“তোর সামনে দুটো চয়েস আছে। খেলা ছেড়ে দিয়ে চিত্রা নদীর পাড়ে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারিস। তখন তোকে কেউ মনে রাখবে না। যদি ক্রিকেটেই বেঁচে থাকতে চাস, তাহলে তাড়াতাড়ি সেরে ওঠ।”
বাংলাদেশের দেশসেরা পেসার এবং বর্তমান ওয়ানডে অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজাকে যিনি উপরোক্ত কথাটি বলেছিলেন, তাঁর ঝুলিতে ১০-১২টা সেঞ্চুরি নেই, আদতে ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেট, লিস্ট-এ ক্রিকেট এবং আন্তর্জাতিক ক্রিকেট সব মিলিয়েও তাঁর সেঞ্চুরি সংখ্যা ১০ ছুঁতে পারে না। গড়ও এমন আহামরি কিছু নয়, টেস্টে মাত্র ৩০.৮৭ এবং ওয়ানডেতে সেটা আরও কিছুটা কমে ২১.৬৮ হয়ে যায়। ব্যাটিং পরিসংখ্যান দেখতে গেলে তাঁকে মনে রাখার মতো হয়তো তেমন কিছু খুঁজে পাওয়াটা বেশ শক্ত হয়ে যাবে। তবু তিনি বাংলাদেশের প্রথম নির্ভরতার প্রতীক, ব্যাট হাতে বাংলাদেশ ক্রিকেটের প্রথম সত্যিকারের চ্যাম্পিয়ন। আর তিনি হাবিবুল বাশার সুমন, কিংবা কাছের মানুষগুলোর কাছে প্রিয় ‘সুমন ভাই’!
বাংলাদেশে এখন আর যা-ই হোক, ব্যাটিং প্রতিভার বিশেষ অভাব নেই। টানা দুই-তিনটা ম্যাচে সেঞ্চুরি না এলেই অনেকেই কিছুটা যেন ইতস্তত করতে শুরু করেন, “সেঞ্চুরি কেন করে না কেউ?” তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহিম, সাকিব আল হাসান, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ, মমিনুল হক, এমনকি সৌম্য সরকার, সাব্বির রহমান, নাসির হোসেন এবং ইমরুল কায়েস, ব্যাটিং প্রতিভার অভাব অন্তত বর্তমান বাংলাদেশ দলে বিশেষ নেই। সবার থেকেই এখন প্রত্যাশা থাকে একটাই– ইনিংসটাকে বড় করো আর ধারাবাহিক হও।
তবে সবসময় বাংলাদেশ দলে ঠিক এমন চাঁদের হাট বসেনি। একটা সময় ছিলো, যখন বাংলাদেশের অনেকটা নুন আনতে পান্তা ফুরাতো। পাকাপোক্ত ওপেনিং জুটি বলতে তেমন কিছু ছিলো না, প্রথম তিন-চার ওভারের মধ্যেই নেমে পড়তে হতো ওয়ানডাউন ব্যাটসম্যানকে, নেমে নিজ চোখে প্রত্যক্ষ করতে হতো সতীর্থদের উইকেট বিলিয়ে আসার চিরচেনা দৃশ্য। আর সেই সময়টুকুর মধ্যেই বুক চিতিয়ে দাঁড়ানো, আর বাংলাদেশের মুখরক্ষার লড়াই চালানো; এই ছিলো বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ের মোদ্দা কথা। আর এই সময়টাতেই সেই বুক চিতিয়ে দাঁড়ানোর সাহসটা বেশিরভাগ দিনেই করতেন একজন মানুষ, সেই ‘কম গড় আর সেঞ্চুরি করতে না পারা’ ব্যাটসম্যানটি। গুটি গুটি পায়ে তাঁর হাত ধরেই এগোচ্ছিলো বাংলাদেশ, স্বপ্ন দেখেছিলো বড় কিছুর।
কুষ্টিয়ার অখ্যাত এক গ্রাম, নগরকান্দা। বাংলাদেশ তখন যুদ্ধবিদ্ধস্ত এক জাতি, দেশ পুনর্গঠনের কাজ চলছে পুরোদমে। এমনই অস্থিরতাপূর্ণ এক সময়ে, ১৯৭২ সালের ১৭ আগস্ট, জন্মগ্রহণ করেন হাবিবুল বাশার। আশি-নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশে ক্রিকেটের তেমন একটা জনপ্রিয়তা ছিলো না, সাফল্যও ছিলো না বললেই চলে। টেস্ট স্ট্যাটাসের কথা ভাবাটাই তখন দিবাস্বপ্ন। তাঁর বাবা-মা তাই জোর করলেন, পড়াশোনাটা যেন শেষ করে নেন তিনি। কিন্তু ক্রিকেটের প্রতি অদম্য ভালোবাসাটা তাঁকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারলো না ক্রিকেট থেকে, বরং পূর্ণোদ্যমে শুরু করে দিলেন খেলাধুলা। সেটা বাড়তে বাড়তে এতটাই বিশাল রূপ নিলো যে, ১৯৮৮ সাল নাগাদ কুষ্টিয়া ছেড়ে যাত্রা করলেন ঢাকার উদ্দেশ্যে। পরে ক্রিকইনফোর কাছে বলেছেন, “ক্রিকেটকে ক্যারিয়ার ভাবার বিশেষ সুযোগ ছিলো না ১৯৮৮ সালে। কুষ্টিয়া ছেড়ে ক্রিকেট খেলার উদ্দেশ্যে ঢাকায় চলে আসাটা আমার জন্য ছিলো বিশাল এক সিদ্ধান্ত।”
অবশেষে ১৯৮৯ সালে অনুষ্ঠিত এশিয়া ইয়ুথ কাপে বাংলাদেশের অনূর্ধ্ব-১৯ দলে প্রথমবারের মতো সুযোগ পেলেন তিনি, খেললেন সৌরভ গাঙ্গুলি, অজয় জাদেজা, মঈন খান, মারাভান আতাপাত্তুর মতো বড় কিছু নামের বিপক্ষে। নাহ, তখনও সেভাবে খ্যাতি ছড়ায়নি তাঁদের; তবে এই অভিজ্ঞতা হাবিবুল বাশারকে তাঁতিয়ে দিয়েছিলো নিশ্চয়ই! ওই টুর্নামেন্টেই প্রথমবারের মতো নিজের প্রতিভার ঝলক দেখিয়েছিলেন, যার কারণে পরে ১৯৯৩ সালে তাঁকে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের প্রতিনিধিত্বকারী একটি দলে তাঁর নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই দলের হয়ে বেশ কয়েকটি আনঅফিশিয়াল ম্যাচ খেলেন বাশার, বেশ ভালোও করতে থাকেন। এর আগে ‘বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস’ দলের হয়ে ঘরোয়া টুর্নামেন্টগুলোতেও অংশগ্রহণ করেন এবং উল্লেখযোগ্য পারফরম্যান্স করে আস্থা অর্জন করেন। অবশেষে ১৯৯৫ সালে শারজায় অনুষ্ঠিত এশিয়া কাপে প্রথমবারের মতো ওয়ানডে ক্যাপ পরার সৌভাগ্য অর্জন করেন তিনি।
বাংলাদেশের ইনিংসের শুরুতেই আতাহার আলী খান রান আউট হয়ে গেলে ব্যাটিং করতে নামেন অভিষিক্ত হাবিবুল বাশার, কিছুটা প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা করেন। ইনিংসটা খুব বড় করতে পারেননি, ৩৫ বলে ১৬ রানের একটি ইনিংস খেলে সাজঘরে ফিরতে বাধ্য হন তিনি। পরের ম্যাচটি ছিলো পাকিস্তানের বিপক্ষে, ওয়াসিম আকরাম সেদিন বল হাতে আগুন ঝরাচ্ছিলেন। অনভিজ্ঞ বাশার ঠিক সামলাতে পারলেন না, নিজের খেলা দ্বিতীয় বলেই বোল্ড হয়ে গেলেন। শুরুটা তাই তেমন আহামরি কিছু হয়নি তাঁর জন্য।
এরপর তাঁকে অপেক্ষা করতে হলো আরও দুই বছর, ১৯৯৭ সালে আরেকটি এশিয়া কাপ আসর বসার আগে এই সময়কালের মধ্যে একটি ওয়ানডেও খেলেনি বাংলাদেশ। এই টুর্নামেন্ট তাঁর কাটলো দুঃস্বপ্নের মতো, পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রথম বলেই শূন্য রানে ফিরলেন, এরপর শ্রীলংকার বিপক্ষে ম্যাচেও ১২ বলে ৬ রান করে প্যাভিলিয়নে ফিরলেন। টানা তিন ম্যাচে নিদারুণ ব্যর্থতার কারণে তৃতীয় ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে একাদশেই সুযোগ পেলেন না বাশার। তবে কোনোরকমে দলে টিকে গেলেন, ডাক পেলেন নাইরোবিতে অনুষ্ঠিত কেনিয়া এবং জিম্বাবুয়ের সঙ্গে ত্রিজাতীয় টুর্নামেন্টে।
সেখানেই প্রথমবারের মতো কিছুটা হলেও নিজের প্রতিভার স্ফুরণ দেখাতে পারলেন, জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ৭০ রানের একটি ইনিংস খেললেন। যদিও তা অফিশিয়ালি স্বীকৃত কোনো ম্যাচ ছিলো না, তবুও সেই ইনিংসটিই তাঁকে নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজে জায়গা ধরে রাখতে সাহায্য করেছিলো। সেখানেই বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো ফার্স্ট ক্লাস ম্যাচের স্বাদ পায়, অভিষেক হয় হাবিবুল বাশারেরও।
পরের দুই বছর তেমন নজরকাড়া কোনো পারফরম্যান্স না থাকাতে ১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপে সুযোগ হয়নি হাবিবুল বাশারের। তাঁর নিজের ভাষায়, “১৯৯৯ বিশ্বকাপটা মিস করে ফেললাম, সেটা আমার ক্যারিয়ার প্রায় শেষই করে দিয়েছিলো। এমনকি ৩০ জনের প্রাথমিক স্কোয়াডেও আমার নাম ছিলো না! বাধ্য হয়েছিলাম আমার পরিস্থিতি আরেকবার পর্যালোচনা করতে।” তবে সেই হতাশা থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন ঠিকই। ওই বিশ্বকাপের পরপরই ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সংক্ষিপ্ত এক সিরিজে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্বকারী দলে খেলেন তিনি, সেখানে ভালো পারফরম্যান্সের সুবাদে চোখে পড়েন নির্বাচকদের।
তবে নিজের ক্যারিয়ারের পুনর্জন্ম হয় খুব সম্ভবত ১৯৯৯ সালের অক্টোবরে, যেদিন ইংল্যান্ড ‘এ’ দলের বিপক্ষে একটি ফার্স্ট ক্লাস ম্যাচে অপরাজিত ১৪৩ রানের দুর্দান্ত একটি ইনিংস খেলেন বাশার। এই ইনিংসটি তিনি খেলেছিলেন এমন এক বোলিং অ্যাটাকের সামনে, যাকে বলা হচ্ছিলো ইংল্যান্ডের বোলিং লাইনআপের ভবিষ্যৎ। এই ফর্ম টেনে নিলেন ঘরোয়া ক্রিকেটেও, দারুণ পারফর্ম করলেন বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় ক্রিকেট লীগে। এরপর শক্তিশালী এমসিসি একাদশের বিপক্ষে ৮৫ রানের ঝলমলে আরেকটি ইনিংস খেলার পর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে।
আবারও ডাক পেলেন পরের এশিয়া কাপে; ২০০০ সালের মাঝামাঝি সময়ে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ওই টুর্নামেন্টে ভারতের বিপক্ষে করলেন ৫৭ রান। পাকিস্তানের বিপক্ষে ১৯৯৯ বিশ্বকাপের সেই জয়ের পর ভারতের বিপক্ষে বেশ ভালো পারফরম্যান্সের পর বাংলাদেশের টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার দাবি আরও জোরদার হয়। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ টেস্ট মর্যাদা লাভ করে ২০০০ সালের ২৬ জুন।
ভারতের সঙ্গে অনুষ্ঠিতব্য প্রথম টেস্টের আগে নির্বাচকেরা প্রথমে ঠিক করেছিলেন, হাবিবুল বাশারকে ডাকা হবে না এই ম্যাচে। তবে শেষ মুহূর্তে মত পরিবর্তন করে তাঁকে দলে অন্তর্ভুক্ত করলেন তারা। ততক্ষণে ভগ্নহৃদয় বাশার জিনিসপত্র গুছিয়ে বিকেএসপি থেকে ফিরে গেছেন বাড়িতে। বাকিটা শোনা যাক তাঁর নিজের মুখ থেকেই, “যখন নির্বাচকেরা আমার বাদ পড়ার সিদ্ধান্তটিকে পুনর্বিবেচনা করলেন, আমিনুল ইসলাম (বুলবুল) আমার সাথে যোগাযোগ করার জন্য একটা রাস্তা খুঁজছিলেন। আমার বাসায় তো তখনও ফোন ছিলো না কোনো, তাই আমারই এক ক্লাব-সতীর্থ জিয়াউদ্দিন আহমেদ শোভন মারফত খবর পাঠালেন, আমি সিলেক্টেড হয়েছি। আমি তাঁকে বিশ্বাসই করতে পারিনি তখন। এরপর যখন প্র্যাকটিস ম্যাচ খেলতে শুরু করলাম, বুঝতে পারলাম উপলক্ষ্যটা কত বড়। আমি বাংলাদেশের অভিষেক টেস্টে খেলতে যাচ্ছি!”
এরপর মাঠে নামলেন যখন, মাত্র ১০ রানেই প্রথম উইকেট হারিয়ে থরথর কাঁপছে টাইগার শিবির। এমন পরিস্থিতিতে নেমেই তিনি পাল্টা আক্রমণ শুরু করলেন, ভারতের দারুণ সব বোলারদের ভড়কে দিয়ে আমিনুল ইসলাম বুলবুলের সঙ্গে গড়লেন গুরুত্বপূর্ণ এক জুটি। পুল-হুক খেলতে বরাবরই দারুণ ভালোবাসতেন। এগুলো তাঁকে যেমন দিয়েছে প্রচুর রান, তেমনই আউটও হয়েছেন অনেকবার। তেমনটাই হয়েছিলো এই ইনিংসেও, দুর্দান্ত খেলতে খেলতেই জহির খানের শর্ট বলে পুল করতে গিয়ে মিডঅনে ক্যাচ দিয়ে ফিরলেন সাজঘরে। ততক্ষণে স্কোরবোর্ডে নিজের নামের পাশে লিখে ফেলেছেন ৭১ রান। রানসংখ্যার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ছিলো তাঁর ব্যাটিংয়ের ধরণ, সত্যিকারের চ্যাম্পিয়ন মানসিকতায় খেলেছিলেন সেদিন। একপাশে বুলবুল খুঁটি গেঁড়ে বসেছিলেন বটে, তবে অপর প্রান্ত থেকে স্ট্রোকের ফুলঝুরি ছুড়িয়েছেন বাশার। যে ব্যাটসম্যানের অভিষেক টেস্টটা খেলারই কথা ছিলো না, সুযোগ পেয়ে তিনিই কেড়ে নিলেন স্পটলাইট।
প্রথম ইনিংসে রানের পাহাড় গড়ে ভারতকে কিছুটা হলেও চাপের মুখে ফেলতে সক্ষম হয়েছিলো বাংলাদেশ। তবে সেটা ধরে রাখতে পারেনি, অনভিজ্ঞ ব্যাটিং অর্ডার তাসের ঘরের মতো ধ্বসে পড়ে দ্বিতীয় ইনিংসে। বাংলাদেশের ওই ৯১ রানের ছোট্ট সংগ্রহের মধ্যেও উজ্জ্বল ব্যতিক্রম ছিলেন বাশার, ৩০ রানের ছোট্ট কিন্তু সম্মান বাঁচানো এক ইনিংস খেললেন। অভিষেক টেস্টই যেন ঠিক করে দিলো তাঁর নিয়তি।
টেস্ট অঙ্গনে শুরুর দিনগুলোতে বাংলাদেশকে প্রতিদিনই অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে নামতে হতো, প্রতিনিয়ত টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার সামর্থ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠতো। ‘মিনোজ’ নামের একটা গালিও বরাদ্দ হয়ে গিয়েছিলো বাংলাদেশের জন্য, তাই প্রতিটা ম্যাচই বাংলাদেশকে খেলতে হতো দারুণ চাপের মধ্যে থেকে। বাংলাদেশ তখন নিয়মিতভাবে হারতো বটে, তবে এর মধ্যেও নিজের কাজটা বরাবরই করে রাখতেন বাশার। দারুণ ধারাবাহিকতায় ব্যাটিংয়ে সবচেয়ে বড় ভরসার নাম হয়ে উঠতে তাই খুব বেশি সময় লাগেনি তাঁর। তেমনই একটি উদাহরণ ছিলো ২০০১ সালে চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ২য় টেস্ট।
এর আগের ছয় টেস্টেই করে ফেলেছেন পাঁচটি ফিফটি, তবে শতকের দেখা মিলছিলো না। অবশেষে সেটা মিললো বটে, তবে দলকে এ যাত্রায়ও বাঁচাতে পারলেন না। প্রথমে ব্যাটিংয়ে নেমে ট্রেভর গ্রিপার, অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার এবং ক্রেইগ উইশার্টের তিনটি শতকে সওয়ার হয়ে জিম্বাবুয়ে ৫৪২ রানের পাহাড় গড়ে ইনিংস ঘোষণা করে। জবাবে ব্যাটিংয়ে নেমে ব্যাটিং বিপর্যয়ের মুখে পড়ে বাংলাদেশ, অলআউট হয় মাত্র ২৫১ রানে। এর মধ্যেই এক প্রান্ত আগলে রেখে বাশার তুলে নেন নিজের প্রথম শতকটি, এরপর ২য় ইনিংসে ফলোঅনে নেমে ৭১ রানের আরো একটি দুর্দান্ত ইনিংস খেলেন।
২০০৩ সালের বিশ্বকাপ অভিযান বাংলাদেশের জন্য ছিলো বিভীষিকাময় এক অভিজ্ঞতা। পরাজয়ের পর পরাজয়ে দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিলো সময়টা, বিশ্বকাপ শেষ হতেই পদত্যাগ করেন তৎকালীন অধিনায়ক খালেদ মাসুদ পাইলট। সাথে ট্রেভর চ্যাপেল এবং মহসীন কামালদের সংক্ষিপ্ত ‘কোচিং পিরিয়ড’-এর কারণে আরো বেশ খানিকটা পিছিয়ে পড়ে বাংলাদেশের ক্রিকেট। অবশেষে কোচ হয়ে আসেন ডেভ হোয়াটমোর, অধিনায়কত্বের দায়িত্ব পান খালেদ মাহমুদ সুজন। দক্ষিণ আফ্রিকা এবং অস্ট্রেলিয়া সফরে দারুণ পারফর্ম করলেন বাশার, তবে সেরাটুকু বোধহয় জমিয়ে রেখেছিলেন পাকিস্তানের জন্যই। পাকিস্তানের বিপক্ষে তিন টেস্টের সিরিজে ৬৩.১৬ গড়ে করলেন ৩৬৩ রান, যাতে ছিলো তিনটি ফিফটি এবং একটি হান্ড্রেড। ঐ সিরিজেরই তৃতীয় টেস্টটি ছিলো সেই ‘কুখ্যাত’ মুলতান টেস্ট, রশিদ লতিফের ‘চৌর্যবৃত্তি’ এবং নিতান্ত ভাগ্যের সহায়তা না পাওয়াতে একটুর জন্য সেই টেস্ট জয়টা বাংলাদেশের হাত থেকে ফসকে যায়।
২০০৪ সালে জিম্বাবুয়ে সিরিজের আগে অধিনায়কত্বের ব্যাটন তুলে দেওয়া হয় হাবিবুল বাশারের হাতে, ধারাবাহিকতা এবং অধ্যবসায়ের ফল মিললো হাতেনাতে। ওই সিরিজের প্রথম দুই ওয়ানডে বৃষ্টিতে ভেসে যাওয়ার পর তৃতীয় ম্যাচেই বাংলাদেশের বহুল আকাঙ্ক্ষিত জয় ধরা দিলো, রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনাপূর্ণ সেই ম্যাচে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে জয় এনে দিলেন বাশার। পরে ওই জিম্বাবুয়ে সফরেই একটি টেস্ট ড্র করতে সমর্থ হয় বাংলাদেশ, যা ওই সময়ের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের জন্য ছিলো বিশাল সাফল্য। অবশেষে যেন অন্ধকার চিরে আলোর মুখ দেখতে পেলো বাংলাদেশ।
ওই বছরই সেন্ট লুসিয়া টেস্টে বাংলাদেশ আরেকবার ভড়কে দেয় ওয়েস্ট ইন্ডিজকে; বাশার, রফিক এবং পাইলটের তিন শতকে দাপুটে এক ড্র করে তাঁরা। গোটা টেস্টেই পরিষ্কার আধিপত্য ছিলো বাংলাদেশেরই, এমনকি প্রথম ইনিংসে ৬৪ রানের লিডও পেয়েছিলো বাংলাদেশ। শেষ পর্যন্ত ম্যাচটি ড্র হয়, তবে গোটা বিশ্বকে একটা বার্তা ঠিকই দিতে সক্ষম হয়েছিলো বাশারের টাইগারবাহিনী- বাংলাদেশকে ছোট করে দেখার দিন শেষ হয়ে আসছে। কিন্তু শুধু ড্র দিয়েই কি আর সেই বার্তাটা যুতসই হয়? প্রয়োজন একটা জয়, গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে গুরুত্বপূর্ণ জয়। আর শততম ওয়ানডে থেকে বড় উপলক্ষ্য বাংলাদেশের জন্য আর কি-ই বা হতে পারতো!
২০০৪ সালের বক্সিং ডে ম্যাচে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে সুনামি আছড়ে পড়লো, আর সেই সুনামিতে ভেসে গেলো সৌরভ গাঙ্গুলির নেতৃত্বাধীন ভারত। নাহ, সেদিন বাশার খুব বেশি রান করতে সক্ষম হননি। তবে তাঁর নেতৃত্বগুণ রীতিমতো বিস্মিত করেছিলো ভারতের সর্বকালের অন্যতম সেরা অধিনায়ক গাঙ্গুলিকেও। ব্যাটে-বলে-ফিল্ডিংয়ে সেই ম্যাচে অবিসংবাদিত সেরা ছিলেন ইনজুরিফেরত মাশরাফি, তবে সেই জয়ে নেপথ্য নায়ক নিঃসন্দেহে ছিলেন বাশার। অসাধারণ আক্রমণাত্মক ফিল্ড সেটআপ, দারুণ বোলিং পরিবর্তন, টুকটাক মাইন্ডগেমে ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের মানসিক স্থিতির চূড়ান্ত পরীক্ষা নেওয়া, আর উজ্জীবিত অধিনায়কত্বের মাধ্যমে তিনিই নেপথ্যে থেকে জয়ের রাস্তাটা তৈরি করে দিয়েছিলেন।
ছোটখাট বেশ কিছু অর্জনের পর এবার এলো পরম আকাঙ্ক্ষিত প্রথম টেস্ট জয়। অন্তর্দ্বন্দ্বে জর্জরিত অবস্থায় ক্ষয়িষ্ণু জিম্বাবুয়ে দুই টেস্ট এবং পাঁচ ওয়ানডে খেলার জন্য এলো বাংলাদেশ সফরে। আর প্রথম টেস্টেই দল হিসেবে সমন্বিত পারফরম্যান্সে জিম্বাবুয়েকে ২২৬ রানের বিশাল ব্যবধানে পরাজিত করতে সক্ষম হয় বাংলাদেশ। দুই ইনিংসে যথাক্রমে ৯৪ এবং ৫৫ রানের দারুণ দুটি ইনিংস খেলে দলকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন হাবিবুল বাশার। পরের টেস্টেও দাপুটে ড্র করে বাংলাদেশ, বাংলাদেশের ক্রিকেটে স্বর্ণালী সময়ের স্বপ্ন তখন উঁকি মারতে শুরু করেছে। আর সেই স্বপ্নের নেপথ্য কারিগর ছিলো বাশার এবং হোয়াটমোরের যুগলবন্দী।
কিন্তু কেন সফল হয়েছিলো তাঁদের এই যুগলবন্দী? মাশরাফি-হাতুরুসিংহে কিংবা সাকিব-সিডন্স জুটিগুলোও বেশ সফলই ছিলো বলা যায়, তবে বাশার-হোয়াটমোরের সঙ্গে যে সেগুলোর তুলনা হয় না সেটা নিয়ে বিশেষ সংশয় নেই। ঠিক কোথায় ছিলো পার্থক্যটা? বাশারের মতে, তফাৎটা ছিলো আন্তরিকতা এবং বোঝাপড়ায়, “আমি কীভাবে ব্যাটিং করি বা আউট হই, তাতে ডেভের আপত্তি ছিলো না- কারণ আমি এভাবে খেলেই রান করেছি, সফল হয়েছি। মাঝেমধ্যে আমার নিজের আউট হওয়ার ধরনে নিজেই বিরক্ত এবং অপমানিত বোধ করতাম। কিন্তু সে আমাকে এমন কিছু কথা বলতো, যা আমাকে আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান করে তুলতো। আর সেখানেই হয়তো রান করার জ্বালানিটা পেয়ে যেতাম!” নিজেকে কখনোই জাত অধিনায়ক বলে দাবি করেননি, সহজাত প্রতিভাবানও ছিলেন না। তবে একটা জায়গায় অভাব ছিলো না কখনোই, শেখার আগ্রহ। আর সেটাই হয়তো পছন্দ করতেন ডেভ হোয়াটমোর, তাই শিষ্যকে পছন্দও করে ফেলেছিলেন খুব দ্রুতই!
তবে খুব বেশিদিন এই মধুচন্দ্রিমা স্থায়ী হয়নি, আকাশে উড়তে থাকা বাংলাদেশকে মাটিতে নামিয়ে আনে ইংল্যান্ড। ওই সফরে খেলা টেস্টগুলো বাস্তবতা আরো একবার চোখে আঙুল দিয়ে মনে করিয়ে দেয় বাংলাদেশকে, উন্নতি করতে হবে আরো অনেকটা! তবে সে পারফরম্যান্সের পরও ন্যাটওয়েস্ট ট্রফিতে কার্ডিফ-কাব্য রচনা করে বাংলাদেশ। সেই ম্যাচে মোহাম্মদ আশরাফুলের সেই বিখ্যাত ইনিংসের সাথে হাবিবুল বাশারের অধিনায়কত্ব এবং ৪৭ রানের স্থিতধী ইনিংসটিও বেশ প্রশংসিত হয়।
পরের বছর ফতুল্লা স্টেডিয়ামে নাক উঁচু অস্ট্রেলিয়া দলকে রীতিমতো নাকানিচুবানি খাইয়ে ছাড়লো বাংলাদেশ, আর সেই রূপকথায় নায়ক শাহরিয়ার নাফীসের সাথে পার্শ্বনায়ক হিসেবে ৭৬ রানের আরেকটি দুর্দান্ত ইনিংস ছিল দারুণ গুরুত্বপূর্ণ। শেষ পর্যন্ত রিকি পন্টিংয়ের ‘অতিমানবীয়’ আরেকটি সেঞ্চুরির কারণে জিততে না পারলেও দারুণ প্রশংসিত হয় বাংলাদেশ। কার্ডিফে সেই দুর্দান্ত জয়ের পর ফতুল্লায় দারুণ একটা টেস্ট উপহার দেওয়ার পর অবশেষে বাংলাদেশ যথাযোগ্য সম্মান পাওয়া শুরু করে।
এরপর বাংলাদেশ মনোযোগ দেয় ২০০৭ সালের বিশ্বকাপের দিকে। দলে আসেন শাহরিয়ার নাফীস, সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহিম, তামিম ইকবালদের মতো তরুণরা- বাংলাদেশ তখন স্বর্ণালী এক ভবিষ্যতের স্বপ্নে বিভোর। বিশ্বকাপের উদ্দেশ্যে যাত্রা করার আগে সংবাদ সম্মেলনে বলে গেলেন, এবার ভালো কিছু পাবে বাংলাদেশ।
এরপর যা যা ঘটলো, রীতিমতো স্বপ্নের মতো। ভারতকে ১৯১ রানে গুটিয়ে দিয়ে ৫ উইকেটে জিতলো বাংলাদেশ, টুর্নামেন্টেরই টপ ফেভারিট ভারত বিদায় নিলো গ্রুপপর্ব থেকেই। এরপর সুপার এইটেও দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারালো বাংলাদেশ, তবে আয়ারল্যান্ডের কাছে পরাজয়ের মধ্য দিয়ে থামলো স্বপ্নযাত্রা। অদ্ভুতভাবে গোটা টুর্নামেন্টেই নিষ্প্রভ রইলেন বরাবরই দারুণ ধারাবাহিক ব্যাটসম্যান হাবিবুল বাশার। পরে ক্রিকইনফোকে বাশার বলেন, “আমি আজ অবধি বুঝতে পারি না, বিশ্বকাপের দুই আসরে কেন আমি কখনো পারফর্ম করতে পারিনি। ২০০৩ সালের বিশ্বকাপে কোনোমতে বেঁচে গিয়েছিলাম, কিন্তু ২০০৭ বিশ্বকাপটাই কার্যত আমার ক্যারিয়ার শেষ করে দিয়েছে।”
বিশ্বকাপের পরপরই ভারতের বিপক্ষে সিরিজ শুরু হয়, সেখানে টেস্ট এবং ওয়ানডে দুটো সিরিজই ভারত জিতে নেয়। টেস্টে যথাক্রমে ০, ৩৭, ৪ ও ৫ রান করার পর ওয়ানডেতে যথাক্রমে ০ এবং ৪৩ রান করেন। বাশারের বাজে ফর্ম নির্বাচকদের কপালে ভাঁজ ফেলে, এরপর আর ওয়ানডে খেলতে পারেননি বাশার। নিজের ক্যারিয়ারের শেষ ওয়ানডেতেও তিনি ছিলেন দলের পক্ষে সর্বোচ্চ রানসংগ্রাহক।
তবে ওয়ানডে দৃশ্যপট থেকে সরে গেলেও টেস্ট খেলা চালিয়ে গিয়েছিলেন আরো কয়েক মাস, আরো নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজ পর্যন্ত। কিন্তু উপর্যুপরি ব্যর্থতা তাঁর ক্যারিয়ারকে আর দীর্ঘায়িত করতে দেয়নি।
এরপর বাংলাদেশের ক্রিকেটাকাশে হানা দেয় আইসিএল-ঝড়, আর তাতে সাড়া দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসরগ্রহণ করেন হাবিবুল বাশার। বাংলাদেশের স্বর্ণালী যুগের সূচনাকারী অধিনায়ক একবুক অভিমান নিয়ে স্বেচ্ছানির্বাসনে চলে যান। তবে ২০১০ সালে আবারও ঘরোয়া ক্রিকেটে ফেরেন, সেই মৌসুমেই ক্যারিয়ারের শেষ ফার্স্ট ক্লাস ম্যাচে ১০৩ রানের ঝকঝকে এক ইনিংস খেলে সম্মানের সাথে মাথা উঁচু করেই সবধরনের ফরম্যাট থেকে অবসরগ্রহণ করেন ‘মিস্টার ফিফটি’। এখন হাবিবুল বাশার বাংলাদেশ জাতীয় দলের নির্বাচক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।
ফিরে আসা যাক তাঁর অধিনায়কত্বে। তিনি বাংলাদেশ ক্রিকেটের স্বপ্নস্রষ্টাদের একজন, প্রথম ধারাবাহিক ব্যাটসম্যানও বলা চলে। সাথে যোগ হয়েছে একের পর এক সাফল্য, সোনায় মোড়ানো ক্যারিয়ার। তবু নিজেকে কেন ‘জাত অধিনায়ক’ বলে দাবি করেননি তিনি?
২০০৪ সালে হারারে টেস্টে যখন ‘পেয়ার’ (টেস্টের দুই ইনিংসেই শূন্য) মারলাম, ভাবলাম… “যাহ, গেলো এবার!” সৌভাগ্যবশতঃ পাঁচ বছরের মধ্যে প্রথম একটা ওয়ানডে জিতে বসেছিলাম আমরা। মানুষজন বলতে শুরু করলো, আমার মধ্যে নেতৃত্বগুণ নেই, আমি ওসব পারবো না। কিন্তু চ্যালেঞ্জ নিতে খুব ভালোবাসি আমি; ভাবলাম, ওসব নেতৃত্বগুণ-টুন আমার মধ্যে যখন নেই, তাহলে আমি সেটা অর্জন করেই ছাড়বো।
সে কি! এতটা আত্মপ্রত্যয়? অথচ বাশারকে দেখে সেটা বিন্দুমাত্র বোঝার উপায় নেই। বরাবরই তিনি বাড়ির ভদ্র ছেলেটা – মিষ্টি হাসি আর ছোট্ট চোখের চাহনিতেই মনে শ্রদ্ধা জাগাতে পারেন। অথচ তাঁর মধ্যেই এতটা জেদ লুকিয়ে, ভাবা যায়! বাশার অবশ্য নিজে বলেছেন, দেখতে সাদাসিধে মনে হলেও তিনি নাকি ‘ডোন্ট-গিভ-আ-ড্যাম’ মানসিকতার মানুষ। ব্যক্তিগতভাবে তিনি নিজের কাজের ক্ষেত্রে বরাবরই বজ্রকঠিন, “আমার কাছে অধিনায়কত্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার হচ্ছে দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে সম্পর্ক। খেলোয়াড়দের সঙ্গে মাঝেমধ্যে আমার বাকবিতণ্ডা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু কেউ বলতে পারবে না যে আমি দলের জন্য সেরা সিদ্ধান্তটা গ্রহণ করিনি।”
কিন্তু তিনি কি যথাযোগ্য মর্যাদা পেয়েছিলেন আমাদের থেকে? যখন পারফর্ম করেছেন, মোহাম্মদ রফিক-শাহরিয়ার নাফীস-মোহাম্মদ আশরাফুল-আফতাব আহমেদের দুর্দান্ত সব পারফরম্যান্সের ভীড়ে তাঁর স্থিতধী ধারাবাহিক পারফরম্যান্স সেভাবে ধরা পড়েনি খালি চোখে। তবু নিজের কাজ করে গেছেন নিয়মিত, অকুণ্ঠচিত্তে। আর ফলাফল কি পেয়েছেন, সেটা তাঁর মুখ থেকেই জেনে নেওয়া যাক, “২০০৭ বিশ্বকাপের পর ওয়েস্ট ইন্ডিজ থেকে ফিরে যখন ঢাকা বিমানবন্দরে পা রাখলাম, একজন বোর্ড মেম্বার আমাকে প্রথম যে কথাটা জিজ্ঞেস করলো, সেটা হচ্ছে আমি কবে রিটায়ার করছি! মানুষের কথা আটকানোর ক্ষমতা আমার নেই, তবে ব্যবহারটা ছিলো খুবই অন্যায্য। “
তিনি যে বয়সে জাতীয় দল থেকে অবসরগ্রহণ করেন, সেটাকে যেকোনো ব্যাটসম্যানের জন্যই সর্বোচ্চ পরিপক্বতার বয়স। তাঁর অভিজ্ঞতা, তাঁর সার্ভিস যে মুহূর্তে বাংলাদেশ দলের কাছে হয়ে উঠতে পারতো পরম মূল্যবান, সেই সময়টাতে তাঁকে ছুঁড়ে ফেলা হয়েছিলো। একবুক অভিমান নিয়ে তাঁকে পাড়ি জমাতে হয়েছিলো তৎকালীন ‘নিষিদ্ধ’ ফ্র্যাঞ্চাইজি লীগ আইসিএলে। সেখানেও খুব খারাপ পারফর্ম করেননি, দেশের ক্রিকেটে ফেরার পরও পারফর্ম করেছেন। নিশ্চিতভাবেই দলকে দেওয়ার মতো আরো কিছু হয়তো ছিলো তাঁর। সেই সুযোগ কিংবা প্রাপ্য সম্মানটুকু তাঁকে দেওয়া হয়নি, তাই তাঁকে অবসর নিতে হয়েছে অশ্রুসজল চোখে। সেটা আমাদের জন্য ছিলো লজ্জাজনক এক অভিজ্ঞতা।
বর্ণিল এই জীবনে অভিনয়টাও করেছেন একবার। ২০০৯ সালে আইসিএল অভিজ্ঞতার পর ফিরে ‘পাসওয়ার্ড নামের একটি নাটকে অভিনয় করেন তিনি। তাঁর ভাষায় অভিজ্ঞতাটা অনেকটা এরকম, “আগে ভাবতাম অভিনয় করা সোজা। কিন্তু করতে গিয়ে দেখলাম, বেশ কঠিন আছে। অনেক মনোযোগ দিয়ে করতে হয়; এমনকি শেন ওয়ার্নকে ফেস করার সময় যতটা মনোযোগ দিতে হয়, তাঁর চেয়েও বেশি।”
তিনি অবসর নেওয়ার পর সময় কেটে গেছে অনেকটা। বাংলাদেশকে এখন আর কেউ ‘মিনোজ’ বলে ডাকে না, এখন তাঁরা বলে-কয়ে বড় দলকে হারাতে জানে। এখন টেস্ট খেলাটা বেশ ধরতে শিখে গেছে বাংলাদেশ, এমনকি গত বেশ কিছুদিনে নিয়মিত জিততেও শিখে গেছে। আর এই অর্জনগুলোর বেশিরভাগই শুরু হয়েছিলো তাঁর হাত ধরেই। তাই বাংলাদেশের ইতিহাসে হাবিবুল বাশার সুমনের পরিচয় নেহায়েত একজন ব্যাটসম্যান কিংবা একজন অধিনায়ক হিসেবে নয়, বাংলাদেশ ক্রিকেটের অন্যতম অভিভাবকও। আর তাই বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে অন্যতম এক নক্ষত্র হিসেবে তিনি সমুজ্জ্বল হয়ে থাকবেন অনন্তকাল ধরে।
ফিচার ইমেজ: The Cricket Monthly