয়ন। আমি তার বহুমুখী লার্জ স্কেল গেমগুলো ভালবাসি। বরিস একজন লার্জ স্কেল দাবাড়ু ছিলেন, যে কিনা ছোটখাট বিষয়ে তেমন মনোযোগ দেয় না। তার খেলার ধরন কিছুটা পল কেরেসের মতো, তবে আরও উদ্ভাবনী সাথে কল্পনাপ্রবণ। কেরেসের কল্পনাশক্তিতে একটু দুর্বলতা ছিল।
স্পাস্কি খুব সঠিক দাবা খেলতেন, এদিক থেকে আবার স্মিস্লভের সাথে তার মিল পাওয়া যায়। তিনি মূলত, একেক গ্রেট থেকে একেকটি গুণ আত্তীকরণ করেছিলেন। স্মিস্লভ যেখানে শান্ত খেলা খেলতেন, স্পাস্কি সেখানে অ্যাটাকিং খেলতেন। সবচেয়ে বড় কথা, স্পাস্কি প্রতিটা খেলায় নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে খেলতেন। সাথে পুরো বোর্ড জুড়েই খেলতেন। তার গেমগুলো দেখতেও দৃষ্টিসুখকর। সম্প্রতি আমি ফিশারের সাথে তার ম্যাচগুলো দেখেছি, আমার মনে হয়নি তিনি খারাপ খেলেছেন।
বারস্কি: তবে কে খারাপ খেলেছেন সেই ম্যাচে?
ক্রামনিক: অর্ধেক গেমে স্পাস্কি হেরেছেন। কিছু জায়গায় শুধু একটা চাল ব্লান্ডার খেলার খেসারত দিতে হয়েছে। দেখে মনে হচ্ছিল ফিশারের যে এনার্জি বাকি সবাইকে ছাপিয়ে গিয়েছিল, সেটিই স্পাস্কিকেও ভুগিয়েছে। স্কোরলাইনই যে সবটা বলে দেয় না- তার প্রমাণ মিলেছিল ইতিহাসে হাতেগোনা কিছু ম্যাচে, তেমন একটা ম্যাচ ছিল ফিশার-স্পাস্কি ম্যাচ। ছোটখাটো বিষয়গুলো আমলে নিতেন না স্পাস্কি, এটা এক গেমে সমস্যায় ফেলেছে তাকে। দেখা গেল, উইনিং পজিশনে তিনি, তাই তেমন ক্যালকুলেশন না করেই র্যান্ডম একটা দান দিয়ে দিলেন। ফলত, তার স্ট্রেংথ উইকনেসে রূপান্তরিত হয়ে গেল। এছাড়া শোনা যায় স্পাস্কি অনুশীলনও একটু কম করতেন, এক্ষেত্রে পেশাদারিত্বের অভাব অনুভূত হচ্ছিল। আর তিনি কিছুটা আনলাকিও ছিলেন, কারণ ফিশার যুগে খেলতে হয়েছিল তাকে। খুব কম বিশ্বচ্যাম্পিয়নই ফিশারকে রুখতে পেরেছিল।
বারস্কি: তাহলে আপনি বলতে চাচ্ছেন, ফিশার যুগের হওয়ার কারণে স্পাস্কি আনলাকি …
ক্রামনিক: অনেক দাবাড়ু আরও আনলাকি ছিলেন, তারা বিশ্বচ্যাম্পিয়নই হয়ে যেতে পারতেন অন্যান্য জিনিয়াসরা সেযুগের না হলে। সেদিক থেকে স্পাস্কির ভাগ্য মন্দের ভালো বলতে গেলে…
চলবে…